বলে আমার মুখে কী-একটা হলদে বড়ি পুরে দিলেন, সে যে কী আশ্চর্য বড়ি আর কী বলব। খেতেই মনে হল আমি লুচি মাংস চপ কাটলেট ভেটকি-ফ্রাই চিংড়িমাছের মালাইকারি রাবড়ি কেক চকলেট ছাঁচিপান সব খাচ্ছি। একেবারে পেট ভরে গেল। সেই বড়ির শিশিটা আমার হাতে দিয়ে মনোহরবাবু বললেন, এই নাও এক মাসের খোরাক। একটার বেশি দুটো বড়ি কোনোদিন খেয়ো না, খেলেই পেটের অসুখ করবে, মোটা হয়ে যাবে, যন্ত্রের ভেতর আঁটবে না। এসো, এই আরাম কেদারাটাতে বসে পড়ো দিকিনি। হাওয়ার কোনো অভাব হবে না, এমন কল করেছি ভেতরে তোমার নিশ্বাসই আবার অক্সিজেন হয়ে যাবে।
বলে সেই লম্বা চোঙার মতন যন্ত্রটার গায়েয় একটা দরজা খুলে, আমাকে একটা চমৎকার হাওয়ার গদি-আঁটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন আর মাথার ওপর দিয়ে একটা অদ্ভুত পোশাক পরিয়ে দিয়ে কোমরে চেয়ারের সঙ্গে বগলেস এঁটে দিলেন। মুখের জায়গাটা বোধ হয় অভ্র দিয়ে তৈরি, সব দেখতে পাচ্ছিলাম। নাকের কাছে ছাদা, নিশ্বাস নিতে পারছিলাম। তারপর দেখি সেজোমামা তাড়াতাড়ি আমার জিনিসপত্র নিজের পকেটে ভরছেন। চেঁচিয়ে বললাম, গুলতি দিলে না? গুলতি না দিলে যাব না বলেছি-না!
অভ্রের মুখোশের ভেতর থেকে কথা শোনা গেল কিনা জানি না। কিন্তু সেজোমামার বোধ হয় একটু মন কেমন করছিল, কাছে এসে কী যেন বলতে লাগলেন, একবর্ণ শুনতে পেলাম না, যন্ত্রের শোঁ-শোঁ গোঁ-গোঁতে কান ঝালাপালা! দারুণ রেগে গিয়ে সেজোমামার কাছা আঁকড়ে ধরে চেঁচাতে লাগলাম, দাও বলছি, গুলতি না নিয়ে আমি কোথাও যাই না।
এদিকে মনোহরবাবু বার বার ঘড়ি দেখছেন, যন্ত্রটা কেঁপে কেঁপে দুলে দুলে উঠছে, অথচ আমি এমন করে সেজোমামার কাছা আঁকড়েছি যে দরজাটা এঁটে দেওয়া যাচ্ছে না। শেষটা হঠাৎ রেগেমেগে ঠেলে সেজোমামাকে সুষ্ঠু ভেতরে পুরে দিয়ে মনোহরবাবু দরজা এঁটে দিলেন।
বাবা! দিব্যি ফাঁকা ছিল ভেতরটা, সেজোমামা ঢোকাতে একেবারে ঠেঠেসি হয়ে গেল, নড়বার চড়বার জো রইল না। দরজা বন্ধ করাতে বাইরের শব্দ আর কানে আসছিল না, সেজোমামা চিৎকার করতে লাগলেন, ও মনোহর, ফেরবার কল শিখিয়ে দিলে না যে, ফিরব কী করে?
