সেই মাদুলি দাদামশাই এককথায় গুপের হাতে বেঁধে দিয়েছেন কারণ গুপে বায়না ধরেছিল যে মাদুলি না দিলে নাকি সে তেলও মাখবে না, চানও করবে না, ভাতও খাবে না। আর নেহাত যদি খায়ও তাহলে এত কম খাবে যে কিছুদিন বাদে পেট না ভরে ভরে হাত-পা ঝিমঝিম করবে, মুখ দিয়ে ফেনা উঠবে, চোখ উলটে যাবে–এই অবধি শুনেই দাদামশাই কানে হাত দিলেন ও তখনি পট করে মাদুলির সুতো ছিঁড়ে সেটাকে গুপের হাতে বেঁধে দিলেন।
গুপে দেখলে মাদুলির গুণ একটুও কমেনি। আধ ঘণ্টার ভিতর ছোটোমামার ফাউন্টেন পেনের নব খারাপ হয়ে গেল, ছোটোমামা সেটা গুপেকে দিয়ে দিল। পরে অবিশ্যি আবার চেয়েছিল, তাইতেই তো গুপে ছুটির দু-দিন বাকি থাকতেই মামাবাড়ি থেকে চলে এসেছিল।
বাড়ি এসেই শোনে মাস্টারমশাইয়ের মাম্পস হয়েছে, গাল ফুলে চালকুমড়ো, সেরে যদি-বা ওঠেনও তবু একটি মাসের ধাক্কা।
এরপর গুপে যা-তা বলতে আরম্ভ করল। নাকি মাদুলি হাতে পরা থাকলে গুপে যখন যা বলবে তাই ঘটতে বাধ্য। একথা শুনে আমরা সবাই ভীষণ আপত্তি করলাম, তা কি কখনো হয়?
নগা বললে, এক যিশু ছাড়া আর কেউ
গুপে ভীষণ রেগে সরু লম্বা ময়লা নখওয়ালা একটা আঙুল নগার দিকে বাগিয়ে বলল, আজ বলে দিলাম তুই ভূগোল ক্লাসে দাঁড় খাবি।
ওমা! সত্যি সত্যি ভূগোল ক্লাসে নগা দাঁড় তো খেলই, তার উপর কানমলাও খেল! এরপর আর কারুর কিছু বলবার জো নেই। গুপে এক বার মাদুলির দিকে তাকালেই হল, সে যখন যা বলে সবাই তা মেনে নেয়। যখন যা চায় সবাই তাই দিয়ে ফেলে।
তিন সপ্তাহক্লাসসুদ্ধ সবাই গুপের দৌরাত্ম্যে খাবি খেলাম। সে খুশি তাই করতে আরম্ভ করল। এমনকী কালীপদর চুল ছাঁটা পছন্দ হচ্ছিল না বলে সে বেচারাকে ন্যাড়া করিয়ে ছাড়ল।
সবাই দিন দিন রোগা হয়ে যেতে লাগলাম।নগার তো পেন্টেলুন এমন ঢিলে হয়ে গেল যে শেষে তার দাদা তাই নিয়ে টানাটানি। বলে কি না–দেখছিস না, ও আমার, তোর গায়ে বড়ো হচ্ছে। হয় আমার, নয় বাবার।
এদিকে যার যা ভালো জিনিস গুপে সব গাপ করতে লাগল। পেনসিল, রবার, পেনসিলকাটা, রঙিন খড়ির বোঝায় গুপের পকেট ঝুলে ঝুলে ছেড়ে আর কী! শেষে কি না সেসব রাখবার জন্য আমার নতুন টিফিনের বাক্সটা একদিন চেয়ে বসল। তখন আমি বেজায় চটে গেলাম। একটু তোতলামি এসে গেল। মাথাটাথা নেড়ে বললাম- দ্যা-দ্যাখ গুপে, দিন দিন তোর বাড় বাড়ছে। কাল তোর সব অঙ্ক কষে দিয়েছি। আমার টিফিনের অর্ধেকের বেশি খেয়ে ফেলেছিস। ইংরেজি ক্লাসে ছুরি ফটফট করেছিস আর তার জন্য বকুনি খেয়েছি আমি। বেশি বাড়াবাড়ি করিসনে বলে দিলাম!
