- বইয়ের নামঃ পদিপিসীর বর্মিবাক্স
- লেখকের নামঃ লীলা মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
১-২. পাঁচুমামার প্যাঁকাটির মতন হাত
০১.
পাঁচুমামার প্যাঁকাটির মতন হাত ধরে টেনে ওকে ট্রেনে তুলোম। শূন্যে খানিক হাত-পা ছুঁড়ে, ও বাবাগো মাগো বলে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে শেষে পাঁচুমামা খচমচ করে বেঞ্চিতে উঠে বসল। তার পর পকেট থেকে লাল রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে ফেলে, খুব ভালো করে নিজের হাত-পা পরীক্ষা করে দেখল কোথাও ছড়ে গেছে কি না ও আয়োডিন দেওয়া দরকার কি না। তার পর কিছু না পেয়ে দুবার নাক টেনে, পকেটে হাত পুরে, খুদে-খুদে পা দুটো সামনের বেঞ্চিতে তুলে দিয়ে আমার দিকে চেয়ে চিঁচি করে বলল, “ছোটবেলায় একবার ভুলে বাদশাহি জোলাপ খেয়ে অবধি শরীরটা আমার একদম গেছে, কিন্তু বুকে আমার সিংহের মতন সাহস তা নইলে পদিপিসীর বর্মিবাক্স খোঁজার ব্যাপারে হাত দেব কেন?” বলে ভুরু দুটো কপালে তুলে চোখ দুটো জিজ্ঞাসার চিহ্ন বাজিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তো অবাক।
কোনার বেঞ্চিতে যে চিমড়ে ভদ্রলোক ছেলেপুলে বাক্সপ্যাটরা ও মোটা গিন্নি নিয়ে বসে-বসে আমাদের কথা শুনছিলেন, তিনিও অবাক। পাঁচুমামা বলল, “একশো বছর পরে পদিপিসীর বর্মিবাক্স আমি আবিষ্কার করব। জানিস, তাতে এক-একটা পান্না আছে এক-একটা মোরগের ডিমের মতন, চুনী আছে এক-একটা পায়রার ডিমের মতন, মুক্তা আছে হাঁসের ডিমের মতন! মুঠো-মুঠো হীরে আছে, গোছাগোছা মোহর আছে। তার জন্য শত-শত লোক মারা গেছে, রক্তের সালওয়েন নদী বয়ে গেছে, পাপের উপর পাপ চেপে পর্বত তৈরি হয়েছে–সব আমি একা উদ্ধার করব।”
তখন আমার ভারি রাগ হল। বললাম, “তুমি ইঁদুর ভয় পাও, গোরু দেখলে তোমার হাটু বেঁকে যায়, তুমি কী করে উদ্ধার করবে?”
পাঁচুমামা বলল, “আমার মনের ভিতর যে সিংহ গর্জন করছে।” বলে একদম চুপ মেরে গেল। আমি পাঁচুমামাকে একটা ছাঁচি পান দিলাম, এক বোতল লেমোনেড় খাওয়ালাম, খাবারওয়ালাকে ডেকে মস্ত শালপাতার ঠোঙা করে লুচি, আলুর দম, কপির সিঙাড়া, খাজা আর রসগোল্লা কিনে ওর হাতে গুঁজে দিলাম। বললাম, “ও পাঁচুমামা, পদিপিসীর বর্মিবাক্সটা কোথায় আছে?” পাঁচুমামা আমার এত কাছে ঘেঁষে এল যে তার কনুইটা আমার কোঁকে ফুটতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচুমামার ভুরুর প্রত্যেকটা লোম খাড়া হয়ে দুটো শুয়োপোকার মতন দেখাতে লাগল। ওর মাথাটা ঝুলে আমার এত কাছে এসে গেল যে ঐ শুয়োপোকার সুড়সুড়ি আমার কপালে লাগল। পাঁচুমামা নিচু গলায় কথা বলতে লাগল, আর আমি তাই শুনতে-শুনতে টের পেলাম চিম্ড়ে ভদ্রলোক কখন জানি ওঁর নিজের বেঞ্চি ছেড়ে পাঁচুমামার ওপাশে ঘেষে হা করে কথা শুনছেন, তার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেছে আর গলার মধ্যিখানে একটা গুটুলি মতন ওঠানামা করছে। তাই দেখে আর পাঁচুমামার কথা শুনে আমার সারা গা সিরসির করতে লাগল।
০২.
