শাহিনা শোনে আর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে আল্লাহকে বলে, খোদা, সহ্য করার শক্তি দাও, আর যে সহ্য হয় না।
বলা হয়েছিল মাসের শেষে যাবে। কিন্তু কেমন করে যেন দু’পক্ষের কী যোগাযোগ হয়ে গেল। আর তাতেই দিন দশেক পরেই একদিন সকালে আতিক এসে বলল, এবার গাঁটরি-বোচকা বাঁধো; আমরা অন্য বাসায় যাবো।
দেখতে দেখতে সব কিছু বাঁধাছাদা হয়ে গেল। কিন্তু সাবিদ আলীর বইগুলো নিয়ে সমস্যা দাঁড়াল। শাহিনা বুঝতে পারে না কী করবে। বইগুলো ঐ বাসাতেই রেখে যাবে, না বাড়িওয়ালার বাসায় দিয়ে আসবে। সাবিদ আলী ওদিকে পরীক্ষার পর দেশের বাড়ি বেড়াতে গেছে। সে বউগুলো নিয়ে ওর বড়বোনকে দিতে গেল, মহিলা বলে ওঠেন, ওর বইয়ের ঝামেলা আমার ওপর কেন চাপাচ্ছেন? ওগুলো আপনিই নিয়ে যান। একটু থেমে ফের বলেন, যদি না নেন, তাহলে ঐ বাসাতেই কোথাও রেখে যান।
শাহিনা শেষে কী করে, বইগুলো বসার ঘরে তাকে সাজিয়ে রেখে বাসা ছেড়ে চলে যায়।
যাত্রাবাড়ির নতুন বাসায় কয়েদিন খুব মনমরা ভাব থাকে শাহিনার। কিন্তু সেও অল্প দু-চার দিন। তারপর সেটা আর থাকে নি। কারণ হতে পারে এই যে, নতুন বাসায় আতিক বেশিক্ষণ বাসায় থাকছে। তাছাড়া সাজানো-গোছানো এসব কাজ তো ছিলোই।
নতুন বাসাও দোতলাতেই। কিন্তু ঘরগুলো ছোট। একেবারেই খুপড়ি খুপড়ি। ডাইনিং স্পেস এমন একটুখানি যে তাতে খাবার টেবিলের পর মাত্র দু’খানা চেয়ার বসানো যায়। শোয়ার ঘরে একখানা খাট পাতলে আর দ্বিতীয় খানার জায়গা হয় না। সুরাং দুই ঘরে দুই খাট পাততে হয়। বারান্দা এমনই চিকন যে ওখানে শুধু দাঁড়ানো যায়। চেয়ার পেতে বসা যায় না। আতিক হাসে খাট পাবার সময়। বলে, মেয়েকে নিয়ে এ ঘরে শোবে তুমি। আমি ও ঘরে। অসুবিধাটা অবশ্যি তোমাকেই পোহাতে হবে, এক রাতে দুই ঘরে শোয়া সোজা কথা নয়। বলতে বলতে মানুষটা এমন অশ্লীল হাসে যে শাহিনার কানে আঙুল দিতে ইচ্ছে করে।
যত অসুবিধার কথা ওঠে সব আতিক একের পর এক হেসে উড়িয়ে দেয়। রান্নাঘর এতো ছোট যে নড়াচড়া করা যায় না–আতিকের সে ব্যাপারে জবাব, তুমিতো রান্নাঘরে লাফঝাপ করতে যাচ্ছে না। বসে বসে শুধু রান্না করবে। তাতে আর অসুবিধা কী?
