কিন্তু জন্তুজানোয়ারদের তো মানুষরা ভালোবাসে, তাদের কথা তো জানতে পারে?
কে বলেছে মানুষরা জন্তুজানোয়ার ভালোবাসে? একবার হাতি ধরার খেদায় গিয়েছিলাম। দেখলাম সুন্দর সব পোষা হাতি সাজিয়ে রেখে, বুনো হাতি ধরা হচ্ছে। ভালোবাসে বললে? যারা দলে দলে গাছপালা ভেঙে হুড়মুড়িয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নামে, তাদের পায়ে শেকল পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখলাম।
হাতির বাচ্চার ভীষণ কাতুকুতু তা জান? খররা বুরুশ দিয়ে ঘষে তাদের কাতুকুতু ছাড়িয়ে, পিঠে হাওদা চাপানো হয় তা জান? তা নইলে একটুকু ছুঁলেই তারা হেসে লুটোপুটি। তোমরা কি এগুলোকে ভালোবাসা বল?
রুমু বলল, আমরা কুকুর ভালোবাসি, না দাদা? আমরা ভুলোকে ভালোবাসি। তুমিও তো বলেছ মকার লোকরা বেড়াল বাদে সব জন্তুজানোয়ার ভালোবাসে।
দুমকার লোকদের কথা আলাদা। একবার দুমকার বনে দাবানল লেগেছিল। দলে দলে জন্তুজানোয়ার ভয়ের চোটে ছুটে বেরিয়ে এল। গাঁয়ের লোকেরাও তাদের ঘর বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল, জানোয়ারদের কেউ কিছু বলল না।
একটা ভাল্লুক ছিল, সেরকম ভাল্লুক কেউ কখনো দেখেনি। তার গলার লোমগুলো ছিল সাদা, মনে হত ফুলের মালা পরেছে বুঝি। আর যেমনি তার গায়ের জোর, তেমনি তার সাহস! ওর জ্বালায় কারো মৌচাকে মধু থাকত না, আর কত লোককে যে খুনজখম করেছিল তার ঠিক নেই। কিন্তু এমনি চালাক যে কেউ তাকে মারতেও পারেনি, ধরতেও পারেনি।
দাবানলের দিন সে-ও বন থেকে বেরিয়ে এল, সঙ্গে একটা বাচ্চা, তার পায়ে কী হয়েছে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। পড়ে গেল আমাদের সর্দারের একেবারে সুমুখে। আগের বছর সর্দারের ছেলের পায়ের হাড় চিবিয়েছে ওই ভাল্লুক, সর্দারের হাতে তির-ধনুক।
মেরে ফেলল?
সর্দার ধনু তুলতেই ভাল্লুক তার বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে সর্দারের মুখের দিকে চেয়ে রইল। আর সর্দারও ধনুক নামিয়ে পিছন ফিরে চলে গেল। জন্তুজানোয়ারকে ভালোবাসা চারটি খানিক কথা নয়, দিদি। একটা কুকুর কি একটা বেড়াল ঘরে বেঁধে রেখে তাকে আদর করলেই কি আর ভালোবাসা হল!
রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রুমু ডাকল, দাদা!
কেন, কী হয়েছে?
মাঝে মাঝে ভুলো কেন পালিয়ে যায়? হয়তো এখানে ওর ততটা ভালো লাগে না?
বোগি উঠে বসল, ভালো লাগে না? এখানে ভুলোর ভালো লাগে না? তুই কি পাগল হয়েছিস?
তবে আসছে না কেন?
বোগি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, আসছে না কারণ আসতে পারছেনা। আর হয়তো আসবেও না!
