সেদিন বাড়ি থেকে বেরুবার আমার তেমন কোনো তাড়া ছিল না, অন্তত ঐরূপ তীরবেগে অকস্মাৎ ধাবিত হব এমন অভিপ্রায় ছিল না আদৌ, কিন্তু পাথরটার সংঘর্ষ আমার গতিবেগকে সহসা এত দ্রুত করে দিল যে, অন্যদিক থেকে মোটর আসছে দেখেও আত্মসম্বরণ করতে অক্ষম হলুম কী ভাগ্যি, ড্রাইভারটা ছিলো হুঁশিয়ার—তাই রক্ষে!
সেদিন থেকেই ভাবছি কি করা যায়। আমার জীবন-পথের মাঝখানে সামান্য একটুকরো পাথর যে এমন প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দেখা দেবে কোনোদিন এরূপ কল্পনা করিনি! তাছাড়া, ক্রমশই এটা জীবন-মরণের সমস্যা হয়ে উঠছে, কেননা ধাবমান মোটর চিরদিনই কিছু আমার পদলনকে মার্জনার চোখে দেখবে এমন আশা করতে পারি না।
তাই ভাবছি একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক, হয় ও থাকুক নয় আমি ও থাকলে আমি বেশিদিন। থাকব কিনা সন্দেহস্থলা তাই যখন আমার থাকাটাই, অন্তত আমার দিক থেকে বেশি বাঞ্ছনীয়, তখন একদা প্রাতঃকালে একা কোদাল যোগাড় করে লেগে পড়তে হলো।
একটা বড় গোছের নুড়ি, ওর সামান্য অংশই রাস্তার ওপর মাথা তুলেছিলা বহু পরিশ্রমের পর। যখন ওটাকে সমূলে উৎখাত করতে পেরেছি, তখন মাথার ঘাম মুছে দেখি আমার চারিদিকে রীতিমত জনতা। বেশ বুঝলাম এতক্ষণ এঁদেরই নীরব ও সরব সহানুভূতি আমার উদ্যমে উৎসাহ। সঞ্চার করছিল।
তাঁদের সকলের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—আপনারা কেউ চান এই পাথরটা?
জনতার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল, কিন্তু কারু ঔৎসুক্য আছে কি নেই বোঝা গেল না। তাই আবার ঘোষণা করতে হলো—যদি দরকার থাকে নিতে পারেনা অনায়াসেই নিতে পারেনা আমার শ্রম তাহলে সার্থক জ্ঞান করব এবং আমি খুশী হব।
জনতার এক তরফ থেকে একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলে—এটা খুঁড়ছিলেন কেন? কোনো স্বপ্ন টপ্ন পেয়েছেন নাকি?
আমি লোকটার দিকে একটু তাকালাম, তারপর ঘাড় নেড়ে বললাম—না, যা ভাবছেন তা নয়। পাথরটাকে রাস্তার এক নিরাপদ কোণে স্থাপিত করা গেল। কিন্তু আমার কথায় যেন ওর প্রত্যয় হলো না, কয়েকবার আপনমনে মাথা নেড়ে সে আবার প্রশ্ন করলে—সত্যি বলছেন পাননি, কোনো প্রত্যাদেশ-টত্যাদেশ?
—কিচ্ছু না।
লোকটার কৌতূহলকে একেবারে দমিয়ে দিয়ে ওপরে এসে মাকে বললাম, দু’কাপ চা তৈরী করতো আমার জন্যই দু’ কাপ পাথরটার সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে কাতর হয়ে পড়েছিলাম প্রায় প্রস্তরীভূত হয়ে গেছলাম, বলতে কি!
এরপর প্রায়ই বাড়ি থেকে বেরুতে এবং বেড়িয়ে ফিরতে নুড়িটার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় অনেক সময় হয় না, যখন অন্যমনস্ক থাকি। এখন ওকে আমি সর্বান্তঃকরণে মার্জনা করতে পেরেছি, কেননা আমাকে অপদস্থ করার ক্ষমতা ওর আর নেই। সে-দৈবশক্তি ওর লোপ পেয়েছে।
আমাদের মধ্যে একরকম হৃদ্যতা জন্মেছে এখন বলা যেতে পারে। এমন সময়ে অকস্মাৎ একদিন দেখলাম নুড়িটার কান্তি ফিরেছে, ধুলোবালি মুছে গিয়ে দিব্য চাকচিক্য দেখা দিয়েছে। যারা সকালে বিকালে হোস পাইপে রাস্তায় জল ছিটোয়, বোঝা গেল, তাদেরই কারুর স্নেহদৃষ্টি এর ওপর পড়েছিল। ওর চেহারার শ্রীবৃদ্ধি দেখে সুখী হলাম।
–ব্যাপার কিরকম বুঝচেন?
