দিদিমাকে নিয়ে একটু গোল বাধল, ঝগড়ু, তোমার সঙ্গে না গিয়ে ওদের দাদুর সঙ্গে গেলেই ভালো হত-না?
না, দিদিমা, দাদু গাছতলায় বসে খালি বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে চায়, হাঁটতে চায় না।
শেষপর্যন্ত ঝগড়ুর সঙ্গেই যাওয়া হল। দিদিমা বললেন, সারাক্ষণ ঝগডুর সঙ্গে সঙ্গে থাকবে, তেলেভাজা খাবে না, অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলবে না।
মেলার মাঠের উপরে মেঘের মতো ধুলো উড়ছে, পা পোঁ করে বাজনা বাজছে। বোগি বলল, সার্কাস দেখাবে তো, ঝগড়ু? জান, বাঁদরে ছাগল-টানা গাড়ি চালায়, টেবিল-চেয়ারে বসে চা ঢেলে খায়! আছে তোমাদের দুমকাতে অমন বাঁদর?
ঝগড়ু বলল, হাসিয়ো না, বোগিদাদা, দুমকাতে ওসব ছেঁদো বাঁদরকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। পয়সা নষ্ট করে সার্কাস দেখে একবার দুমকার বনের মধ্যে যেয়ো দিকিনি!
সে কীরকম বন, ঝগড়ু?
ঝগড়ুর মুখটা অন্যরকম হয়ে গেল, মেলার মাঠের উপরে ধুলোর মেঘের দিকে তাকিয়ে, হোঁচট খেতে খেতে ঝগড়ু চলতে লাগল। সে গভীর বন, রমুদিদি, শাল গাছ, মহুয়া গাছ, সীতাহার গাছ, শিমুল গাছের ভিড় সেখানে। গাছের গা জড়িয়ে লতা ওঠে, শীতের আগে সেই লতায় ঝুরো ব্যুরো সাদা ফুল ফোটে। বুনো মুরগি দেখেছ, রমুদিদি? দুমকার বনে বুনো মুরগি চরে, কী তাদের রঙের বাহার। সমস্ত বন জুড়ে জন্তুজানোয়ারদের খুটখুট কিচিরমিচির, কিন্তু হঠাৎ চোখে কাউকে দেখতে পাবে না। নজর করে দেখো, দিদি, গাছের ডালের সঙ্গে রং মিলিয়ে ছাই রঙের পাখি বসে থাকে, চোখে পড়ে না। যেই-না একটু বাতাস বইল, লতাপাতা ডালপালা শিরশির দুলদুল করে উঠল, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক রোদ্দুর এসে পাখির গায়ে লাগল, অমনি সে ডানা মেলে আকাশে ওড়ে। বাইরেটাই শুধু ছাই রঙের, ডানার তলাটা শাঁখের মতো ঝকঝকে সাদা। গাছতলায়। ঝোঁপঝাঁপ থাকে, দিদি, তাতে ফুল ফোটে, কী তাদের সুবাস, ঝাকে ঝুঁকে প্রজাপতিরা সেখানে ঘোরাফেরা করে।
কিন্তু ঝোঁপের মধ্যে না যাওয়াই ভালো, বোগিদাদা, সেখানে সাপের বাস। হঠাৎ যখন চক্কর মেলে ওঠেন তারা, যেমনি তাঁদের রূপের ছটা, তেমনি তাদের বিষের জ্বালা। রূপের বড়া জুলুনি, দিদি।
তোমরা ঝোঁপের মধ্যে যাও না, ঝগড়ু?
আমরা যাব না কেন? দুমকার ছেলেরা সবাই সাপের মন্ত্র জানে।
কী মন্ত্র বলো।
ঝগড়ু জিব কেটে বলল, সে অন্য কাউকে বলা যায় না, বোগিদাদা, তবে ছোট্ট একটা তামার মাদুলিতে ভরে, তোমার হাতে বেঁধে দিলে, আর ওঁরা তোমায় কিছু বলবেন না।
বলো, দুমকার বনের কথা আরও বলো।
ওইখানে ছোটোবেলায় বাবুদের সঙ্গে পাখি শিকারে গিয়েছিলাম।
পাখি তো বিলের ধারে শিকার করতে হয়, আঃ, রমু, খালি খালি কাঁদ কেন?
