.
ভাই গুপি,
আর গোপনতার কোনো দরকার নেই, যা সর্বনাশ হবার তা হয়ে গেছে। শম্ভু আর মন্টু দু-জনে মিলে রাতে নতুন খুড়োর পুকুরে পাঁচটা ছিপই কেঁচো গেঁথে ফেলে রেখেছিল। ভোরে গিয়ে দেখে পাঁচটা চার-সেরি, সাড়ে-চার-সেরি কাতলা পড়েছে। সেইগুলোকে তুলে নিয়ে চারটেকে ওরা পুজো কমিটির চার জনার বাড়িতে নিজেদের নামে দিয়ে এসেছে আর একটা দিয়েছে নতুন খুড়োকে। এত বড়ো মিথ্যাবাদী যে, বলেছে টালিগঞ্জে গিয়ে নাকি কোন বন্ধুর পুকুর থেকে ধরেছে। তারা তো সব আহ্লাদে আটখানা। মাছের গায়ে তো আর টিকিট ঝোলানো নেই যে, নতুন খুড়োর পুকুর থেকে ধরা।
নতুন খুড়ো এইমাত্র জ্যাঠামশাইকে বলে গেলেন, শম্ভু আর মন্টু নাকি পুজোর নাটকে রাজা আর শত্রু-রাজা হবে, আর তোকে আমাকে নাকি মন্ত্রী আর সেনাপতি করা হবে। সে পার্টগুলো কত ছোটো তোর মনে আছে তো ভাই? আর শম্ভু মন্টুর পেজোমি দেখলি! নতুন খুড়োর পুকুর থেকেই রাতারাতি মাছ চুরি করে চুরি নয় তো কী ভাই?– ওকে আর ওর দলটিকে দিয়ে আমাদের পার্টগুলো বাগিয়ে নিলে। এই বয়সেই এই, আরও বড়ো হলে যে পাকা দাগি চোর হবে, তাই-বা কে বলবে! অথচ বুদ্ধিটা হল তোর আমার! কচুবন থেকে ফড়িং ধরে এনেছিলুম আমি, নেহাত তুই বাঁচাতে পারলি না বলে কেঁচো দিয়ে ধরতে হল। কিন্তু সমস্তটা আমাদের মাথা থেকেই বেরুল, অথচ ফল ভোগ করছে ওরা দুটোতে। তোর বাবা আমাদের বাইরের ঘরে বসেছিলেন, নতুন খুড়ো তাকে কী বললেন জানিস? বললেন, ওই জগু গুপি দু-টি গুণধরকে আলাদা করে দিয়ে খুব বুদ্ধির কাজ করেছেন, দাদা।শম্ভ মন্টুর মতো ভালো ছেলেদের সঙ্গে মিশলে এখনও ওদের সুমতি হতে পারে। নিজের পুকুরের মাছ উপহার পেয়েই একেবারে গলে জল। ওই বুড়োকে কী করে জব্দ করা যায় এখন তাই ভাবছি। সবচেয়ে দুঃখ হচ্ছে, গুপ্ত জায়গাটা ওরা জেনে গেল বলে।নইলে কচু বনের পেছনের ভাঙা দেয়ালের আলগা ইট সরিয়ে তার পেছনে চিঠি রেখে, আবার ইট বন্ধ করার কথা তোর ছাড়া আর কার মাথা থেকে বেরুত ভাই?
