মন্দাকিনী নিজেকে শত শত গঞ্জনা দিল। তার কোন অনুযোগের কারণ নেই। ডাক্তার চ্যাটার্জির বাড়িতে তাঁর যে কোনও অতিথি আসুক না কেন, মন্দাকিনীর তাতে কি? কিন্তু তবুও দার্জিলিংয়ের হিমকুজঝটিকা একেবারে হৃদয়ে গিয়ে প্রবেশ করল তার ব্যথিত দৃষ্টি হিমালয়ের পুঞ্জিত রূপরাশির মধ্যে কোনও দিন কোন কোমলতা খুঁজে পায় নি, আজও পেল না।
এক সপ্তাহ কাল উত্তরবিহীন আত্মজিজ্ঞাসার পর মন্দাকিনী আবার ডাক্তার চ্যাটার্জির সমীপে উপস্থিত হল। আর তার কোন আশঙ্কা নেই, মন তার বর্ম পরেছে। নৈরাশ্যের গভীরতম অতলে যে ডুব দিয়েছে সে আবার চোখে আলোর রেখা দেখতে পায়। সে ঔদাসীন্যের চন্দ্রলোক, শীতল সুন্দর।
মন্দাকিনী তাই সাহসে বুক বেঁধে, দৃষ্টিতে ত্যাগের মহিমা নিয়ে ডাক্তার চ্যাটার্জির সমীপে উপস্থিত হল।
দেখল দরজা-জানালা খোলা হয় নি, ফুলগাছে জল দেওয়া হয় নি। উদাসী মনের উপর উদ্বেগের কালো ছায়া নেমে এল। যাকে ত্যাগ করা যায় তার মঙ্গল কামনা করাতে কোন বাধা নেই।
কম্পিত পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে উপরে গিয়ে মন্দাকিনী দেখল শোবার ঘরের পর্দা উঠানো, জানালা বন্ধ, শার্সিতে ধুলো এবং টেবিলে বই, ড্রেসিংটেবিলে বই, আরামকেদারায় বই, আরামকেদারার নিচে বই, পাশে বই, পিছনে বই, মোড়াতে বই, জলচৌকিতে বই এবং মেঝের গালিচাতে রাশি রাশি দিশী ও বিলেতী বই। স্প্রিংযুক্ত লোহার খাটে বাদামী রঙের কম্বলে ঢাকা রোগপাণ্ডুর মুখে ডাক্তার চ্যাটার্জিকেও দেখা গেল।
আবেগের আতিশয্যে মন্দাকিনীর বাক্যরোধ হল। ডাক্তার চ্যাটার্জি হাত থেকে রিলিজিও মেডিচিখানা নামিয়ে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।
মন্দাকিনী নির্বাক রইল তার অভিজ্ঞতামতে মনে যার অভিমান নেই, তার মনে স্নেহপ্রেমের লেশমাত্রও নেই। মন্দাকিনী তাই হতাশ হল। কিন্তু তার উৎকর্ণ মন মুহূর্তের মধ্যে নৈরাশ্যের চেয়ে ঘরের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়ল সে আয়নার সামনে গিয়ে প্রথমে নিজের কেশ-বেশ সংস্কারের পরে রুমাল দিয়ে ওই আয়না সংস্কারে মনোনিবেশ করল।
শান্তকণ্ঠে ডাক্তার চ্যাটার্জি বললেন, আমার ভাগ্নী এসেছিল, তোমায় দেখাতে পারলাম না মন্দাকিনী এর উত্তরে কি বলবে ভেবে পেল না। ভাবল, হয়তো মন্দাকিনীর মনোভাব সম্বন্ধে ডাক্তার চ্যাটার্জির কোন কৌতূহল নেই।
হঠাৎ রুমালের আঘাতে ছোট একটা জিনিস মাটিতে পড়ল। মন্দাকিনী অপ্রতিভ হয়ে তুলে নিয়ে দেখল একটি নক্ষত্রোজ্জ্বল হীরাবসানো মেয়েদের আংটি।
চোখ তুলতেই ডাক্তার চ্যাটার্জির ঈষৎ ক্লান্ত চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। ডাক্তার চ্যাটার্জি স্নিগ্ধস্বরে বললেন, আমার মায়ের বিয়ের আংটিা মনে করেছি তোমার হাতে মানাবো বলে পরিয়ে দেবার বিন্দুমাত্র উদ্যোগ না করে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।
