সারাদিন গুপের ত্রিসীমানায় গেলুম না। ক্লাসে ফাস্ট বেঞ্চে বসলুম। টিফিনের সময় পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে ব্যাকরণ বুঝতে গেলুম। এমনি করে কোনোমতে দিনটা কাটল। কিন্তু বাড়ি ফেরবার পথে কে যেন পিছন থেকে এসে কাঁধে হাত দিল! আঁতকে উঠে ফিরে দেখি গুপে! সে বললে মনে থাকে যেন সন্ধ্যে বেলা!
হঠাৎ বলে ফেললুম, গুপে, আমি যাব না।
সে একটু চুপ করে থেকে বললে, ও বুঝেছি, ভয় পেয়েছিস। তা তুই বাড়ি গিয়ে দিদিমার কাছে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমির গল্প শোন গে, আমি কেলোকে নিয়ে যাব। তোর চেয়ে ছোটো হলেও তার খুব সাহস।
বড়ো রাগ হল, বললুম, ওরে গুপে, সত্যিই কি ভয় পেয়েছি, ঝোঁপ-জঙ্গলে সাপখোপের বাসা তাই ভাবছিলুম। আচ্ছা, না হয় যাওয়াই যাবে।
গুপে বলল, তাই বল!
আবার চারদিক ঝাঁপসা করে সন্ধ্যে এল। মাঠ থেকে ফিরতে গুপে ইচ্ছে করে দেরি করল। সূর্য ডুবে গেল, আমরাও বাঁশঝাড়ের দিকে রওনা হলুম। আজ আমি প্রাণ হাতে নিয়ে এসেছি, মারা যাব তবু শব্দটি করব না! বাঁশঝাড়ের কাছে এসেই কেমন গা-কেমন করতে লাগল। সত্যিই জায়গাটাতে ভূতে আনাগোনা করে। এত ভালো ভালো জায়গা থাকতে এই মশাওয়ালা বাঁশঝাড়ে আড্ডা গাড়বার আমি কোনো কারণ ভেবে পেলাম না।
আজ তারার আলো একটু বেশি ছিল, সেই আলোতে দেখতে পেলাম, তারা আবার এসেছে। ঠিক মানুষের মতন দেখতে, তবে পা উলটো কিনা বুঝতে পারলাম না। মনে হল এদের উলটো হয়ে গাছে ঝোলা কিছুই আশ্চর্য নয়।
তারা এ ওর দিকে তাকিয়ে শকুনের মতন হাসতে লাগল। তারপর কোদাল বের করে ঠিক সেই জায়গাটা খুঁড়তে লাগল। দম আটকে আসছিল। কে জানে কী বীভৎস ভোজের আশায় ওরা এসেছে! খুঁড়ে সেই কালো জিনিসটা টেনে তুলল, দেখলুম ছালা নয়, চিত্তির-আঁকা কলসি। ভাবলুম গুপ্তধন।
তারা কলসির মুখ খুলতেই আবার সেই দুর্গন্ধ!নিশ্চিত কিছু বিশ্রী জিনিস আছে ওর মধ্যে। কিন্তু তারা খাবার কোনো আয়োজন করলে না।
এক জন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট খুদির মায়ের গলায় বলল, হ্যাঁলা বাগদিবউ, পদিপিসি ঠিকই বলেছিল, দেখু-না বাঁশঝাড়ে পুঁতে শুঁটকিগুলো কেমন মজেছে!
গুপে একটা প্রচণ্ড দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শিউরে উঠল। বলল, চল, পৃথিবীতে দেখছি অ্যাডভেঞ্চার বলে কিছু নেই! আমি তৎক্ষণাৎ বাড়িমুখো রওনা দিলাম।
গুপে বাড়ির কাছে এসে বলল, কোথায় মড়া, কোথায় গুপ্তধন আর শুঁটকিমাছ! আর কারু কাছে কিছু আশা করব না। আমি কিন্তু ব্যাপারটাতে খুশি হলাম।
কিছু বললাম না, কেবল মনে মনে সংকল্প করলাম, খোক্কসের হাতে বরং পড়ব, তবু গুপের হাতে কখনো নয়।
ঘোতন কোথায়?
