তা ছাড়া সেই যে বিভু আরশুল্লা পুষত, এবার গুবরেপোকাও খেয়েছিল, সে বলেছে সে দেখেছে– মাস্টারমশাইয়ের বাস্কে হলদেটে তুলোট কাগজে লাল দিয়ে লেখা খাতা আছে, সে লাল কালিও হতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে! ওঁর লেবু গাছে মাকড়সারা কেন জানি জাল বোনে না; পেঁপে গাছে সেই গোল-চোখ চকচকে জন্তু নেই, দেয়ালে টিকটিকি নেই। একটা হতে পারে মাস্টারমশাইয়ের রোগা গিন্নি মোটা বাঁশের ডগায় ঝটা বেঁধে দিনরাত ওত পেতে থাকেন। কিন্তু কিছু বলা যায় না! মন্দা তো ওবাড়ি কোনোমতেই যায় না, মেজোও বাড়ির ছায়াটি মাড়ায় না, আর ছোটো ছেলে ধনা, তার তোওবাড়ির হাওয়া গায়ে লাগলেই সর্দি কাশি হয়ে যায়। রামশরণ পর্যন্ত বাড়ির কুল খায় না, গুঁড়িয়ার মা শজনেডাঁটা নেয় না!
মা কিন্তু ওদের কুমড়োডাঁটা দিব্যি খান; আর বড়োমামা তো ওঁরই দাদা, ওই একই ধাত! ওঁরা চমৎকার গল্প বলতে পারেন, কিন্তু ভূত কী ম্যাজিক, কী মন্তর-পড়া এসব একেবারে বিশ্বাস করেন না! কে জানে কোনদিন হয়তো কানে ধরে ওইইস্কুলেই আমাকে ভরতি করে দেবেন, আর শেষটা কি সারাজীবন ব্যা-ব্যা করে নটে চিবুবঃ ইস্কুল থেকে ফিরতে দেরি দেখে বড়োমামা হয়তো চটি পায়েই খোঁজ নিতে গিয়ে দেখবেন, পাথরের উপর শিং ঘষে শান দিচ্ছি! কেঁউ কেঁউ, ফেঁৎ ফোৎ!– কান্না পেয়ে গেল ভাই।
অ্যাদ্দিনে তোমায় লিখছি ভাই, আর হয়তো লেখা হবে না। দিব্যি টের পাচ্ছি দিন ঘনিয়ে আসছে। বড়োমামা যখন-তখন আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গোঁফের ফাঁকে বিশ্রী ফ্যাচরফ্যাচার হাসেন। বুঝছি গতিক ভালোনয়। দু-একবার তিন তলার ছাদে গিয়ে ব্যা-ব্যা করে ডেকে দেখেছি, সে আমার ঠিক হয় না। কেউ যখন দেখছে না গোটাকতক দুব্বো ঘাস চিবিয়ে দেখেছি– বদ খেতে, তাতে আবার ছোট্ট শুয়ো পোকা ছিল! খোনকে বলেছি গলায় দড়ি বেঁধে একটু টেনে বেড়াতে, ও কিন্তু রাজি হল না। এদিকে অভ্যেস না থাকলে কী যে হবে তাও তো জানি না!
