- বইয়ের নামঃ ক্রীতদাসের হাসি
- লেখকের নামঃ শওকত ওসমান
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. ক্রীতদাসের হাসি পুস্তকের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার
ক্রীতদাসের হাসি
শওকত ওসমান
‘ক্রীতদাসের হাসি’ পুস্তকের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার এক দৈবী ব্যাপার।
মৌলানা জালাল, মাসুদ সহ, আমরা তিনজনে ছুটি কাটাতে বেরিয়েছিলাম। নেহায়েৎ নিরুদ্দেশের পাড়ি। কিন্তু নানা দুর্বিপাকে এসে পৌঁছলাম এক অখ্যাত পাড়াগাঁয়ে, আমারই এক সহপাঠিনীর বাড়িতে, নাম রউফন নেসা। খুব ভাল ছাত্রী ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের আর এক সেরা ছাত্র তাকে দাগা দিয়ে গিয়েছিল, তার খুঁটিনাটি হদিস আমার জানা আছে। ডিগ্রীর উচ্চতা দিয়ে কত মেয়ে যে প্রতারিত হয়, তার উদাহরণ রফউন। ছাত্রটা পরে এক ঠিকাদারের মেয়েকে বিয়ে করেছিল আট আনা রাজত্ব সহ।
দশ বছর আর রউফনের কোন খোঁজ রাখি নি। হঠাৎ অকুস্থলে পৌঁছে জানা গেল, সে গ্রামে এক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে, সে-ই প্রধান শিক্ষয়িত্রী। সংসারে একমাত্র অবলম্বন পিতামহ শাহ ফরিদউদ্দীন জৌনপুরী। নব্বই বছর বয়স। এখন আর চোখে দেখেন না। কানে ঠিকমত শোনেন না। কানের কাছে মুখ নিয়ে অথবা খুব জোরে কথা বলতে হয়। প্রথম জীবনে তিনি লেখাপড়ার কাছ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করতেন। বর্মাযুদ্ধের সময় লুসাই অঞ্চলে লড়ায়ে যান। পরে গৃহত্যাগ করে যান বিহার-যুক্ত প্রদেশ এলাকায়। ফিরে আসেন আবী-ফার্সির বিরাট মৌলানা-রূপে। বহু সাগরেদ আছে বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু গত তিরিশ বছর তিনি বাইরের জগতের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ রাখেন না। তাঁর সংগৃহীত পাণ্ডুলিপিশালা যে-কোন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিরাট সম্পদ।
একদিনের প্রবাস জীবন।
পরদিন সকালে বিদায়। অতিথি আপ্যায়নের ঘটা ছিল বেশী। তাই মৌলানা জালাল রসিকতা করে বলেছিলেন, “রউফন তুমি কী আমাদের সেই ‘সহস্র ও এক রজনী’ বা ‘আলেফ লায়লা ওয়া লায়লা’র পেটোরোগী বানাতে চাও যে গৃহকর্তা রুটি আনতে গেলে তরকারী খেয়ে বসত আর তরকারী আনতে গেলে রুটি খেয়ে ফেলত।”
তারপর সকলে বেশ তুমুল হাসি হাসছিলাম।
দাদু, শাহ সাহেব, কানে শোনেন না। কিন্তু অত হট্টগোলে সচেতনরউফনকে হাত ইশারায় ডেকেছিলেন।
ফরিদউদ্দীন জৌনপুরীর কানের কাছে রউফন মুখ নিয়ে বলেছিল, “দাদু, ওরা ‘আলেফ লায়লা ওয়া লায়লা’র গল্প নিয়ে হাসাহাসি করছে।”
দাদু হেসে-হেসে বলেছিলেন, “বন্ধুগণ, ওটা আলেফ লায়লা ওয়া লায়লা (সহস্র ও এক রাত্রি) নয়। ও কেতাবের পুরা নাম “আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানে। সহস্র দুই রাত্রি।”
“দাদু, আমি ইংরেজীর ছাত্র। আমি ত শুনেছি ‘thousand and one night’ সহস্র ও এক রাত্রি।” জবাব মাসুদের।
“ভুল শুনেছ।”
“ভুল?” মাসুদের কণ্ঠস্বরে ঈষৎ চ্যালেঞ্জের ছোঁয়াচ।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভুল। তোমরা ত পড়ো বেঈমান ইংরেজের কেতাব। যাদের গোলাম ছিলে দেড়শ’ বছর। আসল বই ত দ্যাখো নি।”
দাদুর কণ্ঠস্বর তপ্ত। তিনি নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন। চোখে না দেখলেও, উঠান-ঘর সব তার মুখস্থ। আলমারী খুলে ঠিক তৃতীয় সেফের মাঝখান থেকে একটা জেদ-করা কেতাব বের করলেন।
তারপর একটু অবজ্ঞা-জড়িত সুরেই কেতাবখানা আমাদের টেবিলে ফেলে দিয়ে বলেন, “দোস্তেরা, একবার চোখে দেখে নাও।”
আমরা তিনজনে হুমড়ি খেয়ে পড়ি। মৌলানা জালাল আরবী জানেন। কিন্তু আমরা ত পড়তে পারি।
বিরাট পাণ্ডুলিপি। ছাপা কেতাব নয়। মলাট খোলর পর দেখা গেল কেতাবের নাম: আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানে।
আমরা ত অবাক।
জিজ্ঞেস করল মাসুদ, “দাদু, এ পাণ্ডুলিপি আপনি কোথায় পেলেন?”
দশ মিনিট ধরে তিনি ইতিহাস বলেন। হালাকু খানের বগ্দাদ ধ্বংসের সময় এই পাণ্ডুলিপি আসে হিন্দুস্থানে। নানা হাত-ফেরীর পর পৌঁছায় শাহ্ সুজার কাছে। তিনি আরাকানে পলায়নের সময় পাণ্ডুলিপি মুর্শিদাবাদে এক ওমরাহের কাছে রেখে চলে যান। সেখান থেকে জৌনপুর। ফরিদ উদ্দীন সাহেব জৌনপুর থেকে এটা উদ্ধার করেন।
তিনি বলেন, “নাস্তালিখ অক্ষরে লেখা। অনেকে এটা ঠিকমত পড়তে পারে না। পর্যন্ত।”
জিজ্ঞেস করলাম, “এটাই তা-হেলে আসল আলেফ লায়লা?
“হ্যাঁ, ভাই।”
আমরা উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগলাম। মাসুদ বলে, “দ্যাখেন ত শেষ গল্পটা কি? অর্থাৎ হাজার এক রাত্রির গল্পটা।”
“শাহজাদা হাবিবের কাহিনী।”
“তা-হোলে ঠিক আছে। তারপরের কাহিনীর নাম কি?”
মৌলানা জালাল পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে জবাব দিলেন, “জাহাকুল আব্দ অর্থাৎ গোলামের হাসি।”
আমরা বিস্মিত। কিন্তু মৌলানা জালাল আৰী জানেন, সহজে মেনে নেবেন কেন? তিনি পাতা উল্টে জিজ্ঞেস করলেন, “হুজুর, আলেফ লায়লায় প্রত্যেক গল্প দুনিয়াজাদীর অনুরোধে শাহরেজাদী বলা শুরু করে। এখানে ত তা দেখছি না।”
“ওই কটা পাতা নেই। সংখ্যা দেখো।”
মৌলানা তা মিলিয়ে নিয়ে খুবই অবাক! আমাদের দিকে তাকালেন।
বিশ্বের বিস্ময় এই পাণ্ডুলিপি। আমি প্রস্তাব দিলাম, “দাদু, এটা আমরা কপি করিয়ে নিতে চাই আমাদের লাইব্রেরীর জন্য। তারপর আপনার কপি পাঠিয়ে দেব।”
ঈষৎ কাঠখড় পোড়ানোর পর দাদু রাজী হোয়ে গেলেন। রউফনের মুখে শুনেছিলাম, সাধারণত তিনি এসব কাছছাড়া করেন না। সেদিন আমাদের জন্য তার স্নেহের ঢল নেমেছিল বোঝা যায়।
শুকরিয়া, ধন্যবাদ মৌলানা জালাল, তুমি এখানে আমাদের পথ দেখিয়ে এনেছিলে! এই আবিষ্কার আমাকে পাগল করে তুলেছিল।
আরো দু-দিন হয়ত থাকা যেত, কারণ চতুর্থ দিনে কলেজ খুলছে। কিন্তু আর না। এই রত্নগুহা থেকে আবিষ্কৃত একটি রত্ন পৃথিবীকে না দেখানো পর্যন্ত আমার আর স্বস্তি ছিল না।
সেদিনই বিদায় নিলাম দুপুরের পর। রউফনের মিনতির কোন দাম দিতে পারলাম, দুঃখ।
শা’ সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিতে সত্যি কষ্ট হচ্ছিল। তাঁকে ধরে-ধরে আনা হোলো দলিজ পর্যন্ত।
সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে এল রউফন। জীবনের কাছে পরাজয় না-মানা বীরেরই পৌত্রী। সে কিন্তু তার সজল চোখ আজ লুকাতে পারল না। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের সেই সেরা ছাত্রটির কাছে প্রত্যাখ্যাত হোয়ে রউফন এমনি চোখেই আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। জীবনকে কিন্তু সে খোয়র হোতে দেয় নি। বীরের পৌত্রী আপ্ত-মানবী।
গাড়িতে উঠে মাথা ঝুঁকিয়ে হাত তুলোম। শ্রদ্ধা স্নেহ মমতা–সব কিছুর পতাকা যেন আমার করতালু।
আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল।
মাথা নীচু করে রউফন সড়ক থেকে বাড়ি অভিমুখে এগোতে লাগল।
.
শহর ফিরেই মৌলানা জালালের সহায়তাআলেফ লায়লা ওয়া লায়লানের শেষ কাহিনীটা বাংলায় তরজমা করে ফেলোম।
বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাঁদের মমতার জন্যেই ত পৃথিবীতে বাঁচা।
.
জাহাফুল আবদ
:
ক্রীতদাসের হাসি
০১.
খলিফা হারুনর রশীদের প্রাসাদের এক অংশে সহধর্মিণী বেগম জুবায়দা ও বাঁদী মেহেরজান কথোপকথন-রত।
বেগম : মেহের।
মেহেরজান : বেগম সাহেবা।
বেগম : যা, এবার যা।
মেহের : আগে ওরা তন্দ্রায় ঝিমোক। মহলের প্রহরীরা এখনও জেগে আছে।
বেগম : আর তাতারী জেগে আছে তোর জেন্য।
মেহের : কিন্তু বেগম সাহেবা, ধরা পড়লে খলিফা আমাকে কতল করে ছাড়বেন।
বেগম : সে আমি দেখে নেব। আর এই নে। যদি বিপদে পড়ি আমার অঙ্গুরী রেখে দে। পাহারাদারদের দেখালে ছেড়ে দেবে।
মেহের : তবু ভয় লাগে, বেগম সাহেবা।
বেগম : আজ হঠাৎ ভয় লাগছে কেন?
মেহের : এম্নি। খলিফা ত আমাকে দেখেন নি। দেখলে মেহেরবানী করতেন। প্রহরীদের হাতে ধরা পড়লে আর রক্ষা থাকবে না।
বেগম : যা। এই সুসাম রাত। এখন জওয়ানের বুকের মধ্যে বাঁধা পড়তে কি যে সুখ—
মেহের : আপনি আমাকে ঈর্ষা করছেন, বেগম সাহেবা?
“মেহেরজান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বেগম সাহেবা বললেন, “দুই সীনা একত্র দেখলে আমার কি যে খুশী লাগে!”
“বেগম সাহেবা”, মেহেরজান জবাব দিলে, “এইজন্যে আমি কেয়ামত তক আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আপনার বাঁদী ত আছি-ই। বেহেশতেও যেন আল্লা আমাকে আপনার। বাঁদী বানিয়ে রাখেন।”
–তুই যা। বড় বাজে কথা বলি। যা, আর দেরী করিস্ না। একটু দাঁড়া–তোর চোখের সুর্মা কোণের দিকে একটু মুছে গেছে।
বেগম সাহেবা নিজেই আয়নার সামনে মেহেরজানকে দাঁড় করানোর পর সুর্মার রেখা স্থান-শোভায় ভরিয়ে তুললেন।
–আহ্, তোকে যা মানিয়েছে। এই ঘাঘরা সদ্রিয়া, ওড়না নেকাব। ফেরেস্তারা তোকে না তুলে নিয়ে যায়।
–বড় লজ্জা দেন, বেগম সাহেবা।
–যা, তাতারী না পাগল হোয়ে যায় আজ তোকে দেখে।
–বেয়াদবী মাফ করবেন, বেগম সাহেবা। সে ত পাগল আছেই। বুকে জড়িয়ে না ছাতু করে ফেলে।
সে ত ভালই। তুই তার বদনে বদনে লেপটে যাবি, আর কাছছাড়া হোতে হবে না।
–কি যে বলেন, বেগম সাহেবা। ঘোড়ার সহিস, শুধু আপনার মেহেরবানীতে–
–ওকে দেখে ভেবেছিলাম, তোর সঙ্গে ভাল মানাবে। হাব্সী গোলাম। কিন্তু সুন্দর সুঠাম দেহ নওজোয়ান।
–মানুষ হিসেবে ও আরো সুন্দর।
–যা, যা। বড় কথা বাড়াস্। আঙুর নিয়েছিস্ ত?
মেহেরজান ওড়নার আড়াল থেকে বেগম সাহেবাকে এক গোছা আঙুর দেখাল।
–তুই নিজেই আজ আঙুর। এর চেয়ে আর বড় মেওয়া তাতারীর কাছে কিছুই হোতে পারে না। (বুকে টোকা দিয়া) এখানেও ত বোটায় ভাল ফল ধরেছে।
বেগম সাহেবা হাতে লাগলেন। সরমে মেহেরজান মুখ নীচু করে আর কুঁচকানো গালের পাশ দিয়ে চোখের দৃষ্টি ছড়িয়ে বেগম সাহেবাকে দেখে।
–এবার যা।
–আর থোড়া–একটা কথা, বেগম সাহেবা। আপনি কেন আমাকে এত পেয়ার করেন?
–তুই এলি। তাই আমি খুশি। তুই আছিস্, তাই এই প্রাসাদে আমার আনন্দ আছে। নচেৎ এই বিরাট মহলে কে কার? বেগম, বাঁদী ত শত শত। কিন্তু কাছের মানুষ মেলা দায়।
–খলিফা ত আপনাকেই…
–সে কথা রাখ।
–আমার আজ যেতে ইচ্ছে করছে না। আমিরুল মুমেনীন ত আজ আপনার মহলে আসবেন না। কাছে থাকতে দিন।
–না। আর এ-কি বছিস্, মেহেরজান? যা, যা। আর একজনের বুক খাঁ খাঁ করছে। গোনাগার হোতে পারব না। ভোর হওয়ার আগে ঠিক ফিরে আসি।
–আমি ত ভয় পাই! দু-জনে কখন ঘুমিয়ে পড়ি জানি না। যদি রাত্রে ঘুম আর না ভাঙে…
–না, এ ভুল কোনদিন করিস্ নে। যদিও খলিফা আমার কথা রাখেন–কিন্তু কখন কি হয়, কে জানে। মরজী যেখানে ইনসাফ সেখানে কোন কিছুর উপর বিশ্বাস রাখতে নেই।
–আপনি ভয় পান, আর আমি ভয় পাব না, বেগম সাহেবা?
–না। তবু সাবধান থাকা ভাল।
–তবে খলিফা আমাকে কখনও দেখেন নি। সেই যা ভরসা। হঠাৎ পথে ধরা পড়লে বলব, বেগম সাহেবা বাগানে ফুল আনতে পাঠিয়েছিলেন।
–খলিফা দেখেন নি। সে ভাল-ই। কখন কি ঘটে এই মহলে, কেউ বলতে পারে না।
–আমার তাই ত রোজ যেতে ইচ্ছে করে না, বেগম সাহেবা।
–না, যা। তাতারী জেগে আছে মহলের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে।
–আচ্ছা, বেগম সাহেবা।
–খোদা হাফেজ। ফি আমানীল্লাহ।
নীচে তরুলতা শোভিত প্রাঙ্গণ চত্বর। তারপর বাগানের সীমানা শুরু। বাতাবী লেবুর সারি, দ্রাক্ষাকুঞ্জ–অন্যান্য গাছের ঘন সন্নিবেশে রাত্রি অন্ধকার-জমাট। পথের হদিস পাওয়া কষ্টকর। বেগম জুবায়দা অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। বাঁদী মেহেরজান কি কালো অন্ধকার, না হাব্সী গোলামের কালো বুকে এতক্ষণে হারিয়ে গেল?
আখরোট-খুবানী ডাল ঝুলে আছে ওইখানে পুব দরওয়াজার দু’পাশের দেওয়ালের পাথর ঘিরে। তারই নীচে তো তাতারী প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। ডালের ঝোঁপ ছেড়ে মেহেরজান কখন তার হাতে হাতে দিয়ে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
হাব্সী গোলাম আজ অপেক্ষা করবে ত? দাঁড়িয়ে থাকবে না স্পন্দিত বুকে, সারাদিনের কঠোর ক্লান্তির পর?
বেগম জুবায়দার মনে সেই প্রশ্ন, মেহেরজানের মনে সেই প্রশ্ন।
০২. প্রাসাদ-কক্ষে হারুনর রশীদ
প্রাসাদ-কক্ষে হারুনর রশীদ পায়চারী-রত। মুখে আবেগ-চাঞ্চল্যের ছাপ। বারান্দায় পদধ্বনির শব্দে উৎকর্ণ বগ্দাদ-অধিপতি হেঁকে উঠলেন, “কে?”
জবাব আসে “জাঁহাপনা, বান্দা-নেওয়াজ, আমি মশ্রুর।”
হারুন : এসো, এসো মশ্রুর। আজ আমি বড় একা। হ্যাঁ, একা।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আর্মেনিয়া থেকে একশ’ মুজ্রানী-নর্তকী আনিয়েছি। ওদের ডাক দেব, হুকুম দিন।
হারুন : বড় একা, মশ্রুর। মুজরানী দিয়ে শুন্যতার সেই বোধ দূর হবে না।
মশ্রুর : হুজুর, আপনার যা খায়েশ, শুধু বলুন। আসসামায়ো তায়াতান। (শ্রবণ অর্থ পালন)। হারুন : না, কিছু না। বড় একা লাগছে। আজ জাফর বামেকী নেই, আব্বাসা নেই।
মশ্রুর : জনাবে আ’লা, সেদিনও আপনার ফরমাবরদার গোলাম কোন কিছু অমান্য করে নি।
হারুন : হ্যাঁ, মশ্রুর। তোমার আবলুস কালো দেওয়ের মত কদ, তোমার পাহাড়ের মত বাজু–সব সময় আমার আর তলওয়ারের ইজ্জৎ রক্ষা করে এসেছে। কিন্তু আমার বুকের পাষাণ-ভার নামাতে পারে না? তুমিই একমাত্র পুরাতন বন্ধু রয়ে গেছে। আর সবাই ওপারে।
মশ্রুর : আলম্পানা—আলম্পানা—
হারুন : দহসৎ–ভয় পেয়ো না। আমি এখন আমিরুল মুমেনীন হারুনর রশীদ নই। আমি দরবারে নেই–হারেমে আছি। আমি তোমার বন্ধু, মশ্রুর।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আপনি যেদিন রাত্রে উজীরে আজম জাফর বার্মেকীর কতল পারোয়ানা লিখলেন, তখন বার বার ফিরে এসেছি তার দরওয়াজা থেকে। আপনার কাছে নাফরমান সাজতে পারব না–আবার ছুটে গিয়েছি। আপনি সবুর করলেন না।
হারুন : মশ্রুর, আজো নিজের বিচার মানুষ নিজে করতে শেখেনি। সে খোদ্কসী (আত্মহত্যা করতে পারে, যেমন সে রোজ গোস্তের জন্য দুম্বা কি গাইকসী করে, কিন্তু নিজের বিচার করে না। সে-কথা আর উত্থাপন করো না কোনদিন।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, গোস্তাখি মাফ করবেন। মা’জী মা’জী–অতীত অতীত। তা আর কবর খুঁড়ে তুলবেন না।
হারুন : মশ্রুর, মানুষের লাশ কি কবরে পড়ে থাকে আর পচে?
মশ্রুর : আলেমরা সেই রায় দেয়।
হারুন : না, না–মশ্রুর। দিওয়ানে এতক্ষণ বসেছিলাম। এখন পায়চারী করছি। কেন জানো? লাশ কবরে শুয়ে থাকে না। লাশ কথা বলে। তার ধাক্কা আরো শক্ত আরো কঠিন। জেন্দা মানুষের কণ্ঠ সেখানে ক্ষীণ ফিসফিসানি, ভাঁড়ার ঘরে নেংটি ইঁদুরের পায়ের আওয়াজ মাত্র। বসে থাকতে পারলাম না।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, মন থেকে সব মুছে ফেলুন।
হারুন : সবে মুছে দিতে পারি। কিন্তু স্মৃতি, মশ্রুর? স্মৃতি লাশ জেন্দা করে তোলে।
মশ্রুর : স্মৃতি সমস্ত কওম-কে জেন্দা করে তুলতে পারে, জনাব। কিন্তু আলম্পানা, সকলের স্মৃতিশক্তি থাকে না। হাবা বোবারা যেমন। তবে অতীতের কথা অনেকে বলে। সে ত এগোতে না পেরে, দুঃসহ বর্তমান থেকে পালানোর কুস্তি-প্যাঁচ মাত্র। ও এক রকমের ভেল্কি, জীবনী-শক্তির লক্ষণ নয়। বলিষ্ঠ মানুষেরই স্মৃতিশক্তির প্রয়োজন হয় সামনে পা ফেলার জন্য।
হারুন : আহ্ মশ্রুর, তুমি ত শুধু জল্লাদ নও, তুমি আলেমুল আলেম। পণ্ডিতের পণ্ডিত। তাই ত আমার বন্ধু। কিন্তু স্মৃতি আমাকে ঘুমাতে দেয় না।
মশ্রুর : চলুন, কিছুদিন বগ্দাদের ঝামেলা ছেড়ে আর কোথাও যাই।
হারুন : কিন্তু আব্বাসা আমার সঙ্গ ছাড়বে? না-না। ঘরের মধ্যে জ্যান্ত, কবরে দাফন হোলো তার। সোজা কথায়, পুঁতে ফেলোম। কতটুকু তার অপরাধ? জাফরের প্রতি মহব্বৎ–কিন্তু আমি কি?
খলিফা হারুনর রশীদ হা-হা-রবে প্রায় উন্মত্তের মত হেসে উঠলেন। পায়চারী করতে লাগলেন। হাব্সী মশ্রুর মাথা-নীচু, তহরীমা বাঁধার ভঙ্গী বুকে দুই হাত, পাথর-মূর্তির মত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। হারুনর রশীদ পায়চারী হঠাৎ থামিয়ে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য মশুরুরের বুকে মৃদু তর্জনী আঘাত করলেন। আবার হা-হা হাসি। তারপরই পায়চারীরত অবস্থায় বলে উঠলেন, “কতটুকু তার অপরাধ? জাফরের সঙ্গে কি রকম শাদী দিলাম? ‘আকদ’ হলো অথচ রসুমৎ হবে না কোনদিন। শক্ত শর্ত। কঠিন কারার। মশ্রুর”—
মশ্রুর : আলম্পানা।
হারুন : আব্বাসা বাকী কাজ নিজে তামাম করলে। রসুমৎ-ব্যবস্থার ভার নিজের হাতে নিলে যা বেরাদর নিলেন না। শর্ত ভঙ্গের কঠোর শাস্তিও দিলাম। আব্বাসী কওমের খুন বার্ষেকী কওমের সঙ্গে মিশে নাপাক হবে–না, তা হতে দিতাম না মশ্রুর—
মশ্রুর : আলম্পানা।
হারুন : আব্বাসা আমার সগ্গা সহোদর বোন। হা-হাঃ।
মশ্রুর : জাঁহাপনা–।
হারুনর রশীদ মরুরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন, হাব্সী জল্লাদ চক্ষু তোলার সাহস পায় না। পায়চারী-সচল মুহূর্ত পৃথিবীর মতই ঘূর্ণমান। কিন্তু সমান তাল ও রেখায় নয়। আমিরুল মুমেনীন আবার হঠাৎ থেমে মৃদু কণ্ঠে বলেন, “মশ্রুর, আমি স্মৃতি উপড়ে ফেলতে চাই, সমস্ত স্মৃতি।”
মশ্রুর : চলুন, বাগানে যাই। নারঙ্গী বনে ফুল ফুটেছে। কোথাও জাম্বুরায় পাক ধরছে। বাগানে অঝোর গন্ধ। খোশবু মনের বোঝা হাল্কা করে আলম্পানা।
হারুন : তা-ই চলো। হারেমের এই কামরা আমার কাছে দোজখ। স্মৃতির হাবিয়া
নরক আমার খুন শুকিয়ে দিয়েছে। গুম-খুন আমার ঘুম। এখানে আর না। মশ্রুর ঠিকই বলেছিল। ফল আর ফুলের খোশবুর সঙ্গে জুটেছিল ঠাণ্ডা হাওয়ার হাল্কা স্পর্শ। থোকা থোকা অন্ধকার কোথাও জমাট, কোথাও ঈষৎ ফিকে। তাই এখানকার বহুমাত্রিক দুনিয়া বহুমাত্রিক মনের নাগাল পায় বৈকি। পায়ের নিচে ঘাসের কোমলতা অন্যান্য অঙ্গের সান্নিধ্য খোঁজে। মিটিমিটি নক্ষত্র বর্তিকা বাঁদীর কর্তব্য-সমাপনে নেমে আসে।
পায়চারী করতে করতে খলিফা বলেন, “মশ্রুর, তোমার কথামত ঠিক জায়গায় এসেছি। আমি মনে শান্তি পাচ্ছি। আগুনের জ্বালা আর পোড়ায় না। আঁচ, আঁচ ত থাকবেই।”
মশ্রুর : শুক্রিয়া, জাঁহাপনা।
হারুন : মশ্রুর, তোমার মনে পড়ে, আমরা চারজনে কতদিন বাগদাদের সড়কে, কতো বেগানার কত রাত কাটিয়ে দিয়েছি?
মশ্রুর : জাঁহাপনা, মওতের আগে তক্ বান্দা তা ভুলতে পারবে না।
হারুন : মনে পড়ে … মণিকার মাজারের মহলে সেই রাত্রির কথা? অদ্ভুত সেই আওরত–শাদীর সময় যার শর্ত ছিল শওহর ব্যভিচারী হোলে, দু’শ’ কোড়া দুই পাঁজরে খেতে হবে। দুই চক্ষু উপড়ে তুলে দিতে হবে। … মনে পড়ে?
মশ্রুর : কেয়ামৎ তক্ মনে থাকবে, বান্দা নওয়াজ, ভৃত্যপালনকারী।
হারুন : মনে পড়ে, সিন্দবাদ নাবিকের কথা? তার হপ্তম সফরের সেই রোমাঞ্চকর কাহিনী?
