–কেউ আসবে না কীরে? ওরা ক-জনাই শুধু আসবে না, আর তো সবাই থাকবে। কাকর, কাকরের ভাই উদো, তুই, তোর মা বাবা, কাকা, পিসি, তাদের বাবা আর ভুলো। ভুলোকে ভুলিস নে যেন নেড়িকুত্তো হলে কী হবে, কী গায়ের জোর ভুলোর। ও হয়তো একটু বেশিই খাবে। কিন্তু
মনুয়া বুড়ো দাদুর পায়ে হাত বুলিয়ে বলে, কিন্তু কী বুড়ো দাদু।
–আমি তোকে কী দেব? দে তো দেখি আমার হাতবাক্সটা। বল কী চাস্? গয়না চাস?
–গয়না তুমি কোথায় পাবে বুড়ো দাদু?
–কেন? আমার ঠাকুমার কত গয়না ছিল! ডাকাতদের সর্দার ছিল আমার ঠাকুমার বাবা। তার ভয়ে এ-অঞ্চলে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। সন্ধ্যের পর ভয়ে কেউ পথে বেরুত না। বেরুলে তাদের মেরে কেটে, গয়নাগাটি যা ছিল কেড়েকুড়ে,–ও কী মনুয়া মুখ ঢাকছিস কেন? আচ্ছা, আচ্ছা, গয়নাগাটি না-ই নিলি। তা ছাড়া সেসব নেইও। মোহর নিবি? থোলো থোলো সোনার মোহর একটাও ডাকাতি করে পাওয়া নয়। রাজা ছিল রে আমার ঠাকুরদা। ওদের বাড়িতে সবাই দুধে চান করত, সোনার খাটে বসে রুপোর খাটে পা রাখত, তকমা-পরা দাস-দাসীরা সোনা-বাঁধানো চামর দোলাত।
মনুয়া বললে, কোথায় পেত থোলো থোলো সোনার মোহর ওরা?
বুড়ো দাদু হেসে বললেন, ওমা তাও জানিস নে বুঝি? প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হত যে, না দিয়ে সব যাবে কোথা! ধান কেটে, ঘর জ্বালিয়ে
–ও কী মনুয়া, কঁদছিস নাকি? আচ্ছা মোহর না-ই নিলি, সেসব হয়তো খরচও হয়ে গেছে। অ্যাদ্দিনে। তুই বরং এই মোটা কাচের কাগজ চাপাটা নে। বুড়ো দাদু মোটা কাচের কাগজ চাপা উঁচু করে তুলে ধরেন। বুড়ো দাদুর পায়ের কাছে মাদুরে শুয়ে মনুয়া সেই কাচের মধ্যে দিয়ে ঘন নীল আকাশ দেখতে পায়। কাচের ওপর রোদ পড়ে; ধার দিয়ে রামধনুর রং ছিটোয়। রামধনুর রং এসে বুড়ো দাদুর গায়ে, মনুয়ার গায়ে বেগনি, নীল, কমলা, লাল রঙের আঁকিবুকি কাটে। পেয়ারা গাছের ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়ে। পেয়ারা গাছের আঁকাবাঁকা ডালপালার ছায়া ওদের গায়ে এসে পড়ে।
মা এসে বাটি করে ওদের জন্যে গরম দুধ, পাঁউরুটি আর নরম নরম লাল চিনি দিয়ে যান। বলেন, ও মনুয়া, কাল তোর জন্মদিনে কাঁকরদের নেমন্তন্ন করে আসিস।
মনুয়া বলে, কাল বুড়ো দাদুরও জন্মদিন। বুড়ো দাদুও কাঁকরদের নেমন্তন্ন করবে।
বদ্যিনাথের বড়ি
