ওখানে আর দাঁড়ানো নয়। ঘরে এসে দেখে বোগি পালকটাকে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলেছে। বোগি বলল, ধেত। নেড়িকুকুর পুষতে হয় না। ওদের জাত খারাপ, পোষ মানে না, যা-তা খায়। তার চেয়ে বিলিতি কুকুর ঢের ভালো। সেজো মামা একটা দেবে, চাইলেই দেবে। তার জন্য নতুন লাল কলার কিনব। এটাকে ফেলে দে।
রুমু অমনি জানলা গলিয়ে কলারটা বাইরে ফেলে দিল। নেড়িকুত্তোর কলার আবার কে পরবে?
বোগি উঠে দাঁড়াল।
দেখ রুমু, তারপর যদি কখনো ভুলোটা ফিরে আসে, খবরদার ঢুকতে দিবিনা কিন্তু। ঠেলে বের করে দিবি।
দাদা, ভুলোকে ঠেলে দিলে যে আবার দৌড়ে দৌড়ে ফিরে আসে! মনে হয় ঠেলে দিলে খুশি হয়।
তা হলে বেঁটে লাঠি দিয়ে মেরে তাড়াবি।
ওকে মারলে ও নিশ্চয় আমাকে কামড়ে দেবে। কক্ষনো যাবে না।
দেখ, কলারটা বরং আবার তুলে নিয়ে আয়। ছেলেটার গলায়ও মন্দ দেখাবে না। ও কী, এ-সময়ে শুয়ে পড়লি যে? সর, আমিও সোব, আমার শরীর খারাপ লাগছে।
০৩. একটা ভাঙা মাটির ভাঁড়ে
বিকেলে ঝগড়ু, একটা ভাঙা মাটির ভাঁড়ে করে কী যেন নিয়ে এল।
কী রে ঝগড়ু? কী এনেছিস?
উঠেই দেখো-না, এ সেই আমাদের দুমকার জাদুকরি মাঞ্জা, ঘুড়ির সুতোয় লাগিয়েছ কী দেখো কী কাণ্ড হয়।
কোথায় পেলি রে?
আরে দুমকা থেকে কত কষ্ট করে আমার শালা এনে দিয়েছে। আহা, হাত দিয়ো না দিদি, মাঞ্জায় কাচের গুঁড়ো দেয়া থাকে জান না?
তুমিই তো বলেছ দুমকায় কাচ পাওয়া যায় না বলে জানলায় তোমরা চাটাই বুনে দাও, কাচ কোথায় পেল তোমার শালা? রোজ রোজ উলটোরকম কথা বল!
বেশ, বিশ্বাস না হয় আমি কুসিদিদিদের বাড়িতে দিয়ে আসছি, জগুরাও সুতোলাটাই কিনেছে দেখে এলাম। তা ছাড়া দুমকায় কাচ নেই বলে থাকতে পারি, কাচ হয় না তা তো বলিনি। জাদুকরি মাঞ্জায় দুমকার সেই কাচের গুঁড়ো না দিলে অন্য মাঞ্জা থেকে কোনো তফাতই থাকে না।
রুমু বোগি বিছানা থেকে উঠে এসে বলল, কীরকম কাচ, ঝগডু?
