বোগি রুমু একবার ঝগড়ুর দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু আর বলা হল না। ঝগড়ুটা ভারি বাজে বকে, এখনি দাদু-টাদুকে বলে একাকার করবে।
ঝগড়ু বলল, কে জানে, যা পাজি কুকুর, ঘরের ভাত মুখে রোচে না, কোত্থেকে কী খেয়ে এসেছে কে জানে!
বোগি শুধু বলল, থাক চেনে বাঁধা। আজ রাত্রে ছাড়িস না ওকে।
রুমু বলল, কিন্তু রাতে যদি ক্যাঁওম্যাঁও লাগায়? দাদু যদি রাগ করে?
ঝগড়ু, মশারির দড়িটাকে দাঁত দিয়ে কামড়ে টান করে ধরে, দু-হাতে গিঁট বাঁধতে বাঁধতে বলল, কম বদমাশ ওই কুত্তো! সব বাড়ির কুকুর সারাক্ষণ বাঁধা থাকে, আর এনাকে একটু বাঁধলেই পাড়া মাত করবেন! ইদিকে ছাড়লে আবার একে কামড়ে, ওকে কামড়ে একাকার করবেন!
রুমু বলল, আহা, রুটিওলা যে ওর ল্যাজ মাড়িয়ে দিয়েছিল।
তোমাদের দাদুর বন্ধু অনিমেষবাবুও ল্যাজ মাড়িয়েছিল?
বোগির বিরক্ত লাগছিল।দেখো ঝগড়ু, বাজে বোকো না। অনিমেষবাবু কালো জোব্বা গায়ে দিয়ে এসেছিলেন। জানোই তো কালো জোব্বা দেখলে ভুলো রেগে যায়।
বেশ, বোগিদাদা, বেশ! তোমাদের কুকুরের জন্য তোমাদের হাতে হাতকড়া পড়লে আমার আর কী হবে, বলো!
ঝগড়ু চলে গেলে, বোগি অনেকক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইল। তারপর একবার উঠে, টেবিল থেকে টর্চটা নিয়ে, গুটিগুটি গিয়ে ভুলোকে দেখে এল। ভুলো নাক ডাকাচ্ছে!
আবার এসে শুতেই রুমু চাপা গলায় ডাকল, দাদা!
চুপ কর। ঘুমো। ঠিক আছে।
পরদিন সকালে দাঁত মাজতে মাজতে পিছনের বারান্দায় গিয়ে রুমু বোগি দেখে, জানলার শিকের সঙ্গে ভুলোর চেন বাঁধা, তার আগায় কলার আটকানো, কিন্তু ভুলো নেই।
নেই তো নেই। চা খেতেও এল না। বোগি সে-বিষয় কোনো কথা না বলে বাড়ির চারপাশটা একবার খুঁজে এল। রুমু রান্নাঘরের পিছনে ঝগড়ুকে একটু বলতে গিয়েছিল। ঝগড়ু চেঁচিয়ে মেচিয়ে এক কাণ্ড করে বসল। আমি যেতে পারি নেড়িকুত্তো খুঁজতে এই সাত সকালে, যদি তোমরা দুজন কুয়ো থেকে জল তুলে স্নানের ঘরের চৌবাচ্চা ভরে, রান্নাঘরের ট্যাঙ্কি ভরে, চারাগাছে জল দিয়ে–দিদিমাও রান্নাঘর থেকে ডেকে বললেন, আচ্ছা, নেড়িকুত্তো কখনো পোষ মানে শুনেছিস? হাজার চান করিয়ে, পাউডার মাখিয়ে, কানা-তোলা থালায় করে খেতে দিস, সেই এর বাড়ি ওর বাড়ি আঁস্তাকুড়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াবে–যা দিকিনি এখন, সকাল বেলাটা হল গিয়ে সংসারের চাকায় তেল দেবার সময়।
রুমু ঘরে ফিরে এল। বোগি কোলের উপর বই নিয়ে বসে আছে।
দাদা, হলদে পালকটা দেখি।
অদ্ভুত পালকটা। অন্য পালকের রোঁয়াগুলো একসঙ্গে সেঁটে মোলায়েম হয়ে থাকে। হলদে পালকটার রোঁয়াগুলো কোঁকড়া, রোদ লেগে ঝকমক করছে, হাওয়ায় ফুরফুর করছে। গোড়াটা সাদা কাচের একটা ফুলের মতো।
