দুঃখের বিষয় এমন সুপ্রকাশ যার রূপ, সে ব্যক্তি চিরকাল মন্দাকিনীর আগ্রহাধীর নয়নযুগলকে ফাঁকি দিয়ে যেতে লাগল। কত যে বর্ষা-সন্ধ্যা, কত যে জ্যোৎস্নাময় নিশীথ বিফল হয়ে যেতে লাগল তার কোন হিসাব নেই। শেষ পর্যন্ত মন্দাকিনী তার দুর্লভ আদর্শটিকে ধরা ছোঁয়ার গোচর করবার দুরাশায় তাকে অনেকটা খর্ব করেও এনেছিল।
তার অমন সুঠাম দেহের দৈর্ঘ্য থেকে দু-চার ইঞ্চি হেঁটে দিয়ে, তার ওই উজ্জ্বল গৌর কান্তিতে একটুখানি শ্যামলের ছোপ ধরিয়ে, তার দাড়িকে শেষ পর্যন্ত না-মঞ্জুর করে, (কারণ কে না জানে যে ভক্তির রাজ্যে যাই হোক, প্রেমের রাজ্যে দাড়ি অচল) তার গোঁফ সম্বন্ধে একটু উদার হয়ে, তাকে প্রায় সাধারণত্বের কোটায় এনে ফেলেছিল।
তবু তার দিশা পাওয়া যায় নি। একটি সুকোমল নারীহৃদয়ে তার জন্য এত সম্ভার রক্ষিত আছে, তবু যদি সে নরাধম অনুপস্থিত থাকে তবে সে কোন রকম সহানুভূতিরও অযোগ্য একথা। জেনে অবশেষে একদা নির্দয়ভাবে স্বহস্তে তাকে প্রিয়তমের সিংহাসন থেকে বিদায় দিল। এমন কি মনে-মনে তাকে আহাম্মক আখ্যা দিতেও কুণ্ঠাবোধ করলে না। তবু মাঝে মাঝে নির্জন নিশীথে তার মনে সংশয়ের দোলা লাগত, আর ওই শূন্য সিংহাসনখানা অন্ধকারে হাহাকার করত।
সময় কিন্তু লঘুপদে চলে যেতে লাগল আর মন্দাকিনীর যৌবন থেকে একটু একটু করে মধু চুরি করে নিতে লাগল। মন্দাকিনী এতদিন অলস ছিল না, ধীরে ধীরে অনেক বিদ্যাকে অনেক ললিতকলাকে আয়ত্ত করে ফেলেছিল।
তার কাঁচা-রূপের সাজ আভরণে আস্তে আস্তে অভিজ্ঞ সুরুচির পরিচয় পাওয়া গেল। সে রূপসীও নয়, কুরূপাও নয়। দুইয়ের মাঝামাঝি এমনটি, যার মাধুর্য দেখামাত্র চোখে পড়ে না, কিন্তু মন দিয়ে খুঁজলে সুপ্রকাশ হয়ে পড়ে।
যত দিন যেতে লাগল তার কথায়, ভঙ্গিতে, সজ্জায়, এমন কি কবরী রচনাতেও একটা তীব্রতা প্রকাশ পেল, যার মাধুর্য মধুরের চেয়ে তিক্ত বেশি রৌদ্রবর্ণ বহুমূল্য সুরা যেমন বেশিদিন রেখে দিলে তিতিয়ে যায়। আর নিয়ত তার কানে বাজতে লাগল কালের রথের চাকার ধ্বনি।
জীবনটাকে যখন শূন্য বোধ হবার আশঙ্কা হল, মন্দাকিনীরও সুবুদ্ধি হল। হৃদয়ের সমস্ত অপ্রার্থিত প্রেমরাশি একজন অনাগত মানুষের চরণ থেকে অপসারিত করে সে সহজে আয়ত্ত বস্তুর উপর ন্যস্ত করল। বস্তুর পোষমানা ভাবটা তাকে নিগূঢ়ভাবে আকর্ষণ করতে লাগল। যে সকল বস্তুকে কামনা করলে, এবং যে-ভাবে কামনা করলে অন্তঃকরণ স্কুল ও বৈষয়িক হয়ে যায়, তারা সেভাবে মন্দাকিনীকে লুব্ধ করল না। সে ভালবাসল প্রাচীন ও আধুনিক চিত্র, পুঁথি, বাসন, সূচিকর্ম, নকশা-দেওয়া হাতে-বোনা পর্দা, মিনে-করা চৌকি—এমন আরও কত কী!
