আমরা প্রথম তো অবাক! শ্রাদ্ধের কথাটা গবুর সম্পূর্ণ বানানো। কোথায় নটবর ইয়ার্কি দেবার জন্য মার খাবে, না সত্যি হেডমাস্টারের বাপের শ্রাদ্ধ! এ-রকম কিন্তু আরও হয়। আমি একবার একটা অচেনা ছেলেকে মজা দেখবার জন্য বলেছিলাম, কী হে, চাটগাঁ থেকে কবে এলে? সে বলল– কাল এলাম, তুমি কী করে জানলে? আমি অবিশ্যি আর কিছু ভেঙে বলিনি।
যাই হোক, আমরা তো গেলাম। দেখলাম হেডমাস্টার গোমড়া মুখ করে ফার্স্ট ক্লাসের ছেলেদের ইংরেজি খাতায় লাল পেনসিলের দাগ কাটছেন। আমাদের দেখে খেঁকিয়ে বললেন– কী, ব্যাপার কী তোমাদের? ক্লাস নেই নাকি, এখানে যে বড়ো দঙ্গল বেঁধে এসেছ?
নগা গলা পরিষ্কার করে বলল– আজ্ঞে, আপনার বাবার শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করতে এসেছি। এই আমরা–এইটুকু বলতেই হেডমাস্টারের এক ভীষণ পরিবর্তন হল। মুখটা লাল হয়ে বেগুনি হল, হাতের পেনসিলের মোটা সিস মট করে ভেঙে গেল, গোঁফ-চুল সবখাড়া হয়ে গেল, জোরে জোরে নিশ্বাস পড়তে লাগল। তার চোটে শার্টের গলার বোতাম ফট করে ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে গেল। কীরকম একটা শব্দ করে আস্তে আস্তে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমরা এতক্ষণ হাঁ করে দেখছিলাম, এবার হঠাৎ একটা বিকট সন্দেহ হল। নটবর আগাগোড়া মিছে কথা বলেছে। হেডমাস্টার ডাকেননি। সে হয়তো দেখাই করেনি! হেডমাস্টার গর্জন করে উঠলেন, জানলার খড়খড়ি কেঁপে উঠল। আমরা ছিটকে বাইরে এসে পড়লাম, তিনি ফেলে দিলেন কী আমরাই পালিয়ে গেলাম, আজও ঠিক জানি না। কাঁপতে কাঁপতে ক্লাসে ঢুকেই শুনলাম, পণ্ডিতমশাইনটবরকে বলছেন, সে কী নটবর, হেডমাস্টারের ভাইপো তুমি, সেকথা অ্যাদ্দিন বলনি!
নটবর বললে- বাবা বলেন ও সম্পর্কটা কিছু ঢাক পেটাবার মতো নয়। তা ছাড়া ইস্কুলটা বাজে। এইমাত্র কাকাকে সেই কথা বলে এলাম। তিনি তো রেগে কাই।
এমন সময় দরোয়ান এসে বলল, গবুবাবু আর ভোঁদাবাবুকে বেত খেতে হেডমাস্টারবাবু ডাকছেন।
তাই শুনে পণ্ডিতমশাইও বললেন–আর, বেত খেয়ে এসে আধ ঘণ্টা বেঞ্চে দাঁড়াবে, লেট করে ক্লাসে এসেছ।
তাই বলি পৃথিবীটাই অসার!
