- বইয়ের নামঃ প্রদোষে প্রাকৃতজন
- লেখকের নামঃ শওকত আলী
- প্রকাশনাঃ দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড(ইউ পি এল)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. চৈত্রের দাবদাহে অশ্বত্থছায়া
০১.
চৈত্রের দাবদাহে অশ্বত্থছায়া বড়ই শ্রান্তিহারক। নতুবা এতো শীঘ ক্লান্তি অপনোদন সম্ভব ছিলো না। দণ্ড দুই আগেও তার দৃষ্টি ছিলো অস্বচ্ছ। দৃশ্যবস্তু বিচিত্র বিভঙ্গে দোলায়িত হচ্ছিলো। কঠিন পথ বারেক মনে হচ্ছিলো সম্মুখে ঢেউয়ের মতো উপরে উঠছে, আবার মনে হচ্ছিলো, ক্রমেই নেমে যাচ্ছে অতলে। পদক্ষেপও তখন স্ববশে ছিলো না। প্রমত্ত মাদকসেবীর মতোই সে টলে টলে যাচ্ছিলো। কখনও বামে, কখনও দক্ষিণে।
সে বড় বিচিত্র অবস্থা। এখন স্মরণ হলে কৌতুক বোধ হয়। অবশ্য তখনও তার কৌতুক বোধ হচ্ছিলো। কৌতুক বোধ হবারই কথা। কারণ প্রথমে তুমি দেখলে বংশবীথিকার বিনত শাখায় একটি বনকপোত। পরক্ষণে সেই ক্ষুদ্রাকার পাখিটি হয়ে গেলো একটি উর্ধলক্ষী মর্কট–মুহূর্তেক পরে সেই মর্কটও আর থাকলো না, নিমিষে হয়ে গেলো একটি বিশুষ্ক বৃক্ষশাখা। চক্ষু কচালিত করলে অতঃপর তুমি আর কিছুই দেখলে না। বংশবীথিকা না, বনকপোত না, মর্কট না–বিশুষ্ক শাখাও না। কী অদ্ভুত কাণ্ড আসলে কিছুই নেই সম্মুখে। শুধুই ক্রোশ ক্রোশ ব্যাপ্ত কুশক্ষেত্র। গ্রাম নেই দিগন্ত রেখায়, বৃক্ষরাজি গোচরে আসে না, প্রান্তরের বিস্তৃতি কেবলই দূর থেকে দূরে প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে, আকাশসীমা ধূসরতায় বিলীন।
শ্যামাঙ্গ অশ্বত্থের ছায়ায় শয়ান অবস্থায় নিমীলিত চোখে নিজ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে। সে বোঝে, তার মৃত্যু হওয়াও অসম্ভব ছিলো না। তার সৌভাগ্য যে ঐ সময় দূর থেকে একটি পথিক দল তাকে দেখতে পায়। তার কিছুই স্মরণ নেই, কখন সে ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলো, কখন ছুটে এসেছিলো পথিক দল এবং কীভাবেই বা তারা শুশ্রূষা করে তার জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছে।
প্রৌঢ় লোকটি ঐ সময় কাছে এসে জানতে চাইলেন, এখন সুস্থ বোধ করছেন তো?
শ্যামাঙ্গ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পায়নি এতোক্ষণ। এবার বললো, আপনারা আমার প্রাণরক্ষা করেছেন–আমি কীভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো জানি না
থাক, থাক, এখন ওসব কথা নয়–আপনি বিশ্রাম নিন, পথিক প্রৌঢ়ের কণ্ঠে প্রগাঢ় মমতা প্রকাশ পায়।
অশ্বত্থের পাতায় পাতায় চৈত্রের বাতাস শব্দ করে যাচ্ছিলো। শ্যামাঙ্গ সেই শব্দ শুনতে শুনতে আবার নিমীলিত–চক্ষু হলো। তার মনে হচ্ছিলো, প্রৌঢ় পথিক অহেতুক তার জন্য চিন্তিত হয়ে রয়েছেন। সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। একবার ভাবলো, উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো, কী দরকার প্রৌঢ় লোকটিকে অস্থির করে, আরও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেই বা ক্ষতি কি? ততক্ষণে নদীতীর থেকে লোকটি ফিরে আসুক।
প্রৌঢ় পথিক ঐ সময় পুনরায় কাছে এসে উপবেশন করলেন। বললেন, আপনি কি আমাদের সঙ্গী হবেন?
