নুড়িটার এই পদোন্নতিতে আন্তরিক খুশি হলাম আমি একদিন ওকে মুক্তি দিয়েছি, এখন সবাইকে ও মুক্তি বিতরণ করতে থাক—ওর গৌরব, সে তো আমারই গর্ব। পৃথিবীর বুকে ওর জন্মদাতা আমি, এইজন্য মনে মনে পিতৃত্বের একটা পুলক অনুভব না করে পারলাম না! এবং কায়মনোবাক্যে ওকে আশীর্বাদ করলাম।
সেই লোকটাকে তার দেবতার সন্ধান দেব কিনা মাঝে মাঝে ভেবেছি। পথে ঘাটে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কিন্তু পাথরটার কথা ও আর পাড়ে না। পাথরটার পলায়নে ভেবেছিলাম ও মুহ্যমান হয়ে পড়বে, কিন্তু উলটে ওকে প্রফুল্লই দেখা গেল। এত বড় একটা বিচ্ছেদ-বেদনা যখন ও কাটিয়ে উঠতে পেরেছে তখন আর ওকে উতলা করে তোলায় কি লাভ।
মাঝে মাঝে অশথতলার পাশ দিয়েই বাড়ি ফিরি, লক্ষ্য করি, দিনকের দিন নুড়িটার মর্যাদা। বাড়ছে। একদিন দেখলাম, গোটাকতক সন্ন্যাসী এসে আস্তানা গেড়েছে, গাঁজার গন্ধ এবং ববমবম শব্দের ঠেলায় ওখান দিয়ে নাক কান বাঁচিয়ে যাওয়া দুষ্কর। ঘ্রাণ এবং কর্ণেন্দ্রিয়ের ওপরে দস্তুরমতই অত্যাচার।
যখন সন্ন্যাসী জুটেছে তখন ভক্ত জুটতে দেরি হবে না এবং ভক্তির আতিশয্য অনতিবিলম্বেই ইট-কাঠের মূর্তি ধরে মন্দিররূপে অভ্রভেদী হয়ে দেখা দেবো দেবতা তখন বিশেষভাবে বনেদী হবেন এবং সর্বসাধারণের কাছ থেকে তাঁর তরফে খাজনা আদায় করবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েমী হয়ে দাঁড়াবে।
এর কিছুদিন পরে একটা চিনির কলের ব্যাপারে কয়েক মাসের জন্য আমাকে চম্পারণ যেতে হলো। অশথতলার পাশ দিয়ে গেলেও চলে, ভাবলাম, যাবার আগে দেবতার অবস্থাটা দেখে যাই। যা অনুমান করেছিলাম তাই, সন্ন্যাসীর সমাগমে ভক্তের সমারোহ হয়েছে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের আলাপ আলোচনা অনুসরণে যা বুঝলাম তার মর্ম এই যে, ইনি হচ্ছেন। ত্রিলোকেশ্বর শিব, সাক্ষাৎ স্বয়ম্ভু, একেবারে পাতাল ছুঁড়ে ফেঁপে উঠেছেন—এঁর তল নেই। অতএব এঁর উপযুক্ত সম্বর্ধনা করতে হলে এখানে একটা মন্দির খাড়া না করলে চলে না।
একবার বাসনা হলো, ত্রিলোকেশ্বর শিবের নিস্তলতার ইতিহাস সবাইকে ডেকে বলে দিই, কিন্তু জীবন-বীমা করা ছিল না এবং ভক্তি কতটা ভয়াবহ হতে পারে জানতাম, আর তা ছাড়া ট্রেনের বিলম্বও বেশি নেই ইত্যাদি বিবেচনা করে নিরস্ত হলাম। সেই লোকটাকে খবর না দিয়ে দেখলাম ভালোই করেছি, কেননা যতদূর ধারণা হয়, নুড়িটাকে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করাই তার অভিরুচি ছিল কিন্তু ইনি যে ভক্তের তোয়াক্কা না রেখেই স্বকীয় প্রতিভাবলে এবং স্বচেষ্টায় ইতিমধ্যেই লব্ধপ্রতিষ্ঠ হয়েছেন, এই সংবাদে সে পুলকিত কিম্বা মর্মাহত হতো বলা কঠিন।
কয়েক মাস বাদে যখন ফিরলাম তখন অশথতলার মোড়কে আর চেনাই যায় না। ছোটখাট একটা মন্দির উঠেছে, শঙ্খঘণ্টার আর্তনাদে কান পাতা দায় এবং ভক্তের ভিড় ঠেলে চলা দুরূহ। কিন্তু সে কথা বলছি না, সবচেয়ে বিস্মিত হলাম সেই সঙ্গে আরেক জনের আবির্ভাবে, কেবলমাত্র আবির্ভাব নয় কলেবর পরিবর্তন পর্যন্ত দেখো মন্দিরের চত্বরে সেই লোকটা—প্রথমতম, সেই আদি ও অকৃত্রিম উপাসকগেরুয়া, তিলক এবং রুদ্রাক্ষের চাপে তাকে আর চেনাই যায় না এখন!
