যারা জলে জলে কাজ করে, জান তো তাদের জলের নেশা লেগে যায়, জল ছেড়ে থাকতে পারে না। আমারও হল তাই। রোজ কাপুনি দিয়ে জ্বর আসে, সে কী দারুণ শীত সে আর কী বলব, বুকের ভিতরটা পর্যন্ত হিম হয়ে যায়, তারপর বিকেল বেলায় ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়। কাজও করতে পারি না, অথচ ঘরে শুয়েও থাকতে পারি না।
কেন, নাথু, শুয়ে থাকতে পার না কেন?
শুলে যে সময় চলে যায়, রুমুদিদি, একটু একটু করে সময় ফুরিয়ে যায়। শোনোই-না গল্প। আমাদের গাঁ ছেড়ে খানিকটা উত্তরে একটা আম গাছ আছে জলের কিনারায়। সেইটে ঠেস দিয়ে বসে মাছ ধরি। পোকামাকড়ের টোপ দিই না, দিদি, পোকামাকড়ে সাধারণ মাছ ওঠে।
সাধারণ মাছ উঠলে কী হয়, নাথু?
কী জ্বালা! সাধারণ মাছ তো হাটেও কিনতে পাওয়া যায়, ও দিয়ে আমি কী করব?
আচ্ছা, আচ্ছা, বলো।
একদিন আমি বঁড়শিতে একটা লাল টুকটুকে কুঁচফল গেঁথে ছিপ ফেললাম। ভারি জল তখন, আমাদের এখানে রোদ ঝকঝক করছে, কিন্তু নদীর গোড়ায় কোথায় বৃষ্টি পড়েছে, ভারি জোর স্রোত। ভাবছি এত স্রোতে মাছ পড়বে না, সারা গা রোদে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু বুকের বরফ কিছুতেই গলছে না, এমনি সময় সুতোয় টান লাগল। টেনে তাকে তুলতে পারি না, হাঁপ ধরে গেল, শেষে অনেক কষ্টে তাকে ডাঙায় ওঠালাম। ওরকম মাছ তোমরা চোখে দেখনি, বোগিদাদা, রুমুদিদি। দেখবেও না কখনো।
থামলে কেন নাথু? বলো, বলো।
আঃ! থামলাম সেকথা মনে করেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে বলে। শোনোমন দিয়ে। মাছটা দুই হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। রোদের আলোতে স্পষ্ট দেখলাম তার মাথা-ভরা কালচে সবুজ চুল ঘাড়ে গলায় লেপটে রয়েছে, ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে বড়ো কষ্টে নিঃশ্বাস ফেলছে, মুক্তোর সারির মতো দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে, কানের কাছে চুলের সঙ্গে বঁড়শি আটকে গেছে, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। ছোটো দু-টি কানে দুটি সোনার মাকড়ি পরা। দেখলাম পদ্মফুলের মতো হাত দুটি দিয়ে শক্ত করে ঘাস আঁকড়ে রয়েছে, নীল নীল শিরা দেখা যাচ্ছে, দিঘির মাঝখানকার মতো ঘন সবুজ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, বুটা কত যন্ত্রণায় উঠছে পড়ছে। কোমরের তলা থেকে মাছের মতো দেখতে, ল্যাজটার কী রঙের বাহার, ময়ূরের পেখমের মতো মেলে রয়েছে। দেখতে দেখতে আমার চোখের সামনে তার সব রং ফিকে হয়ে আসতে লাগল, নিঃশ্বাসের ওজন যেন এক-শো মন, দু-ফোঁটা চোখের জল আমার হাতে এসে পড়ল। অমনি আমার বুকের ভিতরকার বরফ গলে গেল, আমি তাড়াতাড়ি টাক থেকে আমার ছুরিটা বের করে ছিপের সুতো কেটে দিলাম। ভয় হল এখুনি বুঝি এলিয়ে পড়বে, কোলে তুলে তাকে মাঝ নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। সারা গা আমার ভিজে গেল। তারপর আর মনে নেই।