নিশ্চয় আসবে। একটা পাঁচ-ঠেঙা মাকড়সা আর একটা সোনা রুপোর মাদুলি পেলেই আসবে দেখো।
০৭. খরখরে শুকনো হলে হবে কী
ঝগড়ু, বলল, আমাদের দুমকা একেবারে খরখরে শুকনো হলে হবে কী, আমাদের পাহাড়ে নদীর জলে যখন বান ডাকে তখন সব ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। এই ভিন গাঁয়ে গেলাম দিব্যি সুন্দর পায়ে হেঁটে নদী পার হয়ে, আর ঘণ্টা তিন বাদে এসে দেখি লাল ঘোলা জলে-ভরতি বিরাট নদী, আর তার সে কী আওয়াজ, কান ঝালাপালা হয়ে যায়। আবার রাত পোয়ালে যে নদী সেই। পায়ে হেঁটে পার হয়ে গায়ে ফেরা যায়।
কোত্থেকে বানের জলে হাজার হাজার মাছ ভেসে আসে। নদীর জল দুই পাড় ছাপিয়ে ওঠে, তারপর যখন আবার নেমে যায়, যেখানে-সেখানে পাথরের ফোকরে ফাটলে জল আটকে থাকে, তার মধ্যে কতরকম মাছ কিলবিল করতে থাকে।
সে মাছ তোমরা ধর, ঝগড়ু?
ধরি বই কী। ক-দিন ধরে গাঁয়ের লোকে মনের সুখে মাছ খায়। দুমকার লোকরা বড়ো গরিব হয়, দিদি। তাদের বড়ো কষ্ট। শীত কালে টোপাকুল পাকলে, বিচিসুদ্ধ পাথর দিয়ে হেঁচে খায় লোকে। তাহলে অনেকক্ষণ পেট ভরে থাকে, ভাত খেতে ইচ্ছা হয় না।
তবে শুধু কি আর মাছ ধরে, তার চাইতেও আশ্চর্য সব জিনিস মাঝে মাঝে ধরা পড়ে।
কী জিনিস, ঝগড়ু?
একবার আমাদের গাঁয়ের নান্দু জল নেমে যাবার পর, সন্ধে বেলায় চাঁদের আলোয় গেছেনদীর ধারে, বর্শা দিয়ে মাছ গাঁথবে, তীরের কাছ থেকে। দেখে কিনা চাঁদের আলোয় কী একটা লম্বা জিনিস বালিতে বেধে গিয়ে, স্রোতের সঙ্গে একটু একটু দুলছে।
কাছে গিয়ে দেখে আগাগোড়া আশ্চর্যরকম কারিকুরি-করা সাদা রঙের একটা ছোটো নৌকো। হাতির দাঁতের কি হাড়ের তৈরি বুঝতে পারল না। নৌকোর সামনের দিকটার গড়ন একটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ের মতো, কিন্তু তার পায়ের বদলে আঁশে-ঢাকা মাছের ল্যাজ।
হাত বাড়িয়ে নৌকোটাকে টেনে ডাঙায় তুলতেই, নান্দুর চক্ষু চড়কগাছ!
নৌকোর মধ্যে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে আশ্চর্য একটি মেয়ে। তার গায়ের রঙও হাতির দাঁতের মতো, হালকা পালকের মতো গড়নটি, চোখ খুলতেই নান্দু দেখল তার ঘোর নীল রং, পরনে একটা ঘন সবুজ রেশমি কাপড়। চমকে মেয়েটি উঠে বসল একবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, তারপরে এক নিমিষে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিল।
নান্দু তার আঁচলখানি চেপে ধরল, এক মুঠি সবুজ রেশম তার হাতে রয়ে গেল, মেয়েটি স্রোতের মধ্যে তলিয়ে গেল আর নৌকোটা বালির উপর পড়ে থাকল। ছোটোবেলায় ওই নৌকো আমিও দেখেছি।
ঝগড়ু থামলে বোগি রাগ করতে লাগল। তোমার সব গল্প হারানোর গল্প, ঝগড়ু, পাওনি কখনো কিছু?
তাহলে যাবে কাল দোলতলার মেলায়? সেখানে কিছু পাওয়া যেতে পারে। রমুদিদি, যাবেনাকি তোমার সেই একচোখা লোকের খোঁজে?
রমু বলল, যাব, যাব, ঝগড়ু। চিনির মঠ কিনে দেবে তো?