এমন অবস্থায় শাহিনার আর কী উপায়? সে পিল খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তারপর একদিন রাতে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, সামিনা তো ছ’বছরের হল, এখন আমাদের আর একজন দরকার, তাই না?
তার অমন দৃঢ় স্বরের কথার প্রতিক্রিয়ায় বীর পুরুষটির মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোয় না—যা হয় তার সবই শারীরিক এবং ধামসাধামসিটা সে রাতে এতো বেশি জোরে হয় যে দশ মাস আগে রাস্তার ধার থেকে কেনা পুরনো খাটখানি ভেঙে পড়ে।
শাহিনার ধারণা হয়েছিল তার পিল খাওয়া বন্ধের খবর এবং সন্তান ধারণের ইচ্ছা জানার পর আতিকের বাসাবদলের বাতিকটা কেটে যাবে। দেখা গেল আতিক সত্যিসত্যিই বাসা বদল সম্পর্কে কিছু বলছে না। উপরন্তু বাসায় ফেরার সময় কলাটা, কমলাটা, আপেলটা, প্রায় প্রতিদিনই আনছে। আর বাসায় ফিরতে বেশি রাতও করছে না।
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে যায়। আতিক বউয়ের মুখের দিকে তাকায়, শরীরের দিকে তাকায়। কিন্তু উঁহু! কোনো লক্ষণই আবিষ্কার করতে পারে না। শাহিনারও চিন্তা হয়, ব্যাপারটা কী? সে বাঁজাটাজা হয়ে গেল নাকি? ছবর বার্থ কন্ট্রোল করলে মেয়েরা কি বাঁজা হয়ে যায়? সে ভেবে পায় না কার কাছে জিজ্ঞেস করবে কথাটা।
তার চিন্তা হয়, কিন্তু তবু বেশি পাত্তা পায় না চিন্তাটা। কারণ পড়াশেনার দিকে ততোদিনে তার মন বেশি ঝুঁকে পড়েছে। ইতিহাসের ফার্স্ট সেকেন্ড দুটো পেপারই মোটামুটি তার আয়ত্তে এসে গেছে। এখন বাকি শুধু থার্ড পেপারটা—সে ওটা নিয়েই তখন ব্যস্ত। তাকে বই জোগানো, প্রশ্ন তার সঙ্গে আলোচনা সাবিদ আলীই করছে।
একদিন দুপুরের আগে, বেলা তখন বোধহয় এগারোটা, হঠাৎ আতিককে আসতে দেখা যায়। তখন সাবিদের সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে আলাপ করছিল। অবশ্যি সাবিদ আতিককে দেখামাত্র নিচে নেমে যায়। আর সেও চলে আসে নিজের ঘরে। তাই প্রথমে মনে হয়েছিল আতিক তাদের দেখে নি। কারণ দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া করল। রান্না খুব ভাল হয়েছে বলে প্রশংসা করল, কটার সময় মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাবে, তাও জিজ্ঞেস করল। তার অমন কথাবার্তা শুনে কে আন্দাজ করবে যে মানুষটা মনের ভেতরে অন্যরকম শয়তানি প্যাঁচ কষছে।
বিছানায় গড়িয়ে পড়ার সময় আতিক ডেকে বলে, একটা কথা শোনো, আমি কিন্তু রোজ দুপুরের আগেই বাসায় এসে যাবো, বুঝলে?
শাহিনার অবাক লাগে, কী এমন ঘটল যে সাহেবের এমন সুমতি! কথাটা তার মনে হয় কিন্তু মুখে সে কিছুই বলে না।
কী বললাম, বুঝলে? আতিক পরে জিজ্ঞেস করে। তারপরে জিজ্ঞেস করে, ঐ সময় আমি যদি বাসায় আসি তাহলে কি তোমার অসুবিধা হবে?
বাহ্, আমার কেন অসুবিধা হবে? শাহিনার রীতিমতো রাগ হয়। সে সোজাসুজি জবাব দেয়। বলে, তুমি যখন খুশি আসবে-যাবে, তাতে কার কী? তুমি সংসারের কর্তা ওভাবে ন্যাকার মতো কথা কেন বলেছে?
ও, আমি তাহলে ন্যাকামি করছি তাই না?
চোখে চোখ রেখে আতিক কুটিল হাসি হাসে। বলে, দুপুরের আলাপটা তোমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করো, নাকি ঘরের ভেতরেও তোমাদের আলাপ চলে?