মশ্রুর : বান্দার স্মৃতিশক্তির পরিচয় ত আপনার জানা আছে, জিলুল্লাহ।
হারুন : সব মনে আছে। জাফর আর আব্বাসা কবরে শুয়েও ভুলে যায় নি। কিন্তু আমি ভুলে যেতে চাই।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, সে-সব কথা আর তুলবেন না। চমৎকার রাত্রি। আপনি যদি মঞ্জুর করেন, কবি ইস্হাককে ডেকে আনি। তার গজল শোনা যাক।
হারুন : না, মশ্রুর। নির্জনতাই আমার পছন্দ। এখানে রাত্রির হাওয়া পাঁজরের দাহ নিভিয়ে দিতে পারে। কবির জায়গা আর কোথাও। ওরা বুকের কল্লোল আরো বাড়িয়ে তোলে।
মশ্রুর : বান্দা-নওয়াজ, ভৃত্য-পালক, তবে চলুন–শহরের সড়কে হাঁটি। বগ্দাদ শহর ত ঘুম জানে না। কোথাও না কোথাও কিছু পাওয়া যাবে, মনের বাতাস ফেরাতে।
হারুন : না মশ্রুর। এই লেবাসে অসম্ভব। আর দুজনে ত বহুদিন বেরোই নি। উম্মায়েদ খুনীদের গোয়েন্দা, গুণ্ডা কোথায় কিভাবে ওঁৎ পেতে আছে, কে জানে।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, উম্ময়েরা কর্দোবা শহরে পালিয়েছে। ওরা আর এদিকে চোখ ফেরাবে না। হারুন মশ্রুর, খেলাফৎ ত পাও নি। বুঝবে না রাজত্বের লোভ কত। ওই লোভের আগুনের কাছে হাবিয়া-দোজখ সামাদানের ঝিলিক মাত্র। বিবেক, মমতা, মনুষ্যত্ব–সব পুড়ে যায় সেই আগুনে। উমাইয়ারা আমার বংশ প্রতিষ্ঠাতা আবুল আব্বাসকে গাল দেয় সাফফাহ–রক্তপিপাসু বলে–আর ওরা? জাল দরিয়ার তীরে যদি আবুল আব্বাস হেরে যেত? জয় বা পরাজয়ের গ্লানি মেটাতে পরাজিতদের গাল দেওয়া একটা রেওয়াজ হোয়ে দাঁড়িয়েছে। উমাইয়াদের পাশা যদি ঠিক পড়ত তখন? নীতি এখানে বড় কথা নয়। বল–লোক-বল, অস্ত্র-বল, অর্থ-বল সব নীতির মাপকাঠি। তাই দুজনের বগ্দাদ শহরে এই অবস্থায় পায়চারী করা যুক্তিযুক্ত হবে না।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, উমাইয়াদের ঘাড় অত তাকৎ রাখে না।
হারুন : না রাখুক। হুঁশিয়ারী ভাল, হুঁশিয়ারী ভাল, মশ্রুর।
মশ্রুর : জিলুল্লাহ, আপনার মহল এই “কাওসুল আক্কারের” বাগানে কতদিনের পুরাতন গাছ রয়েছে।
হারুন : বহুদিনের। আব্বাজান মরহুম মেহদী বলতেন–দুইশ’ বছর আগে এখানে–কিন্তু ও কি, মশ্রুরয়
মশ্রুর : কি, জাঁহাপনা?
হারুন : (উৎকর্ণ) ওই
মশ্রুর : কি, আমিরুল মুমেনীন?
হারুন : তুমি শুনতে পাচ্ছে না?
মশ্রুর : না, আলম্পানা।
হারুন : হাসি, হাসি–কে যেন হাসছে।
মশ্রুর : হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।
হারুন : আমার মহলের গায়ে কে হাসছে এত রাত্রে এই হাসি–একটু চুপ করো।
খলিফা হারুনর রশীদ ঠোঁটে তর্জনী রেখে ইঙ্গিত করলেন, একদম নিঃস্তব্ধ দাঁড়াও। সত্যি, চতুর্দিকের সুসাম বিয়াবান যেন হাসির মওজে দোলা খাচ্ছে। খুব জোর হাসি নয়। অস্পষ্ট। তবু তার রণন উৎসমুখের খবর পাঠায়। উৎকর্ণ কিছুক্ষণ শোনার পর, হারুনর রশীদ স্তব্ধতা ভেঙ্গে উচ্চারণ করলেন, “মশ্রুর। শুনেছো এমন হাসি? কে হাসছে আমার মহলের দেওয়ালের ওদিকে? এ হাসি ঠোঁট থেকে উৎসারিত হয় না। এই উৎস সুখ-ডগমগ হৃদয়ের নিভৃত প্রদেশ। ঝর্ণা যেমন নির্জন পাহাড়ের উৎসঙ্গ–দেশ থেকে বেরিয়ে আসে উপলবিনুনী পাশে ঠেলে ঠেলে–বিজন পথ-ভ্রষ্ট তৃষ্ণার্ত পথিককে সঙ্গীতে আমন্ত্রণ দিতে এই হাসি তেমনই বক্ষঝর্ণা-উৎসারিত। কিন্তু কে এই সুখীজন–আমার হিংসা হয়, মশ্রুর। আমি বগ্দাদ-অধীশর সুখ-ভিক্ষুক। সে ত আমার তুলনায় বগ্দাদের ভিক্ষুক, তবু সুখের অধীশ্বর! কে, সে?
মশ্রুর জবাব দিলে, “আলম্পানা, ওদিকে ত হাব্সী গোলামেরা থাকে।”
হারুন : হাব্সী গোলাম?
মশ্রুর : হ্যাঁ, বাদশা-নামদার।
হারুন : গোলামেরা এমন হাসি হাসতে পারে?
মশ্রুর : পারে, আমিরুল মুমেনীন। ওরা সুখ পায় না, কিন্তু সুখের মর্ম বোঝে।
মনুষ্যত্বহীন, কিন্তু মনুষ্যত্বের আস্বাদ পায়। ওরা হাসে।
হারুন : মনে হয় কোন জ্বীন-পরীর হাসি। কিন্তু কান দিয়ে শোন ত। মিহি-মোটা দু-রকম হাসি যেন একত্রে মিশে বাতাসের লাগাম ধরে আছে।
মশ্রুর : তা-ই মনে হয়।
হারুন : কিন্তু কারা হাসছে? কোন মানব-মানবী? কোন মানব-মানবী একত্রে?
মশ্রুর : গোলামের হাসি, জাঁহাপনা।
হারুন : ওরা হাসবে, আমি হাসতে পারব না? না, তা হয় না।
মশ্রুর : হাসি থেমে গেল, জিল্লুল্লাহ্।
হারুন : হ্যাঁ। তা-ই মশ্রুর। কিন্তু ওর রেশ আমার কানে এখনও বাজছে।
মশ্রুর : সত্যি, অদ্ভুত হাসি।
হারুন : মশ্রুর, চেয়ে দেখো ওই দিকে। ওই খুবানির গাছের ডাল যেখানে দেওয়ালের লাগালাগি মিশেছে কে যেন সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ল।
মশ্রুর : না, জাঁহাপনা। এখানে কে আসবে? কার এত সাহস?
হারুন : একটু এগোও। দেখো, ঝাঁপ দিয়ে পড়লে ডাল যেমন কাঁপে, খুবানির শাখা তেমনই কাঁপছে।
মশ্রুর : আমিরুল মুমেনীন, কোন নিশাচর পাখি বসেছিল, হয়ত এখনই উড়ে গেল। তার ডানার ঝাঁপটের শব্দে এমন মনে হয়। হারুন : হয়ত তা-ই। এখন কত রাত্রি?
মশ্রুর : আলম্পানা, ঐ ত দজ্লা নদীর উপরে আদিম-সুরত হেঁটে হেঁটে দূরে নাম্ছে! আর বেশী প্রহর বাকী নেই শুকতারা ওঠার।
হারুন : চলো, এখন মহলে ফিরে যাই। এই রাত্রির কথা যেন কেউ টের না পায়, মশ্রুর। আহ, ঐ হাসি আমি হাসতে পারতাম! কাল আবার আমাদের তালাসী নিতে হবে–এমনই রাত্রে।
মশ্রুর : আসসামায়ো তায়তান–-শ্রবণ অর্থ পালন।
হারুন : মশ্রুর।
মশ্রুর : জাঁহাপনা।
হারুন : আজ আমি ঘুমাব, অনেক-অনেক ঘুম। কাল দরবার হবে না, ওদের বলে দিও। আমি শুধু হাসি শুছি। আমি এমনই হাসি হাসতে চাই। চলে। …
০৩. হারুনর রশীদের কওসুল-আকদার
হারুনর রশীদের কওসুল-আক্দার বা সবুজ প্রাসাদ রাত্রির নৈঃশব্দ্য-মোড়কে কৃষ্ণবর্ণ। মহলের কোথাও কোথাও আলো জ্বলছে, কিন্ত উদ্যান আগেকার মতই সুপ্তি-মগ্ন, অন্ধকার। খোজা প্রহরীরা কোথাও কোথাও নিজের জায়গায় মোতায়েন আছে। তাদের দেখা যায় না। জুতার আওয়াজ নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে ওঠে নি এখনও। বাতাসের গোয়তি হয়ত শব্দ তোলে, কিন্তু তার ছোঁয়াচ নির্জনতা ভেদ করতে পারে না। সৃপ্তির বর্ম এখানে বড় কঠিন।
“মশ্রুর, ধীরে”, আবার কাফ্তান গোলাপ ডালের কাঁটায় বিঁধে গিয়েছিল, তা ছাড়াতে ছাড়াতে খলিফা হারুনর রশীদ বলেন।
“জাঁহাপনা, আজ কেউ আর হাসছে না।” মশ্রুর জবাব দিলে।
দু’জনে হাঁটছিলেন উদ্যানের সাধারণ রক্তিম পাথরের পথ ছেড়ে, ঘাসের উপর, গাছের কোল ঘেঁষে ঘেঁষে। নির্জনতার প্রান্তরে অজ্ঞাতবাস বিক্ষত হৃদয়ের প্রলেপ। হয়ত সেই জন্যে অথবা অন্য কারণে আমিরুল মুমেনীন হাঁটছিলেন। আজ তার দেহাবয়বে চাঞ্চল্য প্রায় অনুপস্থিত। হাঁটছেন, দু’একটা কথা বছেন। আবার কান খাড়া করছেন। ছায়ার মত সঙ্গী মঞ্জর অন্ধকারে যেন নিঃশ্বাসের বাতাস।
–মশ্রুর।
–জাঁহাপনা।
–কিছু শুনতে পাচ্ছো?
–হ্যাঁ, জিল্লুল্লাহ্। সেই হাসি। দাঁড়াও, চুপ করে শোনো।
–আজ আরো স্পষ্ট, আরো তীব্র।
–মানব-মানবীর মিলিত হাসি।
–গোলামেরা এত রাত জেগে থাকে।
–থাকে, জাঁহাপনা! বিশ্রাম অর্থ ত শুধু ঘুম নয়।
–এগোও, দেখা যাক্ কোন্ দিক থেকে এই হাসির শব্দ আসে।
তারা দু’জনে এগোতে লাগলেন। কাওসুল আারের বিস্তৃত দেওয়ালের ওপার থেকে বিচ্ছুরিত হাসির অনুরণন ছুটে আসে। আর কিছু বোঝা যায় না। দু’জন স্তব্ধ দাঁড়িয়ে শোনেন, খোলা আকাশের নীচে। সূর্ত এই হাসির পরিমাপ শুধু শব্দে করা চলে না। কর্ণপটে আশাবরী রাগ তারা গ্রামে পৌঁছে যে-সুরের ঝিকিমিকি রচনা করে এই হাসি প্রায় তারই তুলনা। কিন্তু মানুষ এই হাসি হাসতে পারে–বিশেষ করে গোলামেরা? আমিরুল মুমেনীন প্রশ্ন তুললেন ফিস্ ফিস্ কণ্ঠে।
জবাব দিলে মশ্রুর, “জাঁহাপনা, চলুন। প্রহরীদের সঙ্গে নিয়ে এর তল্লাশ শেষ করি।
হারুন : না, মশ্রুর, এত হট্টগোলে হয়ত সব পণ্ড হয়ে যাবে। বুলবুলের ডাক বনের আড়ালে বসে শুনতে হয়।
মশ্রুর : আমি কিন্তু বুলবুল দেখার পক্ষপাতী, আলম্পানা।
হারুন : আমি কিন্তু কম পক্ষপাতী? কিন্তু এত তাড়াহুড়ায় হয়ত কোন খোঁজ পাওয়া যাবে না। বুলবুল উড়ে পালাবে।
মশ্রুর : তার চেয়ে আমাকে দুই রাত্রি সময় দিন, আমি সব হদিস বের করব।
হারুন : বেশ। দু’দিন বহু কাজ আছে। শুনেছি রোমের সুলতান সেই হতভাগ্য নিসিফোরাসের বহু সমর্থক গুপ্তঘাতক সেজেছে। আমিরদের আমিরী চালে নানা গলদ ঢুকেছে। তাই নানা কাজ, আমি দু’দিন ব্যস্তই থাকব। তুমি বের কর হাসির হদিস।
মশ্রুর : আস্সাময়য়া তায়তান।
হারুন : কিন্তু মনে রেখো, মশ্রুর। দু’দিন সময়। তার বেশী নয়।
মশ্রুর : বান্দার গর্দান জিম্মা রইল, জাঁহাপনা।
হারুন : বেশ। এবারকার যুদ্ধে রোমের বহু গোলাম বন্দী হয়েছে। বাজারে গোলামের দাম খুব সস্তা। ওরা তবু হাসে? আর এই হাসি অসম্ভব মনে হয়।
মশ্রুর : দু’দিন আমিরুল মুমেনীন। সবই জানা যাবে। হারুন : বেশ। হারুনর রশীদ আবার উৎকর্ণ। শুনলেন সেই মানব-মানবীরা হাসূছে। রুমুঝুমু নিনাদ তরুলতার ক্রোড়ে, বাতাসের পাখনায়, পাখ পাখালিদের স্থির পালকের আবেশে, যখন–বসুন্ধরা হাসমগ্ন।
০৪. তৃতীয় রাত্রি
তৃতীয় রাত্রি।
স্থান, কাওসুল আারের উদ্যান। এই রঙ্গমঞ্চে দুইজন পরিচিত অভিনেতাই উপস্থিত, আরো দুই রাত্রি যাদের সঙ্গে দেখা।
–জাঁহাপনা।
–মশ্রুর, তোমার হদিস বাতাও।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, জায়গা বিশেষে কানের চেয়ে চোখের কিমৎ বেশী। আমি আজ হদিস মুখে বলব না, আপনাকে শোনাব না। আপনার মেহেরবান দুই আঁখিপটে সব ছবি পড়বে, আপনি দেবেন। এখন আমাকে অনুসরণ করুন।
হারুন : কোন্ দিকে মশ্রুর?
মশ্রুর : সেই দেওয়ালের কাছেই। কিন্তু একটু দূরে। একটা বাদাম গাছের ডালের কাছে।
হারুন : তা-ই চলো।
মশ্রুর : বান্দার গোস্তাখি মাফ করবেন, জাঁহাপনা। আর একটা আরজ। আপনাকে তলীফ করে সামান্য উঁচুতে গাছের ডালে চড়তে হবে।
হারুন : তক্লীফ কি? তুমি জানো না, ছেলেবেলায় আমি পিতার চোখে ধুলো দিয়ে কতদিন এইসব গাছে চড়েছি। আমার কোন কষ্ট নেই।
মশ্রুর : তা আমি শুনেছি নাদার। দুই জনে অন্ধকারে লেবাস পর্যন্ত গোপন করে এগোতে লাগলেন। গাছের পাকা পাতা ঝরে। আমিরুল মুমেনীন কান খাড়া করেন।
হাঁটতে হাঁটতে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘মশ্রুর, আজ এত রাত্রি, সেই হাসির রণন ত পাচ্ছি না।’
মশ্রুর : জাঁহাপনা, বান্দাকে এই বিষয়ে আর কোন সওয়াল করবেন না। আপনার সতর্ক, নেঘাবান চোখের কাছে সব হাজির হবে।
হারুন : মশ্রুর, তুমি ধাঁধায় ফেললে। হঠাৎ প্রহরীদের সঙ্গে দেখা হোয়ে গেলে?
মশ্রুর : না, ওরা আজ এদিকে আসবে না। আমি মানা করে দিয়েছি।
হারুন : তা বুঝেছি। মশ্রুর কোন কাঁচা কাজ করে না।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, এই সেই বাদামের দারাখৎ (বৃক্ষ), এই গাছের ডালে আমাদের চড়তে হবে।
হারুন : আচ্ছা, জুতা খোলর প্রয়োজন হবে না। আমার আবা শুধু খুলে এক পাশে রেখে দিই। আলম্পানা, আমি খুলে নিচ্ছি।
প্রায় পনর হাত ঊর্ধ্বে খাড়ী ডালে মশ্রুর ও আমিরুল মুমেনীন উঠে বলেন।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, একবার রাত্রির বগ্দাদ–আপনার গড়া বগ্দাদকে এই উঁচু থেকে দেখে নিন। চমৎকার। কত আলো চারদিকে। এই রাত্রি তবু মানুষের স্পন্দন, হৃৎস্পন্দনের মতই ধুকধুক করছে। দজ্লা নদীর বুকে গুফার উপর আলোর ঝিকিমিকি দেখুন। গুফাদারেরা গজল গাইছে, দাঁড় টানছে। আমিরুল মুমেনীনের গড়া বগ্দাদ, এক-কথায় অপূর্ব।
হারুন : মশ্রুর, মহলের মিনার থেকে কত রাত বগ্দাদকে দেখেছি। কিন্তু আজকের দেখা কোনদিন ভুলতে পারব না। গাছপালার মধ্যে বসে যেন আদিম দুনিয়া থেকে দেখছি মানুষের গড়া জিনিসকে। ইনসান-ও স্রষ্টা। আর ইনসানের তৈরী চিজ বিধাতার চিজের চেয়ে কিছু নগণ্য নয়। আমার বগ্দাদের এই ইমারৎ, সব কিছু হয়ত আজরাইলের থাবায় লয় পেয়ে যাবে, কিন্তু বগ্দাদ অমর উপকথায় পরিণত হবে। আজরাইল সেখানে পৌঁছতে পারবে না।
মশ্রুর : আলহামদোলিল্লাহ্, জাঁহাপনা।
হারুন : বগ্দাদ দুনিয়ার দুর্ভেদ্য অন্ধকারে রোশনাই হোয়ে থাকবে, মশ্রুর।
মশ্রুর : আলহামদোলিল্লাহ্। সকল প্রশংসা আল্লার।
হারুন : কিন্তু মশ্রুর, সেই হাসির ত কোন আলাম-চিহ্ন-পাওয়া যাচ্ছে না।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আমার হাত থেকে এই কাঁচখানা গ্রহণ করুন, কিমিয়ার কাছ থেকে আনা।
হারুন : কেন?
মশ্রুর : এটা চোখে দিলে গাঢ় অন্ধকারেও আবৃছা কিছু দেখতে পাবেন। আর ওই দিকে তাকান। ওই যে খুবানীর ডাল ঝুলে রয়েছে সেদিন যে-জায়গাটা আপনার নেঘাবান চোখে পড়েছিল, সেদিকে তাকিয়ে থাকুন, আলম্পানা।
হারুন : বেশ। কিন্তু কিছুই ত দেখতে পাচ্ছি না।
মশ্রুর। দেখতে পাবেন, নুরুল্লাহ্। আর খুব আস্তে কথা বলবেন। আশেপাশে দেখুন। আমার কাছে-ও একটা কাঁচ আছে। চোখে লাগাই। হারুন কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সব অন্ধকার।
মশ্রুর : আমিরুল মুমেনীন, ঐ ঝুলন্ত ডালের সোজাসুজি দেওয়ালের ওপাশে অর্থাৎ বাগানের দিকে দেখুন।
হারুন : হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। অবশ্য ঝাপ্সা। একজন আওরৎ. হ্যাঁ, আওরৎ-ই আসছে। ওড়না, সদরীয়া, নেকাব–সবই আছে। আমার মহলের আওরৎ কোন বেগম, কোন্ বাঁদী, মশ্রুর?
মশ্রুর : বান্দাকে নাচার করবেন না, জাঁহাপনা। শুধু আপনার মেহেরবান চোখে দেখুন।
হারুন : কিন্তু আমার চোখ মেহেরবান নয়। আমার মহলের বেগম না–বাঁদী? একি মশ্রুর, ডাল ধরে ঝুলে ও-যে দেওয়ালের উপর চড়ল, তারপর ওদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল–ইশারায় কী যেন বললে। নিচে কি কেউ দাঁড়িয়ে আছে? ও কি মহলে বেগম, না বাঁদী?
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আমি কোন জবাব দেব না। একটু সবুর করুন। বান্দাকে আর গোস্তাখির গোনায় গোনাগার করবেন না।
হারুন : সবুর। মশ্রুর, গোয় আমার খুন টগবগ ফুটছে।
মশ্রুর : আলম্পানা, সবুৎ (প্রমাণ) বা একটা কাজের সব না দেখে আপনি গোস্বা হোতে পারেন না।
হারুন : তা সহী (ঠিক)।
মশ্রুর : আলম্পনা, এবার ডাইনে বিশ-তিরিশ হাত দূরে একটু কোনাকোনি আপনার নেঘাবান চোখ সরান। ওটা গোলামদের বস্তী। ঐ এক ঝরোকায় আলো জ্বলছে মিটিমিটি। ওদিকে তাকান। চোখে কাঁচ লাগাতে ভুলবেন না।
হারুন : ওখানে কেন?
মশ্রুর : দেখুন, আলি-শান।
হারুন : মশ্রুর, তুমি শুধু তেলেসমাতি ধাঁধা সৃষ্টি করছ।
মশ্রুর : এবার দেখুন।
হারুন : ও ত গোলাম বসতের ঘর। কিছু মাটি উঁচু করে ফেলে দিওয়ানের মত বানিয়েছে। উপরে বিছানা পাতা। বেশ রঙীনই মনেহয়। গোলামের ঘরে–এই তাকিয়া? আর ত কিছু দেখা যাচ্ছে না।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আপনি শুধু দেখে যান।
হারুন : আমি ত দেখছি-ই।
পাশাপাশি উপবিষ্ট মশ্রুর ও হারুনর রশীদ। কত রাত্রি কে জানে? গাছের কয়েকটা ডাল এক জায়গা থেকে বেরিয়েছে। এমন খড়ি। বেশ হেলান দিয়ে এখানে বসা যায়। কিন্তু কৌতূহলী মানুষ ত আরামের স্বাদ-প্রার্থী নয়। আমিরুল মুমেনীন ও মশ্রুর শিরদাঁড়া সটান মনোনিবেশে দৃশ্য দেখতে লাগলেন। শোনার ক্ষেত্র নেই, বলা বাহুল্য।
গোলাম-বসতের সাধারণ মাটির ঘর যেমন হয়, এই ঘরের মশালা তার চেয়ে অন্য কিছু নয়। কিন্তু তবু পরিপাটি আছে। মাটির দিওয়ান জানালার পাশে। মরুভূমির লু’হাওয়া থেকে বাঁচার জন্য সমস্ত ঘরের জানালা উঁচুতে। যেন সোজাসুজি বাতাস মুখে না লাগে। গাছের পাতার তৈরি দুই পাল্লা। কখনও বন্ধ, কখনও খোলা থাকে। নিচের রাস্তা থেকে কিছু দেখা যায় না। অনেক উপর থেকে ঘরের মেঝে চোখে পড়ে।
হঠাৎ মেটে দিওয়ানের উপর এক হাব্সী নওজোয়ান এসে শুয়ে পড়ল, ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। তার পেছনেই এলো আরমেনী এক তরুণী। সে বসে পড়ল এক পাশে। হাতে একগোছা আঙুর। গুচ্ছ সমেত সে হাব্সী নওজোয়ানের ঠোঁটের উপর ধরে ও নাড়াতে থাকে। হাব্সী আঙুরের লোভে ঠোঁট বাড়ায়। তরুণী তখন দ্রাক্ষাগুচ্ছ উপরে তুলে নেয় আর মিটিমিটি হাসে। হাব্সী জোয়ান এবার বালিশ থেকে আরো উর্ধ্বে মুখ তোলে, কিন্তু আঙুর গুচ্ছ তেমনই আরো উপরে সরে যায়।
কথা শোনা যায় না, তবু কেউ কাছে থাকলে শুনতে পেত বৈকি।
তরুণী : তুমি বড় লোভী, তাতারী? তোমার সবুর সয় না।
যুবক : মেহেরজান, সবুর করা যায় না। ভাল মেওয়া দেখলে জিভে পানি এম্নি আসে।
তরুণী : এসো, আর একবার চেষ্টা করো, তোমার ঠোঁটের কাছে আঙুর ঝুলিয়ে ধরি।
যুবক : তোমার ঠোঁটে আরো বেশী মেওয়া আছে।
তরুণী: বেশ, তাই খাও। কিন্ত আঙুর পাবে না।
যুবক : আঙুরে আমার প্রয়োজন নেই। ও আমার আমাদের নসীবে জুটে না। বেগম জুবায়দার মেহেরবানী, আঙুর-ও জুটছে।
তরুণী : শুধু আঙুর? আর কিছু না?
যুবক : সেই মেওয়া—
উভয়ের হাস্যধ্বনি আর কামরার ভেতরে আবদ্ধ থাকে না। এই প্রাণ হাসি শুধু এই মুহূর্তে পাওয়া যায়–হৃদয় যেখানে হৃদয়ের বার্তা উপলব্ধি করে, সান্নিধ্যের ব্যগ্রতায় নিজের অস্তিত্ব আর আলাদা রাখতে নারাজ। বাতাস হয়ত লোভেই ছুটে আসে তার তরঙ্গে নতুন সুর জুড়ে দিতে। বাতাসকে এখানে আমন্ত্রণ দিতে হয় না।
যুবক : মেহেরজান, আগে এই মেওয়া দাও। তারপর তোমার মেওয়া দিও।
তরুণী : আবার চেষ্টা করো।
যুবক : না। আমি এই মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লাম।
তরুণী : আহা, রাগ করো না। আজ আমিও সবুর করতে পারব না। ভয় হয়। খলিফার কানে গেলে—
যুবক : ভেবে লাভ নেই, মেহেরজান। বেগম সাহেবা যখন আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন, আমি আর ডরাই না।
তরুণী: এসো, আঙুর খাও। আমি ত তোমার জন্যে আনি। বেগম সাহেবা আমাকে রোজ অনেক কিছু খাওয়ান।
যুবক : মেহেরজান, তুমি ভারী সুন্দর, তোমার কথার মতই সুন্দর। বিধাতা তোমাকে ঝুটো করেই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।
তরুণী: ঝুটো?
যুবক : বিধাতা ত সব জানেন। তোমার ভূত-ভিবষ্যৎ। এই আঠারো বছরে তুমি কি দাঁড়াবে তা ত তিনি জানতেন। সেই কল্পনার মূর্তিতে তিনি কি তোমার ঠোঁট আস্ত রেখেছেন, মেহেরজান?
তরুণী : তিনি কি করেছেন জানি না, তুমি ত—
আবার সেই উতরোল হাসি ওঠে এই জীর্ণগৃহের মধ্যে। ফিরদৌস (বেহেশতের নাম) ত দূরে নয়। বুকের কপাট খুললে যে হাওয়া বেরোয় তারই স্নিগ্ধতা আর শীতলতা দিয়েই বেহেশ্ত তৈরী। আজকের হাসি সহজে থামা জানে না। লয়ান্তরের মত তারি মধ্যে তরুণী মুখের কথা ছড়িয়ে যায়।
তরুণী : বিধাতার উপর খালি চুম্বনের অপবাদ কেন? রসিক কী সেখানেই শুধু থেমে থাকতে পারে?