সকালে খুব দেরি করে উঠলাম। উঠেই গায়ের চাদরটা এক লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে তারই উপর দাঁড়ালাম। চটি খুঁজে পেলাম না। খালি পায়ে স্নানের ঘরে গেলাম। দাঁত মাজলাম না, তাতে যে সময়টুকু বাঁচল সে সময়টা কলের মুখ টিপে ধরে পিচকিরির মতন দেয়ালে-টেয়ালে জল ছিটোলাম। খানিকটা আবার বাবার তোয়ালের উপরও পড়ল দেখলাম। তারপর চোখে-মুখে জল দিয়ে, মুখ-হাত মুছে সেটাকে তালগোল পাকিয়ে ঘরের কোনায় ছুঁড়ে মারলাম। তারপর একমুখ জল ভরে নিয়ে, শোবার ঘরে গিয়ে জানলা দিয়ে নীচে রাস্তায় একজন বুড়ো লোকের গায়ে পু চূ করে ফেলেই তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে চুলটাকে খুব যত্ন করে আঁচড়াতে লাগলাম।
ততক্ষণে নীচের তলায় মহা শোরগোল লেগে গেছে। পিসিমা দুধের বাটি নিয়ে বলছেন:ঘোতন কোথায়?মা আমার চটি-জোড়া নিয়ে বলছেন:ঘোতন কোথায়?আর সব থেকে বিরক্ত লাগল শুনে যে মাস্টারমশাইও সেইসঙ্গে ম্যাও ধরেছেন: প্রশান্তকুমার কি আজ পড়বে না?ভীষণ রাগ হল। জীবনে কি আমার কোনো শান্তি নেই? এই সক্কাল বেলা থেকে সবাই মিলে পেছু নিয়েছে!
পিসিমাকে সিঁড়ির উপর থেকে ডেকে বললাম– দুধ খাব না। সিঁড়ির নীচে মাকে এসে বললাম–চটি পরা ছেড়ে দিয়েছি। বসবার ঘরে গিয়ে গলা নীচু করে মাস্টারমশাইকে বললাম– মা বলে দিয়েছেন, আজ আমার পেট ব্যথা হয়েছে, আজ আমি পড়ব না। তারপর একেবারে তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে, সারাটা সকাল রোয়াকে রোদ্দুরে বসে বসে পা দোলালাম, আর রাস্তা দিয়ে যত ছ্যাকড়া গাড়ি গেল তার গাড়োয়ানদের ভ্যাংচালাম।
দশটা বাজতেই উঠে গিয়ে বই-টই কতক কতক গুছিয়ে, আর কতক কতক খুঁজেই পাওয়া গেল না বলে ফেলে রেখে, ঝুপ ঝুপ করে একটু স্নান করে নিয়ে, খুব যত্ন করে চুলটা ফের আঁচড়ে নিয়ে খাবার ঘরে গেলাম।
মা জলের গেলাস দিতে দিতে বললেন: হারে মাস্টারমশাই কখন গেলেন। শুনতে পেলাম না তো?
আমি সত্যি করেই বললাম: সে ক-খ-ন চলে গেছেন কেবা তার খবর রাখে!
ভাত কতক খেলাম, কতক চার পাশে ছড়ালাম, কতক পুসিকে দিলাম, আর কতক পাতে পড়ে রইল। মাছটা খেলাম, ডাল খেলাম, আর ঝিঙে, বেগুন ইত্যাদি রাবিশগুলো সব ফেলে দিলাম। মা রান্নাঘর থেকে দেখতেও পেলেন না। ট্রামভাড়াটা পকেটে নিয়ে মাকে বললাম: মা যাচ্ছি। এই পর্যন্ত প্রায় রোজই যেমন হয় তেমনই হল। অবিশ্যি মাস্টারমশাইর ব্যাপারটা রোজ হয় না, তাই যদি হত তাহলে বাবা-টাবাকে বলে মাস্টারমশাই এক মহাকাণ্ড বাধাতেন সন্দেহ নেই।
কিন্তু এরপর থেকে সেদিন সব যেন কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। মনে আছে ট্রামে উঠে ডান দিকের একটা কোনা দেখে আরাম করে বসলাম। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি আর খালি মনে হচ্ছে কে যেন আমাকে দেখছে। একবার ট্রামসুদ্ধ সবাইকে দেখে নিলাম, বুঝতে পারলাম না। কে। তারপর আবার যেই বাইরে চোখ ফিরিয়েছি আবার মনে হল কে আমাকে এমন করে দেখছে। যে আমার খুলি ভেদ করে ব্রেন পর্যন্ত দেখে ফেলছে। তাইতে আমার ভারি ভাবনা হল। এমনিতেই নানান আপদ, তার উপর আবার ব্রেনের ভিতরকার কথাগুলো জেনে ফেললে তো আর রক্ষে নেই।