যখন জ্ঞান হল, দেখি ঘরে শুয়ে আছি, জ্বর গায়ে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য বাড়ির লোকেরা রাগারাগি করল। এখন যাই, বোগিদাদা রুমুদিদি। ঝগড়ুর গল্প সব সত্যি না-ও হতে পারে।ও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে।
যেতে যেতে থেমে বলে, এই আমার এক কানে সোনার মাকড়ি দেখছ, এটিকে পরদিন ওই আম গাছের তলায় পেয়েছিলাম।
নাথু গাঁটরি নিয়ে চলে গেল, আর ঝগড়ু হেসে বলল, জ্বরও হল গিয়ে স্বপ্নেরই জাতভাই, দাদা। স্বপ্ন দেখতে না পারলে আর পারলে কী? উঠি। গা-টা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, কাঠ ফেড়ে ঘাম করিয়ে শরীরটাকে ঝরঝরে করে ফেলি। কাল সারা রাত ঘুমোইনি, বোগিদাদা, চাঁদনি রাতে কুকুররাও ঘুমোয় না, আমারও চোখে ঘুম থাকে না, আমার শালার ছেলেটা কিন্তু খুব ঘুমিয়েছে।
চাঁদনি রাতে ভুলো তো ঘুমোত, ঝগড়ু।
ভুলো? সে তো সুখী কুকুর, সুখীদের ঘুমোতে বাধা নেই।
সুখী তো পালিয়ে যায় কেন, ঝগড়ু? সুখীরা পালায় না কে বলেছে দিদি? সুখীরা পালায় ওই সুখের কাছ থেকেই; দুঃখ পায় না বলে দুঃখকে খুঁজে বেড়ায়। বলব একদিন আমার বাবার বর্মা যাওয়ার কথা!
১৩. চাঁদনি রাতে দুঃখী কুকুররা
চাঁদনি রাতে দুঃখী কুকুররা সত্যি ঘুমোয় না, সারা রাত চাঁদের দিকে মুখ তুলে হু-হুঁ করে কাঁদে। তাই শুনে রুমুরও কান্না পায়, বোগির খাটে উঠে এসে শোয়।
ঝগড়ু এসে বলে, শুনবে নাকি আমার বাবার বর্মা যাওয়ার গল্প?
হা, ঝগড়ু শুনব।
বুঝলে, আমার ঠাকুরদার তখন খুব ভালো অবস্থা। আমার বাবা আর কাকা রাজার হালে থাকে, কাজকর্ম বিশেষ করতে হয় না, সারাদিন হরিণ শিকার করে, বাঁশি বাজিয়ে, মাছ ধরে ঘরে ফিরে মাংস-ভাত খেতে পায়। রাতে বিছানায় নরম তোশক পায়, কম্বল পায়। সোনার আংটিও হল দু জনার, যার যা শখ ছিল মিটে গেল! তখন তারা আর সইতে না পেরে একদিন ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল।
কেন, ঝগড়ু, ভালো ছিল তো, পালাল কেন?
শখ মিটে যাওয়া ভালো নয়, দিদি, তখন পালানো ছাড়া আর উপায় থাকে না।
ঝগডু!
কী, বোগিদাদা?
তোমার কী মনে হয় ভুলোর সব শখ মিটে গেছিল?
তা কী করে মিটবে, বোগিদাদা? কয়েকটা শখ তো মেটেনি জানি। যেমন আমার পায়ের গুলি কেটে নেবার শখ। রেবতীবাবুদের বেড়াল খাবার শখ। তোমার দাদুর ইজিচেয়ারে বসবার শখ। না, দাদা, ভুলোর শখ মিটতে দেরি আছে।
আচ্ছা, তোমার বাবার কথাই বলো। কোথায় গেল তারা?
কাঠের আড়তে লোক নিচ্ছিল, বর্মায় কাঠ কাটতে যেতে হবে। বাবা আর কাকা সেইখেনে গিয়ে নাম লিখিয়ে, সেই রাত্রের গাড়িতেই এক দলের সঙ্গে রওনা হয়ে গেল। গাঁয়ের কেউ জানতে পারল না। ঠাকুমা কেঁদে কেঁদে সারা।