আতিকুল ইসলাম প্রধান, বি.এসসি. কে পেয়ে বেলাল মাস্টার যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যান। পছন্দ না করার কোনো যুক্তি নেই। আলাদা জায়গা তো তার নেই। একই উঠোনের একদিকে একখানা শুধু ঘর তুলে দেবেন, কেন পারবেননা—খুব পারবেন। মেয়ের মা খুঁতখুঁতে করে উঠেছিল ছেলের নাকি বয়স বেশি। তা হোক বয়স বেশি, বউকে ধমকে উঠেছিল বেলাল মাস্টার। বলেছিল, তোমার মেয়ের বয়স কি কম, এ্যাঁ? বলো, কম তোমার মেয়ের বয়স?
ধমকে উঠলে কী হবে, বেলাল মাস্টার নিজেও জানজ্ঞে ছেলের বয়স মেয়ের। তুলনায় বেজায় বেশি, ১৯৭২ সালে স্কুলের পড়া শেষ করলে ১৯৯৪ তে কত বয়স হয় ছেলের! কম করে হলেও ৩৭/৩৮। তাহলে? ২৩/২৪ বছরের মেয়ের বয়স হলে ফারাকটা কতো হয়?
হোক ফারাক, বেলাল মাস্টার কথার নড়চড় করেন না। পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনমোহরের পঁচিশ হাজার টাকা উসুল দেখিয়ে কাবিননামায় সই হয় শাহিনা আখতার বেগমের। বাপের বাড়ি থেকে বিদায় দেওয়া হয় না তাকে। বাপের বাড়িরই একখানা ঘরে সে একজন পুরুষ মানুষকে নিজের বিছানায় পেয়ে যায়। তারপর আটটা বছর পার হয়ে গেল। এখন কি তার অন্য কিছু ভাব্বার উপায় আছে? বাপের বাড়িতেই বা সে কয়দিন থাকতে পারবে? এখন স্বামীর ইচ্ছাতেই তার ইচ্ছা, স্বামীর খুশিতেই তার খুশি, স্বামীর পছন্দেই তার পছন্দ। এখন স্বামীর যদি সন্দেহ হয় তার ওপর, তাহলে যাতে সন্দেহ না হয়, তাকে সেইভাবে চলতে হবে। সে আর বই হাতে। তোলে না। পরীক্ষা দিয়ে বি.এ. পাস করার চিন্তাটাকে সে মন থেকে হটিয়ে দেয়। দুপুরবেলা স্বামী বাসায় ফিরলে তার সামনে দাঁড়ায়, স্নানের আগে লুঙ্গি গেঞ্জি গামছা তেল সাবান এগিয়ে দেয়, স্বামী তার দিকে তাকিয়ে হাসলে সেও পাল্টা হাসে। ঘাড়ে হাত চাপলে সে আরও গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। কোনো কোনোদিন আতিকুল ইসলাম আট বছরের পুরনো বউয়ের বুকে হাত দেয়। গাল টিপে ধরে। চুমু খাবার সময় ঠোঁট কামড়ে ধরে। কিন্তু শাহিনা আখতার উঃ আঃ কিছুই করে না—শুধুই হাসে। কখনো দুষ্টু হাসি হাসে। কখনো ধন্য হওয়ার হাসি হাসে। কখনো কৌতুকের হাসি হাসে। একইভাবে খুশি হওয়ার, কী কৃতজ্ঞ হওয়ার, কিংবা চমক লাগার হাসিও সে হাসতে পারে।
এরই মধ্যে একদিন সাবিদ আলী খবর নিয়ে আসে যে, প্রাইভেট পরীক্ষার্থীদের জন্য টেস্ট পরীক্ষার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এখন ভাবীর দরখাস্ত করা দরকার।
শাহিনা শোনে, কিন্তু দরখাস্ত দেওয়া কিংবা না-দেওয়া সম্পর্কে কিছুই বলে না। শুধু জানায় সামিনার আব্বা আসুক। উনিই যা করার করবেন।
সেদিন দুপুরে ফের আসে সাবিদ আলী। আতিককে খবরটা জানানো হলে সে একটু যেন থমকায়। তারপর গলা খুলে হাসে একদফা। হাসতে হাসতেই শাহিনাকে ডেকে বলে, দেখো কী খবর এনেছে সাবিদ আলী। তুমি কি পরীক্ষা দেবে? প্রিপারেশন হয়েছে তোমার?
