মনোহরবাবু তাই শুনে ছোটো গোঁফটাকে একটু নেড়ে বললেন, আর তুমিও তার চেয়ে খুব বেশি কম বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হবে না। কী যেন নাম তোমার বললে?
বললাম, আগে বলিনি, এখন বলছি–ইন্দ্র।
খুশি হয়ে বললেন, ইন্দ্র? তা ইন্দ্রই বটে, চাঁদের মাটিতে প্রথম পা দেবার গৌরব হবে যার, সে ইন্দ্রের চেয়ে কোন দিক দিয়ে কম বলো দিকিনি।
চারপাশের লোকজনেরা বলতে লাগল, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।
আমার তো চক্ষু ছানাবড়া। চাঁদে যাব নাকি আমি?
বললাম, সে আমার যেতে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু একা যাব না। তা ছাড়া, আবার ফিরে আসব তো? ডিসেম্বরে আমার ক্রিকেট ম্যাচের সিট বলা আছে কিন্তু।
সেজোমামা আর মনোহরবাবুমুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। শেষটা মনোহরবাবু বললেন, তা হা– তা ফিরে আসবে বই কী, যাবে আর আসবে না, সে কি একটা কথা হল নাকি! কিন্তু আর দেরি কীসের জন্য? চলো তো দেখি ইন্দ্র, আমার সঙ্গে।
গেলাম বাগান পেরিয়ে একটা জায়গায়। তার মাথার ওপর দিয়ে লম্বা একটা কী বেরিয়ে রয়েছে, বিকেলের পড়ন্ত রোদে চিকচিক করছে, আগাটা ক্রমশ ছুঁচলো হয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে।
বেড়ার দরজা চাবি দিয়ে খুলে মনোহরবাবু সরে দাঁড়ালেন, আমিই আগে ঢুকলাম।
গিয়ে যা দেখলাম সে আর কী বলব। আগাগোড়া অ্যালুমিনিয়ামের মতো কী ধাতু দিয়ে তৈরি কী একটা বিশাল যন্ত্র, অবিকল উড়ুক্কু মাছের মতো দেখতে, তবে ডানাগুলো অনেক ছোটো আর পিছন দিকে বেঁকিয়ে বসানো। দেখলেই বোঝা যায় যে একবার ছেড়ে দিলেই অমনি সুড়ুৎ করে তিরের মতো ওপরে উঠে, নীল আকাশের মধ্যে সেঁদিয়ে যাবে। চাদে যাওয়া এর পক্ষে সেরকম কিছুই শক্ত হবে না।
নীচে একটা গোল প্ল্যাটফর্ম ওটাকে চারিদিকে ঘিরে আছে, সেটাই প্রায় একতলার সমান উঁচু হবে, তারো নীচে যন্ত্রটার আরও অনেকখানি রয়েছে। রুপোলি গায়ে কালো দিয়ে লেখা ধূমকেতু। আর এক জোড়া এই বড়ো বড়ো চোখ আঁকা। আশেপাশে কতরকম যন্ত্র দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা, বোঝা গেল– একবার সেইগুলো খুলে দিলেই আর দেখতে হবে না!
মনোহরবাবু চোখ ছোটো করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, পকেটে কী? ওরকম ঝুলে আছে যে? ও হবে না, যতটা সম্ভব হালকা চাওয়া চাই। এই বেদে, দেখ তো ওর পকেটে কী।
বেদে বলে লোকটা এগিয়ে আসতেই বললাম, এই খবরদার, তাহলে কিন্তু চাঁদে যাব না বলে রাখলাম।
মনোহরবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ও-রকম করিসনে বাপ, চাঁদে যাবি না কী রে? তুই না গেলে কে যাবে বল দিকিনি? কেউ রাজিও হবে না, তা ছাড়া তোর প্যান্টের মাপে সব তৈরি। এখন না গেলে যে আমার জীবনের সব কাজ ব্যর্থ হয়ে যাবে! বলছি আমার শালাকে বলে তোকে মোহনবাগান ক্লাবের লাইফ মেম্বর করে দেব।
ওঁর হাত ধরে বললাম, দেবে তো ঠিক? বাবা! সেজোমামা কত চেষ্টা করেও হতে পারেনি। শেষটা কিন্তু অন্যরকম বললে–
মনোহরবাবু রেগে উঠলেন, বলছি করে দেব, আবার অত কথা কীসের? ফিরে তো এসো আগে।
বেদে বললে, যদি আস!