শ্যামাঙ্গ বুঝতে পারে না, কী করবে। কিছু পূর্বে প্রৌঢ়ের আরও একজন সঙ্গী এই প্রশ্ন করেছিলো। তখনও সে কিছু বলতে পারেনি। নৌকাযোগে এরা যাবে দক্ষিণে, বাণপুরের দিকে–আর তাকে যেতে হবে আত্রেয়ী তীরে, রজতপটে। কিছুদূর পর্যন্ত সঙ্গী হওয়া যায়। তারপর তাকে আবার একাকীই পথে নামতে হবে। সে অকপট হলো প্রৌঢ়ের কাছে। বললো, আমার গন্তব্য তো আপনার জানা, আপনিই বলুন, আমার কি কর্তব্য–আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, আপনি পরামর্শ দিন।
প্রৌঢ়টি কিছু বলতেন হয়তো। কিন্তু ঐ সময়ই প্রেরিত লোকটিকে ছুটতে ছুটতে আসতে দেখা গেলো। সে জানালো যে অনতিবিলম্বে একখানি নৌকা যাত্রা করবে তাদের গন্তব্যের উদ্দেশে।
যারা লম্বমান হয়ে ছিলো অশ্বত্থ তলে, তারা লম্ফ দিয়ে উঠলো এবং যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে আরম্ভ করলো। প্রৌঢ়টিও ঈষৎ চঞ্চল হলেন। তবু তিনি পুনরায় জানতে চাইলেন, আপনি কি যাবেন আমাদের সঙ্গে?
শ্যামাঙ্গ এবারও কোন উত্তর দিতে পারে না।
শেষে নিজেই বললেন প্রৌঢ়, আপনাকে একাকী এভাবে রেখে যেতে প্রাণ চায় না। আর যদি সঙ্গে নিয়ে যাই, তাহলে পরে গৃহে প্রত্যাবর্তনের কালে আপনার অধিকতর কষ্ট হবে, সেও এক চিন্তার বিষয়।
কথাটা ঠিক। সত্যিই যদি পুনর্ভবার স্রোতোবাহী হয়ে দক্ষিণে যেতে হয় তাকে, তাহলে মধ্যপথে তাকে নৌকা থেকে নামতে হবে এবং দীর্ঘতর পথ অতিক্রম করতে হবে পদব্রজেই। ঐ পথ আবার অরণ্য–সঙ্কুল।
শ্যামাঙ্গ যাবে কি যাবে না সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পূর্বেই পথিক দল অশ্বত্থ তল পরিত্যাগ করলো। এক যুবকের স্কন্ধে দেহভার রেখে ধীর পদক্ষেপে শ্যামাঙ্গও হেঁটে এলো নদীতীর পর্যন্ত। সেখানেও একটি বটবৃক্ষ ছিলো। শ্যামাঙ্গ বটতলে উপবেশন করে চতুর্দিকে চেয়ে দেখলো, ছায়াদায়ী বৃক্ষ একটি নয়, কয়েকটি। তার অনুমান হলো, পুনর্ভবা তীরের অধিবাসীরা সজ্জন। স্থানটি তার ভালো লাগলো। বিশ্রামস্থলটি ভারী মনোরম।
পর পারে একটি ধবল গাভী চরছে–দুটি ছাগ শিশুকে তাড়না করে ছুটছে একটি শ্যামলী বালিকা। নদীর জলস্রোত ভারী ধীর। তীরের নৌকাগুলি ভাসমান কিন্তু স্থির। মনে হয় না, তাদের নিচে জলস্রোত বইছে।
পথিকেরা কাল বিলম্ব না করে নৌকায় আরোহণ করলো। তারা কেন যে অস্থির হয়ে উঠেছিলো বলা দুষ্কর। কেনো নৌকাটি শীঘ্র যাত্রা করবে এমন মনে হচ্ছিলো না।