এই কি তবে পরিদের দেশ? কী ভালো এই দেশটি। আর যে ওসব জিনিস কখনো দেখতে পাব, তা ভাবিনি।
ওই তো আমার বুড়ি দিদিমারা তিনজনেই এখানে! যখন পড়তে শিখিনি, কত পরির গল্পই-না বলেছেন আমাকে। আহা, এমন মানুষদেরও ভুলে যেতে আছে? এরা যে ডানাওয়ালা পরিদের চেয়েও অনেক, অনেক ভালো! দু-হাত বাড়িয়ে সবাইকে একসঙ্গে বুকে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করতে লাগলাম।
গল্প থামিয়ে মেজোদাদামশাই উঠে পড়েন, আহা, অমন দেশ ছেড়েও লোকে আবার ফিরে আসে! ওরে, ও টুনু মিনু নেগো ধেলো ইলু বিলু মন্টু, তোরা তো নিত্য সব ভুলে যাস, চল চল আমার সঙ্গে পরির দেশে চল। সেখানে যে তোদের জন্যে আলাদিনের ভাড়ার ঘর খোলা রয়েছে, যাবি তো চল।
আর দ্যাখ, আর কিছু নেবার দরকার নেই, খালি একটু টিফিন নিয়ে চল। ওখানে সবই আছে, শুধু খাবারের কোনো ব্যবস্থাই দেখলাম না, খাবার খেতে বুঝি কেউ আর ভোলে না?
তবে আমার ছোটোবেলাকার ওই আম গাছেতে আমের গুটি দেখেছিলাম, আহা, ওই টক আম কী যে মিষ্টি লাগত সে ভুলেই গিয়েছিলাম!
সেজোমামার চন্দ্র-যাত্রা
আমার ছোটোকাকা মাঝে মাঝে আমাদের বলেন, এই যে তোরা আজকাল চাঁদে যাওয়া নিয়ে এত নাচানাচি করিস, সেকথা শুনলে আমার হাসি পায়। কই, এত খরচাপাতি, খবরের কাগজে লেখালেখি করেও তো শুনলাম না কেউ চাদে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে! তোরা আবার এটাকে বৈজ্ঞানিক যুগ বলিস, ছোঃ!
আমরা তখন বলি, তার মানে? কী বলতে চাও খুলে বলোনা।
ছোটোকাকা বলেন, তার মানেটা খুবই সোজা। চাঁদে যাওয়াটা কিছু-একটা তেমন আজকালকার ব্যাপারও নয়। পঞ্চাশ বছর আগে আমি নিজেই তো একরকম বলতে গেলে চাদে ঘুরে এসেছি।
আমরা তো অবাক! একরকম বলতে গেলে কী? গেছিলে, না যাওনি?
ছোটোকাকা বইয়ের পাতার কোনা মুড়ে রেখে পা গুটিয়ে বসে বললেন, তাহলে দেখছি সব কথাই খুলে বলতে হয়। বয়স আমার তখন বারো-তেরো হবে, পুজোর ছুটিতে গেলাম মামাবাড়িতে। সেজোমামা অনেক করে লিখেছেন। এমনিতেই আমি কোথাও গেলে সেখানকার লোকরা খুব যে খুশি হয় বলে মনে হয় না, আর সেজোমামা তো নয়ই। তা ছাড়া দিদিমা সারাক্ষণই এটা-ওটা দেন, খাওয়া-দাওয়া ভালো, পুকুরে ছিপ ফেললেই এই মোটা মোটা মাছ, গাছে চড়লেই ভঁসা পেয়ারা। না যাবার কোনো কারণই ছিল না।
সেখানে পৌঁছে দেখি সেজোমামা কোত্থেকে একটা লড়ঝড়ে মোটর গাড়ি জোগাড় করে আমাকে নিতে স্টেশনে এসেছেন। আমাকে দেখেই, মাথা থেকে পা অবধি চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, আগের চেয়ে যেন একটু ভারী-ভারী লাগছে! হারে, তোর ওজন কত রে?