ঠিক করেছি, তোর জ্বর হয়েছে বলে বাবা জ্যাঠামশাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে একবার তোকে দেখতে যাব। তখন বাকি কথা হবে। ইতি–
তোর প্রাণের বন্ধু
জগু
ভূতের ছেলে
রাত যখন ভোর হয়ে আসে তখন ওই তিন-বাঁকা নিম গাছটায় হুতুম প্যাঁচাটারও ঘুম পায়। নেড়ু দেখেছে ওর কান লোমে ঢাকা, ওর চোখে চশমা, ওর মুখ হাঁড়ি। হুতুমটা কেন যে চিল-ছাদের ছোটো খুপরিতে পায়রাদের সঙ্গে বাসা করে না, নেড়ু ভেবেই পায় না। বোধ হয় ভূতদের জন্যে।
নিম গাছতলায় ভূত আছে।
একদিন ভোর বেলায়, মই বগলে ছাগলদাড়ি লোকটা রাস্তার আলো নিবিয়ে নিবিয়ে চলে গেলে পর, নেড়ু দেখেছিল কোমরে রুপোর ঘুনসিওয়ালা, মাথায় গুটিকতক কোঁকড়া চুল, ভূতদের ছোটো কালো ছেলে নিম গাছতলায় কাঁসার বাটিতে নিম ফুল কুড়চ্ছে। নেড়ুকে দেখেই ছেলেটা এক চোখ বুজে বগ দেখাল। নেড়ু, ভাবল, ভূত কিনা, তাই ভদ্রলোক নয়।
তারপর অনেক দিন নেড়ু অনেক বেলা পর্যন্ত গাঁক গাঁক করে ঘুম লাগিয়েছে, শেষটা এমনকী ভজাদা এসে ঠ্যাং ধরে টেনে খাট থেকে নামিয়েছে। নেড়ু, কিন্তু একটুও রেগেমেগে যায়নি। ও তো আর সুকুমারদা নয় যে মুখ দেখলে বালতির দুধ দই হয়ে যাবে! কিন্তু সেই ছানাটাকে আর দেখা হয়নি।
শেষটা হঠাৎ একদিন নেড়ু স্বপ্ন দেখল কালো ছেলেটা ওকে লেঙ্গি মেরে মাটিতে ফেলে নাকের ফুটোয় কাগের নোংরা পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। রাগের চোটে নেড়ুর ঘুম ছুটে গেল। ইচ্ছে করল ছেলেটার মাথায় সুপুরি বসিয়ে লাগায় খড়ম! খানিক চোখ রগড়ে, জিভ দিয়ে তালুতে চুকচুক করে চুলকে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল, মই বগলে সেই লোকটা। তারপর নিমতলায় তাকিয়ে দেখল ভূতের ছানাটা একলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বেজায় হাসছে, যেন কালো ভাল্লুক মুলো চিবোচ্ছে। সে কী বিশ্রী হাসি! গোটা কতক শুট লাগালে হয়!
ছেলেটা নেড়ুকে দেখে আজ আর বগ দেখাল না, ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। ভূতের ছেলে বাবা! বিশ্বাস নেই! নেড়ুর একটু ভয় করছিল, ঘরের ভিতর এদিক-ওদিক একবার তাকাল। দেখে ভূতের ছেলে কিনা কুঁজোর পিছন থেকে একটা এয়া বড়া টিকটিকি মুণ্ডু বাড়িয়ে, ঘোলাটে চোখ পিটপিট করে ঘুরিয়ে আহ্লাদে আহ্লাদে ভাব করে টিক-টিকটিক করে আবার মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে নিল, কেমন যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব! নেড়ুর ভারি রাগ হল। কী, ভয় পাই। নাকি!
নেড়ু আস্তে আস্তে নীচে গেল। দাঁত মাজল না। চোখ ধুল না। তাতে কী হয়েছে? সেই ছেলেটার তো নাকে সর্দি!
নিমতলায় যাবার পথে দেখে দুই দিকে দেয়ালে খুঁটে। দেওয়া। কতকগুলো গোল গোল মতন, সেগুলো ধোপার। মা দিয়েছে; আর কতকগুলো ঠ্যাংওয়ালা, সেগুলো ধোপার মায়ের মেয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিমতলায় গিয়ে দেখে ছেলেটা কোথায় যেন সটকে পড়েছে। কী। জানি ভোর হয়ে এসেছে, আলো-টালো দেখে উঠে গেল না তো!
সেই দিনই সন্ধ্যা বেলায় নেডুর দাঁত ব্যথা করছিল, তাই লবঙ্গ-জল দিয়ে মুখ ধুয়ে জানলার উপর বসে ভাবছিল, আচ্ছা নেপাল খুড়োর কেনই-বা অমন সিন্ধুঘোটকের মতন গোঁফ, আর বিধুদাই-বা কেন দিনরাত টিকটিক করেন!
এদিকে ওদের বাড়ির দারোয়ান কী যেন গাইছিল, মনে হচ্ছিল–