যুবক : আহ মেহেরজান—
যুবক আর দিওয়ানে শুয়ে থাকে না। ধড়মড় উঠে পড়েই সে তরুণীকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে। তারপর বিধাতার উপর যে অপবাদ দিয়েছিল সে তারই অভিনয় শুরু করে। চারি চক্ষুর মিলন, বহু শতাব্দীর প্রবাদ। ঠোঁটের কথা কেন কেউ কোনদিন উল্লেখ করে নি?
যুবক : (ফিস্ফিস্ কন্ঠে) তোমার বুকের মেওয়া কি কম মধুময়, মেহেরজান।
তরুণী : তুমি যে কতদিনের দুর্ভিক্ষে উপবাসী। খালি খাওয়া ছাড়া আর কোন কথাই নেই মুখে।
যুবক : উপবাসী, অনাহারী। নিশ্চয়ই তোমার মত ইফতারীর জন্য আমি সারা জন্ম উপবাসী থাকতে রাজী। কিন্তু আর কথা বলব না।
তরুণী : তুমি আমার সদরিয়া, কাঁচুলী খুলছ কেন? তোমার দুই হাত আমি ভেঙে দেব। খাওয়া ছেড়ে এবার চাওয়া ধরেছ।
যুবক : মেহেরজান, তুমি সত্যি, সত্যি মেহেরজান। প্রাণে করুণা ঢেলে দিতে পারো।
তরুণী : আমার খোলা সীনায় তোমার ঠোঁট তাতারী। আগে আমার ঠোঁটে ছিল তোমার ঠোঁট। তোমার অধঃপতন ঘটছে, ক্রমশঃ নীচের দিকে নামছে। কোথায় গিয়ে যে থাম্বে–যাও।
কৃত্রিম ক্রোধ ও হাসির যুগল-ডানায় সওয়ার মেহেরজান। বাহুপাশ ছাড়িয়ে, দিওয়ানের পাশে দাঁড়ায়। সমস্ত শরীর নগ্ন। পরনে শুধু ঘাগরা।
তাতারীও সামনে এসে দাঁড়িয়ে তরুণীর চোখের দিকে তাকায়। নিস্তব্ধ মুহূর্ত। তারপর মেহেরজানের ঘাড়ে হাত দিয়ে সে-ও হাসতে থাকে। দুইজনে হাসে। যেন স্মৃতির রোমন্থন লীলায় দু’জন ভেসে যাচ্ছে। এই সুখ-সমুদ্রের প্রবাহ অনন্তকালের রেখায় হয়ত মিশে গেছে। কবে? তারা কেউ জানে না।
হঠাৎ কিছুক্ষণ পরে যেন উভয়ের সম্বিত ফিরে আসে। হাব্সী যুবক মেহেরজানকে বুকে জড়িয়ে শূন্যে তুলে নিয়ে এসে আলতোভাবে দিওয়ানে রাখলে। তারপর বাতি নিভিয়ে দিল।
অন্ধকারে দুই জনে অনেকক্ষণ হাসতে থাকে। কেন? সে তারা-ই ভাল জানে, আর জানে বিধাতা। প্রেমিক-প্রেমিকার কুহর শুনেছো কোন দিন? না শুনে থাকো, লেখক তোমাকে আর কিছু বোঝাতে পারবে না।
০৫. মশ্রুর : জাঁহাপনা
মশ্রুর : জাঁহাপনা।
হারুন : কি মশ্রুর?
মশ্রুর : কি দেখছেন?
হারুন : দেখ্ছি না, শুনছি?
মশ্রুর : কি, আলম্পানা?
হারুন : হাসি শুনছি। হাসি থেমে গেছে, তবুও শুনছি। কিন্তু আমার মহল থেকে নৈশ অভিসার! কে–কে এরা, কে?
মশ্রুর : জাঁহাপনা।
হারুন : মশ্রুর, আমি জানতে চাই, মহলের কোন বেগম না বাঁদী?
মশ্রুর : মহলের কেউ নিশ্চয়। আর ত কিছু জানার প্রয়োজন নেই আলম্পানা।
হারুন : আছে। আমার ইজ্জৎ কি কিছু নয়?
মশ্রুর : তৌবাস্তাগফেরুল্লা।
হারুন : তবে কে ওরা?
মশ্রুর : আর জানার চেষ্টা করবেন না, জিল্লুল্লাহ।
হারুন : না, আমাকে জান্তেই হবে, আর তা জানাবে তুমি।
মশ্রুর : বাদশা নামদার, বান্দাকে গোনাগার করবেন না।
হারুন : বলো তুমি কি জানো?
মশ্রুর : জাঁহাপনা, মাফ করুন বান্দাকে।
হারুন : না, মশ্রুর। পুরাতন বন্ধুদের মধ্যে শুধু তুমি আছ। তোমার প্রতি বেদীল্ হওয়ার অপরাধে আমাকে অপরাধী করো না।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আমি মাফ চাইছি দুহাত জোড় করে। আমার কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনে কি বুঝতে পারছেন না, আলম্পানা, কেন–কেন আমার মুখ বন্ধ হয়ে আসছে।
হারুন : কিন্তু মশ্রুর, তুমি কি নিজের গর্দানের কোন দামও দাও না?
মশ্রুর : জাঁহাপনা, অনেক গর্দান নিয়েছি এই হাতে, আর কত দামী দামী গর্দান–মহামান্য জাফর বামেকী, যিনি দুনিয়াকে কামিজের গলায় কান লাগানো শিখিয়ে গেছেন–সেই গর্দান। আমার এই হলকুমের (গ্রীবাদেশ) দাম তো তুচ্ছ তার কাছে। আপনার মেহেরবানী হয়, দানা পানি নিঃশ্বাসের জন্য এই হলকুম রাখবেন–না হয় কলম-তরাস–কর্তন করবেন।
হারুন : এত অভিমান করো না। তুমি জানো, তার দাম আমার কাছে কিছু নয়। সোজা বলো, আসল রহস্য কী? বড় ভুল করেছি–কবি ইস্হাককে সঙ্গে না নিয়ে। ঐ প্রেমের দৃশ্য দেখে হয়ত উম্দা গজল লিখে বস্ত, না হয় তোমার বেয়াদবির সাক্ষী থাকত।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, এই সুমসাম রাত্রি। এই রইল তলওয়ার। আপনি নিজের হাতে আমাকে কতল করুন, কেউ দেখবেনা, কেউ শুনবে না। কিন্তু মশ্রুর বেয়াদবির কলঙ্ক বোঝা মাথায় সইতে পারবে না। নচেৎ হুকুম দিন, আপনার বহু নেমক-পানি যে হলকুমের পথে গেছে, তা আপনার সামনে এই তলওয়ার খিঁচে দুফাঁক করে আপনাকে উপহার দিয়ে যাই।
হারুন : মাথা তোলো, মশ্রুর। আমার ইজ্জৎ তুমি দেখছ না। কোন ব্যভিচারিণী বেগম থাকলে তোমার কি উচিৎ নয়, হুঁশিয়ার হওয়ার জন্য খবর দেওয়া? তুমি বন্ধুর কাজ করছ না।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আমি এইটুকু বলতে পারি, মজকুর আওরৎ মহলের কোন বেগম নয়।
হারুন : বেশ। তাহোলে তুমি আসল ভেদ খোলাসা করছ না কেন? তোমার বাধা কোথায়? আর মনে রেখো, মহলের ভেতর ব্যভিচারিণী বাঁদী পর্যন্ত আমি রাখতে পারি না।
মশ্রুর : ও ব্যভিচারিণী নয়, জাঁহাপনা। তাও আপনাকে জানিয়ে দিলুম।
হারুন : তুমি ধাঁধা আরও বাড়িয়ে তুলছ, মশ্রুর।
মশ্রুর : আমাকে গোনাগার করবেন না। তার চেয়ে তলওয়ার নিজের হাতে গ্রহণ করুন। মশ্রুর প্রাণের জন্য এতটুকু লালায়িত নয়। অবাধ্য বান্দা হিসেবে তার বাঁচার কোন অধিকার নেই, বাঁচতে চায় না সে।
হারুন : আমি জানতে চাই।
মশ্রুর : আমি জানাতে পারি না, আমি অক্ষম, আলম্পানা।
হারুন : কেন পারো না?
মশ্রুর : আরো মানুষ এর সঙ্গে জড়িত।
হারুন : বেশ। আচ্ছা নাদান তুমি, এতক্ষণ তা বলে নি কেন?
মশ্রুর : জাঁহাপনা, বান্দার আক্কেল কম, তা আপনি জানেন।
হারুন : শোনো মশ্রুর, আমি পাক্ কোরান-ছোঁয়া কসম করে বলছি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তির কোন ক্ষতি করব না। আর তার গোস্তাখি যদি অমার্জনীয় হয়–হজরত মোহাম্মদ (দঃ) এর নামে কসম, তবু আমি তার বা তাদের কোন ক্ষতি করব না।
মশ্রুর : আলম্পানা, তাহোলে শুনুন। এর মধ্যে কোন রহস্য নেই। মজকুর আওরৎ আর্মেনী বাঁদী, নাম মেহেরজান। বেগম জুবায়দা ওকে খুবই পেয়ার করেন। তাই হাব্সী গোলামের সঙ্গে গোপনে ওর শাদী দিয়েছেন।
হারুন : হাহ্ হা, মশ্রুর। এ-ই কথাটুকু বলতে তোমার এত সঙ্কোচ। তুমি হাসালে,
সত্যি হাসালে। তুমি সাফ পানি ঘোলা করতে ওস্তাদ। বেগম জুবায়দা এমন কিছু কসুর করেন নি, যার জন্য তুমি এত ঘোরপাক খেলে।
মশ্রুর : তবু জাঁহাপনা, আমি যে তার কাছে কড়াল করেছিলাম—
হারুন : সে আমি দেখব। মশ্রুর, সত্যি হাসি পাচ্ছে। একটা ছোট ব্যাপার নিয়ে হঠাৎ যদি কিছু করে বসতাম, আমার আফসোসের সীমা থাকত না। কিন্তু মশ্রুর, আমি এমন বাঁদী জীবনে দেখি নি।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, মেহেরজান সত্যি খুবসুরাৎ। মুসলে এক সিপাহসালারের ‘মাল-এ গনীমৎ’ (যুদ্ধের বাখরায় প্রাপ্ত দ্রব্য) ছিল। বেগম সাহেবা ওকে মহলে আনান। বড় বিশ্বাসী আওরৎ। তাই বেগম সাহেবা ওকে ভালবাসেন।
হারুন : মশ্রুর, কিন্তু কাল আবার রাত্রে দেখা হবে। আমার অন্য এরাদা আছে। বেগম সাহেবা যেন এইসব রাত্রির খোঁজ না পান।
মশ্রুর : বহুৎ আচ্ছা, জনাব। বান্দার গর্দান জিম্মা।
হারুন : হ্যাঁ, শোনো মশ্রুর। তুমি কবি ইস্হাককে খবর দিও, সে যেন রুবাব সঙ্গে নিয়ে কাল রাত্রে হাজির হয়।
মশ্রুর : আস্সামায়ো তায়তান ইয়া আমিরুল মুমেনীন।
০৬. রুবাবের কান্না
রুবাবের কান্না এই মাত্র থেমে গেল। তারপর চাপা হাসির আওয়াজ শোনা যায়। চাপা কিন্তু প্রাণদ। অন্যান্য দিনের মত এই রাত্রিও স্তব্ধ শীতলতার ভাণ্ডার, বাতাসের কারাগার। বাগিচায় হারুনর রশীদ, আবু ইস্হাক, মশ্রুর কথোপকথন-রত।
হারুন : আবু ইস্হাক, তোমার সঙ্গ এইজন্যে ছাড়তে পারি নে। বহুদিন পর তুমি হাসালে, সত্যি হাসালে। আবার আবৃত্তি করো।
ইস্হাক : আলম্পানা, আবু ইস্হাকও কোনদিন আমিরুল মুমেনীনকে ত্যাগ করে যেতে পারবে না। তবে শুনুন :
ইরানী মেয়ের সীনা ভাল,
মিশরী মেয়ের ঊরু।
আরবী মেয়ের নাভীর নীচে
স্বর্গ ঠারে ভুরু।
হারুন : হাহ্ হা, শোনো মশ্রুর। কিন্তু মিশরী মেয়েরা তোমাকে কতল করে ছাড়বে কবি।
ইস্হাক : আলম্পানা, আবু ইস্হাক এমন বহুবার কতল হয়ে গেছে, সুতরাং ডর নিস্ত।
হারুন : ইরানী মেয়েরা তোমাকে খুন করবে, কবি।
ইস্হাক : ওদের দুই সীনার উপত্যকার মাঝখানে আমার কবর হয়ে গেছে, জাঁহাপনা! লাশকে কি কেউ খুন করে?
হারুন : শোনো, মশ্রুর। বিষণ্ণ রাত্রে কবি ইসহাকের সঙ্গ পেলে আর কোন চিন্তা থাকে না। কিন্তু কবি কখন কোন্ পাশালায় হারিয়ে যায়, খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
ইস্হাক : আপনার বান্দা মশ্রুর তা জানে। শুধু মশ্রুর কেন, দুনিয়ার সবাই জানে, মরুরের তলওয়ারের ঝিলিক আর ইসহাকের কথার ঝিলিকের কাছে বিদ্যুৎ তুচ্ছ।
হারুন : কিন্তু কবি, তুমি আরমেনী মেয়ে সম্পর্কে কোন রুবায়ী লিখ্বে না?
ইস্হাক : জাঁহাপনা, আজ প্রথম দেখলাম আরমেনী মেয়ে, তাও দূর থেকে গাছে সওয়ার হয়ে। তাই ওরা খারিজ আছে।
হারুন : কিন্তু কি দেখলে?
ইস্হাক : দেখলাম মরুরের তলওয়ারের ঝিলিক হার মেনে গেল।
হারুন : আর কি দেখলে?
ইস্হাক : দেখলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম না–দেহের প্রতীক ছন্দ, না ছন্দের প্রতীক দেহ।
হারুন : আর কি শুনলে?
ইস্হাক : শুনলাম, আদমকে তৈরীর পর বিধাতা হয়ত যে-হাসি হেসেছিল তারই অনুরণন।
হারুন : আবু ইস্হাক, তুমি সত্যি সুরের কবি। মশ্রুর, কাল খাজাঞ্চীখানা থেকে কবিকে চার হাজার আশরফী দেওয়ার বন্দোবস্ত করবে। আমার ফরমান।
মশ্রুর : আসৃসামায়ো তায়তান।
হারুন : কবি, তোমাকে আর একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
ইস্হাক : বলুন, আলম্পানা।
হারুন : ঝুটো চিজ কি খাওয়া যায়?
ইস্হাক : চিজ?
হারুন : হ্যাঁ।
ইস্হাক : খাওয়া যায়, আবার যায় না।
হারুন : সে কেমন?
ইস্হাক : অনেক জিনিস ঝুটো হয়, তা খাওয়া চলে না। হেকিমী ইলেমের বিরোধী। আবার অনেক চিজ যা কখনই ঝুটো হয় না, উচ্ছিষ্ট হয় না। সেখানে হেকিম ইলেম ‘থ’ অসহায়।
হারুন : এমন চিজ আছে?
ইস্হাক : কিন্তু হঠাৎ এমন অদ্ভুত সওয়াল, জাঁহাপনা?
হারুন : এমনি জিজ্ঞেস করছি। হ্যাঁ, কোন্ চিজ কোনদিন ঝুটা হয় না?
ইস্হাক : জীবন এবং যৌবন, জাঁহাপনা। নদী কি কেউ কোনদিন উচ্ছিষ্ট করতে পারে?
হারুন : না, পারে না।
ইস্হাক : জীবন যৌবন বহতা নদীর মত। কত তৃষ্ণার্ত আকণ্ঠ পান করে যাবে, তবু ঝুটা হবে না। কিন্তু জীবন যৌবন ছাড়া আর সব কিছু উচ্ছিষ্ট হয়ে যায়। যা বহতা নয়, তা-ই উচ্ছিষ্ট।
হারুন : কবি আবু ইস্হাক, তুমি শুধু বাদক নও, সত্যিকার কবি–বিরাট কবি। মশ্রুর, ইস্হাককে আরো পাঁচ হাজার আশরফী সওগাত দিলাম। কাল বন্দোবস্ত করো।
মশ্রুর : আস্সামায়ো তায়তান।
ইস্হাক : আমিরুল মুমেনীন, আপনি বান্দা-নওয়াজ তা জানি, কিন্তু গরীবের উপর এত মেহেরবান হবেন না।
হারুন : আবু ইস্হাক, তোমার মর্যাদা হারুনর রশীদের খাজাঞ্চীখানা দিতে পারে না। তা জানি, তবু–
ইস্হাক : জাঁহাপনা, শুকরিয়া—হাজার–লাখ শুকরিয়া।
হারুন : মশ্রুর!
মশ্রুর : আমিরুল মুমেনীন।
হারুন : আজকের নৈশ অভিযান এখানে শেষ হোক। আমার ঘুম পাচ্ছে। কাল তুমি শহর কোতোয়ালকে বলে রাখবে, আমার দশ-পনর জন কোতোয়াল দরকার হবে।
মশ্রুর : যো হুকুম, আলম্পানা।
হারুন : হ্যাঁ, কাল আবার আমাদের এখানে দেখা হচ্ছে। মজ্লিশ ভাঙার আগে, আবু ইস্হাক, তোমার রুবাবে আবার আনন্দের মওজ তোলো।
[রুবাব বেজে চলে]
কাওসুল আকদারের বাগ-বাগিচায় সুরের হিল্লোল।
বগ্দাদের সড়কে অবাধ রাত্রি।
গোলাম-বস্তি নিঝুম।
০৭. গোলাম-বস্তী
পরদিন রাত্রি।
গোলাম-বস্তী নিঝঝুম।
তারা দু’জনে ঘুমিয়ে ছিল, মৃত্যু-রূপা ঘুম–একে অপরের অঙ্গের পাকে পাকে একাকার।
হঠাৎ দরজায় করাঘাতের শব্দ হলো। প্রথমে ধীরে, মৃদু শব্দ। তারপর জোরে, দ্রুত।
–তাতারী, শুনছো?
–কে… কি …
মেহেরজান : শুনছো?
তাতারী : কি মেহেরজান?
মেহেরজান : দুয়ারে কে ঘা দিচ্ছে।
তাতারী : আমার ঘোড়াটা হয়ত দড়ি ছিঁড়ে আমার খোঁজে এসেছে।
মেহেরজান : না, না–এ তোমার পেয়ারা ঘোড়া নয়। মানুষ।
তাতারী : শুয়ে থাকো, কোন সাড়া দিও না।
মেহেরজান : আরো জোরে ঘা দিচ্ছে, দরজা ভেঙে পড়বে। আমি হলফ করে বলতে পারি ঘোড়া নয়। তুমি সাড়া দাও।
তাতারী : কে?
নেপথ্যে : দরজা খোল।
তাতারী : কেন?
নেপথ্যে : দরকার আছে।
তাতারী : কে?
নেপথ্যে : এই গোলাম, দরজা খোল। নচেৎ লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলব।
তাতারী : কে আপনি, জনাব?
নেপথ্যে : আমি মশ্রুর।
তাতারী : জাঁহাপনা, এখনই খুলছি। (ফিসফিস্ কণ্ঠে) মেহেরজান, সর্বনাশ! তুমি তাড়াতাড়ি বোরখা পরে নাও।
মেহেরজান : (ফিসফিস্ শব্দে) তাতারী, আল্লা যেন সহায়, নেঘাবান হন। কোথাও লুকানোর জায়গা নেই?
তাতারী : এই ছোট খুপরী, লুকাবে কোথায়?
মেহেরজান : তবে আল্লা যা নসীবে রেখেছেন, আমি বোরখা পরে নিই, তুমি দরজা খুলে দাও।
নেপথ্যে : এই জলদি কর, দরজা খোল্।
তাতারী : দিচ্ছি জনাব। বোরখা পরেছ?
মেহেরজান : পরেছি।
তাতারী : আসুন, জনাব। (নতজানু) আহ্লান ওয়া সাহলা ইয়া মওলানা। এ কি! স্বয়ং আমিরুল মুমেনীন। লা-হাওলা ওলা কুয়াতা, আলম্পানা, বান্দার গোস্তাখি মাফ করবেন। এই শির কালাম। গোস্তাখির জন্য আমার কঠোর সাজা দিন, জাঁহাপনা।
হারুন : তুই ঘরের প্রদীপ জ্বালিয়েছিস, আরো আলো–আরো রোশনাই চাই।
তাতারী : জাঁহাপনা গরীবের আর তো কিছু নেই। তবে পাশের প্রতিবেশীর কাছ থেকে চেয়ে আনি।
হারুন : মশ্রুর, কোতোয়ালদের একটা আলো আনতে বলো, শিগগির।
মশ্রুর : যে হুকুম, জাঁহাপনা।
তাতারী : আলম্পানা, গোস্তাখি মাফ করবেন বান্দার সওয়ালে। এই সুসাম রাত্রে আপনার পয়জার এই গোলামদের বস্তীতে জিল্লুল্লাহর আবির্ভাব? কিছু বুঝতে পারছি নে।
হারুন : আবু ইস্হাক।
ইস্হাক : জাঁহাপনা।
হারুন : আমার বদলে তুমি জবাব দাও।
ইস্হাক : এই গোলাম, জাঁহাপনা তোর হাসি শুনে খুব সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাই তোর জন্যে ইনাম নিয়ে এসেছেন।
তাতারী : ইনাম?
ইস্হাক : হ্যাঁ, ইনাম।
তাতারী : কিন্তু জাঁহাপনা, বান্দার কোন গুণ নেই, আর বান্দা এমন কোন কাজ করে নি, যার জন্যে সে ইনাম প্রত্যাশী হতে পারে।
ইস্হাক : গোলাম, তোর হাসি বড় মধুর। তাই আমিরুল মুমেনীন সেই হাসির রেশ ধরে এখানে এসে পৌঁছেছেন।
তাতারী : জনাব, বান্দাকে আর গোনাগার করবেন না। গোলাম, তার আবার হাসি!
হারুন : না, সত্যি। ইস্হাক আমার কথাই বলছে। আমি সেই জন্যেই এসেছি।
তাতারী : আমিরুল মুমেনীন, আল্লা আপনার শান শওকত আরো বৃদ্ধি করুন, আপনার দবদবা দিকেদিকে ছড়িয়ে পড়ুক। আপনি দুনিয়ার আমীর হন। গরীবের এই জুপড়িতে কি করে যে আপনারে জায়গা দিই।
মশ্রুর : চুপ কর, গোলাম।
হারুন : এই যে কোতোয়ালের আলো এনেছে। এখন চারিদিক বেশ চোখে পড়ে। এই গোলাম, ওটা কী?
তাতারী : কি জাঁহাপনা?
হারুন : ওই যে দেওয়ালের সাথে কালো বোরখা লেগে রয়েছে।
তাতারী : জাঁহাপনা–
হারুন : কি?
তাতারী : জাঁহাপনা–
মশ্রুর : জবাব দে, নফর।
তাতারী : জাঁহাপনা, বান্দাকে কতl করুন। বান্দা এই জবাব দিতে অক্ষম।
হারুন : জবাব দে, নচেৎ–
তাতারী : জাঁহাপনা।
হারুন : মশ্রুর, এই বান্দরের জিভ ছিঁড়ে নাও, এখনও জবাব দিচ্ছে না।
মশ্রুর : আবু ইস্হাক, দ্যাখো দ্যাখো, গোলামটা ধুলোয় লুটিয়ে কাঁদছে, তবু জবাব দিচ্ছে না।
ইস্হাক : আমি দেখি, মশ্রুর। এই, আমিরুল মুমেনীনের সওয়ালের জবাব দে।
হারুন : মশ্রুর, যা ভেবেছিলাম তা নয়, না-ফরমান গোলাম। একে কতল করো এক্ষনি।
মেহেরজান : (বোরখা খুলিতে খুলিতে) না, না আমিরুল মুমেনীন। দেওয়ালের গায়ে শুধু বোরখা নেই, আমি আছি তার ভেতরে। ওকে মাফ করুন।
হারুন : আবু ইস্হাক, মশ্রুর দ্যাখো। বোরখার অন্ধকার ছিঁড়ে এই মাহতাব (চাঁদ) কোথা থেকে উদয় হোলো? থামো মশ্রুর। জবাব পাওয়া গেছে। এই, তুই কে?
মেহেরজান : (নতজানু) জাঁহাপনা, মজ্কুর জানানা আপনার বাঁদী।
হারুন : বাঁদী।
মেহেরজান : হা, জাঁহাপনা।
হারুন : কোন্ দেশী বাঁদী এমন?
মেহেরজান : আরমেনী বাঁদী, আমিরুল মুমেনীন।
হারুন : এই গোলাম, উঠে দাঁড়া। একটা জবাব দিবি, তবু এত ভয়। এ তোর কে?
তাতারী : আমার বিবি আলম্পানা।
হারুন : তোর বিবি?
তাতারী : হ্যাঁ, জাঁহাপনা।
হারুন: তুই শাদী করেছিস্, অথচ খবর দিস্ নি? গোলামের আস্পর্ধা বড় বেড়ে গেছে। আলেপ্পো শহরে কতকগুলো গোলামের তাই মাথা থেঁৎলে দিতে হোলো।
তাতারী : জাঁহাপনা, গোস্তাখি মাফ করবেন। আপনার পায়ের খাক্ এই গোলাম। তার আবার শাদী। তার আবার দাওয়াৎ।
হারুন : তোর কি জানা নেই, আপন মাওলার (প্রভু) হুকুম ছাড়া কোন গোলাম শাদী করতে পারে না বা নিজের বেটির শাদী দিতে পারে না?
তাতারী : জানি, জাঁহাপনা।
হারুন : তবে—
তাতারী : তার সাজা নিতে আমি প্রস্তুত আছি। অবাধ্য, নাফরমান বান্দার যা’ শাস্তি হয়, তাই আমার প্রাপ্য।
হারুন : হ্যাঁ, তোর গর্দান যাওয়াই উচিৎ। এই বাঁদী, তুই কোথা থাকিস্?
মেহেরজান : আপনার মহলের বাঁদী, জাঁহাপনা।
হারুন : আমার মহলের বাঁদী শাদী করেছে গোলাম, অথচ আমাকে কেউ জানায় নি। তাজ্জব ব্যাপার। তোকে কোনদিন দেখি নি?
মেহেরজান : না, আলম্পানা।
হারুন : অমন নতজানু করজোড়ে তোর থাকার দরকার নেই। উঠে দাঁড়া।
মেহেরজান : জাঁহাপনা। বান্দীকে আর গোনাগার করবেন না।
হারুন : আমি যা বলি, তা শোন্। এখানে মশ্রুর খাড়া আছে তা ভুলে যাস্ নি। উঠে দাঁড়া।
মশ্রুর : জাঁহাপনা–
হারুন : গোলাম, তোর আস্পর্ধা আসমান ছাড়িয়ে গেছে। কুকুরের মত তোদের জিভ ছিঁড়ে নিলে তবে গায়ের ঝাল মেটে।
তাতারী : জাঁহাপনা, বান্দা গোনাগার। আপনার যা মরজী, তা-ই করুন। বান্দার কোন দুঃখ নেই।
হারুন : আবু ইস্হাক, এ গোলাম ত চমৎকার কথা বলে। ঠিক তোমার মত।
ইস্হাক : হ্যাঁ, আলম্পানা। যারা ভাল কথা বলতে পারে, তারা ভাল হাসতে-ও পারে।
হারুন : কেন, আবু ইস্হাক?