পাঁচুমামা বলতে লাগল, “দেখ, মামাবাড়ি তো যাচ্ছিস। সেখানকার গোপন সব লোমহর্ষণ কাহিনীগুলো তোর জানা দরকার এ কথা কখনো ভেবে দেখেছিস? পদিপিসীর নাম ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে লেখা থাকতে পারত তা জানিস? ঠাকুরদার পদিপিসী, অদ্ভুক্ত রাঁধতে পারতেন। একবার ঘাস দিয়ে এইসা চচ্চড়ি বেঁধেছিলেন যে বড়লাট সাহেব একেবারে থ! বলেছিলেন, এই খেয়েই তোমলোককো দেশকো এইসা দশা! থাক গে সে কথা! অদ্ভুত রাঁধুনি ছিলেন পদিপিসী। বেঁটেখাটো বিধবা মানুষ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, আর মনে জিলিপির প্যাঁচা সিংহের মতন তেজও ছিল তার, হাজার হোক, এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে আমি তো তারই বংশধর। বুঝলি, ঐ পদিপিসী গোরুর গাড়ি চড়ে, মাঘীপূর্ণিমার রাতে বালাপোশ গাঁয়ে, নিমাইখুড়োর বাড়ি চলেছেন বত্রিশবিঘার ঘন শালবনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন আর মনে-মনে ভাবছেন নিমাইখুড়োর ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত, জঙ্গলে একা থাকেন, মেলা সাঙ্গোপাঙ্গ চেলা নিয়ে, কপালে চন্দন সিঁদুর দিয়ে চিত্তির করা, কথায় কথায় ভগবানের নাম। অথচ এদিকে মনে হয় দেদার টাকা, দানটানও করেন, জিজ্ঞেস করলে বলেন–সবই ভগবানের দয়া! এত লোক থাকতে ভগবান যে কেন ওকেই দয়া করতে যাবেন সেও একটা কথা।
“এই-সব ভাবছেন হঠাৎ হৈ-হৈ রৈরৈ করে একদল লাল লুঙ্গিপরা, লাল পাগড়ি বাঁধা, লাল চোখওয়ালা ডাকাতপানা লোক একেবারে গোরুর গাড়ি ঘেরাও করে ফেললে! নিমেষের মধ্যে গোরু দুটো গাড়ি থেকে খুলে নিল, আর পদিপিসীর সঙ্গে রমাকান্ত ছিল, তাকে তো টেনেহিঁচড়ে গোরুর গাড়ি থেকে বার করে তার ট্যাক থেকে সাড়ে সাতআনা পয়সা আর নস্যির কৌটো কেড়ে নিলে। পদিপিসী থান পরা, রুদ্রাক্ষের মালা গলায়, কোমরে কাপড় জড়িয়ে আর তার উপর দুই হাত দিয়ে রাস্তার মাঝখানে এমন করে দাঁড়ালেন যে ভয়ে কেউ তার কাছে এগুলো না। শেষটা তিনি হাঁক দিয়ে বললেন, “ওরে বাটপাড়েরা, গাড়োয়ান, রমাকান্ত সবাইকে তো আধমরা করে ফেললি, গোরুগুলোরও কিছু বাকি রেখেছিস কি না জানি না। এবার তোরাই আমাকে নিমাইখুড়োর বাড়ি কাঁধে করে পৌঁছে দে! তাই-না শুনে ডাকাতরা জিভ-টিভ কেটে, পদিপিসীর পায়ে একেবারে কেঁদে পড়ে বলল, “নিমাইসর্দার যদি জানতে পারে তার কুটুমকে এরা ধরেছিল– নিমাইসর্দার এদের প্রত্যেকের ছাল ছাড়িয়ে নেবে, হাউমাউ!’ তখন তারা ফের গোরু জুতে, পয়সা ফিরিয়ে, রমাকান্তর গায়ে হাত বুলিয়ে, গাড়োয়ানকে নগদ চারটে পয়সা ঘুষ দিয়ে, নিজেরাই নিমাইখুড়োর বাড়ির পথ দেখিয়ে দিয়েছিল।
“পদিপিসীও নিমাইখুড়োর কথা জানতে পেরে মহাখুশি!”
