কিছুতেই আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। আবার মাথা ঘুরিয়ে ট্রামের প্রত্যেকটি লোককে ভালো করে দেখলাম।
এবার লক্ষ করলাম ঠিক আমার সামনে কালো পোশাক পরা একটি অদ্ভুত লোক। তার মুখটা তিনকোনা মতন, মাথায় গাধার টুপির মতন কালো টুপি, গায়ের কালো পোশাকে লাল নীল হলদে সবুজ চড়াবড়া তারা-চাঁদ আঁকা, পায়ে শুড়ওয়ালা কালো জুতো, দুই হাঁটুর মাঝে হাতে ঝুলছে একটা সন্দেহজনক কালো থলে।
এরকম লোক সচরাচর দেখা। যায় না। অবাক হয়ে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই ভীষণ চমকে উঠলাম। দেখলাম মাথায় টুপি নয়, চুলটাই কীরকম উঁচু হয়ে বাগিয়ে আছে। গায়ে সাধারণ ধুতির উপর কালো আলোয়ান, তাতে ট্রামের ছাতের কাছের রঙিন কাঁচের মধ্যে দিয়ে রং বেরং। হয়ে আলো পড়ছে। আর পায়ে নাকতোলা বিদ্যাসাগরি চটি। খালি হাতের থলেটা সেইরকমই আছে।
কীরকম একটু ভয় ভয় করতে লাগল।
লোকটা খুশি হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর স্পষ্ট গলায় বলল: অতই যদি খারাপ লাগে ইস্কুলে যাও কেন? বড়োরা যখন এতই অবুঝ তাদের কথা মেনে নাও কেন?
আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম: তবে কী করব?
লোকটি বলল: কী করবে? তাকিয়ে দেখো নীল আকাশে ছোটো ছোটো সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। গাছেরা সব ভিজে পাতায় সোনালি রঙের রোদ মেখে বসে আছে। গড়ের মাঠের ধার ঘেঁষে পুকুরটাকে দেখো, ঘোর সবুজ জলে টলমল করছে। আর, টের পাচ্ছ দখিন হাওয়া দিচ্ছে?
তারপর লোকটা তার বড়ো বড়ো ফুটোওয়ালা নাকটা তুলে বাতাসে কী যেন শুকে বলল: , পেঙ্গুইনের গন্ধ পাচ্ছি। গড়ের মাঠের ওপারে, গঙ্গার ওপারে, বঙ্গোপসাগরের ওপারে, ভারত-মহাসাগরের ওপারে, কোনো একটা বরফজমা দ্বীপের উপর সারি সারি পেঙ্গুইন চলাফেরা করছে, তাদের মুখেচোখে রোদ এসে পড়েছে, ঠোঁট দিয়ে ডানা পরিষ্কার করছে, দু-একটা সাদা নরম পালক উড়ে গিয়ে এখানে ওখানে পড়ছে– দেখতে পাচ্ছ না? কী আর বলব, তখন আমি যেন স্পষ্ট ওইসব দেখতে পেলাম, আর আমার সমস্ত মনটা আনচান করে উঠল। মনে হল এমন দিনে কি কেউ ইস্কুলে যায়? এমন পৃথিবীতে কোনো দিনও কেউ ইস্কুলে যায়?
আমি হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আর একটু আস্তে আস্তে বলল: জানো ভোররাতে বড়ো বড়ো চিংড়ি মাছ ধরতে হয়, তার এক-একটার ওজন এক সেরের বেশি। দু-দিন ধরে সমুদ্রের নীচে দড়ি-বাঁধা সব হাঁড়ার মতন ডুবিয়ে রাখতে হয়। আর ভোরবেলা গিয়ে ওই দড়ি ধরে টেনে হাঁড়াসুদ্ধ চিংড়ি তুলতে হয়। তারপর বাড়ি ফেরবার সময় আস্তে আস্তে সকাল হয়। তুমি তো জান যে পুব দিকে সূর্য ওঠে, কিন্তু একথা জান কি যে পশ্চিম দিকের আকাশটা আগে লাল হয়, তারপর পুব দিকে সূর্য ওঠে। তারও পর পশ্চিম দিকের লাল রং মিলিয়ে যায়, আর সমস্ত আকাশটা ফিকে পোড়া ছাইয়ের মতন হয়ে যায়। তারাগুলোকে নিবে যেতে কখনো দেখেছ কি?
