ম্যাজিকের গল্প বলো এবার নাথু।
নাথু বলল, সে আর এমন কী কথা! বছর বারো আগে একবার হাটের দিনে একটা লোক এসে নানারকম ম্যাজিক দেখিয়ে, এক পয়সা দু-পয়সা নিচ্ছিল। লোকেরা সব মজা পেয়ে গেল। ওকে ঘিরে তারাও রগড় করতে লাগল। লোকটাকে একটু বোকা মতন মনে হয়েছিল।
ক্ষেত্ৰী বলে একজন দোকানদার ছিল। ভারি পাজি আর কেউ পয়সা রোজগার করছে দেখলে তার গা জ্বলে যেত। লোকটা তার কাছে আট আনার কীসব জিনিস কিনে যেই তাকে একটা আধুলি দিয়েছে, অমনি সেও ঢং করে অন্য হাত দিয়ে চাপা দিয়ে বলেছে, ফুসমন্তর লাগ লাগ লাগ– কই হে, আধুলি দাওনি তো, এ তো একটা পয়সা!
লোকটা একটু যেন অবাক হয়ে আবার একটা আধুলি দিয়েছে, অমনি আবার সেটা পয়সা হয়ে গেছে। হাটের লোকেদের হেসে হেসে পেটে ব্যথা ধরে গেল। লোকটা ভারি বোকা বনেছে তো।
তখন কে একজন বলল, আরে, তুমিও কি কিছু কম যাও নাকি হে? দাও না ওকে ধুলো-পড়া করে উড়িয়ে!
বলবামাত্র লোকটা একমুঠো ধুলো তুলে শূন্যে ছুঁড়ে দিল, আর হাটসুষ্ঠু সকলের সামনে থেকে ক্ষেত্ৰী অদৃশ্য হয়ে গেল। তখন এমনি একটা শোরগোল উঠল যে তার মধ্যে কোন ফাঁকে যে সে লোকটা সরে পড়ল, কেউ টেরও পেল না। ক্ষেত্রীর টিকিটি আর কেউ দেখেনি। ম্যাজিক যে একেবারেই হয় না, তা বোলো না বোগিদাদা।
তারপর ক্ষেত্রীর কী হল?
সে আর আমি কী জানি। যেমনি ব্যাটা পাজি ছিল, তার ঠিক সাজাই হল। ও কী রুমুদিদি, আবার কী হল?
যদি কেউ ভুলোকে ধুলো-পড়া করে দেয়?
আহা, ভুলো তো আর দুষ্টু নয়, ভুলো তোমাদের ভালো কুকুর।
ভুলো যে দাদুর দুধ খেয়ে ফেলেছিল? অনিমেষবাবুকে কামড়েছিল? দিদিমার জামা ছিঁড়ে দিয়েছিল?
বোগি বলল, কেউ ভুলোকে ধুলো-পড়া করেনি রুমু, ন্যাকামি কোরো না। একটা রুমালও আনতে পার না।
ম্যাজিক দেখে বাড়ি ফেরবার সময় বোগি দেখে, রুমু ফ্রকের কেঁচড়ে করে কী নিয়ে চলেছে। আঃ, রুমু, ফ্রক নামাও, আবার পেট দেখা যাচ্ছে।
রুমু মাথা নাড়ল। ঝগড়ু, বলল, কী আছে দিদি? দাও আমার হাতে, আমি নিয়ে যাই। ও কী! তোমার তো ভারি সাহস হয়েছে দেখছি, অত বড়ো মাকড়সাকে কোলে তুলেছ?
বোগি ব্যস্ত হয়ে উঠল। ছিঃ রুমু, মাকড়সারা বিষাক্ত হয়, কী বলে ধরলে? ভয়ও করল না? ফেলে দাও, ঝগড়ু।
রুমু কেঁদে ফেলল, না, ঝগড়ু, না, ওর পাঁচটা ঠ্যাঙ, ওকে ফেলো না।
ঝগডু একটুক্ষণ কী ভেবে, পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে মাকড়সাটা তার মধ্যে পুরে নিল।
রুমু খুশি হয়ে বলল, এত দিন পরে!
নাথু বলল, ব্যাপার যেন ঘোরালো বলে মনে হচ্ছে, দিদি।
ঝগড়ু বলল, ওকে বিরক্ত কোরো না, নাথু। বলবার হলে বলবে, কারো মনের কথা কেড়ে নিতে হয় না।
রুমু জিজ্ঞেস করল, নিদুলি মন্ত্রটা কী, ঝগড়ু?
