খিদিরপুরের ডকেই যদি কাজ নেয় কে খুঁজে পাবে! সেই যে একবার নন্দ দেখেছিল, একটা পুলের তলায় ইট দিয়ে উনুন বানিয়ে মাটির হাঁড়িতে কী বেঁধে খাচ্ছিল কারা সব, ডকের কুলি হবেও-বা। সেইরকম করে থাকবে। কিংবা যারা গান করে করে গায়ে গায়ে ঘুরে বেড়ায় তাদের সঙ্গেও তো জুটে যাওয়া যায়। গোরুর গাড়ি নিয়ে মেলাতে মেলাতে বেড়ানো যাবে। কিন্তু তার আবার একটা অসুবিধে আছে। দিদিকে গান শেখাতে এসে গোপেশ্বরবাবু বলে গেছেন, কোকিলের ডিম ভেঙে খেলেও এ ছেলের কিছু হবে না।
গান করতে না পারুক, গোরুর গাড়ি তো চালাতে পারবে! হঠাৎ একটা ভীষণ সংকল্প করে নন্দ সটান উঠে একেবারে ঘোরানো সিঁড়ির দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।
মা বলেছেন, খবরদার ও দরজা খুলবি নি। বিপদে পড়বি। কী বিপদ অনেক ভেবে নন্দ মাসিমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। মাসিমা বলেছিলেন, ওরে বাবা! সে ভীষণ বিপদ!
কী ভীষণ? জিজ্ঞেস করাতে আবার বললেন, সিঁড়ির মোড়ে মোড়ে বেজায় হিংস্র লোকেরা নাকি বাঁকা ছুরি হাতে চকচকে চোখ করে ওত পেতে আছে সারা রাত, ভোর বেলা গঙ্গায় জাহাজের বাঁশিগুলো যেই বেজে ওঠে ওরাও কোথায় আবছায়াতে চলে যায়। নন্দ জানতে চাইল তারা কোত্থেকে এসেছে। মাসিমা বললেন, কেউ এসেছে জাভা থেকে, কেউ সানফ্রানসিস্কো, কেউ কাম্বোডিয়া থেকে। আউটরাম ঘাটের কাছে তাদের জাহাজ নোঙর দেওয়া আছে, জাহাজের পাশের রেলিং না-দেওয়া সরু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে রাত দুপুরে নেমে এসেছে, ভোর না হতেই আবার ফিরে গিয়ে জাহাজের নীচে অন্ধকার ঘরে প্রকাণ্ড উনুনে কয়লা পুরবে।
একবার অনেক রাতে নন্দ কোথা থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে ঘরে ফিরছিল। তখন নিজের চোখে দেখেছিল ছোটো ছোটো টিমটিমে আলো নিয়ে কারা যেন ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করছে। তাই দরজার সামনে এসে নন্দ একবার থামল। বেশ রাত হয়েছে, বাইরে খুব হাওয়া দিচ্ছে, কেমন অদ্ভুত একটা আওয়াজ হচ্ছে। হাওয়া তো রোজই দেয় আজকাল, কিন্তু এ-রকম তো কখনো মনে হয় না।
নন্দ দরজা খুলল, চামচিকের খোকার কান্নার মতন একটা শব্দ হল। একটা বড়ো সাইজের ঠ্যাঙে লোমওয়ালা মাকড়সা সড়সড় করে নন্দর পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল।
প্রথম সিঁড়িতে পা দেবার আগে নন্দ উপর দিকে তাকাল, যতদূর দেখা যায় সিঁড়ি ঘুরে পাঁচ তলার ছাদ পর্যন্ত উঠেছে, আর নীচের দিকে যতদূর দেখা যায় ঘুরে ঘুরে এক তলার শানবাঁধানো গলি পর্যন্ত নেমেছে।
সিঁড়ির রেলিংটা ক্যাঁ-কোঁ করে নড়ে উঠল, কার জুতো জানি চাপাগলায় মচমচ করে উপর থেকে নেমে আসতে লাগল। নন্দর হাত-পা হিম হয়ে গেল, অন্ধকারে দেয়ালের গায়ে চ্যাপটা হয়ে টিকটিকির মতন লেগে রইল।
তারপর দেখল বুড়ো-আঙুল-বার-করা, জিভ-কাটা ছেঁড়া হলদে বুট-পায়ে, তালি-দেওয়া সুতো-ঝোলা লম্বা পেন্টেলুন-পরা দুটো ঠ্যাঙ সিঁড়ির বঁক ঘুরে নামতে লাগল। তারপর দেখল, পিঠে তার মস্ত ঝুলি, থুতনিতে খোঁচা দাড়ি, নাকের উপর আঁচিল, তার উপর তিনটে লোম, ন্যাড়া মাথায় নোংরা টুপি বোঝ হয় সেই হিংস্র লোকদের কেউ একজন! ভয়ের চোটে নন্দর একপাটি চটি ছিটকে খুলে, ঠুংঠং করে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নীচে চলল, আর সেই হলদে বুটপরা হিংস্র লোকটা থতমত খেয়ে বোঁচকা ফেলে দে ছুট!