কিছুদিন আগেই ইস্কুলে সবাইকে ওজন করেছে। বললাম, আটত্রিশ সেরের সামান্য বেশি।
সেজোমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, আবার বেশি কেন? সে যাকগে, ওতেই হবে, এখন গাড়িতে ওঠ, চল তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাই, খুব ভালো খাওয়ায় তারা।
সেজোমামাকে গাড়ি চালাতে দেখে আমি তো অবাক, তুমি আবার গাড়ি চালাতে পার নাকি?
সেজোমামা বেজায় রেগে গেলেন, কী যে বলিস! আরে এই সামান্য একটা গাড়িও চালাতে পারব না? বলে কি না যে আমি– যাকগে, চল তো এখন।
সোজা নিয়ে গেলেন কুণাল মিত্তিরের রহস্যময় বাড়িতে। ও বাড়ির ভেতরে এখানকার কেউ কখনো যায়নি, কুণাল মিত্তিরের নাম সবাই জানে, তবে তাকে কেউ চোখে দেখেনি। একটা উঁচু টিলার ওপরেঅদ্ভুত বাড়ি, বাড়ির চারিদিকে দেড়-মানুষ-উঁচু পাঁচিল, তার ওপরে কাঁটাতারের বেড়া, দেয়াল কেটে লোহার গেট বসানো, সে সর্বদাই বন্ধ থাকে। শোনা যায় কুণাল মিত্তির নাকি নানারকম বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন, সেসব সাধারণের জন্য নয়, অতি গোপন ও গুহ্যভাবে করতে হয়।
প্রকাণ্ড টিলাটার গা বেয়ে যদি চড়া যায়, ওপরটা চ্যাপটা, সবটা ঘিরে পাঁচিল, আশেপাশে কোনো গাছগাছড়াও নেই যে তাতে চড়ে পাঁচিলের ভেতরে দেখা যাবে কিছু। তার ওপর মাঝে মাঝে ভেতর থেকে বাড়ি কাঁপানো গর্জন শোনা যায়, লোকে বলে নাকি দু-জোড়া ডালকুত্তা দিনরাত ছাড়া থাকে। মোট কথা, কেউ ওদিকে বড়ো-একটা যায় না। চারিদিকে দু-তিন মাইলের মধ্যে কারো বসতিও নেই। ফঁকা মাঠ আগাছায় ভরা।
সেইখানে তো গেলেন আমাকে নিয়ে সেজোমামা। আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে গাঁ গাঁ করতে করতে গাড়িটা তো টিলার ওপরে চড়ল। তারপর প্যাক-প্যাক করে হর্ন বাজাতেই লোহার দরজা গেল খুলে। আমরাও ভেতরে গেলাম। অবাক হয়ে দেখি চমৎকার ফুলবাগান, একতলা লম্বা একটি বাড়ি, তার বারান্দায় একটা বড়ো কালো বেড়াল সোজা হয়ে বসে সবুজ চোখ দিয়ে আমাদের দেখছে। একটা উঁচু দাঁড়ে নীল কাকাতুয়াও একদৃষ্টে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। আমাদের বলছি কেন, আসলে আমাকে দেখছে।
অমনি চারিদিক থেকে দলে দলে চাকরবাকর ছুটে এসে মহা খাতির করে আমাদের নামাল। বারান্দা থেকে একজন ভদ্রলোকও এগিয়ে এলেন, ফর্সা কোঁকড়া চুল, বেঁটে মোটা, বয়স বেশি নয়। সেজোমামাকে ফিসফিস করে বললাম, ওই নাকি সেই বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কুণাল মিত্তির যাকে কেউ চোখে দেখেনি।
শুনতে পেয়ে ভদ্রলোক চটে গেলেন, কেউ চোখে দেখেনি কী, আমি বিলক্ষণ দেখেছি। বিশ্রী দেখতে।
সেজোমামা বললেন, আহা, বড়ো কথা বলিস। ওই তোর দোষ। কিছু মনে কোরো না, মনোহর-উনি কুণাল মিত্তির হতে যাবেন কেন, কুণাল মিত্তির ওঁর বাবা, ওঁর নাম মনোহর মিত্তির, আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়েছি। একদিন উনি ওঁর বাবার চেয়েও অনেক বেশি বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হবেন। জানিস তো, মিত্তিররা কীরকম চালাক হয়।