মন্দাকিনী শেষ পর্যন্ত আংটিটা নিজেই পরল। আর দুটি মুক্তোর মতন দুই বিন্দু অশ্রু আস্তে আস্তে গাল বেয়ে গড়িয়ে গেল।
ডাক্তার চ্যাটার্জির নিকোটিন-রঞ্জিত ডান হাতখানি মন্দাকিনীর ক্ষীণ মণিবন্ধে নিবদ্ধ হল, আর সেই সঙ্গে মন্দাকিনী অনুভব করল তার হৃদয়ের সকল রুদ্ধ বাতায়নগুলি একে একে খুলে গিয়ে সূর্যালোক আর দক্ষিণ-বাতাস যুগপৎ সেখানে প্রবেশ করল।
লক্ষ্মী ছেলে
এক বেজায় জ্যাঠা ছেলে ছিল। যতদিন বাবা বেঁচে ছিলেন, ততদিন সে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে টো টো করে বেড়িয়েছে। শেষটায় যখন বাবা মারা গেলেন, তখন ছেলে ভারি বিপদে পড়ল। কী করে। লেখাপড়া তো আর বেশি জানে না, যে কাজ করে খাবে? তখন সে ভাবল, আমার তো আর আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। শুধু আছেন মামা। তিনি আবার আমার উপরে চটা। কী আর করি? তার কাছেই যাই। এই-না,ভেবে সেই দিনই দুপুর বেলা সে মামা বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। মামা এদিকে খেয়ে-দেয়ে দিব্যি ঘুম দিচ্ছেন। তার চেঁচামেচিতে তার কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। তিনি চটে বললেন, হতভাগা। কী করতে এসেছিস? কী চাস?
–আজ্ঞে এখানে থাকতে এসেছি।
মামা আর কী করেন বললেন, আচ্ছা থাক। দেখিস বাঁদরামি করিস না।
সেখানে সে বেশ আছে। খায় দায় ঘুম দেয়। একদিন তার মামি বললেন, ওই হাঁড়িতে রসগোল্লা আছে, দেখিস, কেউ যেন খায় না। এই বলে যেই মামি অন্য ঘরে গেছেন, শ্রীমান সব রসগোল্লা গিলেটিলে বসে আছেন।
একটু পরেই মামি ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কে রসগোল্লা খেয়েছে রে? ছেলে সাধুর মতন বলল, আজ্ঞে আমি।
কেন রে?
খিদে পেয়েছিল বলে।
মামি এসব দেখে হাড়ে হাড়ে চটে গেলেন। ঠিক করলেন, তাকে তাড়াতে হবে। তখন ছেলে ভাবল, তাই তো, মামিকে একটু খুশি করতে হবে।
.
একদিন এক কাণ্ড হয়ে গেল, যাতে মামির মত একেবারে উলটে গেল। তখন বোধ হয় রাত একটা হবে, হঠাৎ মামার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তার মনে হল ঘরের ভিতর কে যেন খচমচ করছে। ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। টাক মাথায় চুল ক-টা খাড়া হয়ে গেল, কপালে ঘাম দেখা দিল।
অতি কষ্টে বললেন, কে রে? তবু কোনো উত্তর না পেয়ে চোর চোর বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। অমনি কে জানি হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এমন সময় শুনতে পেলেন বাইরে ছেলেটা বলছে, কে মশাই? না বলে চুরি করতে এসেছেন কেন? বলে এলেই তো পারতেন, তাহলে জিনিস সব বের করে রাখতাম, আপনি শুধু নিয়ে যেতেন।