তার আরও মনে হয়, সে যদি কাজটাজ জুটিয়ে নিতে পারে তাহলে আতিককে এখনকার মতো উদয়াস্ত খেটে বেড়ানোর দরকার হবে না। এইরকম চিন্তাভাবনা আর। আশা-আকাঙ্খ নিয়ে সে বলা যায় একরকম গুছিয়েই বসেছিল। বাড়িওয়ালার শালা সাবিদ আলীও বি.এ. পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল। খবরটা জেনে সে তাকেই ধরল বইপত্র যোগাড়ের ব্যাপারে। আতিককে কিছু বলে নি, কেননা বললে সে হাসাহাসি করবে। ভেবেছিল নিজে তৈরি হয়ে উঠতে পারলে তখন সে সবাইকেই জানাবে।
কিন্তু পারা যায় নি। মাস্টার মানুষ ঘরে বই থাকলে তার নজরে না পড়ে পারে?
প্রথম দিন ইয়োরোপের ইতিহাস বইখানা টেবিল থেকে তুলে হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, এ বইখানা কোত্থেকে এল?
শাহিনা তখন পাশের ঘরে ছিল। মেয়ে সামিনা জানিয়ে দিল, ও বই তো সাবিদ চাচার। আম্মুকে পড়তে দিয়েছে। বলেছে, আরও বই দেবে।
কবে দিয়েছে?
কেন, কাল দিয়ে গেল। আমরা স্কুল থেকে আসবার পর আমার হাতে দিয়ে গেছে।
আতিক বইখানা উল্টেপাল্টে দেখে আবার টেবিলের ওপর রেখে দেয়। দিন দুয়েক পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান-এর বই চোখে পড়লে আতিক ফের মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, সাবিদ চাচা আবার কবে এসেছিল?
বাহ্ এই তো, সকাল বেলা, যখন স্কুলে যাচ্ছিলাম, সামিনা হাসতে হাসতে জবাব দেয়।
তখন কিছু বলে না আতিক। কিন্তু রাতের বিছানায় বউকে এক প্রস্থ ভোগ করার পর জিজ্ঞেস করে, ঐ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইখানা কি তুমি পড়ছে?
হ্যাঁ, শাহিনা ব্লাউজের বোতাম লাগাতে লাগাতে জবাব দেয়। বলে, দুপুরে কোনো কাজ থাকে না, তাই…..।
হুঁ, কাজ না থাকলে বই পড়া ভাল কিন্তু ও তো পাঠ্যবই, ছাত্ররা পড়ে—তুমি কী বুঝবে ওসব বই পড়ে?
দেখি পড়ে, শাহিনা বলে। বলে, একসময় তো পড়তাম, আমিও তো ছাত্রী ছিলাম।
সে তো এক যুগ আগের কথা।
একটু থেমে ফের বলে আতিক, পরীক্ষা-টরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে-টিচ্ছে হচ্ছে নাকি?
ইচ্ছে তো হয়ই।
তা ইচ্ছেটা কি সাবিদ আলী জাগিয়ে দিয়েছে?
শাহিনা লু হাসে। বলে, বাহু তা কেন হবে, ও এবার পরীক্ষা দিচ্ছে, তাই ওর কাছ থেকে বই চেয়ে নিলাম।
আতিক আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ে।
শাহিনার মনে হয়েছিল, ব্যাপারটার ওখানেই শেষ কিন্তু পরে দেখে ব্যাপারটা নতুন সমস্যা তৈরি করে বসে আছে। দিন দুই পর থেকেই দেখে কর্তার মেজাজ একটুতেই খিচড়ে উঠছে। একই বাড়ি নিচতলায় বাড়িওয়ালা থাকে। সিঁড়ির মুখে কেন পানি জমে থাকে তাই নিয়ে গজর গজর করে। কলে যদি পানি না থাকে, তাহলে চাচামেচি জুড়ে দেয় আর নিচতলা সিঁড়ির পাশে, ড্রেনের ওপর বাড়িওয়ালার দু’বছরের নাতিটিকে যদি হাগতে বা মুততে দেখে তাহলে গালাগাল করে বাড়িওয়ালার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দেয়।
ঐ একই সময়ে শাহিনা স্বামীর মুখে এক নতুন আফসোস শুনতে পায়—কেন সে ছেলের বাপ হতে পারল না! বাপ সে হল, কিন্তু ছেলের নয়, মেয়ের। বিয়ে সে করল, তাতেও তার দান-যৌতুকহীন খটখটে কপাল। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে যে সংসার পাতল, সেখানেও আয় বরকত বলে কিছু ছিল না। আর বউটাও এমন যে বেটাছেলে পেটে ধরতে পারে না। আর যদি ছেলেপুলে না হয় বউয়ের, তখন?