ইস্হাক : আলম্পানা, সাধারণ কথা নয়, ভাল কথার মূল কি? ভাল কথা হচ্ছে রুহের (আত্মার) প্রতিধ্বনি–সেখানেই জমে থাকে, তারপর ঝর্নার মত বেরোয়। অনাবিল হাসি হচ্ছে ভাল কথারই শারীরিক রূপ। তাই জিল্লুল্লাহ, যারা ভাল কথা বল্তে পারে, তারা ভাল হাসতেও পারে। হাসি আর কথার মূল উৎস এক জায়গায়।
হারুন : ও আবু ইস্হাক, তুমি ফল্সাফা-দর্শন শুরু করে দিলে। এত বোঝার মত ধৈর্য এখন আমার নেই। এই বাঁদী–তোর কিছু বলার আছে?
তাতারী : না, জাঁহাপনা। গোনাগার, নাফরমান–আমাদের কতল করুন।
হারুন : মশ্রুর, তৈরি হও। আমার ফরমান মোতাবেক এদের শাস্তি দেবে। এক চুল না এদিক-ওদিক হয়।
মশ্রুর : যো হুকুম আলম্পানা।
হারুন : হাজেরান (সমবেত), মজ্লিস–মশ্রুর, কবি আবু ইস্হাক এবং কোতোয়ালগণ, এই দুই বান্দা এবং বান্দী কানুনের খেলাপ যে কাজ করেছে, তার জন্য এদের শাস্তি কী? তলওয়ারে গর্দান গ্রহণ করা যায়, অঙ্গচ্ছেদ করা চলে, একদিকের পাঁজর নামিয়ে নেওয়া চলে। কিন্তু তলওয়ারের আরো শক্তি আছে। তলওয়ারে লোহার জিঞ্জির ছিন্ন করতে পারে। আমি এই মজলিসে ঘোষণা করছি–আজ থেকে এই দুই বান্দা-বান্দীর গোলামীর জিঞ্জির ছিন্ন হোক। এ দুই জনে মুক্ত–আজাদ, আমার রাজত্বের দুই জন স্বাধীন নাগরিক।
[সকলে : মারহাবা। মারহাবা।]
তাতারী : হে আমিরুল মুমেনীন, আপনার মেহেরবানী সীমাহীন, আপনার হৃদয় বিশাল, আমরা উভয়ে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। হে জিল্লুল্লাহ, আপনার দুই বাহুতে আরো শক্তি সঞ্চিত হোক যেন সিকান্দার শা’র মত আপনি পৃথিবীর অধীশ্বর হন। আমিরুল মুমেনীন জিন্দাবাদ।
[সকলে : মারহাবা। মারহাবা।]
হারুন : আমি আরো ঘোষণা করছি, এই মুহূর্ত থেকে হাব্সী তাতারী–কয়েক মুহূর্ত আগে যে গোলাম ছিল, বগ্দাদ শহরে পশ্চিমে আমার যে বাগিচা আছে সেই বাগিচা এবং তার যাবতীয় গোলাম বান্দী, মালমাত্তা, আসবাব সব কিছুর সে মালিক। তার সমস্ত লেবাস ও দিনগুজরানের খরচ আজ থেকে খাজাঞ্চীখানা বহন করবে।
[সকলে : মারহাবা। মারহাবা।]
তাতারী : জাঁহাপনা, আপনার করুণার ঋণ আমরা কোনদিন শোধ দিতে পারব না।
হারুন : যাও, কোতোয়াল–এখন-ই হাব্সী তাতারীকে আমার বাগিচায় নিয়ে যাও। লেবাস সেখানে প্রচুর আছে। এই বেশে যেন কোনদিন ওকে আমি না দেখি।
[সকলে : সোবহান আল্লা, সোবহান আল্লা।]
হারুন : একটু সবুর করো, কোতোয়াল। তোমাদের হাসির জন্য আমি এই ইনাম দিলাম। দাঁড়াও দুইজনে। আর একবার সেই হাসি হাসো।
তাতারী : জাঁহাপনা, বান্দাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তার বোঝায় বান্দার ঘাড় ক্লান্ত। আজ হাসি আসতে পারে না, জাঁহাপনা।
হারুন : বেশ। কিন্তু মনে রেখো, হাসি তোমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। এই হাসিই আমি শুনতে চাই। হ্যাঁ, আমি শুনতে চাই। আমার বুক যখন ভারাক্রান্ত থাকবে, তখনই তোমার হাসি আমি কামনা করব। যাও, এখন নাই-বা হাসলে। কোতোয়াল, একে নিয়ে যা। বাঁদী, তুমি মহলে ফিরে যাও।
ইস্হাক : জাঁহাপনা, গোলাম ত চলে গেল। এখন আবু ইসহাকের কথা শুনুন। এই আরমেনী বাঁদী, তৌবা–এই আরমেনী আওরতের জন্য কি ইনাম দিবেন? কান শোনার জন্য পাগল।
হারুন : সে আরো বড় ইনাম। চলো মেহেরজান। আমাদের সঙ্গে চলো। তুমি বেগম জুবায়দার কাছে ফিরে যাও। তবে তুমি আর বাঁদী নও।
মেহেরজান : জাঁহাপনা, আপনি অশেষ মেহেরবান। আপনার মরজীই আমার মরজী।
হারুন : মেহেরজান, তুমিও এত মিষ্টি কথা বলতে পারো। আজব দুনিয়া। রাত্রি প্রায় শেষ। চলো মশ্রুর। আবু ইস্হাক, তোমার গজল-শোনা রাত্রি আবার আসবে। নিরাশ হয়ো না, কবি।
ইস্হাক : আলম্পানা, আবু ইস্হাক আশা মানে না–নিরাশা জানে না। আবু ইস্হাক বিশ্বের মুসাফির। সে যা দেখে, তারই গান করে। চলুন, জাঁহাপনা।…
০৮. অন্দর মহল
অন্দর মহল। আবু ইস্হাক ও হারুনর রশীদ।
–আবু ইস্হাক।
–জাঁহাপনা।
হারুন : হাব্সী গোলামের খবর জানো?
ইস্হাক : না, আমিরুল মুমেনীন।
হারুন : আমিও তিন দিন খোঁজ নিতে পারি নি, তাই বাগিচার মোহাফেজকে ডাকতে পাঠিয়েছি।
ইস্হাক : মোহাফেজ ডাকার দরকার নেই, আলম্পানা। গোলাম যা পেয়েছে, তার তুলনা নেই। এই বদান্যতা শুধু জিলুল্লাহ খলিফা হারুনর রশীদ-বিন্-মেহ্দীর পক্ষেই সম্ভব।
হারুন : তবু খোঁজ নিতে হয়। কারণ ওর হাসি শোনার প্রয়োজন আমার আছে। ঐ ত মশ্রুর মোহফেজ-কে নিয়ে হাজির। আহ্ আর কুর্ণিশের প্রয়োজন নেই। এসো, মশ্রুর।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, মোহাফেজ হাজির।
হারুন : মোহাফেজ, হাব্সী তাতারীর কোন তক্লীফ হচ্ছে না ত?
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, আপনার নেমক খেয়ে বহুদিন এই বাগিচার মোহাফেজ-পদে নিযুক্ত আছি। বহু কাহিনী শুনেছি। কিন্তু এমন কাহিনী কখনও শুনি নি, জাঁহাপনা। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে যে ভিক্ষুক ছিল, তৃতীয় প্রহরে সে আমীর। এ শুধু বগ্দাদেই সম্ভব।
হারুন : গোলাম লেবাস পরেছে ত?
মোহাফেজ : আমিরুল মুমেনীন, কালো চেরা, লেবাস পরার পর ওকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে।
হারুন : বহুৎ আচ্ছা। ওর কোন কষ্ট হচ্ছে না ত?
মোহাফেজ : আলম্পানা, যেটুকু তলফি, সে-শুধু অনভ্যাসের কষ্ট। বিছানা, গালিচা, গোলাম, বাঁদী, মুজরানী–এর মধ্যে হঠাৎ একটু অস্বোয়াস্তি বোধ করা কী বিচিত্র?
হারুন : কোন অস্বোয়াস্তি দেখলে নাকি?
মোহাফেজ : হ্যাঁ জনাব। এই গোলাম কাউকে হুকুম দেয় না।
হারুন : রপ্ত হোক, তখন দেবে।
মোহাফেজ : নিচে গালিচার উপর শুয়ে থাকে।
হারুন : ও-সব ঠিক হয়ে যাবে। আহেস্তা-আহেস্তা।
মোহাফেজ : আমিরুল মুমেনীন, মুজরানীরা ত বিরক্ত হয়ে গেছে।
হারুন : কেন?
মোহাফেজ : ওরা বলে, এখানে বেকার হয়ে যাচ্ছি। আজ তিনদিন খানাপিনা নাচ-গান কিছু-ই হচ্ছে না।
হারুন : হচ্ছে না?
মোহাফেজ : না, জাঁহাপনা, হবে কি করে? আমি একদিন পাঁচজন মুজ্রানীকে জনাব তাতারীর কাছে পাঠালাম। সবাই নওজওয়ান। সকলকে ফেরৎ পাঠালে। বললে, যাও।
হারুন : আচ্ছা–।
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, তা ছাড়া আপনি এত কিছু দিয়েছেন অন্য মানুষ হলে আনন্দে পাগল হয়ে যেত। এর সে-সব কিছু নেই। সব সময় গম্ভীর।
হারুন : সব সময়?
মোহাফেজ : হ্যাঁ, জাঁহাপনা। বাবুর্চিখানা ঠিক রাখে। একবার খেতে যায় মাত্র।
হারুন : একবার?
মোহফেজ : হ্যাঁ, আলম্পানা। রাতে কিছু খায় না। অলিন্দে বসে আকাশের তারা দেখে আর চুপচাপ বসে থাকে।
হারুন : কোন গোলাম বেয়াদবি করছে না ত ওর সঙ্গে?
মোহাফেজ : না, জাঁহাপনা। আপনার হুকুম–কোন্ শয়তানের বাচ্চা বরখেলাপ করবে?
হারুন : এই গোলাম হাসে না?
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, জোরে হাসি ত দূরের কথা–গোস্তাখি মাফ করবেন, আমরা কেউ ওর দাঁতই দেখলাম না।
হারুন : হাসে না?
মোহাফেজ : না, জিল্লুল্লাহ্।
হারুন : হাসে না?
মোহাফেজ : না, জিলুল্লাহ্।
হারুন : হাসে না?
মোহাফেজ : না, জাঁহাপনা।
হারুন : একবার-ও না?
মোহাফেজ : না, জাঁহাপনা। আমি ‘গীবৎ’ পরনিন্দা করছি না। আপনি এই দোষে আমার গর্দান নিতে পারেন।
হারুন : আশ্চর্য। যাও, মোহাফেজ। তুমি খুব তরীবতের সঙ্গে ওকে রাখবে। যদি কোন ত্রুটি কানে আসে, আমি সমস্ত গোলামদের সঙ্গে তোমাকেও কতল করব।
মোহাফেজ : আস্সামায়ো তায়তান। আসোলামো আলায়কুম ইয়া আমিরুল মুমেনীন।
হারুন: মশ্রুর, মোহাফেজ যা বলে গেল, তোমার বিশ্বাস হয়?
মশ্রুর : বিশ্বাস হয় না, তবু বিশ্বাস করতে হয়, কারণ মোহাফেজ সাহেব ঈমানদার কর্মচারী।
হারুন : আবু ইস্হাক, তোমার বিশ্বাস হয়?
ইস্হাক : হয়, জাঁহাপনা!
হারুন : কেন?
ইস্হাক : হেকিমী দাওয়াই তৈরি করতে অনেক রকম উপাদান প্রয়োজন হয়। তেমনি হাসির জন্য বহু অনুপান দরকার। হাসি একটা জিনিস। কিন্তু হাসি তৈরি হয় নানা জিনিস দিয়ে; খাওয়া লাগে, পরা লাগে, আরাম লাগে, শিক্ষা লাগে, আরো বহু কিছু।
হারুন : নানা চিজ?
ইস্হাক : হ্যাঁ, খলিফ নামাদার। তার একটা উপাদানের যদি অভাব ঘটে, আর হাসি তৈরী হবে না। ধরুন, সব আছে–নিরাপত্তা নেই। হাসি তৈরি হবে না।
হারুন : হবে না?
ইস্হাক : না, জাঁহাপনা। আমার মনে হয়, অনেক উপাদান হয়ত আছে, কিন্তু কোন একটা উপাদানের অভাব ঘটেছে।
হারুন : তোমার কি ধারণা?
ইস্হাক : বেয়াদবি মাফ করবেন ত, জাঁহাপনা?
হারুন : বেয়াদবি? এই কামরায় আমি আমিরুল মুমেনীন নই, তোমাদের বন্ধু। বেয়াদবির কোন প্রশ্ন ওঠে না।
ইস্হাক : মেহেরজান কোথায়, আলম্পানা?
হারুন : সে আর কারো ‘জানে’ মেহের (করুণা) ঢালতে গেছে।
ইস্হাক : তা ত উচিত নয়। মেহেরজান বিবাহিত স্ত্রী। আর কারো জন্যে সে হারাম।
হারুন : তোমার মতে হারাম। কিন্তু আরো-কারো মতে হারাম নয়।
ইস্হাক : হারাম নয়?
হারুন : না।
ইস্হাক : এমন ফতোয়া কেউ দিতে পারে?
হারুন : আলেম পারে। এই দ্যাখো, আলেম আবদুল কুদুসের ফতোয়া। তিনি লিখছেন, মেহেরজান কেনা বাঁদী। মালিকের হুকুম ছাড়া তার কোন শাদী হতে পারে না। যদি হয়, তা না-জায়েজ (শাস্ত্ৰসিদ্ধ নয়)। মজকুর বাঁদী মেহেরজান ও গোলাম হাব্সী তাতারীর শাদী না-জায়েজ। সই দেখেছ?
ইস্হাক : দেখলাম, জাঁহাপনা। কিন্তু জনাব আবদুল কুদুস এই ফতোয়া দিলেন?
হারুন : দেবেন না কেন?
ইস্হাক : জাঁহাপনা, শাস্ত্রকে চোখ ঠারা যায়, কিন্তু বিবেককে চোখ ঠারা অত সহজ নয়।
হারুন : তুমি কি বলতে চাও?
ইস্হাক : আবদুল কুদ্দুস আল্লার কালাম বিক্রি করেছেন।
হারুন : দুনিয়া ত কেনা-বেচার জায়গা। আর তিনি তোমার মত আহম্মক নন।
ইস্হাক : কেন জাঁহাপনা?
হারুন : এই বগ্দাদ শহরে তিন্ তিনখানা আলীশান্ মাকান, ইমারৎ, বাগ-বাগিচা আর বছর বছর পাঁচ হাজার ‘দীরহাম’ যায় খাজাঞ্চীখানা থেকে। তিনি এসব খোয়াতে যাবেন নাকি তোমার মত আক্কেল দেখাতে গিয়ে? আমি কি দিই, তা-ও তিনি যেমন জানেন, আমি কি চাই তা-ও তিনি তেমন বোঝেন। দোকানদার-খরিদ্দারে এ-রকম সম্পর্ক না থাকলে কি দুনিয়া চলে?
ইস্হাক : কিন্তু, জাঁহাপনা—
হারুন : আহ, ইস্হাক, তুমি বড় বন্ধ্যা হুজ্জতে এগোও। খোওয়াব-চারী কবি, কিছুই বোঝ না। তুমি জানো, দীরহামের মোজেজা (অলৌকিক) শক্তি আছে। দীরহাম অঘটন-ঘটন-পটীয়সী।
ইস্হাক : না, আলম্পানা।
হারুন : দীরহামের তাকং অসম্ভব, অশেষ। তোমাকে বুঝিয়ে বলা যাক। তুমি কালো আঙুর পছন্দ করো, না সবুজ আঙুর?
ইস্হাক : সবুজ আঙুর।
হারুন : বেশ। সবুজ আঙুর না পেলে—
ইস্হাক : কালো আঙুর খাই।
হারুন : ধরো, বাজারে সবুজ আঙুর আছে, কিন্তু দাম খুব চড়া। অত পয়সা তোমার নেই। তখন?
ইস্হাক : তখন কালো আঙুর কিনি।
হারুন : কিন্তু মনে রেখো, তোমার কাছে নয়, শুধু এমনিতেও কালো আঙুর সবুজ আঙুর এক নয়। দুয়ের আস্বাদ আলাদা। কিন্তু তোমার দীরহামের পরিমাপে দুই-ই এক। দীরহামের কত কুওৎ, কত শক্তি বুঝতে পারছে।
ইস্হাক : পাচ্ছি, জাঁহাপনা।
হারুন : খোয়াব নিয়ে থাকো, তুমি সহজে এ-সব বুঝবে না। যাক সে ব্যাপার। কথায় কথায় আমরা অনেক তফাৎ চলে এসেছি। গোলামের হাসি বন্ধ। হয়ে গেছে কেন?
ইস্হাক : জাঁহাপনা, ও হয়ত আর হবেই না।
হারুন : আবু ইস্হাক, তোমার জন্যেই আমার পাগলাগারদ বানাতে হবে। গোলাম আবার হাসবে না? দেখে নিও, দীরহাম কি করতে পারে। মশ্রুর, তুমি সাক্ষী।
ইস্হাক : জাঁহাপনা, যদি উপাদানের অভাব হয়?
হারুন : তোমার ওসব ঝুট দর্শন, ইস্হাক। পরশু আমরা তিনজনে গোলামের হাসি শুনতে যাব, কাল খবর পাঠাব। তোমার দাওয়াৎ রইল, আবু ইস্হাক। মনে থাকে যেন, পরশু আমরা তিনজনে হাব্সী তাতারীর মেহমান।
ইস্হাক : বহুৎ খুব, জাঁহাপনা।
হারুন : মশ্রুর, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ইস্হাক আক্কলের তেজ হারিয়ে ফেলছে।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আমার তলওয়ারের তেজ কিন্তু বাড়ছে।
হারুন : চলো, এখন ওঠা যাক।
মশ্রুর : যো-হুঁকুম, আলম্পানা।
০৯. বাগিচার কক্ষ
কাল রাত্রি। বাগিচার কক্ষ। মোহাফেজ ও তাতারী।
–মোহাফেজ।
–জনাব।
–তুমি জানো চারদিন আগে আমি কি ছিলাম?
–জনাব, তা জানি বৈকি।
–কিন্তু তুমি কি ছিলে, তা জানো না। জানো?
–আপনি কি বলতে চান, জনাব?
–তোমার মত অনেকেই জানে না যে তারা কী। আমি গোলাম ছিলাম, খুব নীচুদরের গোলাম। কিন্তু তুমি-ও গোলাম, আমিরুল মুমেনীনের গোলাম। অবশ্যি উঁচুদরের গোলাম।
–তা সত্যি, জনাব।
–আজ চাকা ঘুরে গেছে। তুমি আমার চেয়ে অনেক নীচুদরের গোলাম। আমারও গোলাম।
–আলবৎ।
–কিন্তু আমি ভুলে যাই নি, আমি গোলাম ছিলাম।
–জনাব, তাতারী। আপনি বড় হক কথা বলেন।
–শোনো, মোহাফেজ। এসো হাতে হাত মেলাও। মনে রেখো, তুমি-ও যা, আমিও তা-ই।
–শুক্রিয়া, জনাব।
–কিন্তু বড় গোলামেরা ছোট গোলামদের মনে রাখে না। ছোট গোলাম বড় গোলাম হলে তার-ও সেই অবস্থা ঘটে। গোলামখানার এ এক মহা দস্তুর।
–আপনার কথা শুনতে বড় মিষ্টি লাগে।
–এখন শোনো, মোহাফেজ। বাইরে আমাদের যে-সম্বন্ধ আছে তা থাক। কিন্তু ভেতরে আমরা পরস্পরের মোহাফেজ–রক্ষক।
–শুকরিয়া, জনাব।
–জেনে রেখো, আমি গোলাম গোলাম-ই আছি।
–না, না, জনাব।
–সত্যি। সত্যি বছি। তুমি কি মনে করো, এই বাঁদী গোলাম মুজরানী ইমার গালিচার মধ্যে খুব ষোয়াস্তিতে আছি?
–কোন তক্লীফ হচ্ছে, বলুন। নচেৎ আমিরুল মুমেনীন আমার গর্দান নিয়ে নেবেন।
–না, তোমার দোষ নয়। আমরা অর্থাৎ গোলামেরা নিজের যোগ্যতা আর মেহনৎ দিয়ে কোন জিনিস অর্জন না করলে, স্বোয়াস্তি পাই না। যোগ্যতা, মেহনতের বাইরে থেকে হঠাৎ কিছু যদি আমাদের উপর ঝরে পড়ে, তাতে সুখ কোথায়? মগজ আর তাগদের জোরে কোন জিনিস না পেলে আমরা মজা পাই না। এই বাগাবাগিচা আমার মেহনতের ফল নয়।
–সত্যি হুজুর?
–হ্যাঁ, সত্যি। মনে রেখো, যোগ্যতা থেকে কোন চিজ না পেলে তা ঢিলে লেবাসের মত বেখাপ্পা-ই দেখায়। আর যোগ্যতা-মেহনৎ ব্যতিরেকে যারা পুরস্কার প্রার্থী–তারাই হচ্ছে দুনিয়ার আসল গোলাম।
–জাঁহাপনা, আপনি উজীর মরহুম জাফর বারমেকীর মত আক্কেলমন্দ কথা বলেন।
–চুপ। জাফরের নাম তোমার মুখে শুনলে খলিফা জিভ ছিঁড়ে ফেলবে।
–হুঁজুর আপনি, তাই বলছি।
–আমাকে জনাব-হুঁজুর সম্বোধনে ডাক দিও না। আমরা বন্ধু।
–আপনি যখন অভয় দিলেন—
–শোনো, তোমাকে আমার একটা খবর দিতে হবে।
–খবর?
–হ্যাঁ, খবর। তুমি কি বগ্দাদের সড়কে, কাফিখানায় ফরসুৎ-মত ঘোরাঘুরি কর না?
–তা করি বৈকি।
–তুমি তাহলে খবর যোগাড় করতে পারত্রে।
–কি খবর বলুন?
–কিন্তু, এ-খবর খোদ আমিরুল মুমেনীনের কাওসুল আকদার প্রাসাদের খবর।
–জনাব, পাথরে, দেওয়ালে খবর আটকা থাকে না। যারা মহলে থাকে, তারাও মানুষ। চোখে দেখলে বা কানে শুলে মুখে না বলে পারে না। চোখের, কানের, মুখের একটা যোগসাজশ আছে।
–আছে?
–আছে বৈকি। বেগম খৈজুরান যে নিজের বড় ছেলে হাদীকে দাসী দিয়ে গলা টিপিয়ে মেরেছিল, তা কি করে জানাজানি হলো? খলিফা হাদী মারা গেলেন, তাই না হারুনর রশীদ খলিফা হলেন!
–তা-ই নাকি?
–আপনি জানেন না? বগ্দাদের সবাই জানে, আর আপনি জানেন না? যাকে জিজ্ঞেস করেন, সে-ই ঐ জবাব দেবে, কিছু জানে না। বড় মজার ব্যাপার।
–শোনো মোহাফেজ, যদিও মহলের খবর, কিন্তু খবর একটা তুচ্ছ ব্যক্তির।
–কে সে?
–বলছি। তুচ্ছ ব্যক্তি সে। বেগম জুবায়দার খাস-বাঁদী মেহেরজান। তারই খবর চাই।
–শাহী সড়কের এক কাফিখানায় আমি কাল সন্ধ্যায় বসেছিলাম। সেখানে খবর শুনলাম।
–কি খবর।
–আমার ত তেমন শোনার গা ছিল না। একজন আর একজনকে বলছে, মহলে নাকি এক রূপের তুফান এসেছে–এক আরমেনী বাঁদী। খলিফা নাকি তাকে শাদীও করতে পারে।
–আর কি শুনলে?
–হুঁজুর, আমার কান তো বেশি ওদিকে যায় না, বয়স পঞ্চাশের উপর। জওয়ান হলে এসব রসালো কথার দিকে মন যায়। কানও যায়।
–আজ তুমি বেড়াতে বেরিয়ে দ্যাখো যদি কোন খবর আনতে পারো।
–আচ্ছা, জনাব।
–আবার জনাব কেন? এসো, হাতে হাত মেলাও।
১০. বগদাদের সড়কে রাত্রি
বগ্দাদের সড়কে রাত্রি।
শহরের উপকণ্ঠে নির্জনতার রাজগী অনেক আগে শুরু হয়েছে। কিন্তু সরাইখানার আলো তখনও নেভে নি। আনন্দ-তালাসী পথিকজনের আনাগোনা কৃচিৎ কানে আসে।
আবছা অন্ধকারে দুই ব্যক্তি হাটছিল। হঠাৎ একজন হেসে উঠল। অপর ব্যক্তি আর চুপ থাকতে পারে না। সেও সঙ্গীর পথ অনুসরণ করে।
–আবু নওয়াস।
–কি আবুল আতাহিয়া।
আতাহিয়া : তুমি হাসছো?
নওয়াস : হ্যাঁ, হাসছি।
আতাহিয়া : অবিশ্যি তোমার কবিতা পড়ে মনে হয়, তুমি সত্যি মনে মনে হাসতে পারো। আমাকে দিয়ে তা হয় না।
নওয়াস : তা আমি জানি, তুমি দুনিয়ায় শুধু কেয়ামৎ দ্যাখো।
আতাহিয়া : আর তুমি?
নওয়াস : বেহেশত। এই দুনিয়াই আমার বেহেশত।
আতাহিয়া : শরাব আর সাকী থাকতে, তোমাকে আর আল্লা হেদায়েৎ করবেন না।
নওয়াস : তোমাকে শয়তান পথ দেখায়।
আতাহিয়া : কেন?
নওয়াস : শয়তানের পথ মৃত্যুর পথ। জীবনের সড়ক আলাদা। তুমি শুধু মৃত্যুর কথাই বলো।
আতাহিয়া : তুমি ত মরুভূমির মধ্যে জীবনকে খুঁজেছে।
নওয়াস : মোটেই না। আমার সেই কবিতা পড়ো নি, আতাহিয়া?
আতাহিয়া : কোন্ কবিতা নওয়াস?
নওয়াস : বলছি, শোন।
বেদুইনদের মাঝখানে বৃথা কর আনন্দ-সন্ধান।
কিবা ভোগ করে তারা, যারা ক্ষুধা-তৃষ্ণাতুর লোক?
থাক ওরা ওইখানে, বসে খুব উষ্ট্রদুগ্ধ খাক;
যারা কভু শেখেনিক সূক্ষ্ম প্রাণ-উপভোগ।
আতাহিয়া : একে বুঝি বলে মরুভূমিতে জীবন-সন্ধান?