আমার মনে হল আমার নিশ্চয় এখানে কিছু বলা উচিত কিন্তু আমার জিভ দেখলাম শুকিয়ে কাঠের মতন হয়ে গেছে। কিছু আর বলা হল না। খালি মনটা হু হু করতে লাগল। সে লোকটা আমার দিকে আরও ঝুঁকে পড়ে বলল: কীজন্য কলকাতায় পড়ে থাক আর ইস্কুলে যাও? জান রবিঠাকুর ইস্কুল পালিয়ে পালিয়ে অত বড়ো কবি হয়েছিলেন! আর জান, সাঁওতাল পরগনায় যখন মহুয়া গাছের ফল পাকে, তার গন্ধে জঙ্গলসুদ্ধ সব জিনিসে নেশা লেগে যায়। আর বনের ভাল্লুকগুলো মহুয়া খেয়ে খেয়ে নেশায় বেহুঁশ হয়ে গাছতলায় পড়ে থাকে। পরদিন সকালে কাঠুরেরা তাদের ওইরকমভাবে দেখতে পায়। তুমি জানতে যে মহুয়া ফল খেলে নেশায় ধরে? আমার তখন মনে হল দিনের-পর-দিন ইস্কুলে গিয়ে আমি বৃথাই জীবন নষ্ট করছি। ওই লোকটা নিশ্চয় কখনো ইস্কুলেই যায়নি।
হঠাৎ দেখি সে উঠে দাঁড়িয়েছে, আমার দিকে ফিরে অম্লানবদনে বলল, এসো৷ এমন করে বলল যেন বহুক্ষণ থেকে ওইরকমই কথা ছিল। ও-ও নামবে আর সেই সঙ্গে আমিও নামব।
আমি নামলাম। যদিও আমি জানতাম অচেনা লোক ডাকলে সঙ্গে যেতে নেই। যদিও দিনের-পর-দিন পিসিমা বলেছেন– দুষ্টু লোকেরা বলে: মন্ডা খাবি? সার্কাস দেখবি? এই সব বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে হয় আসামের চা বাগানে চালান দেয়, নয় ঘোর জঙ্গলে মা কালীর কাছে ঘ্যাচ করে বলি দেয়।
তবুও আমি নামলাম। কারণ রোজ রোজ ওই ঘুম থেকে ওঠা, দাঁত মাজা, পড়া তৈরি করা, স্নান করে ভাত খাওয়া, ইস্কুলে যাওয়া, ইস্কুল থেকে সারাটা দিনমান নষ্ট করে বিকেলে আবার বাড়ি ফেরা, সেই খাওয়া, সেই শোয়া– ওইরকম দিনের-পর-দিন, মাসের-পর-মাস, বছরের-পর বছর– যতদিন না অনিশ্চিত ভবিষ্যতে, কবে আমি বড়ো হয়ে ভালো চাকরি করে এইসব জিনিসের ভালো ফল দেখাব-ও আর আমার সহ্য হচ্ছিল না।
বইগুলো ট্রামের কোনায় আমার জায়গায় পড়ে রইল। আমি সেই লোকটার সঙ্গে গেলাম।
তখন মোড়ের ঘড়িতে সাড়ে দশটা বেজেছে।
সে আমাকে একটা চায়ের দোকানের ভিতর দিয়ে পিছন দিকের ছোটো একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে আমাকে একটা টিনের চেয়ারে বসিয়ে কোথায় জানি চলে গেল। একটু পরেই সে আবার ফিরে এল, সঙ্গে একটা একচোখা লোক, অন্য চোখটার গায়ে একটা সবুজ তাপ্পি মারা। একটা পা আছে, আরেকটা পা কাঠের তৈরি।