পেয়ারা গাছের নীচে
বুড়ো দাদু আর মনুয়া দিনভর পেয়ারা গাছতলায় বসে থাকে। শীত এসে যায়, পেয়ারা গাছের পাতা বড়ো কম, ডালের মাঝখান দিয়ে রোদ এসে ওদের গায়ে পড়ে, ডালপালার আঁকাবাঁকা ছায়া ওদের গায়ে পড়ে। সেই ছায়ার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, ওপর দিকে চেয়ে মনুয়া দেখে আকাশের নীল গায়েও ওইরকম ডালপালা সাদা রং দিয়ে আঁকা।
মনুয়া একটা জোরে নিশ্বাস ফেলে বলে, বুড়ো দাদু, কাল আমার জন্মদিন, আমার বন্ধু কাকরের তাই নেমন্তন্ন।
বুড়ো দাদু নীল আকাশ যেখানে নীল বনের পেছনে ডুবে গেছে, সেদিকে চেয়ে বলেন, কাল আমারও জন্মদিন, আমার বন্ধুদেরও নেমন্তন্ন করতে হবে।
মনুয়া বলে, কারা তোমার বন্ধুরা, বুড়ো দাদু? তাদের চিঠি দিতে হবে-না? মা কাল কিশমিশ দিয়ে পায়েস রাঁধবে।
বুড়ো দাদু আরাম কেদারার তলা থেকে ছোট্ট টিনের হাতবাক্স বের করে, কাগজপত্র ঘেঁটে বলেন, কী জানি, তাদের নাম তো মনে পড়ছে না। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমি যে কোপাই নদীতে চান করতে যেতুম, তাদের না বললে যে তারা মনে দুঃখ পাবে।
মনুয়া উঠে এসে বলে, দাও তো দেখি তোমার হাতবাক্স, আমি খুঁজে দেখি তাদের নাম ঠিকানা পাই কি না।
কিন্তু বুড়ো দাদু কিছুতেই বাক্স দেবেন না। বলেন, না রে মনুয়া, তোর বাবাকে, নাকি তার বাবাকে কাকে যেন একবার দিয়েছিলুম সে ঘেঁটেঘুঁটে তছনছ করে দেছল। পরে রসিদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তুই বরং অন্য কোথাও খুঁজে দেখি।
তাহলে মাকে ক-জনার জন্যে পায়েস রাঁধতে বলব, বুড়ো দাদু?
–বল গে এই পাঁচজনার জন্যে। না রে, দাঁড়া দাঁড়া, যে আমার নতুন চটি কোপাইয়ের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল তাকে বলে কাজ নেই। তার নষ্টামির আর শেষ নেই। কী জানি তোদের এসব ফুলগাছটাছ যদি ছিঁড়ে মাড়িয়ে একাকার করে। ওকে বাদ দিলেই ভালো।
বেশ তাহলে বলি চার জন?
–না রে দাঁড়া, দাঁড়া। ওই যার কটা চোখ, সে ভারি ঝগড়ুটি রে মনুয়া। শেষটা যদি তোর বন্ধু কাকরের সঙ্গে মারপিট করে? ওকেও না বলাই ভালো।
–তবে কি তিন জনকে বলা হবে বুড়ো দাদু?
বুড়ো দাদু অবাক হয়ে বলেন, তিন জন আবার কোথায় পেলি মনুয়া? গয়লাবাড়ির ওপারে যে থাকে, গয়লাদের কাছ থেকে চুরি করে সর মাখন খেয়ে খেয়ে, তার যে শরীরের আর কিছু নেই। অত পায়েস তার সইবে কেন? ওর নামটাও কেটে দে।
মনুয়া বললে, তাহলে আমার বন্ধু কঁকর আর কাকরের ছোটো ভাই উদো আসবে। আর তোমার বন্ধু দু-জন তো? যাই মাকে বলে আসি গে।
বুড়ো দাদু তাই শুনে মহা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কী জ্বালা! অত তাড়াটা তোর কীসের শুনি? ওই দুজনের এক জনের মুখে সারাক্ষণ মন্দ কথা লেগেই আছে, সেসব শুনে যদি তোরা শিখে ফেলিস? থাক, ওকে না বলাই ভালো।
মনুয়া বুড়ো দাদুর কাছে ঘেঁষে এসে বলে, তবে কি মোটে এক জনকে বলব?
বুড়ো দাদু, এদিকে-ওদিকে বাগানের চারদিকে, দূরে পাকড়াশিদের বাঁশঝাড়ের দিকে আমতলির পথের দিকে চেয়ে বলেন, আবার একজন কোথায় পেলি রেমনুয়া? আমাকে সুষ্ঠু নিয়ে বলেছিলুম পাঁচ জন।
মনুয়া বুড়ো দাদুর পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে, তবে কি তোমার বন্ধুরা কেউ আসবে না? বুড়ো দাদু শুনে অবাক হন।