মনোহরবাবুকে ধমক দিলেন, তোমাকে অত কথা বলতে কে বলেছে বাছা? যাও, নীচে গিয়ে পাওয়ার লাগাও দিকিনি, নইলে–।
বেদে অমনি একটা ছোটো সিঁড়ি দিয়ে যন্ত্রের তলায় চলে গেল।
সেজোমামা মনোহরবাবুকে বললেন, ফিরে আসার কলকজগুলো ওকে বুঝিয়ে দিয়ো, মনোহর।
মনোহরবাবু বললেন, ও কি ওর বাবা-মার একমাত্র সন্তান?
আমি বললাম, আরে না না, আমার দুটো ভাই দুটো বোন।–আচ্ছা, লাইফ-মেম্বর করে দেবেন তো? কারণ বাবা হয়তো চাদা দেবেন না।
মনোহরবাবু বললেন, তাই দেব। পকেটে কী আছে বের করে এইখানে রাখো তো দেখি।
মেশিনের তলা থেকে একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হল, তারপর কেমন শোঁ-শোঁ করতে লাগল। মনোহরবাবু একবার নিজের হাতঘড়িটা দেখে নিলেন। আমি পকেট থেকে লাট্ট লেত্তিইয়ো-ইয়ো রুমাল নীল গুলি রুমেনিয়ার দুটো ডাকটিকিট মনাদা দিয়েছিল– আধঠোঙা নরম ঝাল ছোলা ভাজা, টর্চ, আমার বড়ো গুলতিটা আর এক কৌটো শট বের করে রাখলাম। মনোহরবাবু তো অবাক!
এসব কিচ্ছু নেবার দরকার নেই, শুধু ওজন বাড়ানো। খালি এই নোট বই আর পেনসিলটা নেবে। কী দেখবে না দেখবে, শরীরে কেমন বোধ করবে, সব টুকে রাখবে। আর এই হাতঘড়িটা নেবে, এতে সেকেন্ডের কাঁটা, তারিখের কাঁটা সব দেওয়া আছে। সব লিখবে, কখন পৌঁছোলে ইত্যাদি, ও কী হল, চলে যাচ্ছ যে।
আমি বললাম, গুলতি শট না দিলে আমি যাব না।
সেজোমামা বললেন, থাকগে মনোহর, এখন মনে হচ্ছে তুমি বরং আর কাউকে দেখো।
মনোহরবাবুবললেন, বেশ, তা হলে আমার হাজার টাকা ফিরিয়ে দাও, আমি এক্ষুনি অন্য লোক দেখছি।
সেজোমামা চুপ। আমি বললাম, তাতে কী হয়েছে সেজোমামা? আমার গুলতি দিলেই আমি যাব। অবিশ্যি বড্ড খিদে পেয়েছে, তাই আগে খানিকটা খেয়েও নেব। আর বলছি তো–একা যাব না।
মনোহরবাবু চটে গেলেন, একা যাব না আবার কী? জানিস, ওই কাকাতুয়াটা আর বেড়ালটা দু-তিনবার একা গেছে, কিছু বলেনি।
বললাম, চাঁদ অবধি গেছে?
মনোহরবাবু বললেন, চাঁদ অবধি গেছে কি বুঝতে পারা যাচ্ছে না বলেই তো তোমাকে পাঠানো হচ্ছে। নিদেন তোমার খাতা পেনসিলটা ওই যে ছোটো হাউই-মতন দেখছ, ওটাতে পুরে ফেলে দিতে পারবে তো, নিজে যদি নেহাতই–আচ্ছা সে যাকগে, এখন এই বড়িটা খাও দিকিনি, কেমন পেট ভরে যায় দেখো।