কোন সকালে কলু কদ্দিন দেখেছে রাস্তার মধ্যিখানে লোহার গোল ঢাকনি খুলে খ্যাংরাকাঠির মতন গোঁফওয়ালা লোক, ছোটো বালতি-হাতে দড়িবাঁধা কালো ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওত পেতে বসে থাকে। লোকটার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে কাদার ছিটে- অমুদা যখন দাড়ি কামাত না তখন তাকে যেমন দেখাত সেইরকম দেখায়। ছোটো ছেলেটা হয়তো ওর ভাইপো হবেও-বা। ওর নাম হয়তো ছক্কু, ওর গায়ে মোটে কাপড় নেই, কিন্তু কানে সোনালি রঙের মাকড়ি, গলায় মাদুলি বাঁধা। বুবু বলে নাকি সত্যি সোনার নয়; ওরা গরিব কিনা, খেতেই পায় না, ও পেতলের হবে। কলু আর বুবু ছাড়া ওদের কেউ দেখেই না। সামনে দিয়ে দেবরঞ্জন মামা, অমুদা, ননিগোপালরা সবাই চলে যায়, তাড়াতাড়ি কোথায় কোন বন্ধুর বাড়ি ওদের চোখেই পড়ে না। কিন্তু কলু দেখেছে লোকটা মাঝে মাঝে বালতি টেনেটুনে উপরে তোলে, সেটা থাকে কাদায় ভরা; সেই নোংরা কাদা রাস্তার পরিষ্কার ডাস্টবিনে ঢেলে আবার বালতি নামিয়ে দেয়। কাদা ছাড়া কখনো কিচ্ছু ওঠে না। কত কী তো হারিয়ে যায়, কিন্তু ওর ভিতর থেকে কিছু কক্ষনো বেরোয় না। দাদা বলেছিল বিদ্যাধরী নদীর সঙ্গে ওর সোজাসুজি যোগ আছে, ওর ভিতর কুঁদো কুমির ছেলেপুলে নিয়ে হুমো দিয়ে থাকে, কই বালতিতে তার ডিমটিম তো কক্ষনো পাওয়া যায় না!
দাদার ফাউন্টেন পেন হারিয়ে গেল; চিনুদার কবিতার খাতা হারিয়ে গেল; বদ্যিনাথের নতুন চটি হারিয়ে গেল গোরামামার বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে; সেইদিনই আবার পাল সাহেবের ছাতাও কোথায় হারিয়ে গেল; ছোড়দির চুড়ি ড্রেনের ভিতর তলিয়ে গেল; এতসব গেল কোথায়? তার কিছু মোটে কোথাও পাওয়াই গেল না। অথচ সেই লোক দুটো কত কাদা ওঠাল!
রাত্রে মাস্টারমশাই পড়াতে আসেন, বুবু পড়ে না, কলু পড়ে। রোজ রাত্রে, রবিবার ছাড়া। কলু কত সময়ে সেই দু-জনের কথা ভাবে, সন্ধি-সমাস গোল হয়ে যায়, মাস্টারমশাই রেগে কাই! বলেন, ওরে আহাম্মুক! আমার ছেলে বিধুশেখর তোর অর্ধেক বয়েসে তোর তিন গুণ পড়া শিখত!
ছেলে বটে ওই বিধুশেখর! তার কথা শুনে শুনে কলু তো হেদিয়ে গেল। সে কক্ষনো হাই তুলত না, কক্ষনো চেয়ারে মচমচ শব্দ করত না, কক্ষনো চটি নাচাত না। প্রথম প্রথম ভাবত, তা হলে সে বোধ হয় এতদিনে নিশ্চয় মরে গিয়েছে। কিন্তু মাস্টারমশাই বলেছেন সে নাকি বিয়ে করে কোথায় পোস্টমাস্টারি করে।
একদিন বদ্যিনাথ কতকগুলো সাদা বড়ি এনেছিল। বলেছিল ওগুলো নাকি ছানা বাঁদরের রস দিয়ে তৈরি, কোন কবিরাজের কাছ থেকে এনেছে। নাকি অনেকদিন আগে মানুষদের পূর্বপুরুষরা বাঁদর ছিল, সেই বাঁদুরে রক্ত মানুষের গায়ে আছেই আছে, ওই আশ্চর্য বড়ি খেলে তাদের আবার বাঁদর হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে–ওই একরকম ধাত কিনা! কলু তার দুটো বড়ি চেয়ে রাখল, কাজে লাগতে পারে।