আরে আজ নয় কাল নয় করে করে বছর ঘুরে গেল, শেষটা বুড়ো ঠাকুরদা একদিন রেগেমেগে তাকে যা নয় তাই বলে বকাবকি করলেন। তারপর সে ঘোর রাত্রে পায়ে হেঁটেই দুমকা থেকে চলে গেল। সারা দিন তাকে খোঁজাখুঁজির পর গভীর রাতে ঠাকুরদা বড়ো চুল্লিটা জ্বেলে, তার মধ্যে ওই পাহাড় পাহাড় মালমশলা আর রাশি রাশি সাহেবদের বই সব ঢেলে দিয়ে, রাগে-দুঃখে সারা রাত বনে বনে ঘুরে বেড়ালেন।
ওরে বাবা! বাঘে খেল না?
আরে তোমরা যে কিছুই জান না দেখছি। রাগী মানুষদের আর পাগলদের কেউ কিছু বলে না, তাও জান না?
যাই হোক, সকালে উসকোখুসকো চুল আর লাল ভাঁটার মতো চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন, চুল্লির সেই গনগনে আগুনে সব জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে, আর তার জায়গায় চুল্লিতে ঠেসে রয়েছে পরত পরত কাচ, আর সবার নীচে উনুনের ছাঁচে ঢালাই হয়ে আছে এই বিশাল এক দলা সবুজ কাচ। কাচ কাটে যারা তারা এল, জানলা হল, প্রদীপের ঢাকনি হল, সব হল, দুমকার দুঃখ তখনকার মতো ঘুচল, আর ফালতু কাচ গুঁড়িয়ে জাদুকরি মাঞ্জায় দেওয়া হল।
দুমকার দুঃখ ঘুচল তো তুমি কেন দুমকা ছেড়ে এখানে এলে চাকরি করতে?
বললাম-না, তখনকার মতো ঘুচল। দুঃখ কি আর চিরকালের মতো ঘোচে, বোগিদাদা? সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বারে বারে ফিরে আসে। তবে হ্যাঁ, এই জাদুকরি মাঞ্জাটাও কিছু কম যায় না!
কেন কী হয় ওতে?
সেই কথাই তো বলছি, তা তোমাদের কিছুতেই তর সয় না।
আচ্ছা ঝগডু, সব জানলায় কাচ হল, তবে তোমরা চাটাই লাগাও কেন?
সেও এক কাহিনী, রুমুদিদি। ষাট বছর আগে যে বড়ো ভূমিকম্প হয়েছিল, তাতে দুমকার একটি বাড়িও দাঁড়িয়ে ছিল না, কাচটাচ সব গুঁড়ো। এই মাঞ্জা তো সেই গুঁড়ো দিয়েই তৈরি। আমাদের দুমকায় ঘরে ঘরে কৌটো করে সেই কাচের গুঁড়ো তুলে রাখে। মাঞ্জার সঙ্গে একটু করে দেয়া হয়, ফুরিয়ে গেলে আর তো পাওয়া যাবে না, দিদি! চলো, এখন না ফিরলে আঁধার হয়ে যাবে, সূর্য ডোবার পর এ জায়গাটাও অন্যরকম হয়ে যায়, চলো এখন ফেরা যাক।
তাহলে রাত্রে শোবার সময় মাঞ্জার কথা বলবে তো ঠিক?
ঝগড়ু দু-জনার কনুই ধরে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলল, হ্যাঁ, হা, সে হবেখন!
রাত্রে মাংস রান্না হয়েছিল। মোটা হাড়গুলো কে খাবে? তার উপর রমুর খুব পা কামড়াচ্ছিল। দিদিমা ঝগড়ুকে বকলেন, কী দরকার ছিল ওদের শাল বন অবধি হাঁটাবার, ঝগড়ু? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার দেখি বুদ্ধি বাড়ছে।
ঝগড়ু কিছু বলল না। ঝগড়ু বোধ হয় খুব বুড়ো, কানের চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে, হাতের অনেকগুলো নখ ভাঙা, শিরাগুলো উঁচু উঁচু হয়ে রয়েছে। রুমু একটা আঙুল দিয়ে ঝগড়ুর শিরায় হাত বুলিয়ে দিল। বোগি বলল, ঝগড়ু, তুমিও চলো, আমরা শোব, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো৷
হাত ধুতে গিয়ে রুমু একবার কানা-তোলা থালাটার কাছে গেল। বোগির রাগ ধরল, কী করে আসবে সে? তুই এত বোকা কেন রুমু? হাড়গুলো তুলে এনে থালায় ফেললি?