নওয়াস : তুমি আজকাল আর্বী ভুলে যাচ্ছ, আতাহিয়া। না, আমার কবিতা বুঝতে তোমার কষ্ট হয়?
আতাহিয়া : তার চেয়ে বলো না কেন আমি আমার ওয়ালেদের (বাপ) নাম ভুলে যাচ্ছি।
নওয়াস : তবে ভুল তুমি করো। বুদ্ধি আর বোধি–আক্কেল আর উপভোগ, দুই-ই জীবনে দরকার। কারণ, ইন্দ্রিয়ের পথ আবার বোধির-ও পথ। যে-মুহূর্তে। তুমি একটা বন্ধ করবে, অন্যটা-ও থেমে যাবে। তখন তুমি আর গোটা ইনসান–পূর্ণ মানব নও।
সাকী, পানপাত্র ভরে দাও মদিরা ধারায়
অন্ধকারে কেন? এসো আলোর সভায়।।
বিনা পানে নিরানন্দ ও অভিশপ্ত ক্ষণ।
মাতালের মত টলি–সেই ত অমূল্য জীবন।।
আর আতাহিয়া, সেই জায়গায় তুমি কি লিখছো?
‘জাম’ ঘিরে বসিয়াছে যত্রর্সব মওজী ইনসান,
দুনিয়ার হাত থেকে করে তারা মৃত্যু-মদ্য পান।।
ছোঃ–এটা কি কবির কথা?
আতাহিয়া : শোন, নওয়াস। কবিতা তোমার চেয়ে খারাপ না লিখলেও কথায় পারব না।
নওয়াস : ও কথা ছাড়ো। তুমি মেহদীর বাঁদী উবা-র প্রেমে পড়েছিলে?
আতাহিয়া : পড়েছিলাম।
নওয়াস : কেন?
আতাহিয়া : তা জানি নে।
নওয়াস : তখন তুমি জীবনকে খুঁজেছিলে। প্রেমের পথ, ডোগের পথ, উপভোগের পথ, জীবনের পথ, সব এক জায়গায় বহু সর্পমিথুনের জড়াজড়ির মত। ওকে আলাদা করতে যেয়ো না, বন্ধু।
আতাহিয়া : আজ অনেক খামর (শরাব) টেনেছে মনে হচ্ছে।
নওয়াস : তা ত বটেই। শোনো, তোমাতে আমাতে তফাৎ কি জানো?
আতাহিয়া : কি তফাৎ?
নওয়াস : আমি আঙুর ফল খাই। আর তুমি? তুমি দ্রাক্ষালতা চিবোও। আর মনে মনে বলো, আঙুর যখন এমন মিষ্টি, দেখা যাক ওর আসল মাদ্দা বা উৎসটা কেমন? একটু চিবোই।
আতাহিয়া : নওয়াস, তুমি আজ বিলকুল শরাবী।
নওয়াস : আতাহিয়া, একটা গল্প শোনো।
আতাহিয়া : বলো।
নওয়াস : তখন আমি কুফা শহরে। এক বাঁদীর আশনায়ের জালে ধরা পড়ে গেলাম।
আতাহিয়া : তোমার মত পাকা মৎস্য?
নওয়াস : : কথায় বাধা দিও না। প্রেমে আর খাদে বেশি তফাৎ নেই, পড়ে গেলাম। সব কথা তোমার শুনে দরকার নেই। যা অনেক ঘোরাফেরা কান্নাকাটি আরজী মিনতি অগয়রহের পর আমার মহবুবা (দয়িত) ওলিদা-কে পেলাম। শোনো, ওর সদরিয়া (জামা বিশেষ) খুলে আমি ত বেহুঁশ হওয়ার উপক্রম। এমন সুগঠিত তীক্ষ্ণ বোটা স্তন আমি, খোদার কসম আর জীবনে দেখি নি। ছেলেরা কেতাব পড়ে তিনকা দিয়ে অক্ষরের কাতার ঠিক রাখার জন্যে। এ ঠিক সেই তিনকার মত। ভাবলাম, এটা হাতে থাকলে আমি আর জীবনে কাতারভ্রষ্ট হব না অর্থাৎ গোনার পথে অসৎ পথে পড়ব না। আল্লার মেহেরবানী, এমন তিনকা জুটিয়ে দিয়েছেন, জীবনের কেতাব পড়তে আমার আর ভুল হবে না। আরো শোনো। সেই অবস্থায় আমি কোথায় তিনকা হাতে গ্রহণ করব, তা না, আমার মাথা ঝুঁকে গেল। আমি সীনার ঠিক নীচে নরম ত্বকের উপর ঠোঁট রাখলাম। লোকে পা চুমে, কদম-বুসী করে, আমি করে বসলাম স্তন-বুসী, সীনা-বুসী,–যা বলো।
আতাহিয়া : হাহ্ হা, আবু নওয়াস। মরহাবা! ইয়া আবু নওয়াস। আহলান সাহলান, ইয়া নওয়াস। মাইয়োকেলা আজিহিল কালাম ইল্লা আবু নওয়াস–আবু নওয়াস ছাড়া কে আর এমন কথা বলতে পারবে? হাহ্ হা হা হা…।
নওয়াস : আহ্, আমার পিঠে এতো থাপড়াচ্ছো কেন, আতাহিয়া? তোমার হাসি থামাও, নচেৎ এখনই তোমার আঁৎড়ী বেরিয়ে পড়বে। আর এতে হেসো না, এখনই আমিরুল মুমেনীন তা কিনে নেবেন।
আতাহিয়া : আহ, আবু নওয়াস। আর একটু হেসে নিতে দাও। পেটে কুলুপ লেগে গেল।… আমিরুল মুমেনীন আজকাল হাসির সওদাগরি করেন না কি?
নওয়াস : তুমি জানো না?
আতাহিয়া : না।
নওয়াস : হাসির অনেক দাম। লাখ দীরহামের-ও বেশি।
আতাহিয়া : সত্যি?
নওয়াস : কাল তিনি তোমাকে আমার মারফৎ দাওয়া দিয়েছেন। গোলামের হাসি শুনতে যাবো। আবু ইস্হাক থাকবে। খানাপিনা গান বাজনা সব আছে।
আতাহিয়া : আলহাম্দোলিল্লাহ্।
নওয়াস : চলো, অনেক রাত হয়ে গেছে। সরাইখানা বন্ধ। সড়কে লোজন কম। তার উপর অন্ধকার।
আতাহিয়া : তোমার ভয় কী? তোমার ত তিনকা আছে।
দুই কবি হেসে উঠল জনশূন্য সড়কের উপর। প্রতিধ্বনি দূরে দূরে সহজে অস্তিত্ব হারায় না।
নিদ্রিত মহানগরী বগ্দাদ।
তার দুই কবি শুধু জেগে ছিল।
জীবনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কবিতা কি কখনও বিশ্রাম নিতে পারে?
১১. বেগম জুবায়দা
বেগম জুবায়দা, আপনার পাঁজর কি রিক্ত? নৈশ হাহাশ্বাসের মুখে দজ্লার উপরের দিকে চেয়ে, প্রতীক্ষার দুর্ভেদ্য অরণ্যে পদধ্বনি শুনে কোন লাভ নেই। বক্ষে বক্ষ, সীনা-ব সীনার সাধনা সন্ন্যাসিনী জানে না। তাই তারা কৃচ্ছ্র আর আত্মনিগ্রহের জোয়ালে প্রতারিত যৌবনের আরশীতে বিবেকের প্রতিফলন দেখতে চায়। বিকৃত ইচ্ছা তাদের কাছেই আনন্দের মরীচিকা। গতিহীনতার দুর্গদ্ধ, স্বর্গীয় সৌরভ মনে হয় নাসিকার নিঃসাড় সড়কে। মেহেরজান আপনার কাছে ফিরে আসবে না হৃদয়ে উত্তাপ দিতে। না-ই আসুক। আপনার তৃষ্ণার্ত দুই চোখ আআর সোপান গড়ে তুলুক কল্পনায়। কল্পনা ত মিথ্যা হয়ে যায় না। মহাকাল তাকেই বরণ করে। নির্জনতা-বিহারী মেহেরজান, নাই বা এলো কোলাহলের জোয়ারের মত। বিশাল আকাশ। তাই ত নক্ষত্রেরা নিঃসঙ্গ। আপনার প্রাণের অসীমতায় শুধু দুটি শুকতারা জেগে থাক্।
আদাব, বেগম সাহেবা।
১২. তাতারীর বাগিচা
তাতারীর বাগিচা।
কার্পেট-শোভিত কক্ষ। বিশেষভাবে আজ আলোকসজ্জার পরিপাটী দেখা যায়। চার কোণে চারটি সামাদান জ্বলছে। উপরে ঝাড়বাতি। তাকিয়া, গেদা চারিদিকে সাজানো। কক্ষের দক্ষিণ দিকে সংলগ্ন একটি বারান্দা।
তাতারী কক্ষের ভেতরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার পরিধানে পাজামা পিরহান।
বাগান থেকে ফুলের পোশর এই কামরা পর্যন্ত ধাওয়া করে। তবু মাঝে মাঝে দ্রাক্ষারস সৌরভের কাছে পেছিয়ে যেতে হয়। তিন-চারজন সাকী জাম ও পেয়ালা হাতে প্রতীক্ষমান।
হারুন : তাতারী!
তাতারী : আলম্পানা।
হারুন : ওখানে কেন? আজ আমরা তোমার মেহমান। এই দ্যাখো, কত শরীফ মানুষ এসেছে তোমার বাগিচায়। আবু নওয়াস, আবুল আলাহিয়া, আবু ইস্হাক। এদের যেমন দরবারে তেমনি নিজের মাকানে পাওয়া নসীবের কথা। তুমি ভুলে যাও না কেন তুমি আর গোলাম নও। এসো, এসো।
তাতারী : জাঁহাপনা…
হারুন : খানাপিনা যথেষ্ট হয়েছে। আবু নওয়াস আর মাটিতে পা ফেল্বে না। কি বলো, আতাহিয়া?
আতাহিয়া : জাঁহাপনা, আবু নওয়াস সব সময় মাথায় হাঁটে। ও আর কখনই বা পা ব্যবহার করে?
হারুন : কিন্তু আজ কদম টলটলমান।
আতাহিয়া : জাঁহাপনা, ওর খোয়ারী এসে গেছে। এই নওয়াস!
নওয়াস : জী।
আতাহিয়া : ঘুমোচ্ছ কেন? হাসি শুনবে না?
নওয়াস : আতাহিয়া, তুমি আমার লেজ ছাড়া আর কিছু নও। কিন্তু দুম্বার লেজ বেজায় ভারী।
আতাহিয়া : আমিরুল মুমেনীন, আপনি সাক্ষী থাকুন। নিজের মুখে স্বীকার করেছে, আবু নওয়াস একটা দুম্বা।
নওয়াস : আতাহিয়া, হুজুরের সামনে বেয়াদবি করো না। তুমি তা হলে মেনে নিচ্ছো, তুমি একটা লেজ।
আতাহিয়া : তুমি দুম্বা হলে, আমার লেজ হতে আপত্তি নেই।
নওয়াস : দু……বা… লেজ। দুম্বা লেজ।
আতাহিয়া : আবু নওয়াস, তোমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
হারুন : থামো দুই জনে। তোমাদের কবিদের সঙ্গ মাঝে মাঝে আমাকে ভয়ানক বিরক্ত করে তোলে। খালি কথা আর কথা। তাতারী, এরা এসেছে তোমার হাসি শুনতে। একবার সেই হাসি–বিশ্বজয়ী হাসি–শুনিয়ে দাও ত। এই নওয়াস…
নওয়াস : জাঁহাপনা।
হারুন : চোখ খোলো।
নওয়াস : আস্সামোয়া তায়তান।
হারুন : হ্যাঁ, তাতারী, তোমার হাসি শুনিয়ে দাও। কী…? এখানে লজ্জা পাচ্ছো। ঐ বারান্দায় গিয়েই হাসি শুনিয়ে দাও।
তাতারী : জাঁহাপনা।
হারুন : কী বলো।
তাতারী : হাসতে পারছি না, আমিরুল মুমেনীন।
হারুন : তুমি কি আবু নওয়াসের মত পানিতে ডুবে আছো?
তাতারী : না, জাঁহাপনা। আপনি দেখেছেন, ও পানি আমি স্পর্শ করি না।
হারুন : তবে হাসবে না যে।
তাতারী : আলম্পানা, হাসি আসছে না।
হারুন : আবু ইস্হাক, একে হাসির দাওয়াই দাও।
ইস্হাক : জাঁহাপনা, ও এখনি হাসবে। এ-ই হাসো ত হে।
তাতারী : হাসতে পারছি না, জনাব আবু ইস্হাক।
হারুন : আমি খোদ আমিরুল মুমেনীন হুকুম দিচ্ছি, তুমি হাসো। তোমার হাসি আমরা শুনতে চাই। হাসি শোনার জন্যে এদের ডেকে এনেছি। বেইজ্জৎ হব?
সময়ের ভারের কাছে হিমালয় পরাজয় স্বীকার করে। এখানে মহাজাল স্বয়ং অনড়। সকলের নিঃশ্বাস ভারী। কামরায় সকলে নিস্তব্ধ। সকলের দৃষ্টি একজনের দুই ঠোঁটের উপর নিবদ্ধ। কাল হয়তো এখানেই থেমে থাকত, যদি না হারুনর রশীদ হঠাৎ গর্জে উঠতেন।
হারুন : হাসোর… কি এখনও হাসছো না?
তাতারী : জাঁহাপনা।
হারুন : আমাকে বহু মানুষ জাঁহাপনা বলে, তোমার কাছ থেকে ও ডাক শুনতে চাই না। আমি শুনতে চাই হাসি।
তাতারী : জাঁহাপনা…
হারুন : বুঝেছি। তুমি হাসবে না। তুমি আমাকে বন্ধুদের সামনে বেইজ্জৎ করতে চাও। মশ্রুর…
মশ্রুর : জাঁহাপনা, এই নাফরমান বান্দার গর্দান এখনই দু-টুকরা করি।
আতাহিয়া : জাঁহাপনা…
হারুন : কি আবুল আতাহিয়া, তুমি আবার কি বলতে চাও।
আতাহিয়া : জিল্লুল্লাহ্ এখনই ওর সাজা দেবেন না?
হারুন : কেন?
আতাহিয়া : আলম্পানা, কারণ এত খানাপিনা আর গান-বাজনা আর হাসির পর, একদা-গোলামের হাসি না শুন্লেও চলবে।
হারুন : আতাহিয়া, তুমি চুপ করো। মশ্রুর—
মশ্রুর : জাঁহাপনা—
হারুন : তল্ওয়ার খোলো। দেরী করছ কেন?
নওয়াস : আলম্পানা, আলম্পানা… আমি কবি আপনি জানেন। নাফরমানের গর্দান নেওয়া উচিত। কিন্তু এর অপরাধ কতটুকু বিচার করে দেখা হোক। ও হাসছে না। কিন্তু হাসির জন্য ওয়াক্ত লাগে, যেমন নামাজের জন্য প্রয়োজন হয়।
হারুন : আবু নওয়াস, তোমার কবিত্বের খোমা এখন গাছে ঝুলিয়ে রাখো। ওয়াক্ত লাগে? সময় লাগে?
আতাহিয়া : হাঁ, জাঁহাপনা। সব সময় হাসি আসে না।
নওয়াস : আমি ত আপনাকে, নুরুল্লাহ্ আগেই বলেছি, উপাদান লাগে।
হারুন : আবু নওয়াস, তুমি হুঁশে আছে তা হলে।
নওয়াস : আলম্পানা, হুঁশে থাকার জন্যই আমি বেহুঁশ হই। আল্ খামারো লী কামারান্। সুরা আমার কাছে আকাশের চাঁদ।
হারুন : কি বলতে চাও তুমি, আবু নওয়াস? সাফ্-সাফ্ বলো।
নওয়াস : আস্সামায়ো তায়তান। হুজুর দুনিয়ায় কত দাঙ্গাহাঙ্গামা, খুন-খারাবি, ঝগড়া-কোন্দল, লোভ মোহ মাৎসর্য। এ সব কি দেখা যায় চোখে? বেহুঁশ থাকাই লাভ। আমার ওই হুঁশ আছে বলেই আমি বেহুঁশ থাকতে চাই। আর যাদের সে হুঁশ নেই অর্থাৎ যারা বেহুঁশ–তারা হুঁশে থাকে, আর যারা ইশে থাকে তারা বেহুঁশ। দুনিয়ার তাবৎ লড়াইবাজ দাঙ্গাবাজ ফেরেব্বাজ আওরতবাজ ঘোড়াবাজ মরদ্বাজ নিজেদের ভয়ানক হুশিয়ার মনে করে।
হারুন : নওয়াস, তুমি যে কী বলছ, আমার ও বোঝার সাধ্য নেই। মরদবাজ আবার কি? আরগুলো থোড়াবহুৎ বুঝি।
নওয়াস : আলম্পানা, সেই লুৎ-আলয়হেস্ সালামের জমানায়–
[সকলে : হা-হ্ হা-হ্ হা। হা হ্ হাহ্ হা হ্]
হারুন : আবুল আলাহিয়া, তোমাদের মত কবি এবং বাদক সঙ্গে থাকলে আর খেলাফৎ চলবে না। মশ্রুর, তোমার তলওয়ার নামাও। কিন্তু মনে রেখো, তাতারী তোমাকে যা দিয়েছি, তা আর কেউ পেলে আবার আমার গোলাম হতে চাইত। এত বাগবাগিচা বান্দী গোলাম ধনদৌলত। খবরদার আর নেমকহারামির অপবাদ নিজের মাথায় ঢালবে না। আজ তোমাকে মাফ করলাম। কয়েকদিন পর আবার আসছি, তোমার হাসি আমরা শুনব। মনে রেখো…।
১৩. মজকুর জায়গা পরিচিত বাগিচা
কাল রাত্রি। মজকুর জায়গা পরিচিত বাগিচা। ঘুঙুরের আওয়াজ শোনা গেল। অনেকক্ষণ। হয়ত কয়েক শতাব্দী। কিন্তু এমন ক্ষেত্রে সময়ের পাখনা ছিঁড়ে যায়। শতাব্দী মুহূর্তের মধ্যে গুহায়িত হয়।
ঘুঙুরের আওয়াজ থেমে গেল। তারপর রুম্ঝুম্ রিনিঠিনি রব ওঠে। সে শুধু পা ফেলার অনুষঙ্গ হিসেবে। যে-পায়ে ঘুঙুর এতক্ষণ মুখর ছিল, সেই যুগল চরণ এখন হাঁটার কাজে নিয়োজিত।
রুমঝুম… রুমঝুম…রিনিঠিনি…হঠাৎ সেই শব্দও নির্বাপিত।
তাতারী হঠাৎ চকিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলে, “তুমি কে… তুমি কে? কে তোমাকে এখানে পাঠালে?”
–জনাব তাতারী, বান্দীকে মাফ করবেন। আমার নাম বুসায়না। আমাকে আমিরুল মুমেনীন পাঠিয়েছেন।
তাতারী : তুমি কে?
বুসায়না : আমার নাম বগ্দাদে জানে না, এমন ইন্সান ত কম আছে। আমি রোক্কাসা (নর্তকী) বুসায়না।
তাতারী : কি চাও?
বুসায়না : খলিফার হুকুম, আমি যেন আপনার খেদমৎ করতে পারি।
তাতারী : বুসায়না, খেদমতের জন্যে এখানে বান্দা-বান্দী আছে।
বুসায়না : কিন্তু তারা আপনাকে আনন্দ দিতে পারে না। আপনার মুখের হাসি কে যেন কেড়ে নিয়েছে। আমি এসেছি আপনার মুখে হাসি ফিরিয়ে দিতে।
তাতারী : বুসায়না, তাই কী তোমার এই লেবাস?
বুসায়না : কি দেখলেন, জনাব?
তাতারী : লেবাস দেহ-আবরণের জন্য। তোমার লেবাস দেহ উলঙ্গার্থে। এর সাহায্যে তুমি আমাকে আনন্দ দেবে?
বুসায়না : জনাব, রোক্কাসা আপনাকে জাগিয়ে তুলবে।
তাতারী : তার চেয়ে তুমি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে যাও বুসায়না, তোমার মেহেরবানী কোনদিন ভুলতে পারব না। আমার চোখে ঘুম নেই। ঘুমের ঘোরে থাকি। কিন্তু শিরা-উপশিরা বিশ্রাম নিতে পারে না। কন্টক-মুকুট মাথায় হজরত ঈসা, যীশুখ্রীষ্ট অমর। আমার কণ্টক-শয্যা আমাকে কি দেবে?
বুসায়না : খলিফা সেই জন্যে আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনার কালো ঠোঁট বর্ষার কালো মেঘের মত। ও তে চুম্বনের বিদ্যুৎ-ই শুধু শোভা পায়।
তাতারী : না। সরে যাও, বুসায়না। তুমি আমাকে বেইজ্জং করতে এগিয়ে না।
বুসায়না : বান্দীর গোনা মাফ করবেন, জনাব।
তাতারী : তুমি আমার পাশ থেকে সরে ঐ দিওয়ানে বসো।
বুসায়না : কেন?
তাতারী : তুমি আমাকে আনন্দ দিতে পারকে না।
বুসায়না : সমস্ত বাদ শহরে বুসায়নার পায়ে মাথা লুটিয়ে দিতে প্রস্তুত। আর আপনার মুখে এই কথা?
তাতারী : আনন্দের উপকরণ তোমার কাছে নেই।
বুসায়না : কেন নেই?
তাতারী : মানবীর যৌবনই কি যথেষ্ট? তাহলে জননী-রূপে সে কিরূপে মর্যাদা পায়? ও কি! তোমার সদৃরিয়া খুলে ফেলছ কেন? জানো, জননীর খোলা স্তন বহুদিন আমি পান করেছি। বুঝলাম, তোমার তূণে আদিম কয়েকটা শর আছে মাত্র।
বুসায়না : জনাব, এগিয়ে আসুন। নতজানু এক নারী আপনাকে আহ্বান দিচ্ছে। আমার এই যৌবন–কে আপনি বেইজ্জাৎ করবেন না।
তাতারী : বুসায়না, তুমি ত মোড়-জানু। অঙ্গসন্ধিক্ষণে আনন্দ-আহরণ আমার কাছে অজ্ঞাত কিছু নয়–জন্তুদের কাছেও না। আমি মানুষ। আমার মন প্রয়োজন হয়!
বুসায়না : সে-মন এখন প্রয়োজন নয় কেন?
তাতারী : বুসায়না, সময়-ও মানুষের সৃষ্টি। মানুষ আছে বলেই সময় আছে। সময়েরও প্রয়োজন হয়।
বুসায়না : সে-সময় এখন নয়?
তাতারী : না। তোমার খোলা বুক ওড়নায় ঢাকো। নারীর বিবসনা হওয়ার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সে কেবল প্রেমে। নারীর নির্লজ্জ হওয়ার অধিকার আছে। তা-ও শুধু প্রেমে। একটি মানুষ যার সান্নিধ্যে তার অস্তিত্ব অর্থবান হয়–তেমন মানুষের জন্যে। জমিন-দরদী দেহকান (চাষী) যেমন নহরের পানি নিজের জমির জন্য বাঁধ দিয়ে বেঁধে রাখে, প্রেমিক-নারী তেমনই সমস্ত লজ্জা-সঙ্কোচ একটি হৃদয়ের জন্য সঞ্চিত রাখে। তোমার দেহের দিকে তাকাও। ও ত সওদাগরের দোকান, লেবাস আর জেরে (অলঙ্কার) ঠাসা। দীরহাম দিলেই পাওয়া যায়। নারীর মূল্য অত সস্তা নয়। যে নারী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব-জাতির শিশুকে পৃথিবীতে আমন্ত্রণ দিয়ে আনে, যে নারী শাশ্বত মানবতার জননী বসুন্ধরার অনন্ত অঙ্গীকার, সে অত সস্তা হয় না, বুসায়না। তুমি ভুল ঠিকানায় এসেছে। যারা তোমাকে পাঠিয়েছে, তারাও পৃথিবীর ঠিকানা জানে না।
বুসায়না : আমাকে আপনি বেইজ্জৎ করবেন না।
তাতারী : না বুসায়না। প্রতিদিন কিছু দীরহাম ছুঁড়ে ফেলে, যারা তোমাকে বেইজ্জৎ করে আমি তাদের মত তোমাদের অসম্মান করতে শিখিনি। আমি গোলাম। দীরহাম দিয়ে সব কিছু কেনার পাগলামি থেকে অন্তত আল্লা আমাকে রেহাই দিয়েছেন।
বুসায়না : না, জনাব। আপনি গোলাম নন! অতীতের কথা ভুলে যান। আপনি আমাকে ইজ্জৎ-আই দিয়েছেন। কিন্তু তোর বদৌলত…
তাতারী : কাঁদছো কেন, বুসায়না। কারো চোখের পানি আর সে পানি যদি শিশু কি আওরতের হয়, আমিসহ্য করতে পারি না। কাঁদছো কেন?
বুসায়না : জনাব…
তাতারী : কি বলো।
বুসায়না : জনাব, বুসায়নার পায়ের তলায় বগ্দাদের আমির-ওমরাদের ফরজন্দ্রা কত চোখের পানি ফেলে যায়। দরবারের ষড়যন্ত্র, ঈর্ষা, বৃদবা, লোভে থকা, বিবি-ক্লান্ত কত আমির রঈস বুসায়নার পয়জারে হাঁফ ছাড়তে আসে–সেই রোক্কাসা আজ কাঁদছি না, হাছি।
তাতারী : কিন্তু হাসি তোমাকে প্রতারণা করছে।
বুসায়না : কাঁদছি। হ্যাঁ, কাঁদছি। কারণ এই বয়সে ধন-দৌলতের আলবুরুজ পাহাড়ে উঠে, কেউ মৃত্যু চোখে দেখতে চায় না।
তাতারী : মৃত্যু?
বুসায়না : যা, মৃত্যু। কাল ফজরে, আপনার বাগিচায় আমি কতল হয়ে যাব। মশরুরের তলওয়ারের তেজ একটি নারীর হকুম (গ্রীবা) ছেদে অপারগ তা উন্মাদিও বিশ্বাস করবে না।
তাতারী : কিন্তু মশ্রুর তোমাকে কতল করবে কেন?
বুসায়না : খলিফার হুকুম। আমিরুল মুমেনীন বলেছেন, আমি যদি আপনার খেদমত করতে না পারি, ফজরে আমার গর্দান যাবে।
তাতারী : তুমি এই বাজি ধরলে কেন?
বুসায়না : আত্মবিশ্বাস ছিল। সমস্ত বগ্দাদ আজ লোভের দরিয়া। এখানে কে শুষ্ক থাকতে পারে? শান্শওক্ত, দব্দবা তারই শিকার সমস্ত মানুষ। তারা কোনদিন মানুষ ছিল ভুলে গেছে। আমি ত বগ্দাদের বাসিন্দা। আমি আর নতুন কি হবে? তাই আত্মবিশ্বাস ছিল। আর থাকবে না বা কেন? কত আমির-ওমর দেলাম। কাঁচা দীরহাম আর কাঁচা গোশতের খরিদ্দার। কতজনকে ফতে করলাম। তার জন্য ইলেম লাগে না, সাধনা লাগে না—একটু হাসি, একটু লেবাস এদিক-ওদিক। ধন-দৌলত বিনা মেহনতে আসে। এখানেও বিনা মেহনৎ। শুধু জয় আর জয়। বাজি ধরেছিলাম। হেরে গেছি। কাফ্ফারা (প্রায়শ্চিত্ত) দেব বৈকি। আর কাঁদব না।
তাতারী : কিন্তু আমি তোমাকে মরতে দেব না।
বুসায়না : কেন?