তোমরা তা হলে হাত-মুখ ধুয়ে, জলখাবার খেয়ে, জামাকাপড় পরে আমার সঙ্গে চলো, শালবনে ফুল ফুটেছে দেখবে চলো। তাহলে জাদুকরি মাঞ্জার কথা বলব।
সত্যি গল্প তো ঝগড়ু? তুমি কিন্তু ভীষণ গুল মার।
ইচ্ছে না হয় বিশ্বাস কোরো না, আমি আর কী করতে পারি। তবে এই কথা মনে রেখো, দরকার না হলে আমি কখনো মিছে কথা বলি না।
শালবন থেকে রেলের লাইন দেখা যায় না, কিন্তু ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় কত দূর থেকে আসছে, আবার তারপরেই মনে হয় একেবারে কানের গোড়ায়, কিন্তু যেই না মুখ ফিরিয়ে দেখতে গেছ, অমনি আবার মনে হবে কত দূরে সরে গেছে।
শাল বনে থেকে থেকে দমকা দমকা হাওয়া দেয়, সাদা গুঁড়োর মতো রেণু ওড়ে, শাল ফুলের সোঁদা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে।
ভুলো এলে বেশ হত, না দাদা? গাছের গোড়ায় ঢিপি ঢিপি ফুল জমেছে, ভুলো থাকলে ওর মধ্যে নাক ঢুকিয়ে নেচে-কুঁদে একাকার করত।
বোগি বলল, ঝগড়ু, আর চালাকি নয়। বলো শিগগির দুমকার কাচের কথা। না, চুপ করে থাকলে চলবে না ঝগড়ু।
চুপ করি কি সাধে! দুমকার কাচের কথা ভাবলেও আমার মনটা উদাস হয়ে যায়। দুমকা কীরকম জায়গা জান তোমরা? শুকনো খরখর করে চারদিক, আর যেই শীত পড়ো-পড়ো হয়ে আসে, অমনি শিরশির করে একরকম বাতাস বইতে থাকে। আর গাছে গাছে পাতাগুলো সব আলাদা আলাদা হয়ে বাতাসে গা মেলে দেয়! রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ওই বাতাসের শব্দ আর পাতা খসার আর দূরে কাঁদের বাড়িতে শীত-লাগা কুকুরের ডাক শোনা যায়। দুমকার লোকেরা কুকুর ভালোবাসে, বোগিদাদা–
এই অবধি বলে টুক করে একবার রুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে ঝগড়ু তাড়াতাড়ি বলতে লাগল, আর শুধু কুকুর কেন–কুকুরদের পেজোমির কথা তো তোমরা জানই–দুমকার লোকরা মুরগি ভালোবাসে, শুয়োর ভালোবাসে বেড়াল বাদে সব জন্তুজানোয়ার ভালোবাসে
কেন, বেড়াল বাদে কেন?
খোলা শত্তুর ভালো, রুমুদিদি, যাদের নখ ঢাকা থাকে আর আলো লাগলে যাদের চোখ ছোটো হয়ে যায়, তাদের ভালোবাসতে নেই। দুমকার লোকেরা তাই বেড়াল ভালোবাসে না।
বোগি বলল, আঃ, কী বেড়াল বেড়াল করছ, কাচের কথাটা বলো না।
এই বলি শোনো। চাটাই দিয়ে জানলা বন্ধ করে ঝাপিকুঁপি হয়ে শুয়ে থাকি, শরীরটা গরমের মধ্যে আরামে শুয়ে থাকে কিন্তু মনটা ওই বাইরে বাইরে শীতের মধ্যে পাতা খসার শুকনো গন্ধের মধ্যে, ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে হু হু করে বেড়ায়।
কেন?
আরে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেলে শরীরের চোখ তো বন্ধ হবেই, আর শরীরের চোখ বন্ধ হলে মনের চোখ খুলবেনা? যাই হোক, আমার বুড়ো ঠাকুরদা ভাবলেন ঘরে আলো আনতে হবে। জানলায় কাচ দিয়ে দিনে আলো আনতে হবে, প্রদীপের চারদিকে কাচ দিয়ে রাতে আলো আনতে হবে। কিন্তু দুমকায় কাচ কোথায়, কাচের বড়ো দাম। তখন আমার বুড়ো ঠাকুরদা শাল গাছ, মহুয়া গাছ আর হাজার হাজার মৌচাকসুষ্ঠু একটা গোটা বন বেচে দিয়ে, শহর থেকে এক বাবু ভাড়া করে আনলেন, সাহেবদের লেখা কেতাব দেখে কাচ তৈরি করে দেবে। তাকে নিজের ঘর ছেড়ে দিলেন, বিরাট চুল্লি তৈরি করে দিলেন, মালমশলার পাহাড় বানিয়ে ফেললেন, মুরগি আর গাওয়া ঘি খেয়ে খেয়ে রোগা বাবু মোটা হয়ে গেল, কিন্তু কাচ আর হল না।
কেন হল না ঝগড়ু?