রুমু পা দিয়ে থালাটাকে একটু সরিয়ে বলল, ঝগড়ুর বউ সন্ধে বেলা ছেলেটাকে কলা চটকে খাওয়াচ্ছিল। আমার বড্ড পা কামড়াচ্ছে, দাদা। রুমু মহা কান্নাকাটি লাগিয়ে দিল।
০৪. ঝগড়ু রুমুর পা টিপে দিল
ঝগড়ু অনেকক্ষণ ধরে রুমুর পা টিপে দিল। পা টিপতে টিপতে মাঞ্জার কথাটা বলল, আমরা যখন ছোটো ছিলাম বোগিদাদা, ওই মাঞ্জা সুতোয় লাগিয়ে একদিন ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম। সারা দিন লেগেছিল সুতোয় মাঞ্জা দিতে। লম্বা করে দুটো শিশু গাছে বেড় দিয়ে সুতো শুকোনো হল। ঘুড়ি উড়োতে সেই বিকেল হয়ে গেল।
আমি আর আমার ভাই ঝমরু, না খেয়ে না দেয়ে সুতো তৈরি করে আকাশে তো ঘুড়ি ছেড়ে দিলাম। ছাড়তেই মনে হল জ্যান্ত পাখি ছেড়ে দিলাম। ঘুড়ি কাত হল না, গোত্তা খেল না, শোঁ শো করে একেবারে সটান মাঝ আকাশে উড়ে গেল।
যতই সুতো ছাড়ি ততই ঘুড়ি উপরে উঠে যায়। ঝমরু বলল, দাদা ঘুড়ির কেন ওজন নেই, টান নেই? বাস্তবিকই তাই, এদিকে লাটাইয়ের সুতোও প্রায় শেষ। আমি বললুম, সারাদিন মাঞ্জা দিলাম, সব কটি সুতো যাবে শেষে, থাক, তুই টেনে নামা।
কী বলব, বোগিদাদা, সে ঘুড়ি নামতে চায় না, জোর করে। ততক্ষণে সূয্যি ডুবেছে, গাঁয়ের লোক আর যারা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল সবাই চলে গেছে, তখন ঘুড়ি এসে চোখের সামনে দেখা দিল। দেখা দিল কিন্তু মাটিতে পড়ল না। ঝমরু আর আমি দেখলাম, ঘুড়ির কলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আশ্চর্য একটা হলদে পাখি! তার পা নেই, মাটি থেকে এক হাত উপরে খালি খালি ফড়ফড় করে উড়ে বেড়াচ্ছে। গলায় স্বর নেই, ডাকছে না, কিন্তু লাল চুনির মতো দুটি চোখ দিয়ে পাগলের মতো ইদিকে-উদিকে তাকাচ্ছে।
বোগি জিজ্ঞেস করল, তবে-না বলেছিলে কেউ ও পাখি চোখে দেখেনি?
মিথ্যা কথা বলেছিলাম, বোগিদাদা। আর কেউ কখনো দেখেনি, শুধু ঝমরু আর আমি দেখেছিলাম। ঝমরু তাকে খপ করে ধরে ফেলল, অমনি সে চোখ বুজে নিঝুম হয়ে গেল, খালি ওর বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। কিন্তু যেই-না আমি তাকে ধরেছি আর ঝমরু তার গলা থেকে সুতোর ফঁস খুলে দিল, অমনি সে ডানা ঝাঁপটা দিয়ে আমার হাত থেকে ফসকে গিয়ে, তিরের মতো আকাশে উড়ে দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল।
তারপর কী হল, ঝগড়ু?
তারপর আর কী হবে? ঝমরু আর আমার আর দেশে থাকা হল না। ওই পাখির ডানার ঝাঁপটা যার গায়ে লেগেছে সে কি আর ঘরে তিধুতে পারে, বোগিদাদা? আজ তুমি ঘুমোও বোগিদাদা, দেখো রুমুর চোখ কখন বুজে গেছে।