রুমুর একটু ভয় ভয় করতে লাগল। এমনি সময় ওরা হাসিটা শুনতে পেল। ঝগড়ুর ঘরের ওদিক থেকে খিলখিল করে কে হাসছে। বোগি রুমু তখুনি এক দৌড়ে সেইখানে।
ঝগড়ুদের দাওয়ায় একটা ছেঁড়া মাদুরের উপর একটা ছোট্ট কালো ছেলে বসে আছে। এত মোটা যে পেটে ভাঁজ ভাঁজ পড়ে গেছে, মাথায় কয়েকগাছি কোঁকড়া চুল, খালি গা, একগাল হাসি, পাটকিলে রঙের চোখ আর বড়ো বড়ো দুটো কান, মাথা থেকে পাখনার মতো আলগা হয়ে রয়েছে, উপর দিকটা একটু ছুঁচলো।
ঝগড়ুর বউ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেটাকে টপ করে কোলে তুলে নিয়ে বলল, আমার ভাইয়ের ছেলে, এখেনে কয়েক দিন থাকবে। তোমাদের এখন পড়ার সময় না?
রুমু জিজ্ঞেস করল, কখন এল? কাল তো ছিল না। কোত্থেকে এল?
বউ বলল, আজ ভোরে এসেছে দুমকা থেকে। তোমরা যাও, তোমাদের দিদিমা রাগ করবে। চাকর-বাকরদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা ভালো নয়।
বোগি দাওয়ার উপর বসে পড়ল। কেন ভালো নয়?
বউ একটু রেগে গেল। দেখ, বোগিদাদা, এখন আমার রাঁধাবাড়ার সময়। অন্য সময় এসো।
ছেলেটাকে দাও, এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।
অ মা! ছেলে নিয়ে তুমি কী করবে?
না দিলে কিছুতেই যাব না।
ঝগড়ুর বউ রেগেমেগে দুম করে ছেলেটাকে মাটিতে বসিয়ে দিয়ে ঘরে চলে গেল।
বোগিও অমনি তাকে তুলে নিয়ে দে দৌড়।
বারান্দায় তাকে ছেড়ে দিতেই সে হামাগুড়ি দিয়ে সটান ভুলোর থালার কাছে গেল। তারপর খালি থালা দেখে তার রাগ দেখে কে!
রুমু একটু রুটি এনে দিতে তবে থামল। বোগি আস্তে আস্তে ডাকল, ভুলো, ভুলো, ভুলো!
ছেলেটা খিলখিল করে হেসে, হামা দিয়ে কাছে এসে, ভিজে ভিজে জিব দিয়ে বোগিকে চেটে দিল।
রুমু কাঁদতে লাগল। গোলমালের মধ্যে ঝগড়ু এসে ছেলেটাকে বারান্দা থেকে নামিয়ে মোমলতার তলায় ছেড়ে দিল।
তোমরা এইখেনে খেলা করো দিদি। বারান্দার উপরে দিদিমা দেখলে রাগ করবে।
ঝুরঝুর করে মোমলতার ফুল ঝরে পড়ছে, তাই দেখে ছেলেটা আহ্লাদে আটখানা। মুঠো মুঠো তুলে মুখে পুরতে চায়! শিশু গাছে দলে দলে বুনো হাঁস এসে বসেছে, দেখে মনে হয় বুঝি বড়ো বড়ো সাদা ফুলে গাছ ভরে গেছে। তাই দেখে খিলখিল করে ছেলেটা হেসে ওঠে।
অমনি যেন নিশানা পেয়ে হাঁসের ঝাঁক একসঙ্গে আকাশে উড়ে পড়ে। আকাশের দিকে দুই হাত তুলে ছেলেটা কাঁদতে থাকে।
রুমু বলল, দাদা, আগেই তো ভালো ছিল।
বোগি ছেলেটাকে খুব আস্তে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলে, কেন খেইছিলি হলদে পাখি? কে বলেছিল খেতে?
ছেলেটার কান্না থেমে যায়, এই বড়ো বড়ো ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে।