বসন্তদাসের ইতস্তত ভাব দেখে শ্রীনাথবর্মণ দুজন প্রহরীকে ডাকলেন। আদেশ করলেন, দেখো তো এই দুর্বিনীত লোকটার কাছে আর কি কি আছে?
ঘোর বিপদ সম্মুখে। বসন্তদাস আর বাক্যব্যয় না করে কটিবন্ধের স্থলীটি উন্মোচিত করে সমুদয় দ্রব্যাদি ভূমিতে সামন্তপতির পদপ্রান্তে রাখলো।
শ্রীনাথবর্মণ কিছু বললেন না। প্রথমে হীরক খণ্ডগুলি হাতে তুলে নিলেন। তারপর এক দুই করে স্বর্ণখণ্ডগুলি গণনা শেষ হলে বললেন, নিলাম হে বণিক, সমস্তই নিলাম।
ঐ কথা বলে আসন থেকে উঠে তিনি অন্তঃপুরের দিকে পদক্ষেপণ করলেন। বসন্তদাসের মনে হলো, তার যথাসর্বস্ব চলে যাচ্ছে। সে কাতর কণ্ঠে বললো, প্রভু মূল্য কখন পাবো?
অ, মূল্য–না? শ্রীনাথবর্মণ ফিরলেন। পুনরায় আসনে উপবেশন করে বললেন, নাম কি?
আজ্ঞে বসন্ত।
বসন্ত কী?
বসন্তদাস।
উত্তম কথা, কুলবৃত্তি কী, সেটি বলছো না কেন?
আজ্ঞে আমরা ক্ষেত্রকর, আমার পিতা হেমন্তদাস আত্রেয়ী তীরে ক্ষেত্রকর্ম করেন।
উত্তম উত্তম–পিতৃনাম স্মরণে আছে তাহলে। তা ক্ষেত্রকররা কি ইদানীং বাণিজ্য করতে আরম্ভ করেছে নাকি, আঁ? বৃত্তি সাংকর্য সৃষ্টি করে চলেছো, তোমার লজ্জা করে। না? পাপবোধ নেই, আঁ?
অদ্ভুত কথা! বসন্তদাস কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। শেষে সবিনয়ে বলে, প্রভু ক্ষমা করবেন, যদি অপরাধ হয়–কিন্তু প্রত্যেক বৃত্তিতেই তো এমন কিছু লোক থাকে যারা কুলবৃত্তি ত্যাগ করে অন্যবৃত্তি গ্রহণ করে।
মিথ্যা ভাষণ করো না বসন্তদাস। শ্রীনাথবর্মণ রোষ কষায়িত দৃষ্টি রাখেন বসন্তের মুখের উপর। বসন্তদাসের মনে ভয় ঈষৎ শিহরিত হয়।
শোন হে ক্ষেত্রকরের পুত্র, শ্রীনাথবর্মণ বলতে লাগলেন, তোমার অপরাধ সীমাহীন প্রথমত, তুমি মিথ্যা কথা বলেছো, অতঃপর এখন যা বলছো, তা যদি সত্য হয়, তাহলে তুমি ধর্মদ্রোহীও বটে। উপরন্তু আমার সন্দেহ, এ সমস্তই তোমার অপহৃত সম্পদ। নাহলে ক্ষেত্রকরের পুত্র হয়ে এতো মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী তুমি কোথায় পাবে? এমতাবস্থায়। এ দ্রব্যগুলি রাজকোষে গচ্ছিত থাকবে। তুমি যার কাছ থেকে এই মণিমাণিক্যাদি সংগ্রহ করেছে তাকে যদি আমার সম্মুখে আনতে পারো, তাহলেই এগুলির মূল্য পাবে, নচেৎ নয়। এখন তুমি যেতে পারো।
প্রভু, দয়া করুন, বলে বসন্তদাস কাকুবাদ করতে আরম্ভ করে। কিন্তু ফল হয় না তাতে। প্রাসাদের প্রহরীরা তাকে তুলে এনে প্রাসাদদ্বারের বাহিরে রেখে যায়। যাবার সময় এক প্রৌঢ় প্রহরী বলে যায়, বৎস তুমি নির্বোধ। ঐভাবে সমুদয় পণ্য নিয়ে কেউ যায় সামন্তপতির কাছে? যা হয়েছে, হয়েছে–এবার গৃহের সন্তান গৃহে ফিরে যাও। এ স্থানে গোলযোগ করলে হয়তো তোমাকে শূলেও দিতে পারেন, সামন্তপতি ভয়ানক ক্রোধী পুরুষ। তিনি যে তোমাকে বন্দী না করে প্রাসাদের বাহিরে পাঠিয়েছেন এ তোমার চতুর্দশ পুরুষের সৌভাগ্য মনে করবে।
