সর্বশেষে কৃষ্ণা দুহাত ধরে মুখপানে দৃষ্টিপাত করেছে। বলেছে, ওহে, আত্রেয়ী তীরের ক্ষেত্রকর, এক রাত্রির সাক্ষাতেও মন্দিরদাসী প্রণয়ীকে হৃদয়দান করতে জানে এখন বিশ্বাস হয় সে কথা?
দারুণ হাসছিলো তখন কৃষ্ণা। আর ঐ একটি প্রশ্নই বারবার করছিলো, বিশ্বাস হয় না তোমার? বলো, বিশ্বাস হয় না?
বসন্তদাস ঐ কথার উত্তর দিতে পারেনি। উত্তরের ভাষা তার জানা ছিলো না। শুধু দুহাতে আকর্ষণ করে কৃষ্ণার সীমন্তে একটি চুম্বন এঁকে দিয়েছে।
ঐ তার শেষ সাক্ষাৎ।
এবং ঐ শেষ সাক্ষাই তাকে যুক্ত করে দিয়েছে বৃহত্তর জগতের সঙ্গে। ঐ বিদায় যেন বিদায় নয়, বন্ধন। তারপর সে একাকী নয়। জগতের নানান প্রসঙ্গ এখন তার চিন্তা ভাবনার বিষয় হয়ে যায়। তার বণিক জীবনের মৃত্যু ঘটেছে ফল্পগ্রামে, বালিগ্রামে হয়েছে। তার অন্ত্যেষ্টি এবং ঐ অন্ত্যেষ্টির পর আরম্ভ হয়েছে তার নতুন জীবন। সে জানে না, এই নতুন জীবনের কী নাম–কিন্তু সে একটি গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করে। এই উপলব্ধিটি মুক্তির। সীমারেখা থেকে মুক্তি, গণ্ডিরেখা থেকে মুক্তি, স্বার্থবুদ্ধি থেকে মুক্তি–এবং এইভাবে ঘৃণা থেকে, সংকোচ থেকে, হীনমন্যতা থেকে ক্রমাগত একের পর এক মুক্তি।
অবশ্য এই গভীর তাৎপর্যময় উপলব্ধিটি স্পষ্ট হয়েছে অনেক পরে। তবে তার সূচনা ঐদিন, যেদিন সে বালিগ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে আসে।
বালিগ্রাম ত্যাগ করে সে মঙ্গলদ্বীপে যায়, সেখানে তার জন্য যেন অপেক্ষা করে ছিলেন দিবানাথ, তার আশ্রয়েই সাক্ষাৎ হয় ভিক্ষু মিত্রানন্দের সঙ্গে।
বসন্তদাসের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনে নবীন ভিক্ষু মিত্রানন্দ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। নিঃসংকোচে বলে, মহাশয়, আপনি সর্বনাশ করেছেন–আপনার শাস্তি হওয়া উচিত।
তীব্র উল্কণ্ঠা তখন বসন্তদাসের মনে, কলহে প্রবৃত্তি ছিলো না। তথাপি বলে, মহাশয় অহেতুক ক্ষিপ্ত হচ্ছেন, আপনি ভিক্ষু, ক্রোধ আপনাতে শোভা পায় না।
ঐ কথায় মিত্রানন্দ সত্য সত্যই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। বলে, ক্রোধের এখনই আপনি কি দেখেছেন, ভবিষ্যতে দেখতে পাবেন–অপেক্ষা করুন।
ভ্রাতঃ আমি তো বুঝলাম না আমার অপরাধ কোথায়! বসন্তদাস বিনয় ত্যাগ করে না।
আপনি তিনটি তরুণীর সর্বনাশ করেছেন, মিত্রানন্দ তীব্রস্বরে বলে, আমাদের মহান একটি কার্য–সম্পাদনের পথে বাধা সৃষ্টি করেছেন, তথাপি বলছেন, আপনার অপরাধ নেই? আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।
কিন্তু আমি তো তাদের কিছু করতে বলিনি–তারাই আমাকে আমন্ত্রণ করে গৃহে নিয়ে গিয়েছিলেন।
চুপ করুন, লোভী, লম্পট, মিথ্যাচারী!
