ঘরের মধ্যে একদম চুপ। পানুদা খাটে বসে পা দোলাতে লাগল আর বোধ হয় হেডমাস্টারমশাইয়ের কথা ভাবতে লাগল। এমন সময়ে সেই গণশাটা এসে হাজির। এসেই পানুদার পিঠ থাবড়ে একগাল হেসে বললে– কী রে পেনো, ফিস্টিটা ভেস্তে গেছে বলে বুঝি মুখোনা হাঁড়ি আর কচি ছেলের উপর উৎপাত? রোজ বলি:ওরে পেনো, একা একা অত খাসনি!
পানুদা গুম হয়ে রইল।
গণশা বলল– তাই বলে কি টাকাগুলো সত্যি দিবি না কি?
পানুদা বলল, দেব না তো কি তুমি আমার হয়ে দিয়ে দেবে?
গণশা হেসে বললে, আরে রামঃ! এমন এক উপায় বাতলাতে এলুম, তোকেও দিতে হবে না, আমাকেও দিতে হবে না। আজ রাত্রে দরজা খুলে শুবি, দেখবি একটা ডাকাত এসে সব টাকা নিয়ে যাবে। পরে হয়তো ফিরে পাবি, কিন্তু ডাকাতটাকে খাওয়াতে হবে বলে রাখলুম।
পানুদা হাঁ করে খানিক তাকিয়ে বলল–সে দেখা যাবে এখন। এ সময়ে তুমি এঘরে যে বড়ো এসেছ, জানো না রুল থ্রি?
গণশা বললে– সাধে শাস্ত্রে বলে কদাচ কাহারও উপকার করিয়ো না।
মুখে পানুদা যতই তেজ দেখাক না কেন, শোবার সময়ে দেখলুম দরজাটা ঠিক খুলে শুল। অন্য দিন তো পারলে জানলাও বন্ধ করে, আমাকে দিয়ে খাটের নীচে খোঁজায়, রাত্রে উঠবার দরকার হলে জগাকে আগে একবার পাঠায়, আর সেদিন দেখি বেজায় সাহস! বালিশে মুখ গুঁজে একটু হেসে নিলাম।
উৎসাহের চোটে আমার অনেকক্ষণ ঘুম হয়নি, অনেক রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে দেখি কে যেন টর্চের আলো ফেলেছে। পানুদা ভোঁসভাঁস করে ঘুমোচ্ছে আর বাকিরা কেউ যদি জেগেও থাকে। ভয়ের চোটে চোখ বুজে পড়ে আছে। আমি দেখলুম কে একটা লোক পা টিপে টিপে এসে পানুদার বালিশের তলা থেকে চাবি বের করল, পানুদার বাক্স খুলল, কী যেন নিল, আবার বাক্স বন্ধ করে চাবি বালিশের নীচে রেখে আস্তে আস্তে চলে গেল। পরদিন সকালে ইস্কুলময় হইচই, পানুদার টাকা চুরি গেছে। হেডমাস্টারমশাই সবাইকে ডেকে যাচ্ছে-তাই করে বলেন, সকলের বাক্স খোঁজা হল। কোথাও কিছু নেই। গণশার বাক্সে তো এত কম জিনিস, এবং তাও এত নোংরা যে তাই নিয়ে গণশা। বেজায় বকুনি খেল।
সেদিন রাত্রে পানুদার হাসি হাসি মুখ।
আজ কাউকে কিছু তো বললই না, এমনকী যে-পানুদা শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেলে আমাদের শার্ট থেকে বোতাম ফেটে নিজের শার্টে লাগিয়ে নিত সে নিজের থেকেই জগাকে দুটো আস্ত খড়ি দিয়ে ফেলল!
এমন সময়ে গণশা আবার ঘরে ঢুকল।
কী রে পেনো! শেষটা সত্যি ডাকাত পোলো তোদের ঘরে?
পানুদা খুব হেসে বলল– দিস ভাই, তোরও নেমন্তন্ন রইল। গণশা যেন আকাশ থেকে পড়ল– কী দেব রে পেনো! বলছিস কী?
কেন, টাকা!