বসন্তদাস হতবাক, এ কি হলো! মুহূর্তের মধ্যে তার সর্বস্ব অপহৃত হয়ে গেলো? তার কিছুই করণীয় নেই? সে বিভ্রান্ত হয়ে পথে পথে ভ্রমণ করতে লাগলো।
শেষে এক বিপণীকার পরামর্শ দিলো, মহাশয়, এভাবে শক্তিক্ষয় করে কোনো ফল হবে না–আপনি বরং মহাসামন্ত শক্তিবর্মণের কাছে যান–তিনি অত্যন্ত প্রতাপশালী, যদি তার দয়া হয়, তাহলে আপনার পণ্যের আংশিক মূল্য পেয়েও যেতে পারেন।
আবার এও জানালো লোকটি–তবে দেখবেন, যেন কোনো কারণে রুষ্ট না হন। তিনি, হলে কিন্তু বিপদ।
ফল্গুগ্রাম থেকে বালিগ্রামের দূরত্ব অধিক নয়–দুই প্রহরের পথ। বালিগ্রাম সমৃদ্ধতর জনপদ–এ স্থানের জয়স্কন্ধাবারটি বৃহত্তর। এটি নির্মিত হয়েছিলো বৈরী সমতট এবং কামরূপের উপর গৌড়াধিপের দৃষ্টি রাখার জন্য। এখন বৈরী কেউ–ই নয়, সুতরাং সেনাবাহিনীর তৎপরতাও সেরূপ নয়। তারা নগরে ভ্রমণ করে এবং আনন্দর্তিতে কালযাপন করে। পথিপার্শ্বের বিপণীগুলিতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত ক্রয়–বিক্রয় চলে। ভগবান বিষ্ণুর বিরাটাকার মন্দিরটিতে লোকজনের গমনাগমনের বিরতি নেই। শৌণ্ডিকালয়গুলিতে মাদকপায়ীদের সোল্লাস চিৎকার প্রায় সর্বক্ষণই শোনা যায়। অর্থাৎ জনপদটি যথার্থই সজীব এবং প্রাণময়।
বসন্তদাস মহাসামন্ত শক্তিবর্মণের প্রাসাদে প্রবেশের কোনো ব্যবস্থাই করতে পারে। না। প্রতিদিন প্রাসাদদ্বারে যায়, প্রহরীদের অনুনয় বিনয় করে এবং ব্যর্থ হয়। প্রতিদিনই এই ঘটনাক্রমে দ্বাররক্ষীরা বিরক্ত হয়ে উঠলো। একদা এক প্রৌঢ় রক্ষী কাছে ডেকে নিয়ে বললো, বৎস, তুমি অহেতুক নিজের বিপদ সৃষ্টি করছো, মহাসামন্তের গূঢ়পুরুষেরা তোমার আচরণে সন্দেহান্বিত হয়ে উঠেছে। আমি বলি কি, তুমি মঙ্গলমতে বিদায় হও, যদি একবার তাদের হাতে বন্দী হও, তাহলে কিন্তু তারা পিতৃনাম বিস্মরণ করিয়ে তবে ছাড়বে।
কিন্তু বসন্তদাসের সংকল্প টলে না। বলে, মহাশয়, তবে কি সুবিচার পাবো না? এদেশে আমাকে সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে যেতে হবে?
লোকটি বিরক্ত হয়ে চলে যায়। বলে, তোমার মঙ্গলের জন্যই সৎ পরামর্শ দিলাম, এখন তোমার অভিরুচি–যা উত্তম বিবেচনা মনে হয়, তাই করো।
সে রাত্রিযাপন করতো একটি প্রাচীন মন্দিরের অতিথিশালায়। মন্দিরটি পরিত্যক্ত প্রায়। অবলোকিতেশ্বরের বিগ্রহটি অবশ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল কিন্তু বিগ্রহের পূজা হতো কি না। বলা কঠিন। কয়েকজন ভিক্ষু ও শ্রমণকে কখনও কখনও দেখা যেতো, কিন্তু তাদের যে। কী কাজ, তা কিছুই বুঝবার উপায় ছিল না।