মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি বহুদূরে, উনি তবু রোজ ঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হতেন। কী শখ বাবা পড়াবার! মাঝে মাঝে দাদারা এসে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে গল্প জুড়ত, কলুকে শব্দরূপ মুখস্থ করতে হত। কলুর চোখ বুজে আসত, মাথা ঝিমঝিম করত, আর দাদারা শুধু কথাই বলত। কলু দড়িবাঁধা ছেলেটার কথা ভাবত, আর শুনতে পেত পাশের বাড়ির ছোটো ছেলেরা খেতে বসে হল্লা করছে। আর ভাবত, এমন অবস্থায় পড়লে মাস্টারমশাইয়ের ছেলে সেই বিধুশেখর কী করত!
এক-এক দিন যেই পড়া শেষ হয়ে আসত, বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামত। মাস্টারমশাই হয়তো বাড়িতে ছাতা ফেলে আসতেন, আটকা পড়তেন।
কলু ব্যস্তভাবে বলত, ছাতা এনে দিই, ভালো ছাতা?
মাস্টারমশাই বলতেন, না না, থাক, থাক। একটু বসে যাই।
কলু আবার সেই মচমচে চেয়ারটাতে বসত।
মাস্টারমশাই তাঁর ছোটোবেলাকার অনেক গল্প বলতেন। তখন বাবাও নাকি ছোটো ছিলেন, একসঙ্গে ইস্কুলে পড়তেন, পুজোর সময় কাঁদের বাড়ি যাত্রাগান হত, পালিয়ে গিয়ে শুনতেন। কলুর চোখ জড়িয়ে আসত, হাই তুলতে সাহস হত না; ভাবত এতক্ষণে সেই দড়িবাঁধাটা নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছে। হাইগুলো মাথায় গিয়ে জমাট বাঁধত, চম্কে জেগে যেত, শুনত মাস্টারমশাই বলছেন, দে বাবা, ছাতাই দে। এ আর আজ থামবে না।
কলু ছুটে ছাতা এনে দিত, মাস্টারমশাই চলে যেতেন আর কলুর ঘুমও ছুটে যেত।
এমনি করে দিন যায়। একদিন বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, মাস্টারমশাই বিধুশেখরের কথা বলছেন। সে শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে কক্ষনো বায়োস্কোপ দেখেনি, থিয়েটারে যায়নি, বিড়ি টানেনি, গল্পের বই খোলেনি। বলতে বলতে মাস্টারমশাই বললেন, ওরে, চুপিচুপি দুটো পান সেজে নিয়ে আয় তো দেখি।
কলু দৌড়ে গেল, পান দিল, চুন দিল, দুটো করে এলাচদানা দিল, বড়ো বড়ো সুপুরির কুচি দিল, আর সবশেষে কী মনে করে বদ্যিনাথের সেই আশ্চর্য বড়িও একটা করে গুঁজে দিল।
মাস্টারমশাই একটা পান তক্ষুনি মুখে পুরে দিলেন, একটা বইয়ের মতন দেখতে টিনের কৌটোতে ভরলেন। কলু তাক করে রইল। প্রথমটা কিছু মনে হল না– তারপর ভালো করে দেখল, মনে হল মাস্টারমশাইয়ের কপালের দিকটা কীরকম যেন লম্বাটে দেখাচ্ছে, থুতনিটা যেন। ঢুকে পড়েছে, চোখ দুটোও কীরকম পিটপিট করতে লাগল।
কলুর বুকের ভিতর কেমন ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। মাস্টারমশাই বাড়ি যান-না কেন? যদি হঠাৎ ল্যাজ দুলিয়ে হুপ করেন? এমন সময়ে বৃষ্টি থেমে গেল, মাস্টারমশাই ধুতির খুঁটটা কাদা থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলে গেলেন। কলু ভাবতে লাগল, ক-দিন আর ধুতির খুঁট? অন্য পানটা বিধুশেখর। বোধ হয় আজ রাত্রে চেয়ে নেবে, তারপর সেই-বা ধুতি নিয়ে করবে কী!
.