সবুজ পায়রার গলায় বন্দুকের গুলি লাগলে রক্ত বেরোয় দেখেছি।
না, দিদি, না, সে সবুজ পায়রার সময় নয়। আমাদের বনে একরকম লালচে রঙেরল্যাজ-ঝোলা পাখি থাকে, মাথায় তাদের কালো ঝুঁটি, বাবুরা তাদের শিকার করে। সে পাখি বিলের ধারে থাকে না।
তারপর কী হল?
বাবুরা অন্য পাখি দেখে, ছোটো ছোটো জানোয়ার দেখে, কিন্তু সব ছেড়ে দেয়। এমনি সময় এক পাল বাঁদরের সামনে পড়ে গেল। বাঁদর মারতে ওরা যায়নি, শুধু শুধু মজা করে বন্দুক তুলতেই, বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, বাঁদরগুলো সব হাতজোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তাই দেখে বাবুরা হেসে উঠল, কিন্তু একজনার হাতের বন্দুককী করে জানি ছুটে গিয়ে, একটা বাঁদরমরে গেল। অমনি এক নিমেষে সব বাঁদর হাওয়া! মরা বাঁদরটা পর্যন্ত রইল না।
তোমার দুঃখ হয়নি, ঝগড়ু?
দুঃখ বলে দুঃখু, রমুদিদি? কিন্তু কী করি, বাবুরাও কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। আর কী আশ্চর্য কথা, বনটার চেহারাও যেন বদলে গেল। হঠাৎ একসময় সকলের খেয়াল হল, কোথাও একটা টু শব্দ নেই। গহন বনটা যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে, কোথাও একটা পাখি নেই, কাঠবেড়ালি নেই, পাতার খসখস শব্দ নেই, ঝোঁপের মধ্যে চকচকে চোখ নেই।
তারপর, ঝগড়ু?
০৮. তারপর বাবুদের মনে ভয় ঢুকে গেল
ঝগড়ু বললে, তারপর? তারপর বাবুদের মনে ভয় ঢুকে গেল, তারা বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচে। যার হাতের বন্দুক ছুটে গেছিল, সে যাচ্ছে সবার আগে, এমন সময় তাকে খরিশে ছোবলাল।
খরিশ? খরিশ কী, ঝগড়ু?
খরিশ আমাদের সাপ, রমুদিদি, ভারি তার তেজ। মাথায় তার খড়ম আঁকা থাকে।
তারপর লোকটা বোধ হয় মরে গেল?
না, বোগিদাদা, আমরা পাঁচজনা দুমকার ছেলে ছিলাম সাথে, মরবে কেন? তাকে আমরা ওষুধ করে বাঁচিয়ে দিলাম, তবে তাকে কথা দিতে হল আর বন্দুক ধরবে না।
তা কেন ঝগড়ু? তোমরাও তো জানোয়ার মার।
বোগিদাদা, আমরা মারি পেটের জ্বালায় কিংবা প্রাণের তরে। তারপর শোনোই-না, এমনি সময় আমার নাকে এল কী মিষ্টি গন্ধ সে আর কী বলব। বাবুরা এগিয়ে গেল, আমি খুঁজে খুঁজে মরি, দেখি গাছের গোড়ায় মাটি থেকে ফুটে আছে এক গোছা উঁইচাপা। কী তাদের রূপ দিদি, মনে হয় সাদা মোমের তৈরি, তার মধ্যে বেগুনি রঙের চিত্তির করা। আর ভূঁইচাপার পাশে মাটির উপর পড়ে আছে সাপের মাথার মণি।
না, ঝগড়ু, যা-তা বললে হবে না, আমাদের বইতে আছে, সাপের মাথায় মণি হয় না।
সে তো তুমি বললেই হবে না, বোগিদাদা, নিজের চোখে দেখলাম।
কোথায় সে?
আরি বাবা! সাপের মাথায় মণিতে হাত দেব আমি! তুমি কি পাগল হলে? তাহলে উনিই-বা আমাকে ছাড়বেন কেন? যেখানেই লুকোয়-না কেন, ঠিক খুঁজে বের করবেন। না, বোগিদাদা, যেখানকার জিনিস সেইখানেই রেখে ঘরে ফিরে এলাম।