কীসের টাকা? টাকা আবার কোথায় পাব রে? দানছত্তর খুলেছি না কি? আর তা যদি খুলিও, তোকে টাকা দেব কেন রে এত যোগ্য লোক থাকতে?
পানুদা ভয়ংকর চটে বললে– দেখ গণশা, ইয়ার্কি ভালো লাগে না। দে বলছি!
গণশা বললে– ইয়ার্কি কি আমারই ভালো লাগে নাকি রে?
তারপর গুনগুন করে গাইতে লাগল–
নিশুত রাতে চোরের সাথে টাকা চুরির খেলা,
ওই চোর বেটা নিলে সেটা পেনো বুঝল ঠেলা!
সেই অবধি গণশাকে আমি ভক্তি করি।
দিন-দুপুরে
দুপুর বেলা বাড়িসুদ্ধ সব্বাই ঘুমোচ্ছে। বাবা ঘুমোচ্ছেন, মা ঘুমোচ্ছেন, মেজোমামা পর্যন্ত এ খবরের কাগজে মুখ ঢাকা দিয়ে বেজায় ঘুমোচ্ছন। কিন্তু টুনুর আর ঘুমই আসে না। তাকিয়ে দেখল হাবুটা অবধি চোখ বুজে মটকা মেরে পড়ে আছে। তাকে ডাকা চলে না মেজোমামা যদি জেগে যান! টুনু শুয়ে শুয়ে ভাবছে বাবার নতুন ঘোড়া খুব সুন্দর হলেও দাদামশাইয়ের বুড়ো ঘোড়া লালুর কাছে লাগে না। লালু কত কালের পুরোনো, সেই কবে মেজোমামা যখন ইস্কুলে যেতেন তখনকার! কীরকম প্রভুভক্ত! ওর গায়ে কী জোর! ভাবতে ভাবতে টুনুর মনে হল– বাদলা দিন বলে বাবা আবার আজ ঘোড়ায় চড়তে বারণ করেছেন। বড়োদের যদি কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি থাকে। আচ্ছা, আজকের দিনই যদি ঘোড়ানা চড়বে, তা চড়বে কবে!
জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই টুনুর মুখটা হাঁ হয়ে গেল, চোখ দুটো গোলমাল হয়ে গেল। দেখল দাদামশাইয়ের বুড়ো ঘোড়া লালু কেমন যেন মুচকি হাসতে হাসতে উঠোন পার হয়ে বাবার নতুন ঘোড়া রতনের আস্তাবলে ঢুকল। টুনু উঠে এসে জানলার আড়ালে দাঁড়াল। একটু বাদেই রতন লালু দুজনেই আস্তাবলের কোণ ঘুরে কোথায় যেন চলে গেল।
টুনু ডাকল– ও কেশরী, ও সই-ই-স! লালু-রতন যে পালিয়ে গেল! কিন্তু গলা দিয়ে আর স্বরই বেরুল না। বাইরে এসে ইদিক-ঊদিক তাকিয়ে যখন কেশরী সিং কিম্বা সইসের পাত্তা পেল না, টুনু নিজেই চলল আস্তাবলের কোণ ঘুরে রতন-লালুর পিছন পিছন।
কী আশ্চর্য! আস্তাবলের পিছনে সেইসব ধোপাদের কুঁড়ে ঘর, তার সামনে নোংরা মাঠে ধোপাদের গাধা বাঁধা থাকত, আর ময়লা দড়িতে সাহেবদের কোট পেন্টেলুন রোদে শুকুত, সেইসব গেল কোথায়? টুনু দেখল দু-পাশে গা ঘেঁষে ঘেঁষে সারি সারি দোকান। কোনোটা আলু কাবলির, কোনোটা লাল-নীল পেনসিলের, কোনোটা কাঁচের মার্বেলের। চারিদিকে দোকানে দোকানে বড়ো বড়ো নোটিস ঝোলানো।
এগজিবিসন!
এই দিকেà
আর একটা দাড়িমুখো মোটকা বুড়ো একটা ফুটো বালতি পিটোচ্ছে আর ষাঁড়ের মতন গলায় চাঁচাচ্ছে পয়সা না ফেলেই ঢুকে যান! পয়সা-টয়সা কিছু চাই না, গেলেই বাঁচি!