সৌন্দর্যের এমন একটা মোহিনী শক্তি আছে যে, যে তাকে অর্থ দিয়ে কেনে তাকেও সে নক্ষত্রলোকে নিয়ে যায়। যা কিছু সুন্দর, সৌন্দর্যই তার সার্থকতা। তার আর কোনও গুণের প্রয়োজন নেই। সে নয়নানন্দ। তার কাছে আর কিছু প্রত্যাশা করলে তার প্রাণময় পরিপূর্ণ রূপরাশি অর্থহীন বিলাসে পরিণত হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে।
যে কেউ সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানে না। কিন্তু মন্দাকিনী জানত। তাই তার বারবার হতাশ হয়ে যাওয়া হৃদয় মরুভূমি না হয়ে গিয়ে নিত্য নূতন রসের উৎসের সন্ধান পেল।
সৌন্দর্যের উপাসকের যে অনাবিল অবসর ও অজস্র অর্থের প্রয়োজন, যে দুষ্ট-শনি মন্দাকিনীর পিছু নিয়েছিল, সে একদিন সে সকল হরণ করে নিল। মন্দাকিনী সৌন্দর্যের উপাসনা তখনকার মতন বন্ধ করে দিয়ে, সৌন্দর্যের সামগ্রীগুলোকে এবাড়ি-ওবাড়ি বাক্সবন্দী করে কেমন করে যেন এক মাস্টারী যোগাড় করে দার্জিলিং চলে গেল।
দার্জিলিংয়ে গুছিয়ে বসলে পর চারিদিকে চেয়ে মন্দাকিনী দেখল হিমালয়ের কোলে কোলে রডোডেনড্রন গাছের সারি, কিন্তু তার একটিরও উদ্ধত শাখার রাঙা পুষ্পস্তবকের নাগাল পাওয়া যায় না। পাহাড়ের কানা ধরে ধরে একটির পর একটি ঝাউ গাছের শ্রেণী, কিন্তু তাদের দীর্ঘ শীর্ণ ছায়াগুলি অগম্য রাজ্যে নিচের উপত্যকায় সাদা মেঘ জমেছে, সেখানে পৌঁছনো অসম্ভব।
এক দিক রোদে স্নান করছে, সেদিকে চাইলে মন গলে জল হয়ে যায় অন্য দিক কুয়াশাচ্ছন্ন, সেদিকে চাইলে মন জমে বরফ হয়ে যায়। কিন্তু এ সৌন্দর্য নৈর্ব্যক্তিক, একে মন্দাকিনীর সেই জয়পুরী চৌকির মতন কোলের কাছে টেনে নেওয়া যায় না। বরং একে বেশিক্ষণ দেখলে মনে একটা নিষ্কাম বৌদ্ধভাব জন্মায়।
ঠিক এই সময়, যখন জগৎটা মন্দাকিনীর কাছে অকিঞ্চিৎকর হয়ে আসছিল তখন সে এক ম্লান গোধূলির আলোতে ডাক্তার চ্যাটার্জির খুদে বাড়িখানা আবিষ্কার করল।
পাহাড়ের গায়ে একটুখানি অপরিসর জমির উপর, সত্যি কথা বলতে কি, খানিকটা শূন্যমার্গে, লোহা ও ইটকাঠের উপর ধৃত হয়ে অতি বিপজ্জনক ভাবে, কায়ক্লেশে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে প্রবল সাক্ষ্য দিয়ে কোনও গতিকে বাড়িটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্দাকিনীর হৃদয়ে তার মায়াজাল বিস্তার করল।
এক মুহূর্তে তার চোখে পৃথিবীর রঙ বদলে গেল। তার যে মন দূর বনান্তরালে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পদাঙ্গুলির অগ্রভাগে নির্ভর করে দুই পক্ষ বিস্তার করে বিহঙ্গের মতন উড়ে যাচ্ছিল, সে আবার। পাখা বন্ধ করে কুলায়ে ফিরে এল।