দিদিমাকে বলে একবার যাও-না কেন ঝগড়ু? তোমার বুড়ি মা কত খুশি হবে।
নানকুর বিয়ে দিতে যাব মনে ঠাউরেছি। কী জান, দিদি, আমাদের গুষ্টির ছেলেরা যে ধানের চাল খাবে সে হেথা-হোথা কত দূর দূর দেশে বোনা হয়েছে।
তা কেন, ঝগড়ু? তোমার বাবা, ঠাকুরদা তো দেশে থাকত।
চিরকাল কি আর দেশে থাকত, বোগিদাদা? আমার বাবা সে একরকম ছিলেন। আর জন্তুজানোয়াররা ছিল তাদের ঘরের লোক। একবার দুমকার ঘোর জঙ্গলে কাঠের খোঁজে গিয়েছিলেন, দেখেন কিনা গাছের গোড়ায় একটা এতটুকু বনবেড়ালের বাচ্চা মিউমিউ করে কাঁদছে। বাবাকে দেখে সে দারুণ খুশি,দু-পা তুলে নেচে-টেচে একাকার। বাবা তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার চোখের দিকে চাইলেন। মনে হল তার হলদে চোখের পিছনে আলো জ্বলছে। বুকে করে বাবা তাকে ঘরে নিয়ে এলেন।
সে-রাত্রে আমাদের গায়ের কেউ ঘুমুতে পারল না, নেকড়ে বাঘ এসে সারা রাত দাপিয়ে বেড়াল। বাবা বনবেড়ালের বাচ্চাকে বুকে নিয়ে শুয়েছিলেন, শেষ রাত্রে মনে হল বাঘ বুঝি উঠোনে এসে কেঁদে বেড়াচ্ছে। জানলার ঝাঁপি খুলে বাবা তখন বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিলেন, অমনি নেকড়েও তাকে মুখে করে তুলে নিয়ে এক ছুটে চলে গেল।
তাহলে বনবেড়ালের বাচ্চা নয়, ঝগড়ু, নেকড়েরই বাচ্চা।
কী জানি, রমুদিদি, ওদের জাতই আলাদা। ওরা মানুষের বাচ্চাও পোষে তা জান? আমাদের। গাঁয়ের একটা ছোট্ট ছ-মাসের ছেলে হারিয়ে গিয়েছিল, তার গলায় মোটা রুপোর কণ্ঠি ছিল। দশ বছর বাদেও নেকড়ের দলে একটা মানুষের ছেলেকে চার হাত-পায়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত, তার গলায় রুপোর কণ্ঠি।
ওর বাবা-মা ওকে ধরে আনল না কেন?
সে কি আর চেষ্টা করেনি, দিদি, মানুষ দেখলেই সে কামড়াতে আসত, ঝোঁপের মধ্যে মিলিয়ে যেত। যে মানুষের রক্তে নেকড়ের দুধ মিশেছে সে কি আর অন্য মানুষের মতো হয় কখন?
ঝগড়ু, তোমার বাবা চিরকাল দেশে থাকেননি বললে, কোথায় গেছিলেন?
বর্মা, জান বোগিদাদা? সমুদুরের ওপারে বর্মা আছে, সেইখানে।
বলো তোমার বাবার বর্মা যাওয়ার গল্প। এখন তার সময় কোথায় দিদি? ওই দেখো নাথু এল কাপড়ের গাঁটরি নিয়ে।
১২. নাথু হল ঝগড়ুর বন্ধু
নাথু হল ঝগড়ুর বন্ধু। ঝগড়ুর জন্য নাথু ট্যাকে করে গুণ্ডি নিয়ে আসে। ঝগডুর বউ নাথুকে দেখতে পারে না, তাই নাথুর কাজ সারা হলে ঝগড়ু ওর সঙ্গে মোমলতার তলায় বসে গল্প করে।
বোগি বলে, কেন তোমার বউ নাথুকে দেখতে পারে না, ঝগড়ু?
নাথু মুচকি হেসে বলে, আমার পা দুটো ডুবে থাকে এখানকার নদীর জলে, কিন্তু মন কোথায় থাকে ঝগড়ুর বউ জানে না, তাই আমাকে দেখতে পারে না!
কেন, নাথু, কোথায় থাকে তোমার মন?