এইসব নানা কারণে এতকাল চিঠি লিকতে পারিনি, বুঝতেই তো পারছ।
একদিন সন্ধ্যাবেলা আর তর সইল না। কেডস পায়ে দিয়ে সুটসুট মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি বেড়া টপকে, ছাগলদড়ি ডিঙিয়ে, জানলার গরাদ খিমচে ধরে, পায়ের বুড়ো আঙুলে দাঁড়িয়ে চিংড়িমাছের মতন ডান্ডার আগায় চোখ বাগিয়ে ঘরের ভিতর উঁকি মারলাম।
দেখলাম মাস্টারমশাই গলাবন্ধ কোট খুলে রেখে মোড়ায় বসে হুঁকো খেতে চেষ্টা করছেন, আর গিন্নি মাটিতে বসে কুলো থেকে খাবলা খাবলা শুকনো বড়ি তুলছেন– কোনটা আস্ত উঠছে, গিন্নি হাসছেন; কোনটা আধখাচড়া উঠছে, গিন্নি দাঁত কিড়মিড় করছেন। আর মাস্টারমশাই গেলাস ভেঙেছেন বসে সমস্তক্ষণ বকবক করছেন ভাই, বড়ো ভালো লাগল।
কিন্তু আনন্দের চোটে যেই খচমচ করে উঠেছি, মাস্টারমশাই চমকে বললেন, ওটা কী রে? ভাবলুম এবার তো গেছি! কান ধরে ঝুলিয়ে ঘরে টেনে আনলেন,নখ দিয়ে খিমচে দিয়ে গিরগিটির মতন মুখ করে বললেন-ও বাঁদর! বললুম, আজ্ঞে সার, ছাগল বানাবেন না স্যার! বললেন, বাঁদর আবার কবে ছাগল হয় রে? গিন্নিও ফিসফিস করে যেন বললেন, ওটিকে রাখো, আমি পুষব।
ভয়ের চোটে কেঁদে ফেললুম। গিন্নি মাথায় হাত বুলিয়ে শিং আছে কিনা দেখে বললেন, তোমার মতন আমার একটি খোকা ছিল। জিজ্ঞেস করলুম, তার কী হল? বললেন, তার এখন দাড়ি গজিয়েছে। বলে বড়ো বড়ো বাতাসা খেতে দিলেন। তারপর বাড়ি চলে গেলাম। জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না, দাড়ির সঙ্গে সঙ্গে খুরও গজিয়েছিল কি না।
ইস্কুলের কথা এখনও কিছু ঠিক হয়নি, এই ফাঁকে তোমায় লিখছি। এ চিঠির আর উত্তর দিয়ো। দেখা করতে চাও তো খোঁয়াড়ে-টোয়াড়ে খোঁজ কোরো। ইতি–
তোমার গণশা
গুপে
ও পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলে ফিরতে বড্ড সন্ধ্যে হয়ে গেল। আমি আর গুপে দু-জনে অন্ধকার দিয়ে ফিরছি খেলার গল্প করতে করতে, এমন সময় গুপে বলল– ওই বাঁশঝাড়টা দেখেছিস? বললুম কই? সে বললে, ওই যে হোথা। মনে হয় ওখানে কী একটা লোমহর্ষক ব্যাপার ঘটেছিল, না?
গুপের দিকে তাকালুম, এমন সময়ে এমন কথা আশা করিনি।
আমি বললুম, গুপে, তুই কিছু খেয়েছিস নাকি?
গুপে বলল, চোখ থাকলেই দেখা যায়, কান থাকলেই শোনা যায়। আমি বললুম, নিশ্চয়ই। মাথা না থাকলে মাথা ব্যথা হবে কী করে? গুপে বলল, তুই ঠিক আমার কথা বুঝলি না! দেখবি চল আমার সঙ্গে।
বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। পেঁচোর মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। সেও সন্ধেবেলা মাছ কিনে ফিরছে, বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে আসছে, এমন সময় কানের কাছে শুনতে পেল, পেঁ-চোঁর মাঁ, মাঁছ দেঁ! পেঁচোর মা হনহনিয়ে চলতে লাগল। কিন্তু সেও সঙ্গে চলল দে বঁলছি, মাঁছ দেঁ!
গুপে ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা লোমহর্ষণ সিরিজের বিকট বই পড়ত। আমায় একটা দিয়েছিল, তার নাম তিব্বতি গুহার ভয়ংকর কি ওই ধরনের একটা কিছু। আমায় বলেছিল, দেখ, রাত্রে যখন সবাই ঘুমুবে, একা ঘরে পিদিম জ্বেলে পড়বি। দেয়ালে পিদিমের ছায়া নড়বে, ভারি গা শিরশির করবে, খুব মজা লাগবে। আমি কিন্তু এক বার চেষ্টা করেই টের পেয়েছিলুম ও-রকম মজা আমার ধাতে সইবে না। আজ আবার এই!
গুপে বললে, কী ভাবছিস? চল্ দেখি গিয়ে। বাবার কে এক বন্ধু একবার দিল্লিতে একটা সেকেলে পুরোনো বাড়িতে একটা শুকনো মরা বুড়ি আর এক ঘড়া সোনা পেয়েছিলেন। দেখেই আসি-না। হয়তো গুপ্তধন পোঁতা আছে। যক্ষ পাহারা দিচ্ছে। তারার আলোয় দেখলুম, তার চোখ দুটো অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করছে। তাই দেখেই আমার ভয় করতে লাগল– আবার বাঁশঝাড়ের যক্ষ!