তাতারী : তুমি মহিয়সী নারী। হয়ত বাচার খাতিরে বগ্দাদের ঐ দরিয়ায় ডুব দিয়েছিলে। কিন্তু সামান্য ভাসমান কাঠের টুকরো দেখে তুমি মাটির মানুষ, ডাঙায় ওঠার চেষ্টা পাচ্ছো। তোমাকে মরতে দেওয়া পাপ।
বুসায়না : কিন্তু কে আমাকে বাঁচাবে? আপনাকে আর বেইজ্জৎ করতে পারব না।
তাতারী : সেইজন্যেই ত সোজা উপায় পেয়ে গেছি।
বুসায়না : সোজা?
তাতারী : হ্যাঁ, বুসায়না, তুমিও আমার মত আত্মার ব্যাধিগ্রস্ত। ঐ দেওয়ালে তলওয়ার লট্কানো–আমাকে কতল করো। এ জায়গা আমার কাছে অসহ্য, শ্বাসরোধী।
বুসায়না : তাহলে পালিয়ে যান না কেন? আপনি ত গোলাম নন।
তাতারী : বাহ হা, বুসায়না। এই ধন-দৌলত দেখে সেই রাতে ভুলে ছিলাম। পরে সব বুঝে ভাবলাম পালাই! বাদ মাগরেব শহরের ফটক থেকে বেরুতে যাব, দেখলাম শাস্ত্রী। বলে, এই শহরের বাইরে যেতে পারবেন না, খলিফার হুকুম। আমি কেমন স্বাধীন, বুঝেছো বুসায়না? এই বান্দী বান্দা মুজ্রানী ইমারতের মধ্যে আমি স্বাধীন। একটা মোরগকে কতগুলো মুরগীর সঙ্গে খুল্লার মধ্যে রেখে দেওয়ার মত। তোমার মেহেরবানী আমি কেয়ামত তক্, রোজ হাশরের দিন পর্যন্ত ভুতে পারব না। আমাকে কতল করো। এই নাও তলওয়ার।
বুসায়না : না বেরাদর, আপনাকে মরতে দিতে পারব না। বগ্দাদের সাহারার মধ্যে এই একটি ওয়েসীস আমি পেয়েছি, তা নাস্তানাবুদ করতে পারব না।
তাতারী : তবে?
বুসায়না : সব মাথায় পেতে নেব। কত কালিমা ত সারা জীবন বইলাম। খুনেই তা সাফ হতে পারে। আসুক মশ্রুর, তার জন্য অপেক্ষা করব।
তাতারী : না বুসায়না। জীবন অনেক মূল্যবান। তা-ই আত্মহত্যা করি নি। আত্মহত্যা ভীরু বুজদীলের কাজ। মানুষ জীবনের মুখোমুখি দাঁড়ায়, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে পিছু হটে না। জরা যেমন লেজ গুটিয়ে পালায়, তেমন পালায় না। কিন্তু বুসায়না, তোমার আত্মার সন্ধান আমি পেয়েছি। তুমি এখান থেকে যেয়ো না। আমি কাল ফজরে জবাব দেব, হয়ত মুখ হাসিশূন্য, কি জবাব দেব আমি। মশ্রুর…। একি, বুসায়না কোথায় গেল?… মোহাফেজ… মোহাফেজ…
তাতারী : বুসায়না কোথায় গেল?
মোহাফেজ : এই ত এখানে ছিল।
তাতারী : দ্যাখো, কোথায় গেল। ওর পায়ে ঘুঙুর আছে। যেখানে যাবে, বাবে।
মোহাফেজ : ঘুঙুর? ঐ ত পড়ে আছে গালিচার উপর।
তাতারী : কখন খুললে, আশ্চর্য! যাও, ওর খোঁজ করে আমার কাছে নিয়ে এসো।
মোহাফেজ : যো হুকুম, হুজুর।
১৪. সরাহখানায় তারা গজল শুনছিল
সরাহখানায় তারা গজল শুনছিল।
কত দূর থেকে আসে লু-হাওয়ার তীর
সে কি তোমার নিঃশ্বাস সাকী,
আমার কদমে জিঞ্জির
কত আমির তোমার উমেদার
এ দীল সংগেল, বেকারার
সুমসাম রাতে আহাজারী সার,
পাথরে কুটা ফুটা শির।
আমার কদমে জিঞ্জির।।
রুবাবের আওয়াজ শুধু এই স্বরে বিষণ্ণতার আমেজ ছুঁইয়ে যায়। বগ্দাদের সরাইখানার অন্ধকার। গায়ক হয়ত আদেশ দিয়েছিল আলো নিভিয়ে দিতে।
গজল অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকে। যেন আজ আর শেষ হবে না। শ্রোতারা বুঁদ। বিরহীর আর্তনাদ সকলের বুকে জারিয়ে গেছে। এখানে সবাই প্রেমিক। ঝাপসা অন্ধকারে শুধু বহু মানুষের আন্দাজ পাওয়া যায়।
হঠাৎ একজন হো হো শব্দে চতুর্দিক সচকিত করে হেসে উঠল।
আসরে ফাটল দেখা দেয়, তাই বহু শ্ৰোতাই বিরক্ত!
সত্যি গায়কের গজল থেমে গেল পরিবেশ মোতাবেক। তার কণ্ঠ থেকে আর রাগ বেরোয় না–যা রাগিণীর পুরুষ রূপ। গোস্বাধৃত তার গলার আওয়াজ।
–আবুল আতাহিয়া, বেয়াদবের মত হাসছো কেন?
–আবু নওয়াস, মাথায় জজমের ঠাণ্ডা পানি ঢালো।
নওয়াস : এমন গজলটা ধরেছিলাম। সব জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলে।
আতাহিয়া : তার মালিক তো স্রেফ আল্লা। আমি তো বান্দা।
নওয়াস : তোমার এমন আক্কেল বলেই তো তেমি কবিতা লেখো।
আতাহিয়া : তোমার আক্কেল আছে, স্মৃতিশক্তি আছে?
নওয়াস : আল্লা মাথার খুলিটা এখনও শূন্য করে নেন নি।
আতাহিয়া : নিয়েছে। টের পাও নি।
নওয়াস : দ্যাখো, এখনই লড়াই বেধে যাবে।
আতাহিয়া : তাতো বাধবেই। নাদানকে নাদান বলেই, তার গলা থেকে গান বেরোয় না।
নওয়াস : আমি নাদান?
আতাহিয়া : প্রায়। পুরো নয়। সেদিন যে বলে, তুমি জীবনের কবি, জীবনের গান গাও; আর আমি মৃত্যুর কবি, নিরাশাবাদী অগয়রহ। আরো কি কি বলে। আজ তুমি কি গজল গাইছ?
নওয়াস : উঃ, আবুল আলাহিয়া। তোমার মাথার খুলিটা হেকিমকে দিয়ে একবার দেখিয়ে নাও। ওটা খালি হয়ে গেছে, টের পাও নি।
আতাহিয়া : এই বুঝি জীবনের গান?
নওয়াস : বিরহে দুঃখ আছে। দুঃখ কি জীবনে আসে না? এতে জীবন-বহির্ভূত কি দেখলে?
আতাহিয়া : মৃত্যু কি জীবনে আসে না?
নওয়াস : আসে। সে একবার মাত্র। তা নিয়ে হাজার বার নাকী কান্না কাঁদতে হবে না কি, তুমি যা করো?
আতাহিয়া : নওয়াস, দুঃখের গান গাওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে। আজ তুমি যে-বিরহের গান গাইলে এমন মজা আর কোনদিন পাইনি। তোমার কবিতা ফিকে লাগে এর কাছে।
নওয়াস : আবুল আলাহিয়া, ভুল করো না। দুঃখ আর মৃত্যু এক জিনিস নয়। দুঃখের গান গাই দুঃখকে দূর করার জন্যে, দুঃখের মোকাবিলায় দাঁড়াতে পারব, তার জন্যে। যারা এই জীবন জীইয়ে তুলতে পারে না, তারা কবিতা লেখে শকুনদের জন্যে। পারশীরা শকুনের কাছে যেমন মড়া ফেলে দেয়, ওই কবিরা তেমন কবিতা ছুঁড়ে দেয় পাঠকদের জন্যে। আজান দিয়ে মুসল্লি ডাকে, তুমি কবিতা দিয়ে মানুষ ডাকার বন্দোবস্ত করো। তুমি—
আতাহিয়া : থামো, থামো। এলাম দু-দণ্ড মওজ করতে, তুমি কি যে ক ক শুরু করে দিলে। তৌবাস্তগ্ফেরুল্লা।
নওয়াস: শয়তান তোমার কাছাকাছি থাকে কি না, তাই তোমার বার বার আস্তাগফেরুল্লা পড়তে হয়।
আতাহিয়া : হাহ্ হা, আমি তো শয়তানের কাছেই বসে আছি, ঠিক বলেছো।
নওয়াস : শয়তানই বিশ্বসৃষ্টির আগে প্রথম ন্যায়শাস্ত্রের প্রয়োগসাধন করেছিল। সেই যুক্তিই মানুষের সভ্যতার উন্নতির অন্যতম বড় উপাদান। মনে রেখো আবুল আতাহিয়া। মাঝে মাঝে শয়তানেই হয়তো আসল মনুষ্যত্বের সূচনা ঘটে।
আতাহিয়া : শয়তানের যুক্তি দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে।
নওয়াস : আতাহিয়া, যুক্তির পেছনে কি থাকে জানো?
আতাহিয়া : না।
নওয়াস : তা তোমার জানার কথা নয়। যুক্তির পেছনে থাকে মুক্তির স্বপ্ন। এই মুক্তির স্বপ্নই মানুষকে মানুষ বানায়। আমি তাই দুনিয়ার তামাসা ভাল করে দেখি।
আতাহিয়া : নওয়াস, তোমার সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা দায়। কারণ, চোর আর ছেনাল কারচুপিতে খুব দড়।
নওয়াস : আতাহিয়া, আজ কষে গালাগাল দাও। আমি আজ মজে আছি। আমার আর এক মজুলিশ বাকী আছে।
আতাহিয়া : তোমার সঙ্গে আজ রাত কাটাচ্ছি না।
নওয়াস : নীরস তুমি। মওজ দেখলে তোমার দীল বাতাসে কাঁপে। কিন্তু বন্ধু, জীবনকে খুঁজে পেতে হাটে হাটে ঘুরতে হয়।
আতাহিয়া : কিন্তু তুমি যে শুধু রূপের হাটে ঘুরে বেড়াও।
নওয়াস : রূপের হাট-ই আসল হাট। মানুষ যদি তা না আবিষ্কার করত, এই দুনিয়ার বাঁচার আর কোন মজা থাকত না। ফুল তো বনে ফোটে। কিন্তু তাকে আমরা সাজিয়ে ফোঁটাতে চাই। তাই বাগান করি। রূপের নেশা থেকেই কাজের উৎপত্তি অথবা কাজ থেকে রূপের নেশার উৎপত্তি… আর কাজই সমস্ত সংসারকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তোমার মত নিষ্কৰ্মারা আকাশের দিকে তাকায়। কাজে আর রূপে মিতালি পাতিয়েই তো ইনসান এগোচ্ছে। যখন আর ওই দুই খোট একত্রে মেলাতে পারে না, তখনই মানুষ হয় ইব্লিশ। মুনাফেকীর (ভণ্ডামি) জন্ম সেইখানে।
আতাহিয়া : কিন্তু নওয়াস, জাহেলী (অজ্ঞতা) থেকেও তো মুনাফেকীর জন্ম হতে পারে।
নওয়াস : তা হয়। কিন্তু জাহেলী তো একটা তাসীর (ফল)। তুমি কেমন মা-বাপ ইয়ার-দোস্ত-মুলুকে মানুষ, তার উপরও অনেকটা নির্ভর করে।
আতাহিয়া : কিন্তু এ আমরা কোথায় যাচ্ছি?
নওয়াস : কেন?
আতাহিয়া : এলাম, দু-দণ্ড মওজ করব। তুমি পান করবে, আমি গান শুনব। সে জায়গায় এসব কি শুরু করলে?
নওয়াস : রুহ্ সাফা (আত্ম-পরিষ্কার) পানি ত তোমার জঠরে যায় না, তাই আমার জায়গাটা তোমার ঠিকানা-মত নয়।
আতাহিয়া : না, ইয়ার। আবার গজল গাও।
নওয়াস : কিন্তু গজল আর জমবে না।
আতাহিয়া : কেন?
নওয়াস : কল্পনার বোরারকে (স্বর্গীয় বাহন) চড়ে, তুমি দুনিয়ার তাবৎ সুলতানার (রানী) সঙ্গে ‘জেনা’ ব্যভিচার করতে পারো, আর এ খাহেশও স্বাভাবিক। কিন্তু মাটির উপর পড়লে, বিবিরও মত নিতে হয়।
আতাহিয়া : লা-হাওয়া, লা-হাওলা। বাঁচাও প্রভু শয়তান থেকে।
নওয়াস : সত্যি।
আতাহিয়া : কিন্তু আমি বলছি, তোমার কল্পনা যদি ভেঙে থাকে, জোড়া দাও।
নওয়াস : তা আর সম্ভব নয়। দ্যাখো আবুল আতাহিয়া, তুমি আর যাই করো আমার সঙ্গে বাজি ধরো না। খোদ্ আমিরুল মুমেনীন আমার সঙ্গে বাজি ধরে প্রায় হারতে বসছেন।
আতাহিয়া : তোমার সঙ্গে বাজি?
নওয়াস : তারই ফয়সালা আছে কাল। পরে সব শুনবে। আজ থাক্, চলো ওঠা যাক্।
আতাহিয়া : আবু নওয়াস, বগ্দাদ তোমাকে চেনে না, তাই তোমার এত বদনাম।
নওয়াস : বন্ধু মহাপুরুষদের অনেক দেরীতে চেনা যায়। চল্লিশ বৎসর লেগে গিয়েছিল হয়রত মুহাম্মদ (দঃ) কে জানতে। তাই বলে আমি একটা বিশেষ কিছু… তা মনে করো না। এক দেশে বাদশার নাম ছিল হবু। মন্ত্রীর নাম ছিল গুব। মহাপুরুষেরা নবুয়ৎ (নবীত্ব) পায়, আমি এবার গবুয়ৎ পেয়ে যাব।
আতাহিয়া : হা-হা-হা, আবু নওয়াস। তোমাকে ঠিকমত বুঝি না, তবু বুকে বুক মিলাতে ইচ্ছা করে।
নওয়াস : খবরদার। এর নাম বুৎ-পরস্তি–প্রতিমা পূজা। ও মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। অর্থাৎ ধ্বংসের পথে। বুঝবে, তবে বুকে বুক মিলাবে। সব জিনিস তুমি যুক্তি দিয়ে গ্রহণ করবে, নচেৎ তুমিও বুৎ-পরস্ত (প্রতিমা পূজক)–সে তুমি মুসলমানই হও আর ইহুদীই হও। না, আর কথা না। ওহে সরাইওয়ালা তোমার শরাবের দাম কাল নিও।
সরাইওয়ালা : আচ্ছা জনাব। আস্সালামো আলায়কুম।
উভয়ে : ওআলায়কুম আসোলাম।
১৫. বেগম জুবায়দা দাঁড়িয়েছিলেন
বেগম জুবায়দা দাঁড়িয়েছিলেন, যেখান থেকে একদিন তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল মেহেরজান। বাগানে তেমনই অন্ধকার। সাদা পাথরের রাস্তা হয়ত কিছুটা আভাস দিয়ে যায়। হয়ত মেহেরজান এই পথেই আবার ফিরে আসবে। মালে-গনীমতের মধ্যে এমন উপহার পাওয়া যায়? কথাটা একবার বেগমের মনে জাগল। তিনি পায়চারী করতে লাগলেন।
কালো বোরখা পরিহিতা এক নারী হঠাৎ পেছন থেকে তাকে ডাক দিলে ফিসফিস কণ্ঠে :
–বেগম সাহেবা।
–কে তুতী?
–জী, বেগম সাহেবা।
তুতী মহলের ক্রীতদাসী। বোরখা খুলে ফেলেছে সে ততক্ষণে।
–কোন খবর পেলি?
–না, বেগম সাহেবা। এই বিরাট মহল। যেখানে শত শত গোলাম আর বান্দী, সেখানে খবর পাওয়া মুশকিল।
–আমি ত আর কিছু চাই নে। কেমন আছে, এইটুকু খবর পেলেই খুশি।
–বেগম সাহেবা, আপনি ওকে বড় ভালবাসতেন।
–তা ত বাসতাম। পরের দুঃখ মুছে নিতে পারলে রুহে আত্মায় কত যে শান্তি, তা যদি মানুষ জান্ত।
–বেগম সাহেবা, আপনি ফেরেশতা। বেহেশতের হুর দুনিয়ায় এসেছেন।
–যা, কি-যে সব বলি। পানির জন্য মানুষের কত কষ্ট। আমি একটা নহর কাটাব ঠিক করেছি।
–বেগম সাহেবা, সবাই আল্লার কাছে হাত তুলে আপনার জন্যে দোয়া মাঙবে।
–তুই মেহেরজানের খবর আন্তে পারলি না।
–বেগম সাহেবা, এই মহলের ব্যাপার ত আপনি জানেন। এখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। সকলে যে-যার স্বার্থ নিয়ে আছে। মেহেরজান… এখানে না-ও থাকতে পারে।
–হুঁ। তুই যা। খবরদার, এ-খবর কেউ না জানে।
–খোদার কসম, বেগম সাহেবা। আপনি মায়ের সমান। আমার কাছ থেকে কোন খবর আল্পর ফেরেশতা পর্যন্ত বের করতে পারবে না।
তুতী চলে গেল।
বেগম সাহেবা দাঁড়িয়ে রইলেন খাম্বার মতই অনড়। উত্তর্ণ। বাতাসের ঈষৎ শব্দ তাঁকে উচ্চকিত করে তোলে।
তীক্ষ্ণ-বুদ্ধি মেহেরজান। তাকে কেউ আটকে রাখতে পারবেনা। তার একমাত্র দুশমন দুরন্ত যৌবন। সেই যা ভয়। নচেৎ এমন নিভাঁজ অন্ধকারেই ত সে ফিরে আসবে।
বেগম জুবায়দা বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন।
১৬. মোহাফেজ এবং হারুনর রশীদ
মোহাফেজ এবং হারুনর রশীদ।
–মোহাফেজ?
–আমিরুল মুমেনীন, আপনার বান্দা।
হারুন : গোলাম তাতারীর ধবর কী? গোলাম এবার হাসছে?
মোহাফেজ : না জাঁহাপনা।
হারুন : এত দূর হিমাকৎ–আস্পর্ধা!
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, গোলাম চুপচাপই থাকে। আহার প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। সে-খবর দিতে আমি আসি নি।
হারুন : তবে তুমি কি খবর নিয়ে এসেছো?
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, বুসায়না আত্মহত্যা করেছে।
হারুন : বুসায়না আত্মহত্যা করেছে!
মোহাফেজ : বাগিচার এক গাছের ডালে ঝুলছিল, আজ বিকেলে দেখা গেল। আমরা কেউ খোঁজই পাইনি।
হারুন : বুসায়না আত্মহত্যা করেছে, না, গোলাম তাকে খুন করেছে?
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, সব খবর আমার জানা নেই। কাল রাত্রে তাতারী আমাকে ডেকে বলে, বুসায়না কোথা গেল খোঁজ কর।
হারুন : বুসায়না, রাত্রে গোলামের কাছে ছিল না?
মোহাফেজ : না জাঁহাপনা।
হারুন : মশ্রুর, মশ্রুর।
মশ্রুর : জাঁহাপনা।
হারুন : এখনই কোতোয়ালকে ডাকো। শুনেছো, বুসায়না আত্মহত্যা করেছে।
মশ্রুর : এখনই শুনলাম।
হারুন : যাও, কোতোয়ালকে খুনের তদারক করতে বলে। আমি এখনই বাগিচায় যাব।
মশ্রুর : আস্সামায়ো তায়তান।
হারুন : মোহাফেজ, এতদূর আস্পর্ধা গোলামের। গোলামকে আবার গোলাম বানাব। তার দেহ টুকরো টুকরো করব না। ছিঁড়ে ছিঁড়ে তিলে তিলে পশুপক্ষী পোকার আহার্য বানাব। হাব্সী গোলামের এত সীনার জোর? মোহাফেজ…
মোহাফেজ : জিল্লুল্লাহ্।
হারুন : গোলাম এই খবর জানে?
মোহাফেজ : আলম্পানা, গোলামের কাছে এই খবর যাওয়া মাত্র সে ত পাগলের মত হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল, তারপর দৌড়ে গেল সেই গাছের নিচে। অন্যান্য গোলামের সাহায্যে গাছ থেকে লাশ নামিয়ে সে ত ছাতিপেটা শুরু করল, আর হাউ হাউ কান্না। জমিনের উপর কি পান খাওয়া। বহেনের জন্যেও ত কেউ এমন করে না।
হারুন : তাজ্জব ব্যাপার। মশ্রুর ফজরে গিয়ে শুনে এসেছিল, বুসায়না নিজের মাকানে ফিরে গেছে। মাকানেও ছিল না।
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, গোলাম বুসায়নার গোসলের ব্যবস্থা করছে।
হারুন : কিন্তু সকালে মশ্রুরকে গোলাম বলেছিল, বুসায়নাকে সে জায়গা দেয় নি ঘরে।
মোহাফেজ : আলম্পানা, আল্লা এর মাজেজার রহস্য জানে।
হারুন : বাগিচায় আর কেউ আছে?
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, বগদা, জাঁহাপনা, বগ্দাদে বুসায়নার রূপের খ্যাতি কে না শুনেছে। ধনদৌলতের রোশনাই-ও তার কম নয়। সমস্ত বগ্দাদ আজ বাগিচায় ভেঙে পড়ছে। লাশের পাশে পাগলের মত কাঁদছে আপনার গোলাম তাতারী।
হারুন : মশ্রুর, কোতোয়াল পাঠিয়ে বাগানের ভিড় হটাও। আমি খোদ্ যাব।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, এই মোহাফেজকে বিদায় দিন, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।
হারুন : যাও, মোহাফেজ।
মাহাফেজ : আস্সালামা আলায়কুম ইয়া আমিরুল মুমেনীন।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, গোলাম খুন করে ওকে গাছে ঝুলিয়ে দেয় নি ত?