বাতাস দিলে তোমাদের বাঁশ বনের শিরশির সরসর শব্দ শুনেছ, দিদি? বাতাস থামলে কোথায় থাকে সেই শব্দ? অমন বোকার মতো কথা জিজ্ঞেস কোরো না।
বোগি বলল, ভারি বোকা রুমুটা, নাথু। যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে। আমি মজা করে বলেছিলাম, পুতুল ভেঙেছে কাদিস না, পুঁতে রাখ গাছ হবে। ও সত্যি পুঁতে রেখেছিল।
রুমু বলল, মোটেই আমি বোকা না। মোটেই আমি যে যা বলে বিশ্বাস করি না। খালি তুমি যা বল বিশ্বাস করি। রুমুর কান্না পাচ্ছিল।
নাথু তাড়াতাড়ি বলল, আর বিশ্বাস করবে নাই-বা কেন? কীসের গাছ হয় আর কীসের হয় না, তার তুমিই-বা কী জান, বোগিদাদা? যারই বুকের মধ্যে শেকড়ের কলি আছে তারই গাছ হয়। আমাদের গায়ের কাছে এক সাধু থাকত, তার একটা কানাকড়িও ছিল না। সেবার বান ডাকার পর দুর্ভিক্ষ হল। সে সারা গাঁকে দশ দিন খাওয়াল কী করে? খালি রাশি রাশি চকচকে পয়সা এনে দেয়। তারপর সরকারি সাহায্য এল, সবার দুঃখ ঘুচল, তখন লোকে বলল, সাধু, তুমি পয়সা জাল কর নাকি, অত নতুন পয়সা পেলে কোথায়?
তাকে নাস্তানাবুদ করল গাঁয়ের লোক, মনের দুঃখে সে আস্তানা ছেড়ে চলেই গেল! সে গেলে সবাই বলল, দাও জালিয়াত সাধুর ঘর পুড়িয়ে, ভণ্ডামি করবার জায়গা পায়নি।
ঘরে ঢুকে দেখে কয়েকটি মাটির বাসন আর একটা চট আর ঘরের মাঝখানে ছোটো একটা শুকনো গাছ। তাকে উপড়ে ফেলতেই বেরুল একটা পয়সা, তার চারদিকে গাছের শেকড় ছড়িয়ে রয়েছে। ও কীসের গাছ?
বোগি বলল, তাই বলে তো আর পয়সার বুকে শেকড়ের কলি থাকে না যে গাছ গজিয়ে উঠবে। ওটা আপনিই কেমন করে শেকড়ে জড়িয়ে গেছিল।
নাথু গাঁটরি তুলে মাথায় নিয়ে বলল, পয়সার বুকে শেকড়ের কলি না থাকলেও, দয়ার বুকে তো আছে।
নাথু, যেয়ো না, তুমি একবার কী মাছ ধরেছিলে সেই কথা বলো।
নাথু আবার গাঁটরি নামিয়ে রেখে বলল, ঝগড়ু, বলেছে বুঝি? ঝগড়ু, তুমি বড্ড বেশি কথা বল!
মনের কথা যাকে-তাকে বিলিয়ে দিতে হয় না। হ্যাঁ, তবে বোগিদাদা রুমুদিদিকে বলা যায়, ওদের চোখেও ঘোর আছে কিনা।
বলল, নাথু, বলো। ঝগড়ুকে বোকো না। ঝগড়ুর ঠাকুরদার ঠাকুরদার পাঁচটা বন ছিল। গাছপালা জন্তুজানোয়ার মৌচাক সব ভঁর ছিল। দারুণ সাহস ছিল তার; আর এই বুকের ছাতি।
একবার কুড়ল দিয়ে লম্বালম্বি ল্যাজের ডগা পর্যন্ত বাঘ চিরে ফেলেছিলেন।
একবার ডাকাতে ধরেছিল তাকে, গাঁ থেকে এক কোশ দূরে, এমনি জোরে গাল বাজিয়ে লোক ডেকেছিলেন যে ঝড় উঠেছিল, ডাকাতরা ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল!
শুনে নাথু খুব হাসল, কে বলেছে এসব? ঝগড়ু তো? ও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে তাও জান না? তবে শোনো আমার মাছ ধরার গল্প।