চর্মচক্ষে মন্দাকিনী দেখল বহুবর্ষের বৃষ্টিধারায় রঙ-ওঠা, কাঁচেমোড়া, বিবর্ণ সবুজ পর্দা ঘেরা ছোট দোতলা বাড়ি ভাঙা কাঁচের অন্তরালে দৃশ্যমান ধূলিমলিন মনোমোহিনী কাঠের সিঁড়ি। পশ্চিমদিকের ঝাউগাছ তাদের আলম্বিত ছায়াগুলিকে দেওয়ালের উপর ফেলেছে। সামনের শানবাঁধানো জমির ধারে ধারে ক্রিস্যান্থিমাম গাছ, জেরেনিয়াম গাছ, আর তাদের পদপ্রান্তে প্রিমরোজ ও ভায়োলেটা কোথাও একটি ফুল ফোটেনি এবং কখনও ফুটবে কিনা সন্দেহ। জনমানুষের সাড়া নেই।
এই শূন্য বাড়িখানা মন্দাকিনীর হৃদয়কে এক নিমেষে গ্রাস করল। সে তার মাস্টারনীসুলভ গাম্ভীর্য ভুলে গিয়ে গেট খুলে অনধিকার প্রবেশ করল এবং অমার্জনীয় ভাবে পায়ের আঙুলের। উপর দাঁড়িয়ে হেঁড়া পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতর দেখল গদি-মোড়া প্রাচীন ও সুশ্রী আসবাবে ধুলো জমেছে।
তারপর ওই বাড়ি তাকে যাদু করল। অনেকদিন পর সে তার মিনে-করা বাসন ইত্যাদির দুঃখ ভুলে গেল। সমস্ত দিনের কর্মব্যস্ততা অসহ্য মনে হত বিকেলবেলা ওই রঙ-ধোওয়া বাড়ির কাছে সে নিজেকে খুঁজে পেত।
দিনের পর সপ্তাহ ও সপ্তাহের পর মাস এই ভাবে গড়িয়ে গেল। মন্দাকিনী মনে মনে বাড়িখানাকে মেজে-ঘষে ফেলল, পুরনো সবুজ পর্দাগুলি ধোপার বাড়ি পাঠিয়ে নতুন ঘোর গোলাপী রঙের পর্দা লাগাল। প্রাচীন আসবাবের ধুলো মুছল, বাগানটির সংস্কার করে অনেক যত্নে সেখানে ফুল ফোঁটালা এমন কি কালো চীনেমাটির চ্যাপটা ফুলদানিতে ফুল সাজাল।
হঠাৎ একদিন মন্দাকিনী মনে মনে একটা বেহিসাবী কাজ করে ফেলল। মনগড়া অপরূপ এক দাঁড়-করানো বিজলী বাতি কিনে ফেলল, কোথায় তাকে মানাবে ভেবে মনে বড় অশান্তি অনুভব করল। মনস্থির করবার জন্য বিকেলবেলা সেখানে গিয়ে গেট খুলে ঢুকেই পটের পুতুলের মতো থমকে দাঁড়ালা
আধ-ময়লা ছাইরঙের পেন্টালুন, গলা-খোলা নীল রঙের শার্ট আর কালো পশমের গেঞ্জি গায়ে একজন লোক ঝাঁঝরি হাতে মরা ফুলগাছে জল দিচ্ছে। তার মুখের ডানপাশে প্রাচীন পাইপ এবং দেখামাত্র বোঝা যায় যে তিনদিন ক্ষৌরকর্ম হয়নি। রান্নাঘরের খোলা জানলা দিয়ে অশুদ্ধ তেলের গন্ধ ভেসে আসছে।
সেই ব্যক্তি মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে, হাত থেকে ঝাঁঝরি নামিয়ে অবাক হয়ে দেখল গেটের উপর হাত রেখে বছর ত্রিশ বয়সের একজন শ্যামবর্ণ মহিলা বেতসলতার মত কাঁপছে। তাকে বিপন্ন মনে করে কাছে যেতেই সে একটু অপ্রতিভ স্বরে বলল, ‘আমি রোজ আসি।’ ডাক্তার চ্যাটার্জি বললেন, বাড়ি আর বাগানের অবস্থা থেকে তার পরিচয় পেয়েছি। ‘ তাইতে মন্দাকিনীর একটু রাগ হল এবং রোষকষায়িত নেত্রে ঝাঁঝরিখানা নিয়ে যে গাছে ডাক্তার চ্যাটার্জি একবার জল দিয়েছেন তাতে আবার জল দিতে লাগল আর ডাক্তার চ্যাটার্জি পাইপটা আবার মুখে দিয়ে প্রসন্নচিত্তে মস্ত এক গাছ-ছাঁটা কাঁচি তুলে নিলেন।