হারুন : নিমকহারামকে দিয়ে কি না সম্ভব! গোলাম একটা পাথরের পিণ্ড ছাড়া আর কি। বুসায়না যে ওর কাছে ছিল না, তাও সত্য। মোহাফেজের জবানী তার প্রমাণ। হয়ত বুসায়না বাজি ধরে হেরে গিয়েছিল। তাই তোমার তলওয়ারের ভয়ে গাছে ঝুলেছে।
মশ্রুর : ওর মাজেরা আলেমুল গায়েবই জানেন।
হারুন : চলো, সরেজমিন তদারক করা যাক। কিন্তু তার আগে মশ্রুর, সেই বান্দীর বাচ্চা, বান্দরের বাচ্চাকে কয়েদখানায় নিয়ে যেতে বলো। একদম ‘হাবিয়া’ কয়েদখানায়। পোকামাকড় বিচ্ছুর সঙ্গেই জিন্দেগানী চলার উপযুক্ত ও একটা কমিনা-কমজাত। নওয়াসের কাছে আমাকে বেইজ্জৎ করে ছাড়ছে। এত বেসুমার মালমারসালিক করে দিলাম। তবু গোলামের বাচ্চা হাসল না। তবে হাসি আমি আদায় করব। যাও, মশ্রুর। আমার প্রতিটি লফ্জ শব্দ যেন ঠিকঠিক পালন হয়।
মশ্রুর : আস্সামায়ো তায়তান।
১৭. আবু নওয়াস হাঁটছিল
আবু নওয়াস হাঁটছিল।
পাশে দজ্লা বয়ে চলেছে। মেঘে গোধূলির ঝিলিমিলি। এখানে শহর থেমে গেছে। বেবহা ময়দানের প্রারম্ভ। মরুভূমির অংশ বিশেষ। তবে এখানে আবাদ আছে। আর আছে খুর্মা গাছের সারি।
নদীর উপর গুফাদারেরা গুফা বেয়ে চলেছে। কোন কোন গুফা বোঝাই তরমুজ, তামাক কফি। সন্ধ্যার আগে ঝাপসা স্তিমিত এই জীবন-লীলার দিকে নওয়াসের কোন লক্ষ্য নেই। বালু-তীর। খালি পায়ে হাঁটার জন্য মনোরম। নওয়াস তাই হাঁটছে। তীরে দজ্লার ঢেউ এসে লাগে, কখনও কখনও নওয়াসের পায়ে আছড়ে পড়ে। কবি একটু চমকায় মাত্র। তারপর হাঁটতে থাকে। কোন কিছুর দিকে তার আকর্ষণ নেই। উটের কাফেলা চলেছে দূরে দূরে। গোধূলির অন্ধকারে খেজুর বীথির পাশে পাশে এই দৃশ্য অবসরভোগীর আশীর্বাদ। কিন্তু নওয়াসের চোখ আজ কোন বস্তুর উপর এককভাবে বিদ্ধ হয় না। দৃষ্টি স্পর্শ করে, গ্রহণ করে না কিছুই।
নওয়াস যেন আজ অনন্তের মুসাফির। তাড়াহুড়া নেই, ক্ষিপ্রতা নেই। আরো–আরো কিছু আছে চোখে দেখার। তাই হঠাৎ একাগ্রতার প্রয়োজন-বোধ লাগে না।
নওয়াস হাঁটছিল। দজ্লা ঈষৎ শান্ত, ঈষৎ নীরব! তবু মানুষের মেহনতের নানা পট তো সাজানো। নওয়াস তা দেখতে প্রস্তুত নয়।
মরুভূমির বুকে কি সে কোন পানশালার খোঁজ পেয়েছে? না, এই বালুর চাঁচর রাজ্যে পানি স্বপ্ন-মাত্র। পাশালা ত বেহেশত।
আর শহরের শ্রেষ্ঠ পান্শালা ত সে ছেড়ে এসেছিল গোধূলির পূর্বে।
আকাশে নক্ষত্র ফুটতে থাকে এক এক করে। নওয়াস সেদিকে একবার তাকিয়ে দিগন্তেই কি যেন খুঁজতে লাগল। পানশালার পর নারী নওয়াসের অন্বিষ্ট। কিন্তু মানবীর কোন প্রয়োজন নেই তার। চাঁদ-সড়কের রোক্কাসাদের উঁচু বুক আজ তাকে বাধা দিতে পারে নি।
হঠাৎ থামল নওয়াস। দজ্লার কুলুকুলু-র শুধু তার কানে আসে। আর কোন শব্দ সে কান দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না।
দিগন্তের দিকে নওয়াসের দুই চোখ অন্ধকারে যেন প্রশ্নের জবাব খুঁজছে। প্রশ্নকারী, উত্তরদাতা উভয়ই সে নিজে।
নওয়াসের দুই ঠোঁটে হঠাৎ মৃদু হাসির আঁচড় দেখা গেল। তারপর বেশ জোরেই হেসে উঠল সে।
আন্দোলিত মন তখন ঠোঁটের কিনারায় প্রতিধ্বনি তোলে : নওয়াস, নওয়াস। আরো হাসো, হাসো। দুনিয়ায় তোমাকে সকলে শরাবী মদ্যপ বলেই জানবে। আর জানবে কবিরূপে। বলবে, ব্যভিচারী নওয়াস। তোমার কলঙ্কই বেঁচে থাকবে, তোমার অস্তিত্ব থাকবে না। কেউ জানবে না, তুমি কেন কলঙ্কের কালি-বোঝা নিজের মুখে মাথায় তুলে নিয়েছিলে? হাসো, হাসো, নওয়াস।
নওয়াস সত্যি নিজের মনে হাসতে লাগল। তারপর চুপ করে গেল। গম্ভীর তার মুখাবয়ব।
খেজুরের বীথি এখানে ঝাপসা, আকাশের গায়ে এসে মিশেছে।
আবার নওয়াস সোচ্চার বলতে লাগল : আমিও মানুষের মনের অন্ধকারে এমনই আকাশ রচনা করে যাব। মৃত্তিকা-জাত, তবু আসমানের সঙ্গী। আমার কলঙ্ক কেউ বুঝবে না। জীবনের দিকে দিকে হে অমৃতের পুত্র, অগ্রসর হও। মৃত্তিকা থেকে আকাশে পাড়ি দাও–কিন্তু তোমার দুই পা সব সময় যেন মাটির উপর থাকে। এইভাবে আকাশও তোমার কাছে ধরা দিয়ে যাবে। কিন্তু তোমরা তা করো না। আকাশের খোঁজে এগোও, এদিকে পৃথিবীতে হারিয়ে যাও। তোমাদের মানুষ বলেই আর কেউ চেনে না। তুমি পৃথিবী-বিস্মৃত, তাই মনুষ্যত্ব-বিস্মৃত। নওয়াস তাই কলঙ্কের কালি মেখে নিলে। শিব-হাল নওয়াস। আবে-হায়াৎ বিলিয়ে দিয়ে জহর নিজে পান করলে। শূন্য আকাশ তোমাদের কাছে এত প্রিয় যে, বৈচিত্র্য-গর্ভা পৃথিবীর দিকে তাকালে না। তাই কবি নওয়াস তার কবি-ব্ৰত ধারণ করলে–। হোক পাক, সহজ আনন্দ–এই সহজ আনন্দের দিকে আগে মানুষকে টানো–জীবনকে ভালবাসতে শিখুক মানুষ। তাই ত শরাব-সাকী আমার কাব্য প্রাত্যহিকতার প্রতীক। কাকে বোঝাব এই কথা?–একটি মানুষ-যদি পৃথিবীতে মানুষের মত বাঁচবার অভিলাষী হয়, নওয়াসের কলঙ্ক সার্থক। সূর্যের মত আমার জন্য থাক্ কলঙ্ক জ্বালা আর জ্বালা–তোমাদের জন্যে থাক শুধু প্রাণদাত্রী আলো আর আলো। চতুর্দিকে কালিমা-ময় জাল বিছিয়ে অঙ্গার কী হীরককে জ্যোতিহীন, না নির্মূল করতে পারে? কিন্তু নওয়াস, তুব–তবু, তোমার হৃদয় আবেগ উদ্বেলিত কেন? শান্ত হও, মন। রাত্রি নামে গোধূলি শিখরে
নওয়াস হঠাৎ অল্প জায়গার মধ্যে পাগলের মত পায়চারী করতে লাগলো। অন্ধকার চারিদিক থেকে হেঁকে ধরেছে। নওয়াস তারই কয়েদখানায় হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে : না, না।
সে জানে এই কণ্ঠস্বর কারো কাছে পৌঁছাবে না। তবু থেকে গেল সে, বুকে অস্থিরতা সত্তেও। আবার শহরের দিকে মুখ ফেরায় আবু নওয়াস। রহস্যময়ী দীপান্বিতা বগ্দাদ আবার হেসে উঠেছে। সেখানেই ত সে ছুটে যাবে। জীবনধারা থেকে আঁজলা পান না করলে ত তার তৃষ্ণা মিটবে না। মানুষের জীবনই মদিরা বিশেষ, তাই ত সে মদিরায় জীবনকে খুঁজেছে।
বগ্দাদ-অভিমুখী নওয়াস। দজ্লা হয়ত জোয়ারে উত্তাল। তার পদধ্বনি বার বার শমে তেহাই মারছে। গজল গাইছে গুফাদারেরা দল বেঁধে। সুরের খেই পাকড়ে গুন গুন করতে লাগল আবু নওয়াস।
জীবনের সবক নিতে বাদেই ত তাকে ফিরে যেতে হবে। বিরাট মরুভূমি আর শূন্যতার উপাসনা তার ব্রত নয়।
আবু নওয়াস জোর পা ফেলতে লাগল।
শহরের দরওয়াজার কাছাকাছি দজ্লার বুকে বিপণী-সারির আলো পড়েছে।
নওয়াস ভাবলে, “দজ্লা ত নদী নয়–আমার বুক। সম্মুখে কোথাও অন্ধকার আছে বলে কী এই নদীর স্রোতদল শহরের আলোস্নাত এক জায়গায় থমকে দাঁড়ায়? অন্ধকারের রহস্য কী তাদের টানে না?… আমি নিজেই এক দজ্লা।”
হাল্কা বুকে হাসল আবু নওয়াস। অতঃপর নিকটস্থ এক পানশালায় ঢুকে পড়ল, সেখানে আবুল আতাহিয়া তার প্রতীক্ষার্থী বসে ছিল।
–এসো, এসো। কোথায় ছিলে তুমি?
–হারিয়ে গিয়েছিলাম, আতাহিয়া।
আতাহিয়া : তুমি দেখছি আর এক মেহেরজান।
নওয়াস : না, আবুল আলাহিয়া। সত্যি হারিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। এই খুঁজে পাওয়ার আনন্দটুকু আজ পান করব। আমার শরাবের প্রয়োজন হবে না।
আতাহিয়া : বেশ, তবে চলো, ওঠা যাক। বগ্দাদের নৈশ স্রোতে অবগাহনের পর আজ ঘরে ফিরব। এসব জায়গা আমার ভাল লাগে না। তোমার জন্যেই শুধু আসা।
নওয়াস : বেশ, তাই চলে।
১৮. লৌহ গরাদের ওপারে আকাশ
লৌহ গরাদের ওপারে আকাশ।
শুধু কি আকাশ? পৃথিবী নিজের অন্তহীন বিস্তার অস্বীকারের জন্য গণ্ডির মধ্যে বিচিত্রার আতসবাজি জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে এগোয়। থামতে চাইলেও থামতে পারে না। তার শ্রেষ্ঠ সন্তান মানুষের মধ্যেই, তাই পৃথিবী ভেঙে ভেঙে টুকরো-টুকরো ছড়িয়ে পড়ে; কিশোরীর দুর্বাবনে কুঁচফল হারিয়ে পুনরায় খোঁজার মত। খুঁজে পাওয়ার পর আবার ছড়ানো। ঝর্ণা-উৎসারিত ছত্রাকার জলবিন্দুর উখানে-পতনে এই লীলার আভাস কিছুটা চোখে পড়ে। তাই গরাদের ওপাশে শুধু আকাশই অস্তিত্বের ইশারা জাগায় না, ধেয়ে আসে চূর্ণিত পৃথিবী, টুকরো-টুকরো রঙীন কাঁচের মত অন্তহীন বর্ণসজ্জায়–পলানুপল, দণ্ড-প্রহর, অহর্নিশ।
গরাদের ওপারে তাই ত মানুষ মাথা কোটে। নিপ্ৰাণ পাথরেও চেতনার প্রলেপ আরোপ করে। মেজে-মেজে হৃদয়কে করে তোলে অমলিন নিদাগ আরশি। সেখানে অন্ততঃ পৃথিবীর ছায়া পড়ক।
গরাদের এপার এবং ওপারের দূরত্ব-পার্থক্য মুছে দিতে তাই নবেন্দ্রিয় সৃষ্টি হয়। ধারা বিচ্ছিন্ন উপনদী সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে। তরঙ্গ-কল্লোল একক শব্দে কখনও মুক্তি পায় না।
ওইখানে হাব্সী-মুখের দিকে তাকাও। কোড়াহত ও-মুখ কি অনড় স্থৈর্যে অবিকল? না। কৃষ্ণ হাব্সীমুখ সফেদ আরমেনী মুখের আদলে কী ডুবে যাচ্ছে না? আশির সমতল রূপান্তর ধরে রাখছে না শুধু।
তুমি হয়ত দেখতে পাও না। কারণ, তুমি সেই নবন্দ্রিয়ের অধিকারী নও। তার চেয়ে গরাদের প্রাচীরেই কান পাতো। পাষাণেও চেতনা-প্রবাহ আছে। অভিশপ্ত বগ্দাদ এখনও নিদ্রা-সমাহিত। তার ঘুম যেন কেয়ামতের পরও ভাঙবে না।
১৯. সরাইখানার প্রবেশ-পথ
বগ্গাদের এই সরাইখানার প্রবেশ-পথ খুবই সঙ্কীর্ণ। মালিক একটা ছোট গালিচার উপর উপবিষ্ট। পিছনে মোটা গের্দা। সামনে রূপার নল-সংযুক্ত হুক্কা। আনমনা ধূমপান করছিল সে।
কিন্তু এই প্রবেশ-পথ পার হয়ে গেলেই সরায়ের আসল চেহারা দেখা যায়। স্তিমিত আলোয় বিরাট হলের মধ্যে নৈশ-বিলাসীরা বসে আছে। কেউ নিঃসঙ্গ। কেউ দল-বাধা। এখানে কফি-শরাবের মজ্লিশ গুজার। কল-গুঞ্জনের বিভিন্ন গ্রাম সমস্ত কক্ষে নিনাদিত। মৃদু ফিসফিসানি থেকে হাহ্ হা– হৈহো রব, সবই এই জায়গায় সাজে। কোনায় কোনায় নর্তকীদের নাচ, মাঝে মাঝে ঘুঙুর ও তাম্বুরীণের আওয়াজের সঙ্গে হঠাৎ ঢেউ তুলে যায়; তা আছড়ে পড়ে নানা বিভঙ্গে। কেউ শুধু তাকিয়ে দেখে আবার জামে ঠোঁট নামায়, কেউ তালি-সংযোগে চীঙ্কার দিয়ে ওঠে, “মারহাবা, মারহাবা।” যেন কেয়ামৎ হঠাৎ দেখা দিয়ে ত্রস্ত পালিয়ে গেল। পৃথিবী আবার আনন্দে নির্বিবাদ।
অন্যান্য দিনের মত আজও সরাইখানা এতক্ষণ গুজার ছিল। তারপর আওয়াজের তোড় কমে গেছে। কিন্তু কথার সোড় থামছে না। অবিশ্যি লয় মৃদু, খাদ-অভিমুখী।
সরাইখানার মাঝখানে একটি পাথুরে-মাটির ছোট উঁচু চবুতরা। তার উপর এতক্ষণ কয়েক জন বসে বসে কফি পান করছিল। এক জন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলঃ সাবাস, আবু নওয়াস, সাবাস।
তারপর সমস্ত সরাইখানায় ওই একই নাম ঘুরে ঘুরে আসে। আবু নওয়াস। আবু–আবু নওয়াস। আবু নওয়াসের কি হবে?
নতুন কয়েকজন আগন্তুক এসে পড়ল। সরাইয়ের গুহায়। হয়ত এই স্তিমিত ভাবের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। সরাইখানায় কি কেউ আসে গৃহোচিত নীরবতা উপভোগে? সকলের তরঙ্গে গা ঢেলে সবাই স্নানার্থী এইখানে। ম্রিয়মাণতা এখানে নিষিদ্ধ, পাপ।
আগন্তুক একজন সরাইয়ের মাঝামাঝি এসে চিৎকার দিয়ে উঠল : গোটা বগ্দাদ কি আজ মৃত না কোন কেয়ামত খবর পাওয়া গেছে–যার জন্যে সরাইখানা আজ ঠাণ্ডা গোরস্থান?
চারিদিক থেকে চোখ এই চ্যালেঞ্জ-দাতার উপর পড়ল।
প্রথমে অনেকে প্রশ্নটা বুঝতে পারে না। উত্তর-প্রার্থীর উদ্দেশ্য কি? কি জবাব চায় সে?
আবার শোনা গেল কর্কশ কণ্ঠস্বর, “বগ্দাদ কি মৃত না কেয়ামতের প্রতীক্ষার্থী?”
এইবার কয়েকজন কফির পেয়ালা ঠোঁট থেকে নামিয়ে নওজোয়ানের দিকে তাকায়। বিরক্ত হয় অনেকে। সরাইয়ের হাওয়া যেন এই তরুণ আগন্তুক বিষিয়ে দিচ্ছে।
পশ্চিম কোনা থেকে আর এক যুবক দাঁড়িয়ে জবাব দিলে, “আপনি অন্ততঃ বসে পড়ে প্রমাণ দিন যে, আপনি মরেন নি”
–কিন্তু বগ্দাদ মরে গেছে।
–না।
–তবে এই সুম্সাম ভাব কেন?
–বগ্দাদ তার যৌবনের উৎসব পালন করছে। বগ্দাদের নওরোজ আজ।
–নওয়োজ কি এইভাবে পালিত হয়? গোরস্থানের স্তব্ধতায়?
–বগ্দাদ মরে গিয়েছিল। আজ বগ্দাদ বেঁচে উঠেছে। তাই আমার হুল্লোড়ে মেতে তার পবিত্রতা নষ্ট করতে রাজি নই। আপনার ভাল না লাগে অন্য সরাই দেখুন। বাদে তার অভাব নেই।
–আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি নে।
–বগ্দাদ দুনিয়ার শয়তানদের কাছে একটা ধাঁধা। আর তুমি এত সহজে বুঝে ফেলবে, নওজোয়ান?
–মেহেরবানী করুন, আপনাদের এই প্রহেলিকা আর সহ্য করতে পারছি নে।
–আজ বগ্দাদ বেঁচে উঠেছে।
–কবে তার মৃত্যু হয়েছিল?
–তার খোঁজ পান নি, টের পান নি?
–ব্যাপার কি, ভাই?
–আজ বগ্দাদ বেঁচে উঠেছে। আপনি তো জানেন, বুসায়না খুনের ইনসাফ হচ্ছিল আজ আমিরুল মুমেনীনের দরবারে। আমির-ওমরাহ-কাজী সবাই বললে, হাব্সী তাতারী এই খুন করেছে। খুন কা বলা খুন। গর্দান নেওয়া হোক হাব্সীর।
তখন সরাইয়ের আর এক কোনায় অন্য দুই নওজোয়ান চিৎকার দিয়ে উঠল, “থামুন–থামুন।” তাদের প্রসারিত করতালু আর আঙুলের দিকে সকলের দৃষ্টি আবার ধাবিত হয়।
“থামুন, থামুন”,রবে দুইজনে এগিয়ে এলো, দুই নওজোয়ান। তারপর তারা বললে, “আজ আমরা দুইজনে দরবারে ছিলাম। সব কথাই মনে আছে। আমাদের একজনকে খলিফা আর একজনকে নওয়াস মনে করলেই আপনারা গোটা দরবার চোখের সামনে দেখতে পাবেন।”
“বেসক-নিশ্চয়-নিশ্চয়,” সমর্থনের রব উঠল চারিদিক থেকে। “এতক্ষণ তো শুনছিলাম, এবার চোখেও দেখতে পাব।” জনান্তিকে একজন প্রস্তাব করলে, “চত্বরটা ছেড়ে দিন। ওখানে খলিফা বসুন। আর নওয়াস নিচে দাঁড়াক। সকলের দেখতে সুবিধা হবে।”
–নিশ্চয়, নিশ্চয়।
প্রস্তাব-মত মঞ্চ সজ্জিত হতে আর বেশি বিলম্ব ঘটে না। তারপরই সরাই দরবারে পরিণত হয়। আগন্তুক দুইজন তখন অভিনেতা।
.
নওয়াস : জাঁহাপনা—
আমিরুল : কি নওয়াস?
নওয়াস : জাঁহাপনা, বান্দার গোস্তাখি মাফ করবেন। বুসায়না-হত্যার বিচার আমি এতক্ষণ নিজের চোখে দেখলাম। কিন্তু এতে খুনের কোন প্রমাণ হয় না।
আমিরুল : প্রমাণ হয় না?
নওয়াস : না। এক জনের জান্ ‘হালাক’ (ধ্বংস) করার আগে সমস্ত নিখুঁত প্রমাণ পাওয়া উচিত। কারণ, আমরা কেউ জানের মালিক নই। প্রাণ-ধ্বংস সহজ, সৃষ্টি অনেক কঠিন কাজ।
আমিরুল : তুমি কি বলতে চাও?
নওয়াস : এই বিচার ভুল, আলম্পানা।
আমিরুল : কেন ভুল?
নওয়াস : প্রমাণ নেই। কেউ চোখে দেখে নি।
আমিরুল : সব সময় চোখে দেখার প্রয়োজন হয় না। সাক্ষীসাবুদ এবং ঘটনা থেকেই আন্দাজ করা যায়।
নওয়াস : বিচারের ক্ষেত্রে আন্দাজের কোন জায়গা নেই।
আমিরুল : বুসায়না কি আমাখা মারা গেল?
নওয়াস : খামাখা না, আলম্পানা। কিন্তু হাব্সী জওয়ান তাকে খুন করে নি। আর এতো খোদ্কসী–আত্মহত্যার ব্যাপার।
আমিরুল : কিন্তু গোলাম নিজের সাফায়ে একটা কথা পর্যন্ত বললে না, মুখ খুললে না। তা কি অভিযোগ স্বীকার নয়?
নওয়াস : না জাঁহাপনা। আর স্বীকার করলেও ক্ষেত্র অনুযায়ী অনেক সময় খুন স্বীকারকারীর উপর বর্তায় না। বেটার হত্যাপরাধ অনেক সময় কি পিতা নিজের কাঁধে তুলে নেয় না?
আমিরুল : কিন্তু এই গোলাম সব কিছু করতে পারে।
নওয়াস : না, জিল্লুল্লাহ। ও কালো গোলাম কালো পাথর। স্তব্ধ। কালো পাথর কোনদিন নকল হয় না। সাদা আর ঝলমলে পাথরই সহজে নকল করা যায়।
আমিরুল : আবু নওয়াস, তুমি কি বলতে চাও, আমার বিচার ভুল?
নওয়াস : হ্যাঁ, আলম্পানা।
আমিরুল : ভুল? আবু নওয়াস, তোমার জিভ সামলাও।
নওয়াস : জাঁহাপনা, ভুলকে ভুল বলা কবিদের ধর্ম। আমরা শুধু সুন্দরের পূজারী-ই নই।
আমিরুল : আমি ভুল বিচার করি?
নওয়াস : জিল্লুল্লাহ, ইনসান ভুল করে বসে বৈকি। আমরা জানি, আমিরুল মুমেনীন ফেরেশতা নন।
আমিরুল : নওয়াস, চুপ–চুপ! তোমার বেয়াদবি আমি ক্ষমা করব না।
নওয়াস : জাঁহাপনা, আলহাক্কো মোর্রুন–সত্য তিক্ত পদার্থ, তা আপনি জানেন।
আমিরুল : আবু নওয়াস, তুমি হদ্ ছাড়িয়ে যাচ্ছ। আমার কাজী-আমির-ওমরা–এত লোক, যারা প্রতিদিন বিচার করে তারা ত বিচারে কোন ভুল দেখল না।
নওয়াস : জাঁহাপনা, তারা যখন অপনার চোখ দিয়েই দেখে, তখন নিজেদের চোখ ব্যবহার করে না। আর যখন নিজেদের চোখও দেখার কাজে লাগায়, তখন আপনার চোখের ঝিলিক তারা আগেই দেখে নেয়।
আমিরুল : উপস্থিত এত শরীফ মানুষদের তুমি বেইজ্জৎ করছ, আবু নওয়াস।
নওয়াস : না জাঁহাপনা। নওয়াস মদ্যপ। মাতালেরা দুনিয়ার কারো উপর শক্রতা করে না–এক নিজের উপর ছাড়া। কাউকে বেইজ্জৎ করা আমার খলতের বাইরে।
আমিরুল : অর্থাৎ আমার ইন্সাফ ভুল।
নওয়াস : হাঁ, আলম্পানা।
আমিরুল : খামুস্, নওয়াস। তোমার বুকের পাটা আল্লার জমিন ছাপিয়ে যাচ্ছে। বেয়াদব ইনসানকে আমি মাফ করি না। তোমাকেও মাফ করব না। শুধু এক শর্তে, তুমি ক্ষমা পেতে পারো–এই উপস্থিত শরীফ ব্যক্তিদের কাছে যদি মাফ চাও। নচেৎ–
নওয়াস : নওয়াস আপনার দরবারে কোন গুনা করে নি, জাঁহাপনা।
আমিরুল : তুমি মাফ চাও।
নওয়াস : বেকসুর নিরপরাধ কিভাবে ক্ষমা চাইবে?
আমিরুল : মাফ চাও।
নওয়াস : আপনি আমাকে এই কাজ থেকে মাফ করুন।
আমিরুল : নওয়াস, তুমি বেয়াদব নও শুধু। না-ফরমান। গোলামের সঙ্গে তোমারও গর্দান ধূলায় লুটিয়ে পড়ুক–। মশ্রুর–
নওয়াস : জাঁহাপনা, আপনার যা মরজী। কিন্তু জাঁহাপনা মনে রাখবেন, আপনার সাধের বগ্দাদকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আজ আমি আমার গর্দান বাড়িয়ে দিলাম কারণ এই বহূদাদকে আমি ভালবাসি, আমার জন্মভূমি বগ্দাদ। ভবিষ্যতের একটি মানুষ অন্ততঃ বলবে, বগ্দাদ অবিচারের কাছে মাথা নোয়ায় নি। জাঁহাপনা—
আমিরুল : মশ্রুর একে আজ কয়েদখানায় রাখো, কাল দরবারে আবার নতুন বিচার হবে এই না-ফরমান, অবাধ্য কবির।
নওয়াস : জাঁহাপনা, একটা কথা বলবার দাবি জানাচ্ছি। বগ্দাদকে আপনি যেমন ভালবাসেন, তেমনি আমিও ভালবাসি। কিন্তু আপনার বগ্দাদের কোন ঐশ্বর্যই টিকবে না। টিকে থাকবে শুধু বগ্দাদের বিবেক এবং বিবেক-সাধনা। ও কেউ ধ্বংস করতে পারে না। ধ্বংসস্তৃপের নিচে পড়ে থাকলেও ওর কণ্ঠধ্বনি অনাগত মানুষ শুনবে–তারা বগ্দাদকে বাঁচিয়ে তুলবে। তাই আজ অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ালুম। যে-বীজ আপনি রোপণ করেছেন, তাই একদিন বগ্দাদকে গ্রাস করবে। তাই আবু নওয়াস আজ বন্ধ সাজল। নিজের হাতে নিজের গর্দানকে গেন্দুয়ার মত ছুঁড়ে ফেলে দিলে যেন বগ্দাদের বিবেক আবার চীৎকার দিয়ে উঠতে পারে, “আমি কবি, চিরন্তনের কণ্ঠস্বর! মরুরের তলওয়ার, আমিরুল মুমেনীনের ভ্রূকুটি-দণ্ড কবির হলকুমের (গ্রীবা) নিকটে পৌঁছাতে পারেনা। বগ্দাদের প্রেম আমাকে বানিয়েছে কবি, বগ্দাদের প্রেম আমাকে করে তোলে শহীদ। কবিরা নিত্যকার শহীদ–কারণ, জীবনকে সব সময় তারা পিছনে ফেলে চলে। জীবন থেকে জীবনান্তর। কবিরা তাই মাত্র একটি বার পুনরুজ্জীবনের স্বর্গলোভী শহীদ নয়। তারা বাঁচে, আবার শহীদ হয়; শহীদ হয়, আবার বেঁচে ওঠে। জীবন-মৃত্যুর সাময়িক ফারাকে তাই তারা বিহ্বল হয় না, শঙ্কাত্রাসে ধূলায় লুটিয়ে পড়ে না। কবিমাত্রই রক্তবীজ, বিবেকের নিষ্কাম সাধক। চলো মশ্রুর। নিয়ে চলো। তোমার তলওয়ারের ধার এতদিন কোন মানুষ স্পর্শ করে নি। এবার অন্ততঃ সে কলঙ্ক থেকে রেহাই পাবে। আদাব, আমিরুল মুমেনীন।”
“আরো বলোম, মশ্রুরের সঙ্গে যেতে যেতে”–হঠাৎ সরাইখানার আর এক কোনায়। দেখা গেল, এতক্ষণ ভিড়ে দণ্ডায়মান এক ব্যক্তি প্রথম বক্তার বাক্য সমাপ্তি-মাত্র কথা। বলতে বলতে অগ্রসর হচ্ছে। ভিড় ঠেলে এগোয় সে। মুখে কথা, “বলোম, বগ্দাদের নর-নারীর কান্নায় আমি কাঁদি, তাদের আনন্দে আমি হাসি–তারাই আমার শ্রেষ্ঠ সান্ত্বনা, শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। তারাই আমার কবিত্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাদের জীবনযাত্রার ধারাই আমার রসের উৎস। মশ্রুর আমার কোন দুঃখ নেই। বগ্দাদের বাসিন্দা আমার ভীরু বুকে সাহস যোগায়। তাদের কথা আমার ঘুমন্ত কথাকে জাগিয়ে তোলে। তাই মৃত্যুতে আমার দুঃখ নেই। কারণ, বগ্দাদের বন্ধুগণ–।”
বক্তা ততক্ষণে অভিনেতা-নওয়াসের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
সকলে আনন্দে চীঙ্কার দিয়ে ওঠে, “আবু নওয়াস, আবু নওয়াস।”
“বগ্দাদের বন্ধুগণ, তোমাদের ভালবাসায়, তোমাদের কবি আবার তোমাদের মাঝখানে ফিরে এসেছে। আমিরুল মুমেনীন পরে নিভৃতে মশ্রুরকে আমার সামনে বললেন, “একজন নিরীহ কবিকে খুন করে–বগ্দাদবাসীদের আমি কি জবাব দেব? তাই বন্ধুগণ, তোমাদের নিকট, তোমাদের নিঃশ্বাসের উত্তাপে চাঙ্গা আবু নওয়াস এইখানে দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্যুর পর ফেরেশতা যদি জিজ্ঞেস করে, তুমি বগ্দাদে না বেহেশতে যেতে চাও? আমি জবাব দেব, বগ্দাদে।”
“আহ্লান সাহলান ইয়া আবু নওয়াস, স্বাগতম, হে আবু নওয়াস”। চারিদিক থেকে রব ওঠে।
“কিন্তু, বন্ধুগণ, সরাইখানা নীরব কেন? জল্লাদের হাতে যদি আমার গর্দান যেতো, তোমরা কি সরাইখানা জমিয়ে তুলতে না? একটি মানুষের মৃত্যু এভাবে দেখা উচিত নয়। আমি ত জীবনের কবি। তোমাদের স্তব্ধ দেখলেই আমার আত্মা বিষণ্ণ হয়ে পড়ত। আকাশের কোন নক্ষত্র খসে গেলে কি অন্যান্য তারা নিজের কর্তব্য ভুলে যায়? রবং সেই শূন্য জায়গা পূরণে এগিয়ে আসে নব উজ্জ্বলতায়।–এসো, সরাইখানা আমরা আজ ভর-পেয়ালা করে তুলি। নতুন গজল শোনাব আমি। আনন্দ কর বগ্দাদবাসী। মওজ-তরঙ্গ তোলো অঙ্গ-সমুদ্রে, চিত্ত অরণ্যে, রুবাব পান্থপঞ্চমে–
সুরে, সুরায়, নৃত্য চঞ্চলতায়, স্বর-মুক্তির স্বচ্ছন্দতায় সরাইখানায় আবার বন্যা ডাকল।
উচ্চ চত্বরে উপবিষ্ট নওয়াস।
আনন্দস্রোত নানা দিক থেকে ওই খানে আছড়ে পড়ছে।
নওয়াসের সম্মুখে পানপাত্র।
কিন্তু তার দুই চোখ বিবাগী। এই প্রাণ-প্রবাহে কি যেন বার বার খুঁজতে লাগল।
২০. আমিরুল মুমেনীনের মহল
আমিরুল মুমেনীনের মহল।
নিশীথ রাত্রি।
–কে?
–মশ্রুর, জাঁহাপনা।
–গোলামকে এনেছো?
–হাঁ, জাঁহাপনা।
–ওকে পৌঁছে দিয়ে, তুমি বাইরে যাও। ওর সঙ্গে আমার কিছু গোপনীয় কথা আছে।
–আস্সামায়ো তায়াতান।
(শৃঙ্খলাবদ্ধ তাতারীর প্রবেশ। সমস্ত শরীর কোড়াঘাতে জর্জর। দেহ প্রায় ত্বকহীন। কপালে, গণ্ডদেশে দগদগে ঘা) তাতারী, জানি, তুমি আমার কথার জবাব দেবে না। কিন্তু আজ খলিফারূপে আমি তোমাকে ডাকি নি।
তাতারী : [কণ্ঠে ঘড়ঘড় শব্দ। শ্বাস-কষ্ট।]
হারুন : আজ তোমার হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু-রূপে তোমাকে এইখানে ডেকে এনেছি। তুমি দেখছো, বাইরের বাতাসের কত দাম। আমি তোমার সমস্ত মঙ্গলের জন্য প্রস্তুত। আমাকে ভুল বুঝো না।
তাতারী : (খলিফার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু চোখ স্ফীত। ফলে তাকানো কষ্টকর।]
হারুন : তুমি একটিবার হাসো। তাহলে তুমি যা চাও, তাই পাবে। আমার সুদক্ষ হেকিম রয়েছে, তারা শরীর সাত দিনে আবার পূর্বের মত চাঙ্গা করে তুলবে। তোমার একটা হাসি শুধু প্রয়োজন। জবাব দাও।
তাতারী : [নিরুত্তর]
হারুন : আবু নওয়াসের কাছে আমি অপদস্থ। তুমি নাকি আর কোনদিন হাসবেই না। কিন্তু কেন? কেন তুমি জীবনের পেয়ালা এমনভাবে পায়ে ঠেলে দিচ্ছ? তুমি নওজোয়ান। জীবনের সমস্ত সড়ক তোমার জন্য দু’পাশে ফল-ফুল। নিয়ে অপেক্ষা করছে। আর তুমি নিজের দুই চোখ যেন অন্ধ করে দিয়েছ। কানে আর শ্রুতিশক্তি রাখো নি। কেন? এই নিশীথ রাত্রি, কেউ শুনবে না। তুমি শুধু জবাব দাও, আমি পাক কোরান ছুঁয়ে কসম করছি—তোমার নালিশের ভিৎ আমি উপড়ে ফেলতে চেষ্টা পাব। তস্বী হাতে কবীর মত আমাকে ভণ্ড মনে করো না আমার কসমের দাম আছে।… তবুও তুমি নিরুত্তর! কি চাও তুমি? একটা গোলামের যা কাম্য, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশী, অনেক কিছু তোমাকে দিয়েছিলুম, তুমি নিলে না। এত জুলুম সহ্য করছ, অথচ তোমার কথা যেখানে কাজে পরিণত হতে পারে সঙ্গে সঙ্গে… সেই সুযোগ তুমি নিচ্ছ না। আমি নিজে ভেবে পাই নে। তোমরা কি আর। কোন ধাতুতে গড়া? একটা জবাব দাও…[পায়চারী রত] একটা জবাব… একটা হাসি… আচ্ছা, হাসি জাহান্নামে যাক, একটা জবাব দাও। আমি তোমার সব অপরাধ মাফ করে দেব। যা চাও তাই পাবে। সময় দিলুম … বুঝেছি, তুমি … নির্বাক থাকবে, হাসবে না … বেশ। যাও। তোমাকে তিন দিনের মেয়াদ দিলুম। শুধু একটি হাসি হেসে তুমি জীবনের সবকিছু অধিকার ফিরে পেতে পারো। নচেৎ আরো শাস্তি–হ্যাঁ, শাস্তি–যা কোনদিন তুমি কল্পনাও করো নি। তোমাকে ভেবে দেখার সময় দিলুম।…
(হাততালি প্রদান) মশ্রুর—
মশ্রুর : জাঁহাপনা!
হারুন : মশ্রুর, গোলামকে নিয়ে যাও।
মশ্রুর : আস্সামায়ো তায়াতান।
হারুন : মশ্রুর,–না থাক, আর একদিন বলব।
[সকলের প্রস্থান]
২১. নহরে জুবায়দার তীর
নহরে জুবায়দার তীর। বিকাল বেলা। খর্জুরবীথির পাশে একটা টিলার উপর আতাহিয়া ও আবু নওয়াস উপবিষ্ট।
আতাহিয়া : নহরে বাতাসের দোলা লাগছে, দ্যাখো দ্যাখো, নওয়াস।
নওয়াস : নারীর স্নেহ পানি-রূপে এখানে বিগলিত হয়ে ঝরে পড়ছে, আতাহিয়া। আহ্, মানবের প্রেম-মমতা যদি এমনই রূপ পেতো!
আতাহিয়া : কিন্তু তুমি দিন দিন এমন উদাসীন হয়ে যাচ্ছ, আমার আর ভাল লাগছে না, আবু নওয়াস। তুমি আর উচ্ছলিত ঝর্ণা নও।
নওয়াস : আতাহিয়া, সাহারা মশ্রুর অনেক নিচে পৃথিবীর বুক যে-পানি সঞ্চিত রেখেছে–তা কি শান্ত, অনুচ্ছল?
আতাহিয়া : তা নয়।
নওয়াস : মাঝে মাঝে উপরে সব শুকিয়ে ফেলতে হয়, ভেতরে সরস তাজা থাকার জন্যে।
আতাহিয়া : কিন্তু আমি তোমার স্তব্ধতা সইতে পারি নে। উপরিভাগ শুকিয়ে ফেলতে যে অনেক কষ্ট, নওয়াস।
নওয়াস : তা ত হবেই। সকলের কথা তোমার মুখ দিয়ে বলার ভার যে নিয়েছ, বন্ধু। তোমার একার বোঝা ত হালকা। কিন্তু শত-সহস্রের বোঝা যখন তোমার কণ্ঠে চাপে—তখন? কে চায় শুকিয়ে সাহারা হতে? কিন্তু প্রাণধারা সঞ্জীবনের জন্য এই বিশুষ্কতাই মাঝে মাঝে বেছে নিতে হয়।
আতাহিয়া : চলো, কোন সরাইখানায় যাই।
নওয়াস : আমি এখন সরাইখানার দর্শক, শরীকদার নই।
আতাহিয়া : তুমি চলো।
নওয়াস : দর্শনকার আর শরীকদার-রূপেই জীবনকে মেলাতে হয় তবেই জীবনের শতদল ফোটে। চলো।
আতাহিয়া : কি চুপ করে যেয়ো না। তোমার কথাই ত আমি শুনতে চাই।
নওয়াস : তা হলে এই বুকে কান পাতো, মুখের দিকে তাকিয়ো না।
আতাহিয়া : যথাদেশ। তা-ই শুনব বন্ধু। চলো, তার আগে কোন পানশালার ওতে আড়াল হয়ে নিই।
নওয়াস : চলো।
২২. কারাগারের চত্বর
সময়, গোধুলি বেলা। স্থান, কারাগারের চত্বর। হারুনর রশীদ, মশরুরের প্রবেশ। চত্বরের পাশে দণ্ডায়মান তাতারী ও কোড়াদার। তাতারীর হাতে-পায়ে জিঞ্জির। কোড়াদারের হাতে চাবুক। চত্বরের দুই ভাগ। একদিক উঁচু। অন্যদিক কয়েদীর অবস্থানভূমি। সেদিকটা নিচু।
হারুন : তাতারী, তিন দিনের জায়গায় তিন বৎসর কেটে গেল। তোমার জীবনের মেয়াদ বহু দিনদিন বাড়িয়ে দিয়েছি। আজ কিন্তু আমি বোঝাঁপড়া করতে চাই। বাজি ধরে, বন্ধুদের কাছে আমি হেরেছি। কিন্তু আর না…। তোমাকে। আমি শেষ সুযোগ দিতে চাই। জবাব দাও…
[তাতারীর দিকে তাকাল। সে নিশ্চল পাথরের মত দণ্ডায়মান। সমস্ত শরীরে চামড়া নেই বললেই চলে। অবয়ব কিন্তু পূর্বের মতই আছে। নির্যাতনে তা ক্ষয়ে যায় নি। তাতারী অবশ্য পৃথিবীকে আর সম্পূর্ণ দেখে না। দুই স্ফীত ভুরু চোখের উপর ঝুলে পড়েছে। চাবুকের আঘাত-ফল।]
জবাব দাও… আবু নওয়াস বলেছিল, তুমি কালো পাথর। সত্যই তুমি কালো পাথর। তোমার শরীর কি ফুলাদের মত ইস্পাতে গড়া? চাবুকের ঘায়ে তুমি নাকি আর্তনাদ পর্যন্ত করো না। সত্যি কোড়াদার?
কোড়াদার : জাঁহাপনা, বহুদিন আপনার নেমক খেয়েছি। কিন্তু এমন হিমাকাওয়ালা কয়েদী আমি কোনদিন দেখি নি। পিটে পিটে ওকে দুরস্ত করলেও, ও শব্দ করে না, আওয়াজ তোলে না।
হারুন : কি করে?
কোড়াদার : দেখবেন, আলম্পানা?
হারুন : হা, সেই জন্যেই ত এসেছি।
কোড়াদার : তবে দেখুন–
[কোড়া চালায়। অব্যক্ত যন্ত্রণায় তাতারী শুধু দক্ষ অভিনেতার মত মুখমণ্ডল বিকৃত করে, আর হাঁপায়]
হারুন : খামুস, কোড়াদার আর কি করে?
কোড়াদার : জাঁহাপনা বেহুঁশ হয়ে যায়। কিন্তু তখনও গোঙায় না, আর্তনাদ করে না। জনাব, এ কয়েদী ইন্সান নয়। জীন, দেও বা পাথর।
হারুন : যা কোড়াদার, তুই বাইরে যা। কোড়া মশরুরের হাতে দে। যে হাতে মশ্রুর তলওয়ার চালায়, সেই হাতে আজ কোড়া চালাবে।
কোড়াদার : জো হুজুর, জাঁহাপনা।
[মরুরের হাতে কোড়া-প্রদান এবং প্রস্থান]
মশ্রুর : আলম্পানা, কয়েদীর সমস্ত শরীর থেকে প্রায় খুন ঝরছে, ওর উপর আর কোড় চালানো বৃথা। বেহুঁশ হয়ে যাবে। আর কথা বলা চলবে না–যে জন্যে আপনার এখানে আগমন।
হারুন : বেশ, কোড়া ফেলে দাও। তবে রাখো, দরকার হোতে পারে।–তাতারী, মনে রেখো আজ তোমার কেয়ামৎ। আজরাইলও (যমদূত) আজ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। জবাব দাও–জবাব দাও। বেতমীজ গোলাম তবু স্থির নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল। মশ্রুর এই বেতমীজের জিভ টেনে টেনে ছেঁড়ার আয়োজন করতে হয়।
মশ্রুর : তা হোলে কি কথা-বলা সহজ হবে, জাঁহাপনা?
হারুন : হুঁ, মশ্রুর, সেও এক সমস্যা। ইনসানের সঙ্গে লড়া যায় কিন্তু এ ত পাথর–(পায়চারী-রত) গোলাম, তোমাকে শেষ সুযোগ দিলাম। নচেৎ–তারপর মশ্রুর তার কাজ শুরু করবে… জবাব দাও… (তাতারী নির্বিকার। শারীরিক যন্ত্রণায় শুধু মুখ কুঁচকে নিঃশ্বাস নেয় আর ফেলে) না, মশ্রুর–বৃথা কালক্ষেপ।
[হাততালি দিল। দুই জন প্রহরীর প্রবেশ]
প্রহরী : জাঁহাপনা।
হারুন : ওই কামরায় একজন জানানা অপেক্ষা করছে, তাকে নিয়ে আয়।
প্রহরীদ্বয় : আস্সামায়ো তায়াতান।
(প্রস্থান)
হারুন : (অঙ্গুলি নির্দেশ) এক আজব সমস্যা।
মশ্রুর জাঁহাপনা, সমস্যা জইয়ে রেখে লাভ কি? আপনি শুধু হুকুম দিন।
হারুন : মশ্রুর, তার জন্য এত ব্যস্ততা কেন? আমি ভাবছি—
মশ্রুর : আলম্পানা, কি ভাবছেন?
হারুন : ভাবছি, এত দৈহিক যন্ত্রণা এরা সহ্য করে কিভাবে?
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আবু নওয়াস বলে–মানুষ আনন্দাতীত আরো কিছু পায়, যার কাছে এই যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা মনে হয় না।
হারুন : আনন্দাতীত–ও একটা পাগলের প্রলাপ। আবুনওয়াসই তা বলতে পারে।
মশ্রুর : আমি কিন্তু এই কয়েদীকে দেখে তা প্রায় বিশ্বাস করতে বসেছি।
হারুন : তুমিও বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছে।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, অথবা এরা বোধ হয় মানুষ নয় অথবা মানুষ যা দিয়ে তৈরি এদের উপাদান তার চেয়ে আলাদা।
হারুন : তোমার পাগল হতে বেশি দেরী নেই। এই দ্যাখো…
[এতক্ষণ তাতারী দাঁড়াইয়াছিল। শরীরে বোধ হয় অব্যক্ত যন্ত্রণা, তাই ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িল। জায়গাটা বালুময়। হতব্যক্তির রক্ত পরিষ্কারের সুবিধার জন্য এই ব্যবস্থা। তাতারী বসিয়া পড়িল। তারপর দুই গোড়ালি চাপিয়া ধরিয়া মাথা দুই হাঁটুর মধ্যে খুঁজিয়া দিল। সবই নিঃশব্দে ঘটে।]
মশ্রুর : জাঁহাপনা–
হারুন : আস্তে আস্তে, মশ্রুর।
[দুই জন ফিসফিস্ কণ্ঠে কথা বলে]
আস্তে, একটু বিশ্রাম নি।
মশ্রুর : ওর বিশ্রামের প্রয়োজন নেই।
হারুন : আছে। একটু তেজ সঞ্চয় করে নি।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, তেজের উৎস আনন্দ। ওর তেজ হয়ত সেই এক জায়গা থেকেই আসে।
হারুন : মশ্রুর। তুমি বড় বাজে বকো। শুধু দেখো, দেখো। ওর তেজের সব পরীক্ষা নেওয়ার বন্দোবস্ত করেছি আজ। এই গোলাম—
[কথার ছেদ পড়ে। মেহেরজানের প্রবেশ। পরনে রেশমি লেবাস। যৌবন সর্বাঙ্গে ক্ষমাপ্রার্থীর মতো লুটাইয়া পড়িতেছে। চোখেমুখে হাসির ঝিলিক ছাপাইয়া ওঠে। আপ্ত-রমণীর মতো চলাফেরা।]
মেহেরজান : জাঁহাপনা, কোথায় আপনার তামাসা? আমি—
হারুন : হঠাৎ পেছন ফিরে ধীরে, আস্তে—
[এবার সকলে খুব নিচু গলায় সংলাপ-রত]
মেহেরজান : বহুৎ আচ্ছা। কিন্তু আপনার তামাশা কোথায়? আমি ত কোতোয়ালের মাকানে বসে বসে হয়রান। শেষে আপনার ডাক যে পড়ল, তার জন্য শুরিয়া, ধন্যবাদ—
হারুন : তামাশা নিশ্চয় দেখবে।
মেহেরজান : কিন্তু কোথায়?
হারুন : আছে, বেগম সাহেবা।
মেহেরজান : কিন্তু কই?
হারুন: [উপবিষ্ট তাতারীর দিকে নির্দেশ] ওই—
মেহেরজান : ও কে?
হারুন : একটা নাফরমান, অবাধ্য কয়েদী, আমার কথার কোন ইজ্জৎ রাখে না।
মেহেরজান : ওর গর্দান দু-টুকরা করেন। ওর অপরাধ কি?
হারুন : তার শুমার নেই।
মেহেরজান : তবু—
হারুন : আমার অবাধ্য গোলাম।
মেহেরজান : চাবুক লাগান।
হারুন : তা-ই লাগিয়ে লাগিয়ে ত শরীরের ওই দশা।
মেহেরজান : বেশ করেছেন। কিন্ত গোলামটা কে?
হারুন : বলছি, সব বলব তোমাকে।
মেহেরজান : কে এই গোলাম, মশ্রুর?
হারুন : মশ্রুর ওর নাম জানে না।
মেহেরজান : তা মশ্রুর নিজের মুখেই বললে পারে। গোলামটা কে?
হারুন : তুমি এগিয়ে গিয়ে নিজেই জিজ্ঞাসা কর না।
মেহেরজান : বেশ।
[অগ্রসর হইয়া চত্বরের কিনারায় আসে,তারপর বেশ জোরেই ডাক দেয়। এরপর স্বাভাবিক কণ্ঠে সব সংলাপ]
কে–তুমি কে?
[হাঁটুর মধ্যে মুখ গোঁজা তাতারী প্রথম ‘ক’ শব্দে বিদ্যুৎ-স্পৃষ্টের মত মাথা তোলে। তারপর ধীরে ধীরে মেহেরজানের দিকে দৃষ্টি-নিবদ্ধ রাখিয়া খাড়া হয়।]
তুমি কে?
(তাতারী উদভ্রান্তের মত জিঞ্জির-বাঁধা দুই হাত তোলার চেষ্টা করে]
কে তুমি?
[কোন জবাব আসে না। পেছনে ফেরে মেহেরজান]
কে এই গোলাম, আমিরুল মুমেনীন?
হারুন : তুমিই জিজ্ঞেস কর, জবাব নাও।
মেহেরজান : (মুখ ফিরাইয়া) তুমি কে? জবাব দাও। জবাব দিচ্ছে না কেন? (আবার খলিফার দিকে) কে এই গোলাম, জাঁহাপনা? ও জবাব দিচ্ছে না।
হারুন : জবাব আদায় কর।
মেহেরজান : তুমি কে?
[তাতারী নিরুত্তর]
হারুন : এ-কে চেনো না?
মেহেরজান : না।
হারুন : মশ্রুর, হাহ্ হা, মশ্রুর।
[হাসিতে লাগিল। বাধা]
মেহেরজান : হাসি বন্ধ করুন আমিরুল মুমেনীন। কে এই গোলাম?
হারুন : তুমি এ-কে চেনো না?
মেহেরজান : দুনিয়ার তামাম মানুষ কি আমার জানা যে এ-কে চিন্ব?
হারুন : হাহ্ হা।… জিজ্ঞেস কর তোমাকে চেনে কি না।
মেহেরজান : জাঁহাপনা, কয়েদখানার এই অন্ধকারে এই বুঝি আপনার তামাশা? আমি বাইরে চলোম।
হারুন : তা যাও। কিন্তু তার জন্যে সারাজীবন আফসোস করতে হবে।
মেহেরজান : কেন?
হারুন : তুমি ওকে চেনো।
মেহেরজান : চিনি?
হারুন : হাঁ। ওই কোঁকড়া-কঠিন চুলের দিকে তাকাও। গায়ের চামড়া তো আর কালো নেই। চুল ঠিক আছে।
মেহেরজান : তুমি কে কয়েদী? জবাব দাও।
হারুন : হাহ্ হা। চার বছর ধরে আমরা জবাব পাই নি, আর তুমি। এই কয়েক লহমায় উত্তর পাবে।
মেহেরজান : কিন্তু এ কে? আমি চিনতে পারছি নে, জাঁহাপনা।
হারুন : হাহ্ হা। চিনতে পারলে না? গোলাম তাতারীকে আজ চিনতে পারলে না, মেহেরজান?
মেহেরজান : তাতারী… তাতারী… কিন্তু তাতারীর এই দশা কেন?
হারুন : নাফরমান অবাধ্য। তাই–
মেহেরজান : নাফরমান। কি ওর অপরাধ? হারুন : মুখের কথা বন্ধ করেছে। ওকে কি না দিয়েছিলুম। বাগবাগিচা তয়খানা,
বাদী গোলাম ইমার–সব ইকার ঘৃণা করলে। বন্ধ করলে মুখের কথা। তাই চার বছর ধরে, তিলে তিলে শায়েস্তা হচ্ছে–
মেহেরজান : ইন্কার করলে?
হারুন : হ্যাঁ।
মেহেরজান : ইন্কার করলে [একটু অগ্রসর হয়, পরে পেছনে ফিরিয়া]… জাঁহাপনা, যে নাফরমান তাকে কতল করেন নি কেন?
হারুন : হিমাকতের শাস্তি দেব বলে।
মেহেরজান : সে শাস্তি ত অনেক পেয়েছে। আজ এখনই ওকে কতল করুন। হুকুম দিন, মরকে।
হারুন : তোমার পরামর্শে হবে না, মেহেরজান। আজো ও কথা বলুক, ওর সব অপরাধ আমি মাফ করে দেব।
মেহেরজান : তাতারী, কথা বল, জবাব দাও। খোদ্ আমিরুল মুমেনীন ওয়াদা করেছেন। কথা বল। তোমার সমস্ত শরীর জখমে-খুনে জারেজার। এই জর্জর দেহের যন্ত্রণা আর কেন সহা করবে? কথা বল।
(তাতারী নিরুত্তর)
হারুন : হাহ্ হা। জবাব আদায় কর, মেহেরজান।
মেহেরজান : তাতারী, খোদার ওয়াস্তে–একবার কথা বলা। বল… [হারুনর রশীদ হাসিতে লাগিলেন। হাসি থামিলে] জাঁহাপনা, ওকে কতল করুন। ওর এই কষ্ট আর সহ্য করা যায় না। হুকুম দিন মশ্রুরকে।
হারুন : না, মেহেরজান। কতল আমি ওকে করব না। জীবনকে যে পাশার ঘুটি বানাতে পারে এত সহজে, তাকে হত্যা করব না। তিলে তিলে দগ্ধে দগ্ধে—
মেহেরজান : না, জাঁহাপনা, এত নিষ্ঠুর হবেন না। দয়া করুন।–
[নতজানু]
আমি আপনার কাছে দয়া ভিক্ষা চাইছি, ওকে কতল করুন।
হারুন : না, না–তা হবে না।
মেহেরজান : হবে না?
হারুন : না।
মেহেরজান : (উদ্ভ্রান্ত) হবে না… তোতারীর দিকে অগ্রসর কথা বল, তাতারী। তুমি এমন নির্বোধ কেন? স্বপ্নভাঙার পর স্বপ্নে-দেখা ধন-দৌলত হারানোর শোকে কেউ কোনদিন কাঁদে নাকি–এক নির্বোধ ছাড়া। নিজেকে কেন এইভাবে চুরমার করে ফেলছ? কথা বল। আমিরুল মুমেনীন ওয়াদা করেছেন… কথা বলো … আমি তোমার দিকে চেয়ে রইলাম, কান পেতে রইলাম…
[তাতারী নিরুত্তর। খলিফা হাসিয়া উঠিলেন। হাসি থামার পর, মেহেরজান ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়, একদম তাতারীর কাছে বালুভূমির উপর] কথা বলো, আমি অনুরোধ করছি। কথা বলো….
তুমি যা বলতে, তুমি কি এত যন্ত্রণা বুকে আজও তাই মনে রেখেছ। তুমি বলতে, “মেহেরজান, গোলামের মহব্বৎ আর এক আলাদা চিজ। তা। আমির-ওমরার মহব্বৎনয়। তারা দৌলতের কদর বোঝে। আর দৌলতের বড় গুণ হল বিনিময় আর হাতফেরী হওয়া। হস্তান্তর ছাড়া তার গুণ প্রকাশ পায় না। আমির-ওমরার মহব্বৎ এই হাতফেরীর মহব্বৎ। গোলামের প্রেম ধ্রুবতারার মত স্থির–আকাশের একটি প্রান্তে একাকী মৌন–অবিচল–রোরুদ্যমান) তুমি তেমনই অবিচল আছ। কিন্তু আমি… আমি ত বিনিময়ের ভাটিতে সিদ্ধ হয়ে গেলাম। আর বান্দী থলািম না। কোড়াঘাতের এত ব্যথা বয়েছ, এস মুছিয়ে দিই মুছিয়ে নিই–
[মেহেরজান হস্ত প্রসার মাত্র]
হারুন : শান্ত্রী শান্ত্রী—
[দুই প্রহরীর প্রবেশ]
শান্ত্রী, যা এই বিবি সাহেবকে বাইরে নিয়ে যা।
মেহেরজান : [আর্তস্বর] না, না।
হারুন : সরম করিস নে, প্রহরী। দুইজনে দুই হাত ধর।
[তথাকরণ, টানিতে টানিতে অগ্রসর]
মেহেরজান : [পশ্চাতে মুখ] তোমার যন্ত্রণা মুছে নিতে পারলাম না, তোমার নির্মল দেহ স্পর্শের যোগ্যতা আমার নেই … নাই বা স্পর্শ করলাম এই কলঙ্কিত হাতে [চিৎকার] তাতারী– তাতারী–
[কারাগার হইতে অপসৃয়মান মুখ, শেষবার মেহেরজান ডাকে : তাতারী]
তাতারী : (সেই দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ) মেহেরজান, মেহেরজান (তারপরই) শোন, হারুন রশীদ—
হারুন : বেতমীজ, জাঁহাপনা বল।
মশ্রুর : বেয়াদব। বল্ আমিরুল মুমেনীন।
তাতারী : শোন, হারুনর রশীদ–
হারুন : কোড়াদার মশ্রুর, মশ্রুর, কোড়া চালাও। বেয়াদব, বেয়াদব–
[কোড়া চালাইতে থাকে সেই অবস্থায়]
তাতারী : শোন, হারুনর রশীদ। দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দী কেনা সম্ভব–! কিন্তু—কিন্তু–ক্রীতদাসের হাসি—না–না–না–
[পতন ও মৃত্যু, বেগে আবু নওয়াসের প্রবেশ]
নওয়াস : আমিরুল মুমেনীন, হাসি মানুষের আত্মারই প্রতিধ্বনি।
[এই খানে পাণ্ডুলিপি ছিন্ন]
অসমাপ্ত