নন্দর কিন্তু আর কিছু মনে নেই। কেমন ভেড় বানিয়ে গিয়েছিল! লোকটা কিন্তু নিজেই টেনে কোথায় দৌড় লাগাল!
.
এদিকে পাঁচ তলার লোকেরা আজও গল্প করে নন্দ নামে একটি ছোটো ছেলে চোর ভাগিয়ে জিনিস বাঁচিয়েছিল।
শুনে শুনে নন্দ মনে ভাবে– বুড়োরা কী হাঁদা! কিন্তু বাইরে কিচ্ছু বলে না, চালাক কিনা!
টাকা চুরির খেলা
প্রথম যখন গণশার সঙ্গে আলাপ হল সে তখন সদ্য সদ্য নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস থেকে নেমেছে। চেহারাটা বেশ একটু ক্যাবলা প্যাটার্নের, হলদে বুট পরেছে–তার ফিতেয় আবার দু-জায়গায় গিট দেওয়া; খাকি হাফ প্যান্ট, আর গলাবন্ধ কালো কোট– তার একটাও বোম নেই, গোটা তিনেক বড়ো বড়ো মরচে-ধরা সেফটিপিন আঁটা। তার উপর মাথায় দিয়েছে সামনে বারান্ডওয়ালা হলদে কালো ডোরাকাটা টুপি। দেখে হেসে আর বাঁচিনে।
ছোটোকাকা সঙ্গে ছিল, গণশার দাদাকে ডেকে বলল, ওহে হরিচরণ, এটি আমার ভাইপো। তোমার ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে মিলবে ভালো। তাই শুনে গণশা রেগে কাই, অত ছোটো ভাই ছোটো ভাই করবেন না মশাই। আর ওই কুচো চিংড়িটার সঙ্গে মিলব ভালো, শুনলেও হাসি পায়।
ছোটোকাকার মুখের রংটা কীরকম পাটকিলে মতন হয়ে গেল। সেঁক গিলে বললেন বটে! সে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ! অথচ শেষ অবধি ওই গণশাকেই আমি বিষম ভক্তি করলুম।
সে এক মস্ত উপাখ্যান।
ছুটির দিন দুপুর বেলায় নিরিবিলি ছাদের ঘরের মেঝেতে বেশ আরাম করে উপুড় হয়ে শুয়ে, পা দুটোকে উঁচুবাগে তুলে একটা চেয়ারের পায়াতে লটকে, দিব্যি করে নিজের মনে দাদার টিকিটের অ্যালবামে নতুন নতুন পাঁচ পয়সার টিকিট সারি সারি মারছি, কারু কোনো অসুবিধা করছি না, কিছু না, এমন সময়ে ওরে গবা, গবা রে! বলে বাপরে সে কী চিল্লানো! আর এরা আমায় কিনা বলে যে গোলমাল করি! সেই বিকট গোলযোগ শুনে তাড়াতাড়ি টিকিট অ্যালবামটা লুকিয়ে ফেলে নীচে যেতে যাব, ভুলেই গেছি যে পা দুটো চেয়ারে লটকানো, তাড়াতাড়ি না টেনে নামাতে গিয়ে চেয়ার উলটে গেল, তার উপর দিদিটা হাঁদার মতন দুটো কাঁচের ফুলদানি রেখেছিল, সে তো গেল ভেঙে; সবচেয়ে খারাপ হল, আমার আধ-খাওয়া পেয়ারাটা ছিটকে গিয়ে ঘরের কোণে পিসিমার গঙ্গাজলের হাঁড়ির মধ্যে পড়ে গেল।