ঝগড়ু মাথা উঁচু করে বলল, ও তো দুমকার ছেলে। আর তা ছাড়া ও হল পক্ষীরাজ, এদের ঘরে বেঁধে রাখা যায় না।
পক্ষীরাজ তো ডানা কোথায়, ঝগড়ু?
ঝগড়ু অবাক হয়ে গেল। সব পক্ষীরাজের কি ডানা গজায় ভেবেছ নাকি? দেখছনা ওর কাঁধের উপরকার হাড় কেমন উঁচু হয়ে রয়েছে? ওর যে ডানার কুঁড়ি রয়েছে, বোগিদাদা। ডানার কুঁড়ি থাকলেও সকলের ডানা গজায় না, গায়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে থাকে, একটুখানি জিরুতে দেয় না, সারাটা জীবন জ্বালিয়ে খায়।
এই বলে ঝগড়ু ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিল। ঘোড়াটাও একবার ঘাড় কঁকি দিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে একবার চিহি করে ডাক ছেড়ে, পেছনের দুটো পায়ের উপর একবার দাঁড়িয়ে উঠে, খোয়াইয়ের উপর দিয়ে খটাখট শব্দ করে দৌড় দিল। চারটে খুর থেকে আগুনের হলকা ছুটতে লাগল, চারিদিকে ধুলো উড়তে লাগল, কাশবনের মধ্যে দিয়ে, তিরের বেগে ছুটে, দেখতে দেখতে সাদা ঘোড়া অদৃশ্য হয়ে গেল।
সারাটা পথ কারো মুখে কথা নেই। ভুলো সেদিনও ফিরল না। ঝগডুর ঘরে কালো ছেলেটা অঘোরে ঘুমুচ্ছে বোগি গিয়ে দেখে এল। রাতে খেতে বসে দাদু বললেন, কী হে, নেড়িকুত্তোর দুঃখ ঘুচল? আনবে নাকি সেজো মামা বিলিতি কুকুরের ছানা?
রুমু বোগির মুখের দিকে চেয়ে দেখে, বোগি মাথা নাড়ছে।
দিদিমা বললেন, কী জানি, পায়ে পায়ে অষ্টপ্রহর ঘুরঘুর করত, ভারি বিরক্ত লাগত, এখন আবার যেন খালি খালি লাগে।
বোগি তবুও কিছুনা বলে, একটা পরিষ্কার চুলের কাটা দিয়ে নলি হাড়ের ভিতর থেকে রস বের করে খেতে লাগল।
রুমু বলল, ভুলো ছাড়া আর কাউকে আমরা চাই না, দাদু।
০৬. রান্নাঘরের পিছনে ঝগড়ুদের ঘর
রান্নাঘরের পিছনে ঝগড়ুদের ঘর আর রান্নাঘরের পাশে গরম জলের ঘর। সেখানে তিনটে বড়ো বড়ো পাথর দিয়ে উনুন করা আছে, তার উপর কেরোসিনের টিনে স্নানের জল গরম করা হয়।
ওই উনুনে কয়লার বদলে কাঠ জ্বালানো হয়। কতরকম কাঠ, তাদের কতরকম রং, কতরকম গন্ধ। মাঝে মাঝে কাঠে আগুন লাগলে কেমন একটা শোঁ শোঁ শব্দ হয় আর সারা ঘর একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধে ভরে যায়।
ঝগড়ু, বলে, তা হবে না, ও যে কাঠপরিদের চুলের সুবাস।
কাঠপরি হয় না, ঝগড়ু।
কাঠপরি হয় না এটা একটা কথা হল, বোগিদাদা?
কোনোরকম পরিই হয় না, ঝগড়ু, কাঠপরিও না।
তবে তোমাদের বইতে লেখে কেন? দিদিমা কাল যে বই থেকে পড়ে শোনালেন?
সব বানানো গল্প, ঝগড়ু, পরি হয় না।
না হয় না! বইতেও লিখেছে, তবু হয় না! তা ছাড়া আমি দেখেছি।
তুমি নিজের চোখে দেখেছ?
না, ঠিক নিজের চোখে দেখিনি, আমার বাবা দেখেছেন। তবে কি আমার বাবা মিছে কথা বলেছেন?
কোথায় দেখেছেন ঝগড়ু, কবে দেখেছেন?