হঠাৎ পেছন থেকে প্রশ্নাহত হয়ে ফিরে তাকালাম সেদিনের সেই অনুসন্ধিৎসু ভদ্রলোক।
জিজ্ঞাসা করলাম—আপনি কি সেই থেকে এখানে পাহারা দিচ্ছেন নাকি? না, কোনো প্রত্যাদেশ-টত্যাদেশ পেলেন?
–না, তা কেন? এই পথেই আমার যাতায়াত কিনা।
ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হন, কিন্তু অল্পক্ষণেই নিজেকে সামলে নিতে পারেন।
–নুড়িটা দেখছি আছে ঠিক। কেউ নেবে না—কি বলেন?
প্রশ্নটা এইভাবে করলো যেন যে-রকম দামী জিনিসটা পথে পড়ে আছে অমন আর ভূভারতে কোথাও মেলে না এবং ওর গুপ্তশত্রুর দল ওটাকে আত্মসাৎ করবার মতলবে ঘোরতর চক্রান্তে লিপ্ত ছোঁ মেরে লুফে নেবার তালে হাত বাড়িয়ে সবাই যেন লোলুপা আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে জানালাম—না, না, আপনার যারা প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারত, সরকার বাহাদুর তাদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে রাঁচির অতিথিশালায় সযত্নে রেখে দিয়েছেন, তাছাড়া, আপনি নিজেই যখন এদিকে কড়া নজর রেখেছেন তখন তো চিন্তা করার কিছু দেখিনে।
সে একটু হেসে বলল—আপনার যেমন কথা! দেখেছেন এদিকে কারা ওর পূজার্চনা করে গেছে?
ভালো করে নিরীক্ষণ করি—সত্যিই, দেখিনি তো, এক বেলার মধ্যেই কারা এসে পাথরটার সর্বাঙ্গে বেশ করে তেলসিঁদুর লেপে দিয়ে গেছে।
আমি আনন্দ প্রকাশ করলাম—ভালোই হয়েছে। এতদিনে তবু ওর কান্তি ফিরলো এবং আরেকটি সমঝদার জুটলো!
পাথরটার সমাদরে পুলকিত হবার কথা, কিন্তু লোকটিকে বেশ ঈর্ষান্বিত দেখলাম। কপাল কুঁচকে সে বললে—সেই তো ভয়! সেই সমঝদার না ইতিমধ্যে ওটিকে সরিয়ে ফ্যালে!
পরদিন সকালে উঠে দেখি কোথাও পাথরটার চিহ্নমাত্র নেই। ওর এই আকস্মিক অন্তর্ধানে আশ্চর্য হলাম খুব। কে ওটাকে নিয়ে গেল, কোথায় নিয়ে গেল, ইত্যাকার নানাবিধ প্রশ্নের অযাচিত উদয় হলো মনে কিন্তু সঠিক সদুত্তর পাওয়া গেল না। পাথরটার এরূপ অনুপস্থিতিতে এই পথে হরদম যাতায়াতকারী সেই লোকটি যে প্রাণে বেজায় ব্যথা পাবে অনুমান করা কঠিন নয়। একথা ভেবে লোকটার জন্য একটু দুঃখই জাগলো—কিম্বা, এ সেই তত্বজিজ্ঞাসুরই কর্মযোগ?
অনেকদিন পরে গলির মোড়ের অশথতলা দিয়ে আসছি—ও হরি! এখানে নুড়িটাকে নিয়ে এসেছে যে! নুড়ির স্কুল অঙ্গটা গাছের গোড়ায় এমন ভাবে পুঁতেছে যে, উপরের উদ্ধৃত গোলাকার নিটোল মসৃণ অংশ দেখে শিবলিঙ্গ বলে ওকে সন্দেহ হতে পারে। এই প্রয়োগনৈপুণ্য যার, তাকে বাহাদুরি দিতে হয়। নুড়িটার চারিদিকে ফুল বেলপাতা আতপচালের ছড়াছড়ি। সকালের দিকে এই পথে যে সব পুণ্যলোভী গঙ্গাস্নানে যায়, তারাই ফেরার পথে সস্তায় পারলৌকিক পাথেয় সঞ্চয়ের সুবর্ণসুযোগরূপে একে গ্রহণ করেছে সহজেই বোঝা গেল। যাই হোক, মহাসমারোহেই ইনি এখানে বিরাজ করছেন—অতঃপর এঁর সমুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কারু দুশ্চিন্তার আর কোনো কারণ নেই।