সেজোমামা বললেন, তবে কোনো ভয় নেই। ওরা নিরামিষ খায়।
আবার শুনলাম জোরে একটা ফোঁস ফোঁস। আমার মোটেই ভালো লাগল না। সেজোমামা কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, কী হবে রে?
কী আবার হবে? এক নিমেষে গুলতিতে শট লাগিয়ে শব্দ লক্ষ করে দিলাম ছেড়ে। অমনি সে যে কী চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল সে আর কী বলব। একটা কেন, মনে হল এক লাখ জানোয়ার একসঙ্গে চেঁচাচ্ছে! সেই চেঁচানি শুনে চাঁদের মানুষেরা জেগে উঠে সব বড়ো বড়ো মশাল নিয়ে দেখি পেয়ালার একদিকের কানা বেয়ে নেমেছে। কী হিংস্র সব চেহারা!কী ষণ্ডা, পৃথিবীর মানুষদের চেয়ে তিনগুণ জোরালো। আর সে কী গর্জন, কান ফেটে যায়।
আর এক মিনিটও অপেক্ষা করলাম না। তারা হয়তো ওই অন্ধকারে আমাদের দেখতে পেল না। পড়িমরি প্রাণপণ ছুটে অন্য ধারের ঘাসে ঢাকা ঢালু দেয়াল বেয়ে পিঁপড়ের মতো আমরা উঠে গেলাম। শরীরে আর এতটুকু ক্লান্তি বোধ করলাম না।
ওপরে উঠেই ছুট লাগালাম। আন্দাজে অন্ধকারের মধ্যে দু-পা না যেতেই চাঁদের পাহাড়ের গা বেয়ে ঝুপ করে খানিকটা পড়েই গড়াতে লাগলাম।
সব সইতে পারি বুঝলি, শুধু ওই গড়ানিটা আমার সহ্য হয় না। তখুনি মুচ্ছো গেলাম।
আবার যখন জ্ঞান ফিরে এল, দেখি সেজোমামা আমার মুখে-চোখে ঠান্ডা জল ছিটোচ্ছেন। আমি নড়ে উঠতেই বললেন, বাপ, বেঁচে আছিস তাহলে? দাঁড়া, গাড়িটা আনি, আর এখানে নয়, চল একেবারে ভোরের গাড়িটা ধরা যাক।
সেজোমামা গাড়ি আনতে গেলেন, আমি একটা পাথরে ঠেসান দিয়ে বসে ভাবতে লাগলাম। আস্তে আস্তে মাথাটা খানিকটা পরিষ্কার হয়ে এলে বুঝলাম কুণাল মিত্তিরদের টিলার নীচেই এসে পড়েছি। সেজোমামা গাড়ি আনতেই বললাম, কী আশ্চর্য, না সেজোমামা? যেখান থেকে চাঁদে গেলাম আবার ঠিক সেই একই জায়গায় এসে নামলাম।
সেজোমামা বললেন, আশ্চর্য বই কী। আমরা যে বেঁচে আছি সেটা আরও আশ্চর্য!
তাই তো, যন্ত্রটা চাদেই পড়ে আছে। পকেট হাতড়াতে লাগলাম। সেজোমামা বললেন, আবার কী?
–কেন সব লিখে রাখতে হবে-না? ওখানে ঠান্ডা বাতাস আছে, জন্তু মানুষ সব আছে।
সেজোমামা বললেন, সে আমি মনোহরকে বলে দেবখন। আর দেখ, এসব কথা খবরদার বাড়িতে বলবি নে।
বাবা-মারা আমাদের দেখে অবাক। এ কী, কাল গেলে, আজই ফিরে এলে?
সেজোমামা বললেন, সেখানে মহামারি লেগেছে। আমাকে আজই ফিরে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করতে হবে। এদিকে আমি কাউকে কিছু বলতে পারছি না, পেট ফেঁপে মরি আর কী!
.
