পাঁচুমামার কাছে আমি এমন বিশ্বাসঘাতকতা আশা করি নি। কিন্তু তখন দেখলাম আপত্তি-টাপত্তি করবার সময় নেই। দেখলাম খেন্তিপিসী, সেজ-দাদামশাই আর চিম্ড়ে ভদ্রলোক নিজেদের ঝগড়া ভুলে, পাঁচুমামার সংস্কৃতের নম্বর ভুলে, গোল হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। শুনতে পেলাম ফোঁস্-ফোঁস্ করে ওদের ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। বুঝলাম বিপদ সন্নিকট!
হঠাৎ ‘ও দিদিমা’ বলে চেঁচিয়ে ধা করে আমার পেছনের দরজা দিয়ে বারান্দায় উপস্থিত হলাম। বুঝলাম দেয়ালে সিঁড়ির খাঁজকাটার কাজ শেষ হয় নি। নিমেষের মধ্যে খাঁজের মধ্যে মধ্যে পায়ের বুড়ো আঙুল গ জে গুঁজে একেবারে ছাদে উপস্থিত হলাম। এবার আমি নিরাপদ, যদিও আমি এখন অবধি চা পাই নি তবু নিরাপদ। আমি ছাদে শুয়ে খুব খানিকটা হাপরের মতন হাঁপিয়ে নিলাম। আমি জানি ওদের কারু সাধ্য নেই ওপরে ওঠে।
আস্তে–আস্তে রোদ এসে ছাদটাকে ভরে দিল। আমার পায়ের আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা ঝিরঝিরে। হাওয়া বইতে লাগল। দেখলাম ছাদে রাশি-রাশি শুকনো পাতা জমেছে কত বছর ধরে কে বা জানে। শুনলাম কত-কত পায়রা বুক ফুলিয়ে বকবকম করছে। দেখলাম বাড়ির সামনের দিকে গম্বুজের মতন করা, তাতে খোপ খোপ আছে, পায়রারা তার মধ্যে থেকে যাওয়া-আসা করছে। চারদিক একটা পায়রা-পায়রা গন্ধ! খিদে যে পায় নি তা নয়। তবু যেই মনে হল নীচে সব ওৎ পেতে বসে আছে, নেমেছি কি কপাং করে ধরবে, আমনি আর আমার নামবার ইচ্ছে রইল না। দরকার হলে ছাদে শুধু দিনটা কেন, রাতটাও কাটাব স্থির করলাম।
কিছু করবার নেই, কিছু দেখবার নেই। চার দিকে পাঁচিল, ওপরে আকাশ আর ক’শো পায়রা কে জানে! শুনতে পাচ্ছিলাম ওরা নানান সুরে কখনো রেগে চেঁচিয়ে, কখনো নরম সুরে ফুসলিয়ে আমাকে ডাকছে। আমি সে ডাকের কাছ থেকে যতদূরে পারি সরে গিয়ে একেবারে খোপওয়ালা গম্বুজের পাশে এসে দাঁড়ালাম। যেন পায়রাদের রাজ্যে এসেছি। খোপের ভেতর থেকে দেখলাম কচিকচি লালমুখোরা আমাকে অবাক হয়ে
দেখছে, আর তাদের মায়েরা চ্যাঁ-চ্যাঁ লাগিয়ে দিয়েছে। সারি সারি খোপে শত-শত পায়রার বাসা। চার দিকে। পায়রার পালক, পায়ের নীচে পায়রার পালকের নরম গালচে তৈরি হয়েছে।।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি সব খোপে পায়রার বাসা, কেবল এক কোণে দুটো খোপ ছাড়া!
তখন আমার গায়ের লোমগুলি খড় খড় করে একটার পর একটা উঠে দাঁড়াল আর পা দুটো তুলতুলে মাখনের মতন হয়ে গেল, কানের মধ্যে স্পষ্ট শুনতে পেলাম শোঁ-শাঁ করে সমুদ্রের শব্দা যে আমি কোনোদিনও অঙ্কে চল্লিশের বেশি পেলাম না, সেই আমি কি তবে আজকে একশো বছর ধরে কেউ যা পায় নি সেই খুঁজে পাব?