এক নিশ্বাসে রাগের মাথায় এতগুলো কথা বলে দেখি গুপে আমাকে শাপ দেবার জন্য তৈরি হচ্ছে। তার চোখ দুটো ছোটো হয়ে হয়ে আলপিনের ডগার মতো হয়ে গেল, ঢোক গিলে, গলা হাঁকড়ে, আঙুল বাগিয়ে, খনখনে গলায় বলল– আজ তোর জীবনের শেষ দিন। দিনটা কাটলেও রাত কাটবে না। ক্লাসময় একটা থমথমে চুপচাপ। তার মধ্যে নরেনবাবু এসে গেলেন, আর কিছু হল না।
একটু পরেই আমার গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসতে লাগল, নিশ্বাসটা কীরকম জোরে জোরে পড়তে লাগল, চুলের গোড়াগুলো শিরশির করতে লাগল, পেটের ভিতর কেমন ফঁকা ফঁকা মনে হতে লাগল। বুঝলাম মাদুলির শাপ আমার লেগেছে। কিছু পড়া-টড়া শুনলাম না, হোমটাস্ক টুকলাম না, ড্রইং ক্লাসে বেয়াদপি করলাম। যার দিন কাটলেও রাত কাটবে না, তার আবার ভাবনা কী? টিফিন বাক্সটা ক্লাসের মধ্যেইনগার হাতে তুলে দিলাম, আমি মরি আর গুপে সেটা ভোগ করুক আর কী! ছুটির ঘণ্টা পড়লে পর মনে হল, আমি তো গেলাম, যাবার আগে ওই সর্বনেশে মাদুলিটাকে শেষ করে তবে যাব।
দেখি গুপেদের পুরোনো চাকর ভদু গুপের বই গুছিয়ে নিচ্ছে, আর গুপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখছে। হঠাৎ খুন চড়ে গেল, ছুটে গিয়ে এক সেকেন্ডে মাদুলিটা কেড়ে মাড়িয়ে ভেঙে একাকার! তার থেকে অন্তত ধোঁয়াও বেরুনো উচিত ছিল, কিন্তু কিছু হল না। গুপে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু ওদের চাকরটা হই হই করে ছুটে এসে হাত-পা ছুঁড়ে বললে- যা, কী করলে! আমার পেটব্যথার অব্যর্থ মাদুলি, আমি কালীঘাট থেকে দু-পয়সা দিয়ে কিনে এনেছি। আগেই জানি গুপি দাদাকে যা দেওয়া যাবে তাই আর কিছু থাকবে না!
আমরা সবাই হাঁ করে গুপের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার নিশ্চয় কিছু বলা উচিত ছিল, কিন্তু সে অম্লানবদনে পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে ভদুকে ছুঁড়ে দিয়ে একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বাড়ি চলে গেল।
সেইখানে
আমার মেজোদাদামশাই কখনো কখনো ডেকে বলতেন, ও রে, টুনু মিনু নেগো ধেলো ইলু বিলু মন্টু, শোন। পরিদের দেশে গেছিস কখনো?
শুনে আমরা হেসেই খুন। পরিদের দেশ আবার হয় নাকি? ও তো ঠাকুমাদের বানানো গল্প!
মেজোদাদামশাই বিরক্ত হয়ে বলতেন, তবে কি আমার ঠাকুরদার বাড়ির চিলেকোঠার মস্ত সিন্দুকটাও ঠাকুমাদের বানানো গল্প বলতে চাস? যাঃ, তোদের আর কোনো কথাই বলব না।
আমরা অমনি তাকে ঘিরে ধরলাম, না মেজোদাদামশাই, না। বলোনা, তোমার ঠাকুরদার বাড়ির চিলেকোঠার সিন্দুকের গল্প।
মেজোদাদামশাইও তো সেই চান। বলতে লাগলেন, শোন তবে ঠাকুরদার বাড়ির চিলেকোঠায় ছিল কার হাতে কবেকার তৈরি একটা কাঠের সিন্দুক। এক মানুষ উঁচু, আলমারির মতো দাঁড় করানো, কাঁঠাল কাঠের তৈরি সেটা। পাল্লার ওপর তেল-সিঁদুর দিয়ে লাল রঙের লক্ষ্মীঠাকুরুনের পাচা আঁকা। তার রং এখন স্কুলে গিয়েছে, তারই নীচে সোনালি রঙের একটা দরজা আঁকা। তারই মাঝখানে আবার ছোট্ট একটা চাবির ছাদাও আঁকা রয়েছে।