এই লোকটা আমার দিকে একচোখ দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল: কী হে ছোঁকরা, পড়াশুনোর উপর নাকি এমনই ঘেন্না ধরে গেছে যে একেবারে সেসব ত্যাগ করে এসেছ? তার গলাটা এমন কর্কশ আর চেহারাটাও এমন বিশ্রী যে আমি সত্যি ভারি ভড়কে গেলাম।
কালো কাপড় পরা লোকটার দিকে তাকাতেই সে গ্রামোফোনের চাকতির মতো বলে যেতে লাগল– পড়াশুনো করে কী হবে? জান, আফ্রিকার জঙ্গলের মধ্যে যেসব বিরাট বিরাট নদী আছে তার ধারে ধারে কুমিরেরা আর হিপ্পোপটেমাসরা শুয়ে শুয়ে দিন কাটায় আর লম্বা লাল ঠ্যাঙে ভর দিয়ে গোলাপি রঙের ফ্ল্যামিংগো পাখিরা রোদ পোয়ায়? আর ওইসব জঙ্গলের মধ্যে এমন বিশাল বিশাল অর্কিড জাতের ফুল ফোটে যে তার মধ্যে একটা মানুষ দিব্যি আরামে শুয়ে থাকতে পারে?
বুঝতে পারছিলাম এ লোকটা জাদু জানে। কারণ তক্ষুনি আমার ভয়টয় কোথায় উড়ে গেল– অন্য লোকটাকে জোর গলায় বললাম: হাঁ, সেসব চিরদিনের মতো ত্যাগ করে এসেছি। লোকটা হাসল, বলল: চিরদিন বড়ো দীর্ঘকাল হে ছোঁকরা চিরদিনের কথা কে বলতে পারে? কিন্তু তোমার সাহস আছে, উৎসাহ আছে, তুমি অনেক কিছু করতে পারবে। স্বাস্থ্যটাও তো ভালো দেখছি। আশা করি বাড়ির জন্য মনের টান ইত্যাদি কোনো দুর্বলতা নেই?
হঠাৎ মনে হল মা এতক্ষণে স্নানের জোগাড় করছেন, বাবা আপিস গেছেন, এবং দু-জনেই মনে ভাবছেন আমি বুঝি ইস্কুলে গেছি। গলার কাছটা সবে একটু ব্যথা করতে শুরু করেছিল এমন সময় কালো কাপড় পরা লোকটা বলল: ইস্কুলের বাইরে, বাড়ির বাইরে, কলকাতা থেকে বহুদূরে নরওয়ের উত্তরে চাঁদনি রাতে হারপুন দিয়ে তিমি শিকার হয়। তিমির গায়ে হারপুন বিঁধলে তিমি এমনি ল্যাজ আছড়ায় যে সমুদ্র তোলপাড় হয়ে যায়। কত নৌকো ডুবে যায়। আবার তিমি মরে গিয়ে যখন উলটে গিয়ে ভেসে ওঠে দেখবে তার বুকের রঙটা পিঠের চেয়ে ফিকে। আর, জান, ইংল্যান্ডে শীত কালে সোয়ালো পাখিরা থাকে না। তারা দলে দলে উড়ে স্পেনে চলে যায়, আর যেই শীত কমে আসে আবার তারা দলে দলে সমুদ্রের উপর দিয়ে অবিশ্রান্ত গতিতে উড়ে ফিরে আসে। এসে দেখে তাদের আগেই শীতের বাতাসকে তুচ্ছ করে ড্যাফোডিল ফুলরা ফুটে গেছে।
আমার মন পাখির মতন উড়ে যেতে চাচ্ছিল।
একচোখা বলল: কিন্তু শুধু তিমি মারলে হবে না। তার বহু অসুবিধাও আছে, বহু দূরও। এই কাছাকাছি মানুষ-টানুষ মারতে পারবে? পরে যাবে আফ্রিকা, নরওয়ে, আলাস্কা– আপাতত অন্ধকার রাত্রে গলির মুখে দাঁড়িয়ে বাঁকা ছুরি হাতে নিয়ে ঘচ করে সেটাকে লোকের বুকে আমূল বসিয়ে দিতে পারবে? যেমন রক্তের নদী ছুটবে তুমিও হো হো করে রাত কাপিয়ে কাষ্ঠ হাসি হেসে। উঠবে? মাথায় বাঁধা থাকবে লাল রুমাল?