অনেক বছর আগে, রমুদিদি। দুমকার পাহাড়ে দেখেছেন অবিশ্যি, তোমরা হয়তো বিশ্বাসই করবে না।
না, না, ঝগড়ু, বলোই-না তোমার বাবার কাঠপরি দেখার কথা।
ঝগড়ু জল গরমের উনুনে একটা ফিকে সবুজ রঙের কাঠ গুঁজে দিয়ে বলল, এইরকম কাঠে পরি থাকে, শুকনো মরা কাঠে থাকে না। বলতেই সারা ঘর একটা মিষ্টি ধুনো ধুনো গন্ধে ভরে উঠল।
ঝগড়ু বলল, ভালো করে আগুনের মধ্যে চেয়ে দেখো, বোগিদাদা, যেখানে নতুন ধরেছে সেখানে নয়, যেখানে গনগন করে জ্বলছে সেখানে দেখো৷ কিছু দেখতে পাচ্ছ না, ঘরবাড়ি, গাছপালা?
অমনি রুমু বোগিরও মনে হতে লাগল সত্যি বুঝি আগুনের তৈরি ঘরবাড়ি, গাছপালা দেখতে পাচ্ছে, লাল, একটু একটু নীল, দেয়াল ছাদ ডালপালা কেবলই কাঁপছে, নড়ছে, ভাঙছে আবার গড়ছে। মনে হল আগুনের তৈরি একটা শহরই দেখতে পাচ্ছে।
বোগি চোখ ঢেকে বলল, শুধু কাঠ জ্বালালে নয়, ঝগড়ু, আমি কয়লার আগুনেও দেখেছি যুদ্ধ হচ্ছে, শহর পুড়ে যাচ্ছে, বিরাট বিরাট প্রাসাদ ধসে পড়ছে।
তা হবে হয়তো, বোগিদাদা, দুমকায় আমরা কাঠ জ্বালাই, কয়লার কথা অত বলতে পারব না।
দাদা, তুমি অত কথা বল কেন? বলো ঝগড়ু, তোমার বাবার পরি দেখার কথা।
বুঝলে, বাবার তখন বয়স হয়েছে, হাড়ের ভিতরে শীত আর কিছুতেই যায় না, সারাটা দিন গোল লোহার চুল্লির ধারে বসে থাকেন, হাতের কাছে কাঠের গাদা, থেকে থেকে আগুনে একটা কাঠ গুঁজে দেন, ধোঁয়ায় চারদিক ভরে থাকে, যে আসে তার চোখ জ্বালা করে, তারা বাবাকে শুধোয়, তোমার চোখ জ্বলে না, বুড়ো? বাবা বলেন, আরে বুকের জ্বালাই আর টের পাই না, তা আবার চোখের জ্বালা!
সারা দিন চুল্লির ধারে বসে থাকেন বাবা, আর কাঠির আগায় বিঁধিয়ে রাঙা আলু পুড়িয়ে খান! যে আসে তাকে খাওয়ান। তারা মাঝে মাঝে বলে, রাঙা আলুতে ইঁদুরের দাঁতের দাগ কেন, বুড়ো? তোমাদের খেতে বুঝি ইঁদুর হয়েছে? বাবা চোখে ভালো দেখেন না, রাগ করেন, বলেন, ইচ্ছে না হয় খেয়ো না।
একদিন আগুনের মধ্যে যেই-না কাঠির আগায় বিঁধিয়ে রাঙা আলু ফেলেছেন, অমনি মনে হল যেন আগুনের ভিতরকার ঘরবাড়িতে মানুষ আছে, কে যেন রাঙা আলুটাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পোড়াতে লাগল, লম্বা দাড়ি কে একজন বুড়ো লোক রাঙা আলুতে কামড় দিল। অমনি বাবা তাড়াতাড়ি কাঠি টেনে আনতেই রাঙা আলুর সঙ্গে সঙ্গে বুড়োও বেরিয়ে এল। একটুক্ষণ দেখতে পেলেন, তারপরেই সে ঝুরঝুর করে বাতাসে মিলিয়ে গেল। বলতে চাও এসব বানানো কথা, বোগিদাদা? শুধু বাবা কেন, বনে-জঙ্গলে যারা কাঠ কাটতে যায়, তারা সবাই জানে জঙ্গলে এমন অনেক জিনিস আছে, যাদের কথা কোনো বইতে লেখে না। গাছগাছালির কথা যারা চারটে দেওয়ালের মধ্যে বাস করে তারা জানবে কোত্থেকে?