বসন্তদাস দেখলো, এ ভারী অদ্ভুত কাণ্ড। ক্রোধে মিত্রানন্দের একেবারে হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হবার উপক্রম হয়েছে। সে বললো, মহাশয়, আপনার মুখে সংযম আনুন, না হলে আমিও অসংযমী হয়ে উঠতে পারি।
মিত্রানন্দ আরও কী বলতো কে জানে! ঐ সময় দিবানাথ মধ্যস্থলে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, এ কী করছেন আপনারা–ছি ছি–বিপদে মানুষকে ধীরস্থির থাকতে হয়, আপনারা ধৈর্যহারা হয়ে যদি কলহ করতে থাকেন, তাহলে লাভ কার হবে? এখন না আপনাদের উচিত বিপর্যয় কতখানি হয়েছে সেইটি জানা, আর তা না করে আপনারা কলহে প্রবৃত্ত হয়েছেন?
এ কথায় মিত্রানন্দের যেন সম্বিৎ হয়। সে নত মুখে ঐ স্থান ত্যাগ করে। দিবানাথ জানালেন, আমি এখনই নগরীর উদ্দেশে যাত্রা করছি–সংবাদ নিয়ে আসি–প্রকৃত ঘটনা কী।
দিবানাথ প্রত্যাগমন করলেন সন্ধ্যাকালে। জানালেন, বিভাবতী ও শুক্লা প্রাসাদে বন্দিনী–শত পীড়নেও তারা কোনো কথা প্রকাশ করেনি–আর কৃষ্ণার কোনো সংবাদ নেই, কেউই তার সংবাদ জানে না।
আরও সংবাদ এই যে, মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ যথার্থই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন, নগরীর গৃহে গৃহে সন্ধান করা হচ্ছে–মিত্রানন্দ এবং বসন্তদাসকে চাই–সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে।
কৃষ্ণার সংবাদ নেই শুনে বসন্তদাস বিচলিত হয়। কৃষ্ণার মুখখানি সে বিস্মৃত হতে পারছিলো না। তার উচ্ছল হাসি, কপট ক্রোধের ভ্রূ-ভঙ্গি, তার প্রগাঢ় আলিঙ্গন, তার আশ্লেষ গভীর চুম্বন এবং অশ্রু উদ্বেলিত অথচ হাস্যমুখরিত বিদায় জ্ঞাপন–সমস্তই বারংবার তার মনে পড়ছিলো। কে জানে, হয়তো শক্তিবর্মণের অনুচরেরা এতোক্ষণে তার দেহটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। সন্ধ্যাকাশের উজ্জ্বল তারকাটির দিকে দৃষ্টি রেখে সে উচ্চারণ করে, কৃষ্ণা ক্ষমা করো আমি তোমার অক্ষম প্রণয়ী, তোমাকে রক্ষা না করে আমি পলায়ন করে এসেছি।
মিত্রানন্দ সন্ধ্যাকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলো। তার চিন্তা ভিন্ন। তার চিন্তা হচ্ছিল, বিপুল একটি উপপ্লব কি সত্যই আসন্ন? দাসত্ব ও লাঞ্ছনা থেকে মানুষ কি মুক্তি পেতে চলেছে? মনের আকাক্ষা কি এখন বিশ্বাসে পরিণত হবার পথে? না হলে ঐ তিনটি মন্দিরবাসী যুবতী কেন বিপজ্জনক সহযোগিতাদান করতে এসেছিলো?
মিত্রানন্দের কষ্ট হয় বিভাবতী ও তার সহচরী তরুণী দুটির জন্য। আবার সেই সঙ্গে আশাও গভীরতর হয়। মনে হয়, ঐ তিন মন্দিরবাসীর আত্মাহুতি মানুষের মুক্তি ত্বরান্বিত করে আনছে।
সে বসন্তদাসের কাছে যায়। বসন্তদাসের মুখে বিষাদের ছায়া দেখে বলে, মিত্র বসন্ত, দুঃখ করবেন না–যুদ্ধ আরম্ভ হলে আঘাত তো আসবেই–মনে করুন, এ সেই প্রকারেরই একটি আঘাত।