শাহিনা বুঝতো, মানুষটার বড় আশা ছিল যে প্রথম সন্তানটি ছেলে হবে, কিন্তু তা না হওয়াতে মনের ভেতরে ক্ষোভ জমে আছে।
কিন্তু ঐ ক্ষোভ দূর যে করবে, সেই সাহস তার তখন কোথায় মফস্বলের প্রাইভেট স্কুলের অস্থায়ী চাকরি, কোনো মাসে বেতন হয়, কোনো মাসে হয় না–সরকারি অনুদানের টাকা আসে তিন মাস পর পর। অমন অবস্থায় সে কেমন করে ছেলে হওয়ার ঝুঁকি নেয়! লুকিয়ে লুকিয়ে পিল খাওয়া ধরেছিল, সেটাই সে চালিয়ে যেতে থাকে।
আতিক টের পেয়েছিল কি না সে জানে না। তবে ওব্যাপারে নজর দেওয়ার মতো অবস্থা তার তখন একেবারেই ছিল না। চাকরি খুঁজবে না বউয়ের পেট কেন বানাতে পারছে না তার খোঁজ করবে? সৈয়দপুর জংশন-এর রেলওয়ে স্কুলে লিভ ভ্যাকান্সিতে বছরখানেক কাজ করা পরও যখন চাকরি হল না তখন গেল বদরগঞ্জ। সেখানে সুবিধা না হলে বলীগ জামাতের এক লোক ধরে লম্বা পাড়ি দিয়ে একেবারে টঙ্গীর এক স্কুলে, তারপর সবার শেষে এই ঢাকার মাতুয়াইলে। তবু তো। প্রথম প্রথম মনস্থির করতে পারে নি চাকরিতে থাকতে পারবে কি পারবে না করতে করতে একটা বছর পুরো পার হলে তারপর বউ বাচ্চাকে নিয়ে ঢাকায় আসা। আর সেই তবলীগ জামাতের মানুষটির সুপারিশেই তার খিলগাঁওয়ের বাসা ভাড়া নেওয়া। এখন সকালে স্কুল, বিকেলে কোচিং সেন্টার আর রাতে একটা টিউশনি। রোজগার যা হচ্ছে তাতে সংসার মন্দ চলছে না। কিন্তু মানুষটার পরিশ্রম যে চোখে দেখা যায় না, তার কী হবে! তার খুব খারাপ লাগে। সংসারের জন্য মানুষটা একা একা খেটে মরবে? সংসারটাতো তারও। কিছুই কি সে করতে পারে না?
কিন্তু তার চিন্তাভাবনা যা-ই হোক, তাকে পাত্তাটা দিচ্ছে কে? কর্তাটির মুখে তখন উঠতে বসতে বউকে খোঁটা আর সর্বক্ষণ বাসাবদলের হুমকি। একেকদিন মেয়েকে কোলে বসিয়ে আদর করতে করতে জিজ্ঞেস করে, সাবিদ বই দিতে এসেছিল? আসে নি? বই দিতে এলে কি ঘরে ঢোকে? ঢোকে, তাই না? তখন কি দরজাটা খোলা থাকে?
শাহিনা একটু আড়ালে নিজেদের রাখলে কী হবে, কানে আসে সব কথাই, তখন সে কাদবে না হাসবে বুঝে উঠতে পারে না। সাবিদের মতো একটা অল্পবয়সী ছেলেকে জড়িয়ে বউকে যে মানুষ সন্দেহ করে, সে মানুষকে কী বলা যায়? প্রতিবাদ করারও তো রুচি হয় না তার। সে এও বোঝে—কোনোরকম প্রতিবাদ করে লাভ হবে না। সে বোঝাতে চেষ্টা করে আর সেজন্যে সে আরও ঘনিষ্ঠ হয়। অবশ্য অমন স্বামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারটা যে আসলেই শারীরিক সেটা তার অজানা ছিল না। যে মানুষ সকাল নয়টায় বেরিয়ে দুটোয় বাসায় ফেরে তারপর আবার তিনটায় বেরিয়ে ন’টায় দশটায় ফেরে, তার সঙ্গে কী ধরনের ঘনিষ্ঠতা হতে পারে সে ভেবে পায় না। শোয়ার পর একটু এটাওটা সংসারের কথা হয়। তারপর ধামসাধামসি চলে কিছুক্ষণ। শেষে বাবুসাহেব একেবারে কাত এবং শুরু হয় তার নাসিকা গর্জন।