ঘুমিয়ে পড়বার মন্ত্র, দিদি, বদলে যাবার মন্ত্র।
ঘুমালেই কি বদলে যায়, ঝগড়ু?
ওদের কথা শুনে বোগি খানিকটা এগিয়ে এল, তুমি বেশ বদলে যাও, রুমু। শোবার সময়ে খিটখিট কর, কথায় কথায় কাঁদ। আর সকালে ওঠ হাসিমুখে। ঝগড়ু তুমি তো জান নিদুলি মন্ত্র?
বলেছিনা দুমকায় সবাই জানে নিদুলি মন্ত্র, দাদা। দুমকার ঘুম তো আর এখানকার ঘুমের মতো ছিল না। দুমকায় লোকে ঘুমোত এক চোখ আর এক কান খুলে রেখে। সেও একরকম ঘুম, আবার ঘুমোয় না এমন লোকও তো আছে। তাদেরই জন্য নিদুলি মন্ত্র হয়েছিল। ঘুম পাড়াবার মন্ত্র, বোগিদাদা। তোমার রাতে ঘুম হয় তো?
রুমু বলল, ও ঘুমোয়, আমার কিন্তু ঘুম হয় না। যখনই ঘুম ভেঙে যায়, তখনই দেখি জেগে আছি।
আরে, তা হলে তোমারই জন্য তো নিদুলি মন্ত্র, দিদি।
রুমুর আর পা চলতে চায় না, পা ব্যথা করে, এমন সময় ওরা বাড়ি এসে পৌঁছোয়। রাত্রে শুলে পরে ঝগড়ু এসে পা টিপে দেয়। রুমুর কী যে আরাম হয়; ঝগড়ুকে বলে, ঝগডু, তুমি কি ওই কালো ছেলেটাকে ভালোবাস?
তা বাসি বই কী, দিদি, বউয়ের ভাইয়ের ছেলে, ভালো না বেসে কি আর আমার উপায় আছে?
আচ্ছা, ঝগড়ু, ওকে না দেখলে তোমার কষ্ট হবে?
কষ্টকে ভয় করলে তো আর ভালোবাসা যায় না, দিদি। ওর বাবা-মা এসে ওকে নিয়ে গেলে আর দেখতে পাব না। ভুলোকে দেখতে পাচ্ছনা বলে তোমার কষ্ট হচ্ছে দিদি? তবে কি ভুলোকে ভালো না বাসলে ভালো হত?
রুমুহঠাৎ এক গাল হেসে বলল, ভুলো তো আবার আসবে।তুমি একটা সোনা রুপোর মাদুলি খুঁজে পাও না, ঝগড়ু?
কী হবে, দিদি?
বাঃ, তুমি-না বললে নিদুলি মন্ত্র দিয়ে যে কুকুররা শেয়ালরা হলদে পাখি খেয়ে মানুষ হয়ে যায়, তাদের আবার জানোয়ার করে দেওয়া যায়?কিন্তু সেভারিশক্ত, পাঁচ-ঠ্যাঙ মাকড়সা চাই, সোনা রুপোর মাদুলি চাই। বলনি তুমি?
বোগি অন্য খাট থেকে মাথা তুলে বলল, বলনি তুমি? তবে কি ফের বাজে বকছিলে? গাঁজাখুরি কথা বলছিলে, ঝগডু?
না, না, বোগিদাদা। বিশ্বাস করো, আমি যেমন করে পারি সোনা রুপোর মাদুলি এনে দেব। কিন্তু কাকে জানোয়ার বানাতে হবে তা বললে না?
১৫. রুমু বোগি উঠে বসল
রুমু বোগি উঠে বসল।
বলল, দাদা, তুমি বলো।
ঝগড়ু, ভুলো যেদিন পালিয়ে গিয়ে রাত করে ফিরেছিল, সেদিন ও কোথা থেকে হলদে পাখি খেয়ে এসেছিল, ওর ঠোঁটের কোনায় হলদে পালক গোঁজা ছিল।
সে কী, বোগিদাদা!
হ্যাঁ, ঝগড়ু, হ্যাঁ। পরদিন সকালে দেখি ভুলো নেই, কিন্তু তোমার ঘরে একটা কালো ছেলে। তার চোখ পাটকিলে রঙের আর কানের উপরদিকটা খোঁচামতে। তুমি মুখ ঢাকছ কেন, ঝগড়ু?