খট্ করে হাঁটু দুটো ফের শক্ত হয়ে গেল আর আমি তরতর করে গম্বুজের খাঁজে খাঁজে পা দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। উপরে গিয়ে দেখি গম্বুজের চার দিকটা গোলপানা বটে কিন্তু মাঝখানটা ফোপরা, কেমন। একটু ভিজে ভিজে গন্ধ, আর ভিতরের দেয়াল কেটে লেখা খোঁচাখোঁচা হরফে–
“ইতি শ্রীগজার একমাত্র আশ্রয়।”
ধপাস করে লাফিয়ে পড়লাম ওর ভেতরে। দেখলাম গম্বুজের গায়ে কুলুঙ্গির মতন ছোট তাক করা আছে, বোধ হয় তারই বাইরের দিকটাতে যে খোপ আছে তাতেই জায়গার অভাবে পায়রা বাসা করে নি। তাই দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল।
মাটিতে বসে দুহাত দিয়ে কুলুঙ্গির মধ্যে থেকে মাঝারি সাইজের একটা বাক্স নামালাম। কি আর বলব! তার রঙ একটুও চটে নি, একেবারে চকচক করছে, আর ঢাকনার উপর আঁকা ড্রাগনের সবুজ চোখ জ্বলজ্বল করছে।
৭. কোলের উপর সেই বাক্স
কোলের উপর সেই বাক্স রেখে তার চাকনা খুলে ফেললাম। উপরে খানিকটা ছেঁড়ামতন হলদে হাতে তৈরি কাগজ, মাঝখানে একটা ছ্যাদা করে সুতো চালিয়ে কাগজগুলো একসঙ্গে আটকানো, যাকে বলে পুঁথি। তার একপৃষ্ঠায় সংস্কৃত মন্ত্র লেখা, অন্যপৃষ্ঠায় খোঁচা-খোঁচা হরফে গজা কি সব লিখেছে।
সেই পুঁথিও নামালাম। নামিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। বাক্সের মধ্যে আট-দশটা সাদা লাল নীল সবুজ পাথর বসানো আংটি. হার, বালা আর একজোড়া জুলুজ্বলে লাল চুনী বসানো কানের দুল। বুঝলাম স্বপ্নে পদিপিসী এইটাই আমার মাকে দিতে বলেছিলেন। তাই সেটা তখুনি পকেটে পুরলাম।
তার পর পুঁথিটা খুলে, কি আর বলব, দেখলাম যে শ্রীগজার লেখা পড়া আমার সাধ্যি নয়। বুঝলাম পুঁথিটা সেজ-দাদামশাইয়ের হাতে দেওয়া দরকার, বাক্সটা দিদিমাকে দেব, যেমন খুশি ভাগ করে দেবেন। তখন আমি ওদের ক্ষমা করলাম। আমাকে গোল হয়ে মিছিমিছি আক্রমণ করার জন্য ওদের ওপর একটুও রাগ রইল না।
বাক্সটা নিয়ে সে যে কত কষ্ট করে দেয়াল বেয়ে গম্বুজের মাথায় উঠলাম, আবার দেয়াল বেয়ে বাইরের দেয়াল দিয়ে নামলাম সে আর কি বলব। তার পর বাঁদর-তাড়ানো সিঁড়ির খাঁজ বেয়ে নামাটাও প্রায় অমানুষিক কাজ। নেমে দেখি ওরা সবাই চক্রাকারে তখনো আমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে, কিন্তু আমার হাতে ধরা একশো বছর আগে হারানো পদিপিসীর বমিবাক্স দেখে সবাই নড়বার-চড়বার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, কেবল ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি কাউকে কিছু না-বলে দিদিমার হাতে বাক্স দিলাম, আর ঢাকনির তলাটা থেকে হলদে পুথি বের করে সেজ-দাদামশায়ের হাতে দিলাম। সেজ-দাদামশাই অন্যমনস্কভাবে সেটা হাতে নিয়ে ওলটাতে লাগলেন। আর চিম্ড়ে ভদ্রলোকও অভ্যাসমতন নিঃশব্দে এগিয়ে ওর ঘাড়ের উপর দিয়ে দেখতে চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু সেজদাদামশাই খুব লম্বা আর চিম্ড়ে ভদ্রলোক খুব বেঁটে হওয়াতে বিশেষ সুবিধে হল না।