আমি উঠে দাঁড়ালাম। সেই কালো কাপড় পরা লোকটা বলল: উত্তর মেরুতে সিল মাছেরা বরফের মধ্যে বাসা করে—
আমি বললাম: কুড়ি বছর পরে উত্তর মেরুর কথা শুনব, এখন আমি ইস্কুলেই বরং যাই, মাথায় আমি লাল রুমাল কিছুতেই বাঁধতে পারব না।
লোকটা বলল: কে জানে ভুল করছ কি না?
আমি ততক্ষণ চায়ের দোকানের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসে ট্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। প্রথম যে ট্রাম এল তাতেই উঠে পড়লাম। উঠেই ভীষণ চমকে গেলাম। দেখলাম ট্রামের কোনায় ডানদিকের সিটে আমার বইগুলো পড়ে রয়েছে। কেমন করে হল বুঝতে না পেরে ফুটপাথে চায়ের দোকানের সামনে কালো কাপড় পরা লোকটার দিকে তাকালাম।
আবার মনে হল তার মাথায় গাধার টুপির মতো টুপি, গায়ের কালো পোশাকে রং-বেরঙের চড়াবড়া আঁকা, আর পায়ে শুড়োলা কালো জাদুকরের জুতো।
সে আমাকে হাত তুলে ইশারা করে চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ল। আর আমি মোড়ের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখনও সাড়ে দশটাই বেজে রয়েছে।
চোর ধরা
নন্দর আজ বেজায় মন খারাপ। সেই সকাল থেকে সব জিনিসকে কীসে যেন পেয়েছে! ঘুম থেকে উঠেই ভোদাকে ঠ্যাঙাতে গিয়ে অত ভালো হকি স্টিকটার হ্যাঁন্ডেলের সুতো কতখানি এল খুলে! তায় আবার ভোদা হতভাগা এমনি চেঁচাল যে বড়োমামা এসে নন্দর কান পেঁচিয়ে মাথায় খটাং খটাং করে দুই গাঁট্টা বসিয়ে দিলেন।
তারপর, সেই দেয়ালে কাজলকালি দিয়ে কুকুর তাড়া করছে, মোটা লোটার ছবি আঁকবার জন্যে বাবা মন্টুর সঙ্গে সেই চমৎকার জায়গায় সেই মজার জিনিস দেখতে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। নন্দ আর কী বলে! ছি, মই-বা কী ভাবল বলো তো? নাঃ! বুড়োরা যে কেন পৃথিবীতে জন্মায় বোঝা যায় না!
আচ্ছা, অন্যদের বাড়ির লোকেরাও কি এমন হাঁদা? এরা কিছু বোঝে না। এই তো কালই দিদির নাগরাইয়ের শুড় পাকিয়ে দেবার জন্য দিদি চাটাল। আচ্ছা, শুড় পাকিয়ে কী এমন খারাপটা দেখাচ্ছিল? ভারি তো নাগরাই! এর। চেয়ে আর কোথাও চলে যাওয়া ভালো–ইজিপ্টে যেখানে নীল নদীর ধারে ফ্লেমিংগো পাখিরা মাছ ধরে খায়, আর মস্ত মস্ত কুমিররা বালির উপর রোদ পোহায়।নয় তো মানস সরোবরে যেখানে এক-শো বছরে একটা নীল পদ্মফুল ফোটে। সেজদা বলেছে, কাগজে আছে কারা নাকি ছোটো ছোটো ঘোড়ার পিঠে বোঁচকা বেঁধে, টিনের দুধ, বিস্কুট, কম্বল-টম্বল নিয়ে সেখানে যাচ্ছে।
কিংবা তাদের ছেড়ে নন্দ আরও উপরে যাবে, যেখানে লোমওয়ালা মানুষরা কীসের জানি রস খায়, সে খেলেই গায়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। কিংবা যাবার তো কত জায়গাই আছে!