শাহিনা সামনে আসে কিন্তু মুখ তোলে না। মুখ নিচু করেই জানায়না, আমি পরীক্ষা দেবো না।
সে কী! সাবিদ আলীর বিশ্বাস হতে চায় না। বলে, এ আপনি কী বলছেন? আপনি যা জানেন, রেগুলার স্টুডেন্টদের অনেকেই তা জানে না। ভাবী, প্লিজ দিন পরীক্ষাটা, দেখবেন, আপনি ভালোভাবে পাস করে যাবেন।
সাবিদ এমনভাবে বলে, যেন শাহিনার পরীক্ষা দেওয়াটা তারই কোনোরকম দায়ের ব্যাপার। সে রীতিমত অনুরোধ করে। কিন্তু শাহিনা মুখ তোলে না, তার নিচু মুখ নিচুই থেকে যায়। ওদিকে আতিকও কিছু বলে না। ব্যাপারটা তার কাছে নাটকের মতো লাগে। সে একবার বউয়ের দিকে তাকায়। একবার বাড়িওয়ালার শালার দিকে। দু’জনের ভাবসাব দেখে সাবিদ আলীর ও সম্ভবত ভাল লাগে না। সে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলে, আমি এবার যাই।
আর তখনই শাহিনা মুখ তুলে পেছনে থেকে ডাকে। বলে, তোমার বইগুলো নিয়ে যাও। ওগুলো এখানে থাকলে খামোকা নষ্ট হবে। অন্য কাউকে দিলে তার কাজে লাগবে।
সাবিদের যে কী হয় বোঝা যায় না। সে এমন ভাব দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় যে মনে হয়, শাহিনার কথা শুনতেই পায়নি।
ওদিকে আতিকুল ইসলাম কী বোঝে সেই জানে। সে বলে ওঠে, আহা ছোঁড়া বোধ হয় দিলে বড় দাগা পেয়েছে গো! তুমি ওভাবে কথাটা বললে কেন?
শাহিনা জবাবে কিছু বলে না, চুপচাপ স্বামীর সামনে থেকে সরে যায়।
আর পরের দিনই আতিকুল ইসলাম বাড়িওয়ালা সোহারাব মিয়াকে জানিয়ে দেয় যে মাসের শেষে সে বাসা ছেড়ে দিচ্ছে।
খবরটা শুনে শাহিনা থ হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, এসময় বাসা বদলালে সামিনার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে না! বছরের আর তিনটে তো মাস। ওর স্কুলের কাছে কি বাসা পাওয়া যাবে?
ধরে নাও, পাওয়া যাবে না। আতিক শান্ত গলায় বলে।
তাহলে?
তাহলে কী?
একটা বছর নষ্ট হবে না ওর?
হ্যাঁ, হবে। আতিক হাসতে হাসতে বলে, মেয়েদের দু-একটা বছজ্ঞ নষ্ট হলে খুব কি যায়-আসে?
অমন কথার পর শাহিনা বলার মতো আর কিছু খুঁজে পায় না।
দিন দুই পরে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাবার তাড়া দেখে আতিক বউকে ডেকে বলে, স্কুলে যাওয়ার জন্যে অতো তাড়া কীসের? ঐ স্কুলে তো মেয়ে আর পড়বে না। ওকে বরং তুমি বাড়িতেই পড়াও। ওতে মেয়ের ভাল হবে। একটু হেসে ফের স্ত্রীর মুখের দিকে তাকায় আতিক। তারপর চোরা হাসি হাসতে হাসতে বলে, আমার কিন্তু তোমার জন্যই বেশি চিন্তা হচ্ছে। আসলেই তোমার খুব কষ্ট হবে এই বাসাটা ছাড়লে, মেয়ের স্কুলে তোমরা বান্ধবী জুটেছিল অনেক তার ওপর সাবিদ আলীর মতো অমন একজন হ্যান্ডসাম ইয়ংম্যান নির্জন দুপুরের সঙ্গী, এমন তো সব জায়গায় পাওয়া যাবে না।