ছোটোকাকা থামলে আমরা বললাম, তবে কেন বললে একরকম বলতে গেলে চাঁদে গিছলে? ছোটোকাকা বললেন, তার কারণ এই ঘটনার মাস চারেক বাদে মা হাতে করে সেজোমামার একটা চিঠি নিয়ে বাবাকে বললেন, শোনো একবার কাণ্ড। ওই যে আমাদের কুণাল মিত্তিরের ছেলে মনোহর না, সে নাকি এক উড়োজাহাজ বানিয়ে, যেখানে কুণাল মিত্তিরের গবেষণা-গোরুরা চরছিল সেখানে নামিয়ে একাকার কাণ্ড করেছে। কুণাল মিত্তির দারুণ রেগে ওকে চাকরি দিয়ে বোম্বাই পাঠিয়েছেন।
বাবা বললেন, গবেষণা-গোরু আবার কী জিনিস?
মা বললেন, ওমা, তাও জান না? কুণাল মিত্তির একরকম বড়ি বানিয়েছেন, তাতে সবরকম পুষ্টিকর জিনিস আছে, সে খেলেই পেট ভরে যায়। ওই টিলার মাথায় খানিকটা জায়গাকে পুকুরের মতো করে কেটে, অবিশ্যি তাতে জল নেই, সেখানে গোরুগুলো ছাড়া থাকত ওই বড়ি খেত আর মন ভালো করবার জন্য একটু একটু ঘাসও চিবুত। বাইশ সের দুধ দিত এক-একটা। ব্যাটা লক্ষ্মীছাড়া মনোহর সেইখানে উড়োজাহাজ নামিয়েছে। ব্যস, আর যাবে কোথা, গোরুরা সব দুধ বন্ধ করে দিয়েছে। কুণাল মিত্তির রেগে টং! ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে, এখন বলে নাকি ছেলের কোনো দোষ নেই, চমৎকার উড়োজাহাজ করেছে, কিন্তু পাড়ার কয়েকটা দুষ্টু লোক মিলেই নাকি ওর মাথাটা খেল। শুনলে একবার কথা!
আমি আস্তে আস্তে সেখান থেকে উঠে গিয়ে গুলতিটা বের করে কাগদের মারতে লাগলাম।
–হ্যাঁ রে, তোরা এখনও বসে রয়েছিস যে, আমাকে কি বইটা শেষ করতে দিবি না? এই বলে ছোটোকাকা আবার পা মেলে দিয়ে বই পড়তে লাগলেন।
হুঁশিয়ার
যখন সামনের লোকটার লোমওয়ালা ঘেমো ঘাড়টার দিকে আর চেয়ে থাকা অসম্ভব মনে হল, চোখ দুটো ফিরিয়ে নিলাম। অমনি কার জানি একরাশি খোঁচা খোঁচা গোঁফ আমার ডান দিকের কানের ভিতর ঢুকে গেল। চমকে গিয়ে ফিরে দেখি ভীষণ রোগা, ভীষণ লম্বা, ভীষণ কালো একটা লোক গলাবন্ধ কালো কোট পরে ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে। তার পিছনে আরও অনেক লোক সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কোন পা জোড়া তার বুঝে নিতে আমার একটু সময় লাগল। শেষটা টের পেলাম খুব সরু, খুব নোমওয়ালা, আর খুব কালো ঠ্যাং দুটো ওর। তায় আবার একজোড়া দাঁত-বেরকরা ছেঁড়া চটি পরা, তার ফুটো দিয়ে নোংরা বুড়ো আঙুল বেরিয়েছে।
এই লোকটা হাসি হাসি মুখ করে আস্তে আস্তে আমার কানের মধ্যে থেকে তার গোঁফটাকে সরিয়ে নিতে নিতে বলল, মনিব্যাগটা আরেকটু খামচে ধরুন, যা চোর-চামারের উপদ্রব! লোকটার কথাগুলো যেন কতদূর থেকে এল, কীরকম একটা হালকা ফিসফিস আওয়াজ। তার চোখ দুটোও যেন আর কিছুতেই গর্তের মধ্যে থাকছিল না, একেবারে বেরিয়ে এসে আমার মনিব্যাগের ভিতরের খোপের মধ্যে পড়ে যেতে চাচ্ছিল।