—এ কি ব্যাপার?
আমিই গায়ে পড়ে প্রশ্ন করলাম একদিন।
—আজ্ঞে, এই দীনই শিবের সেবায়েত।
লোকটি বিনীত ভাবে জবাব দেয়।
—তা তো দেখতেই পাচ্ছি। দিব্যি বিনিপুঁজির ব্যবসা ফাঁদা হয়েছে। এই জন্যেই বুঝি পাথরটার ওপর অত করে নজর রাখা হয়েছিল?
শিলাখণ্ডের প্রতি ওর প্রীতিশীলতা যে অহেতুক এবং একেবারেই নিঃস্বার্থ ছিল না, এইটা জেনেই বোধ করি অকস্মাৎ ওর ওপর দারুণ রাগ হয়ে যায়, ভারি রূঢ় হয়ে পড়ি।
কানে আঙুল দিয়ে সে বলল—অমন বলবেন না। পাথর কি মশাই? শ্রীবিষ্ণু! সাক্ষাৎ দেবতা যে। ত্রিলোকেশ্বর শিব!
উদ্দেশে সে নমস্কার জানায়।
আমি হেসে ফেললাম—ওর তল নেই, না?
এবার সে একটু কুষ্ঠিত হয়—ওরাই তো বলো
—তুমি নিজে কী বলো? ওরা তো বলে নিচে যতই কেন খুঁড়ে যাও না, টিউব-কলের মত ওই শিবলিঙ্গ বরাবর নেমে গেছে। কিন্তু তোমার কী মনে হয়?
–কী জানি! তাই হয়তো হবে।
কতদূর শেকড় নেবেছে খুঁড়ে দেখই না কেন একদিন?
জিভ কেটে লোকটা বলল—ওসব কথা কেন, ওতে অপরাধ হয়। বাবা রাগ করবেন—উনি আমাদের জাগ্রত।
–বটে? কিরকম জাগ্রত শুনি?
—এই ধরুন না কেন! এবার তো কলকাতায় দারুণ বসন্ত, টিকে নিয়ে কিছু করেই কিছু হচ্ছে না—
—য়্যাঁ, বলো কি, মহামারী নাকি, জানতাম না তো!
—খবরের কাগজেই দেখবেন কিরকম লোক মরছে। কর্পোরেশন থেকে টিকে দেবার ত্রুটি নেই অথচ প্রত্যেক পাড়াতেই কিন্তু আমাদের পাড়ায় এ-পর্যন্ত কারু হয়নি দেবতার কৃপায়। আমরা কেউ টিকেও নিইনি, কেবল বাবার চন্নামেত্ত খেয়েছি। এ যদি জাগ্রত না হয় তবে জাগ্রত আপনি কাকে বলেন?
এবার কি জবাব দেব তা চিন্তা করবার সময় ছিল না। আগে একবার এই রোগে যা কষ্ট পেয়েছিলাম এবং যা করে বেঁচেছিলাম তাতে বাবা ত্রিলোকনাথের মহিমা তখন আমার মাথায় উঠেছে। ‘আমি এখন চললুম। আমাকে এক্ষুনি টিকে নিতে হবে আরেকদিন এসে গল্প করব।’ বলে আর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে মেডিকেল কলেজের উদ্দেশে ধাবিত হলাম।
পথে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা দাঁড় করিয়ে সে বললে—আরে, কোথায় চলেছো এমন হন্যে। হয়ে?