শাহিনীর গোছগাছে ঝামেলা পোহাতে পোহাতে বেশ ক্লান্তি লাগে। স্বামীর অমন ফাজলামি তার ভাল লাগে না।
মেয়ে যখন বাপকে জিজ্ঞেস করে, আব্দু আমি স্কুলে কবে যাবো? তো বাপের জবাব, তোমার স্কুল তিন মাস ছুটি, এখন তুমি মায়ের কাছে বাসায় পড়ো, তিন মাস পর তুমি নতুন স্কুলে যাবে।
বাপের কথা শুনে মেয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালে মা মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকায়।
মনের ক্লান্তি শরীরেও ছড়ায় সম্ভবত। ক্লান্তি আর আলস্যে শরীর শিথিল হয়ে থাকে।
এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন বিকেলে সাবিদ আলী বইয়ের দুটো বড় বড় প্যাকেট নিয়ে হাজির।
আতিক বাসায় ছিল। সে অতিথিকে খাতির করে বসাল। শাহিনাকেও ডেকে সামনে আনল। সাবিদ আলীর গলায় অনুযোগ-অভিযোগ দুইই শোনা যায়। সে বলে, ভাইজান, এভাবে হঠাৎ করে আপনার চলে আসা উচিত হয় নি, বুজি-দুলাভাই দু’জনেই খুব কষ্ট পেয়েছেন। অসুবিধা কী হচ্ছিল বলতে পারতেন, দুলাভাই বুজি দুজনেই আপনাদের কথা খুব বলেন। ভাবী, আপনি কিন্তু যানে, বুজি আপনাকে যেতে বলেছেন।
বলতে বলতে সাবিদ আলী বইয়ের প্যাকেট দুটো দেখায়। বলে, বইগুলো কেন রেখে এসেছিলেন? আমার তো এখন আর লাগবে না। ভাবী, পরীক্ষাটা কিন্তু আপনি দেবেন, পরীক্ষা দিলেই আপনি পাস করবেন, আমি সিওর।
বেশ খাতির যত্ন করেই সাবিদ আলীকে বিদায় দেয় আতিকুল ইসলাম। তার অতিথি বিদায় হলে বইয়ের প্যাকেট দুটো দেখিয়ে বউকে বলে, তুমি দেখছি সম্পর্কটা ছাড়তে পারছে না।
ঐ কথা শুনে শাহিনা মুখোমুখি তাকালেও আতিক থামে না। বলে, না হলে ছোঁড়া ঠিকানা জানল কার কাছ থেকে? বলো? আমার তো মনে হচ্ছে এ বাসাটাও ছাড়তে হবে।
শাহিনার ভাল লাগে না স্বামীর অমন নোংরা আর বাজে ইঙ্গিত রা কথা শুনতে। সে কোনো কথা না বলে স্বামীর সামনে থেকে সরে আসে।
পরের দিন যখন দুপুরে সে একাকি বিছানায় শুয়ে, তখন হঠাৎ তার স্মরণ হয় কয়েক বছর আগে ঠিক এমনই ক্লান্ত লাগতো নিজেকে, যখন সামিনা পেটে এসেছিল। সে মনে মনে দশমাসের হিসেব করে। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মনের ভেতরে খুশি ছলকে ওঠে, তাহলে ফের সে মা হতে যাচ্ছে। মনের খুশিতে বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে সে। তারপর মেয়েকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তাকে খুব আদর করে চুমু খায় আর মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, এবার কী? ছেলে না মেয়ে? মনের ভেতর থেকে উঠে আসা জবাবটাই সে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে, হ্যাঁ, এবার ছেলে আমার এবার ছেলে হবে।
বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আতিক খানিক অবাক হয়। বউকে অহেতুক লাজুক আর হাসিখুশি দেখতে পায়। লক্ষ করে, বউ কেমন যেন গায়ে গায়ে লেগে থাকতে চায়। অমন আদিখ্যেতা কেন সে বুঝতে পারে না, খানিক ধাঁধা লাগে তার।
শেষে একসময় শাহিনা খবরটা জানায়। বলে, এই শোনো, আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো, আমি বোধহয় প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছি।
খটা শুনে একটু যেন হাসে আতিকুল ইসলাম প্রধান বি.এসসি.। তারপর মাথা দুলিয়ে বলে, আমিও তাই ভেবেছিলাম। ছোঁড়া কেন এসেছিল সেদিন?