পরদিন বিকেলে বই নিয়ে কলু অনেকক্ষণ বসে রইল, কিন্তু মাস্টারমশাই এলেন না। সন্ধ্যাবেলা বাবা বললেন, ওরে তোর মাস্টারমশাই যে হেডমাস্টার হয়ে বিষ্টুপুর চলে গেলেন।
কলু ভাবল, বিষ্টুপুর কেন, কিষ্কিন্ধে হলেও বুঝতাম! তারপর বহুদিন চলে গেছে। কলুর নতুন মাস্টার এসেছেন, তার ছেলের নাম বিধুশেখর নয়, তার ছেলেই নেই। তিনি কলুকে রোজ ফুটবলের, ক্রিকেটের গল্প বলেন কিন্তু কলুর থেকে থেকে মনে হয়, অন্ধকারে ওবাড়ির পাঁচিলে দুটো কি ল্যাজঝোলা বসে আছে! একটার মুখ কেমন চেনা চেনা, অন্যটা বোধ হয় বিধুশেখর!
বন্দুক ও ছোরা
ভাই বন্দুক,
কাল যখন গুপ্তস্থানে তোমার চিঠি পেলুম না, তখন আমার মনের অবস্থা যে কী হয়েছিল, সে আর কী বলব! তবে কি তুমি এত সহজেই ভয় খেয়ে গেলে? চিরকাল তো দেখে এসেছি যে, স্বয়ং হেড-সার পেছন ফিরে বোর্ডে কিছু লিখতে গেলেই, তুমি ভেংচি কাটতে, বগ দেখাতে, সে-সময় তো তোমার অন্য মূর্তি দেখতুম!
এমনও নয় যে, তোমার অসুখ করেছে। তাহলে আমার চিঠিটা নিলে কী করে? তা ছাড়া মামার সঙ্গে বুক ফুলিয়ে খেলার মাঠে যাওয়া হচ্ছিল, সে কি আমার চোখে পড়েনি ভেবেছ?
তোমাদের বাড়ির লোকদের ধারণা, আমার সঙ্গে মিশলে তুমি গোল্লায় যাবে। তাই তোমার মন ভোলাবার জন্যেই ওদের এসব চেষ্টা, সে কি তুমি বোঝ না?
তাহলে তোমার এও জানা উচিত যে, আমাদের বাড়ির লোকদের বিশ্বাস, তুমি একটা পাজি বদমায়েশ, তাই আমাকে ও ইস্কুল থেকে ছাড়িয়ে অন্য ইস্কুলে ভরতি করে দেওয়া হয়েছে।
তোমার সঙ্গে মিশলে আমি খারাপ হয়ে যাব, একথা জেনেও আমি তোমাকে ছাড়িনি; আর তুমি কি শেষ মুহূর্তে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছ নাকি? আমাদের বাড়ির লোকরা বলে, তোমার টেরি বাগানো দেখেই তোমাকে হাড়ে হাড়ে চেনা যায়। সে কথা কি তবে সত্যি?
অবিশ্যি এক হতে পারে যে, অন্য কোনো দুষ্টু লোকে আমার চিঠিখানা সরিয়েছে, তুমি সেটা পাওইনি। কিন্তু তুমি তাদের বলে না দিলে গুপ্তস্থান খুঁজে বের করা কারো পক্ষে তো সম্ভব নয়!
তোমাদের বাড়ির লোকদের চিনতে আমার বাকি নেই। ওরা যদি তোমার ওপর কোনো রকম জোর-জবরদস্তি করে তো আমাকে একটু জানালেই হয়। ওদের আমি একবার দেখে নিই! যাই হোক, আমাদের বাড়ির লোকদের চেয়ে খারাপ তো আর ওরা হতে পারে না।
এ চিঠির উত্তর তোমার দেওয়া চাই-ই। কারণ সেই তাদের ও-রকম বন্দি অবস্থায় আর বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমার অবস্থা তো সবই জান, ওদের খাবার জোগানো আমার বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠছে না। অথচ কাজ হাসিল হবার আগে মরে গেলেও তো আগাগোড়া লোকসান। ভালো চাও তো চিঠি পেয়েই গুপ্তস্থানে উত্তর রেখে দেবে। ইতি–
ছোরা।