এমনি করে মন্দাকিনীর মন আর মন্দাকিনীর মনোবার মাঝে এক অন্তরাল রচনা হল। ডাক্তার চ্যাটার্জির মধ্যে নয়নলোভন কোনও গুণ প্রকাশ পেল না যা বিন্দুমাত্র চিত্তাকর্ষণ করো এমন কি চিত্তাকর্ষণ করবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা পর্যন্ত দেখা গেল না।
কোন সুদূর মহানগরীর ছায়াময় খ্যাতি তাঁর নামের সঙ্গে জড়িত ছিল তাঁর বিষয় অদম্য কৌতূহল ছাড়া মন্দাকিনীর মনের কোন ভাবান্তর ঘটল না। যৌবনে তার স্বপ্নে-দেখা সেই পুরাতন। প্রিয়তমের ইতিবৃত্ত মন্দাকিনীর জানা ছিল না। সে ধনী কি নির্ধন, কোন কাজকর্ম করে কি ঘরে। বসে থাকে, এই সকল অতি তুচ্ছ তথ্য জানবার প্রয়োজনই তার মনে আসে নি সে দ্বিধাবিহীন চিত্তে দর্শনমাত্রেই তার গলায় বরমাল্য দিয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার চ্যাটার্জি সম্বন্ধে তার জিজ্ঞাসার অন্ত ছিল না।
এক মাস কাল সময়, অশেষ ধৈর্য ধারণ এবং সমস্ত ছোট বাগানখানার আমূল সংসারের পর মন্দাকিনী জানল তাঁর বয়স চল্লিশ বছর, অবিবাহিত, ধর্ম-বিরোধী, কিন্তু ভগবানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে একটু একটু সন্দেহ আছে, দৈর্ঘ্য ৫ফুট ১১ ইঞ্চি, ওজনের কথা প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক।
স্ত্রীজনসুলভ নানান চাতুরী অবলম্বন করে মন্দাকিনী তাঁকে দিয়ে নতুন গোলাপী পর্দা কেনাল, দরজা-জানালায় সবুজ সাদা রঙ লাগাল, গেটের পাশে চেরী গাছের কলম বসাল।
এমনি করে মন্দাকিনীর স্বপ্ন ফুলের মতন ফুটতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলা মন্দাকিনী আবিষ্কার করল ইডেনে সর্প প্রবেশ করেছে।
কে একজন অতি তরুণী, তনুদেহে সবুজ জজের্টের শাড়ি অপরূপ করে জড়িয়ে, কালো কোঁকড়া চুলগুলিকে মাথার উপরে অভিনব রুচিতে চূড়ো করে বেঁধে ডাক্তার চ্যাটার্জির স্কন্ধ অবলম্বন করে অতি-রক্তিম ঠোঁট দুখানিকে ঈষৎ আলগা করে হিমালয় দেখছে। আর তার সর্বাঙ্গ থেকে মাধুরী ঝরে পড়ছে।
এইটুকু মাত্র। কিন্তু মন্দাকিনীর হৃদয় বিকল হল। ত্বরিত পদে সেখান থেকে সে ফিরে গেল। তার মানসচক্ষের সম্মুখে ওই মেয়েটি তার সবুজ জর্জেটের আঁচলখানা মেলে দিয়ে এমন একটা শ্যামল অন্তরাল সৃষ্টি করল যাকে ভেদ করে মন্দাকিনীর লুব্ধ চোখ আর সেই ছোট বাড়ি কি তার মালিককে দেখতে পেল না।
মন্দাকিনীর হৃদয়ে জীবনে এই প্রথম ঈর্ষা জন্ম নিল এবং তার সবুজ চোখের কাছে সমগ্র জগৎখানা বিষময় হয়ে উঠল। যেখানে কোন দাবি নেই সেখানে নৈরাশ্যের জ্বালা সব থেকে তীব্র, কারণ তার কোনও প্রতিকার হয় না।