তা কে কার কথা শোনে। ভীষণ জোরে ফুলে উঠে বোঁ করে যন্ত্রটা আকাশে উড়ে গেল। একবার মনে হল চারদিকে চোখ ঝলসানো আলো, তারপরেই মনে হল ঘোর অন্ধকার।
যখন জ্ঞান ফিরে এল বুঝলাম চাঁদে পৌঁছে গেছি। যন্ত্রটা আর নড়ছে না চড়ছে না, কাত হয়ে পড়ে আছে, আমি বসে বসেই শুয়ে আছি, সেজোমামা আমার তলায় একটু একটু নড়ছেন-চড়ছেন। মুখ তুলে কানের কাছে বললেন, আমার ডান পকেটে তোর টর্চটা আছে, দেখ তো নাগাল পাস কি না।
বুঝলাম ওঁর নিজের হাত নাড়বার জায়গা নেই। হাতড়ে হাতড়ে ঠিক পেলাম। ভয়ে ভয়ে জ্বালালাম, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যন্ত্রের ভেতরটা ভালো করে দেখলাম, ভেতরকার কলকজা সব ঠিক আছে, যে-যার জায়গায় আটকানো। হাত দিয়ে আমার বাঁ-পাশের জিপ ফার খুলে মুখোশ নামিয়ে ফেললাম।
অমনি এক ঝলকা ঠান্ডা বাতাস এসে মুখে লাগল। আঃ, চাঁদের বাতাসই আলাদা রে, এ পৃথিবীতে সে-রকমটি হয় না।
সেজোমামা বললেন, বেড়ে খাসা কল বানিয়েছে তো মনোহর। বলেইছিল যে নামবার সময় এতটুকু কঁকানি লাগবে না, এতটুকু ভাঙবে না, টসকাবে না।
আমি এদিকে টর্চ ঘুরিয়ে দেখি, পড়বার সময় কাত হয়ে যাওয়াতে দরজার বাইরের ছিটকিনি গেছে খুলে, দরজা এখন হাঁ!
বললাম সে কথা সেজোমামাকে, কিন্তু আমি না সরলে তার নড়বার উপায় নেই। তখন কোমরের বগলেস খুলে সেজোমামার পেটের ওপরে দুই পা রেখে এক লাফে যন্ত্র থেকে বেরিয়ে পড়া আমার কাছে কিছুই নয়। পৃথিবীতে যখন থাকতাম এরচেয়ে কত উঁচু উঁচু জায়গা থেকে লাফাতে হয়েছে। সেজোমামা শুধু একটু কোঁৎ করে উঠলেন।
বেরিয়ে বুঝলাম বোধ হয় চাঁদের কোনো একটা নিভে-যাওয়া আগ্নেয়গিরির মুখের মধ্যে পড়ে গেছি। চারদিকে মনে হল নরম ঘাস। মাথার ওপর তারাও দেখতে পেলাম, আবার এক কোনা দিয়ে বোধ হয় আমাদের এই পৃথিবীটাকেই একবার একটু দেখতে পেলাম। ঠিক যেন আরেকটা চাঁদ। মনে হল আফ্রিকাটাকে যেন একটু একটু দেখতে পেলাম। তারপরেই আবার সেটা টুক করে ডুবে গেল।
তখন কানে এল যন্ত্রের ভেতর থেকে সেজোমামা মহা চেঁচামেচি লাগিয়েছেন, টর্চের আলো দেখা, আমিও নামব।
অনেক কষ্টে নেমে আমার পাশে ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসেই বললেন, খিদেয় পেট জ্বলে গেল, সেই বড়ি একটা দেনা।
টের পেলাম আমারও বেজায় খিদে পেয়েছে, দুজনে দুটো বড়ি খেলাম, তারপর ঘাসের ওপর শুয়ে থেকে থেকে অন্ধকারটা একটু চোখ-সওয়া হয়ে এল। আমরা যে একটা বেশ বড়ো গর্তের মতো জায়গাতে শুয়ে আছি সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই, ঠিক যেন একটা বিরাট পেয়ালার মধ্যে রয়েছি। একটু একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিল।
সেজোমামা বললেন, কী রে, উঠে একটু দেখবি না?
বললাম, ভোর হোক আগে।
সেজোমামা বললেন, আবার ভোর কী রে? এটা যদি চাঁদের উলটো পিঠ হয়ে থাকে তা হলে তো ভোরই হবে না।
এবারে উঠলাম। তাই-ই নিশ্চয় সেজোমামা। এ-পিঠটাতে তো সর্বদা আলো থাকে। দিনের বেলাও তাই দেখেছি, রাতেও দেখেছি।
–ফোঁস।
তিন হাত লাফিয়ে উঠলাম। ফোঁস করল কী? তবে কি চাঁদে হিংস্র জন্তুও আছে? বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগল। কিন্তু স্পষ্ট শুনলাম জন্তুটা কচর-মচর করে নরম ঘাসগুলোকে ছিঁড়ে খাচ্ছে।