শাহিনার শরীর-মন থমকে স্থির হয়ে যায়–ছি!! এসব কী বলছে মানুষটা? যার মন এতো নিচু আর প্রশ্নটা এতো নোংরা! সে কী জবাব দেবে? সে জবাব না দিয়ে বলে, তুমি তোমার নোংরা মন নিয়ে যতো ইচ্ছে নোংরা ঘাঁটো, আমি মেয়েকে আনতে স্কুলে গেলাম।
সে ঘর থেকে ঐ মুহূর্তেই বেরিয়ে পড়ে।
ফিরতে সে দেরি করে না। বলা যায় আধঘন্টার মধ্যেই সে ফিরে আসে এবং দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাবিদের সঙ্গে গল্পে আতিক মশগুল। তার ভাবসাব দেখে মনে হয়, যেন কতোকালের আপনজনের সঙ্গে কথা বলছে।
শাহিনার দৃশ্যটা দেখতে ভাল লাগে। আশা হয়, হয়তো সাবিদ আলীর সঙ্গে যে ভুল ধারণাটা আতিকের রয়েছে, সেটা কেটে যাবে। কিন্তু খানিক পরই তার মনের ঐ আশা উবে যায়।
মেয়েকে নিয়ে তখন সে খেতে বসেছে। ঐ সময় বারান্দা থেকে ঘরে এসে আতিক জানায়, আমি এবার যাই। অনেক দেরি হয়ে গেছে, সাবিদ ছেলেটা তো মহা ধুরন্ধর। সহজে কিছুই বলতে চায় না।
শাহিনা মুখের দিকে তাকালে সে ঠাট্টার ভঙ্গিতে ফের বলে, অন্য কিছু না, শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, দুপুরবেলা যে অততক্ষণ ধরে আলাপ করো, তাতে কী বুঝছো, তোমার ভাবী কি পরীক্ষা দিতে পারবে? তো ছোঁড়া স্বীকার করল যে হ্যাঁ, পরীক্ষা দিলেই পাস করে যাবে। কিন্তু এটা কিছুতেই স্বীকার করল না যে রোজ দুপুরবেলা
সে তোমার সঙ্গে আলাপ করে। যখন বললাম, যদি আলাপই না করো, তাহলে কীভাবে বুঝলে যে ও পরীক্ষা দিলেই পাস করবে? তখন আমার ঐ প্রশ্ন শুনে বাছাধন বেকায়দায় পড়ে গেল, মুখ দিয়ে আর কথা বের হয় না, বুঝলে? সব আমি বের করে ফেলতে পারি।
খাওয়া তখন লাটে উঠেছে শাহিনার। বুকের ভেতরটা ভয়ে তখন হিম। মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হয় না রাগ-ঘেন্না-বিরক্তি-এসবের শেষ সীমায় পৌঁছা’লে মানুষ কী করতে পারে? আসলে এমন অবস্থায় মানুষ কিছুই করতে পারে না। সে বোবার মতো স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে আর আতিক এমন ভাব নিয়ে বেরিয়ে যায় যে মনে হয়, সে দুনিয়া জয় করে ফেলেছে।
শাহিনা ঐ দিন থেকে চুপ হয়ে যায়। আতিকের মুখের ওপর কোনো কথা বলে। দুপুরে রোজ বাসায় ফেরে। গোসল, খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় গড়ায়, ততক্ষণে শাহিনা মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফেরে। তিনটের দিকে আতিক ফের বেরিয়ে যায়। ফেরে রাত নটার পর। টিভিতে দশটার খবর আরম্ভ হলে খেতে বসে। খাওয়া দাওয়া শেষ হরে বাসন-কোশন ধোয়া-পাকলা সেরে যতোক্ষণ পর্যন্ত বউ বিছানায় না। আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত জেগে থাকে। বিছানায় বউ এলে কাছে টেনে নিয়ে ঘাড়ে-পিঠে। হাত বোলায়। তারপর নিত্যকার গরম শরীর থেকে খালাস করে দিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়। শাহিনার কিন্তু ঘুম আসে না। এ কেমন জীবন হয়েছে তার? অতীত বর্তমান মনের ভেতরে ওলটপালট করে। মফস্বল শহরের কালো বরন মেয়ে। বাপ স্কুলের মাস্টার, ছাত্রী ভাল হলেই বা কী, মেয়ের শেষ গতি তো বিয়েতে। যতোদিন বিয়ে না হচ্ছে, ততোদিন পড়ুক। আর বিয়ে হবেই বা কীভাবে? মেয়ের বিয়ে দিতে যৌতুক লাগে না? ছেলে গ্র্যাজুয়েট হলেই তার দাম এক লাখ। আর যদি মোটর সাইকেল দিতে পারে শ্বশুর তাহলে তো আরও ভাল। মেয়ের বিয়ে সহজেই হয়ে যায়। যে পারে না, তার মেয়ের বয়স শুধু বেড়েই চলে, আই.এ. পাস করুক কি বি.এ. কিছুতেই কিছু হয় না। শাহিনার যখন ঐ রকম বয়স বাড়ছিল, বি. এ. ক্লাসের ফোর্থ ইয়ারে উঠেছে, ঐ সময় সম্বন্ধটা আসে। ছেলের আসল বাড়ি বর্ডারের ওপারে। জলপাইগুঁড়ি। এপারে বাড়িঘর, আত্মীয়-স্বজন কিছুই নেই, বি.এসসি. পাস. দিতে থুতে হবে না। ছেলের শুধু বসবাস করার জন্য বাড়ি চাই। তবে হ্যাঁ, ঘরজামাই কিন্তু সে থাকবে না।