পাঁচুমামা ঢোক গিলে চোখ গোল করে আরো কত কি বলল। “পদিপিসীর ভীষণ বুদ্ধি, ধাঁ করে টের পেয়ে গেলেন খুড়োই ডাকাতদলের সর্দার। পদিপিসী খুড়োর বাড়ি দুপুর রাতে পৌঁছেই খুড়োর চোখের ওপর চোখ রেখে, দাঁতে-দাঁত ঘষে বললেন–”শালবনে আমাকে ডাকাতে ধরেছিল, তাড়াতাড়ি গোরুর গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে আমার তসরের চাদর খানিকটা ছিঁড়ে গেছে, পায়ের বুড়ো আঙুলে হোঁচট লেগেছে, আর তা ছাড়া মনেও খুব একটা ধাক্কা লেগেছে। এর কী প্রতিশোধ নেব এখনো ঠিক করি নি। এখন রান্না করব, খাব, তার পর পান মুখে দিয়ে শুয়ে শুয়ে ভেবে দেখব।”
“খুড়োর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, হাত থেকে রুপোবাঁধানো গড়গড়ার নলটা মাটিতে পড়ে গেল; খুড়োমশাই বিদ্যাসাগরী চটি পায়ে তারই উপর একটু কাত হয়ে দাঁড়িয়ে গোফ নাড়তে লাগলেন, মুখ দিয়ে কথা বেরোল না! পদিপিসী তাই দেখে প্রসন্ন হয়ে বললেন–”আমার মধ্যে যে-সব সন্দেহরা ঝাঁক বেঁধে অন্ধকার বানিয়ে রেখেছে, তারা যাতে মনের মধ্যেই থেকে যায়, বাইরে প্রকাশ পেয়ে তোমার অনিষ্ট ঘটায়, তার ব্যবস্থা অবিশ্যি তোমার হাতে’ বলে চাদরটা চৌকির উপর রেখে কুঁজো থেকে খাবার জল নিয়ে পা ধুলেন। তার পর রান্নাঘরে গিয়ে খুড়িকে ঠেলে বের করে দিয়ে মনের সুখে গাওয়া ঘি দিয়ে নিজের মতন চারটি ঘিভাত রাঁধতে বসে গেলেন। খুড়োও আস্তে-আস্তে সেইখানে উপস্থিত হয়ে বললেন-–”তোমায় পঞ্চাশ টাকা দেব যদি ডাকাতের কথা কাউকে না বল।”
“পদিপিসী একমনে রাঁধতে লাগলেন। “খুড়ো বললেন—’একশো টাকা দেব।‘ পদিপসী একটু হাসলেন। খুড়ো বললেন–”পাঁচশো টাকা দেব। পদিপিসী একটু কাশলেন। খুড়ো মরীয়া হয়ে বললেন-”হাজার টাকা দেব, পাঁচ হাজার টাকা দেব, আমার লোহার সিন্দুক খুলে দেব, যা খুশি নিয়ো। পদিপিসী খুন্তিকড়া নামিয়ে রেখে সোজা সিন্দুকের সামনে উপস্থিত হলেন। খুড়ো সিন্দুক খুলতেই হীরে-জহরতের আলোয় পদিপিসীর চোখ ঝলসে গেল। খুড়ো ভেবেছিলেন সেইসঙ্গে পদিপিসীর মাথাও ঘুরে যাবে, কী নেবে না-নেবে কিছু ঠাহর করতে পারবে না। কিন্তু পদিপিসী সে মেয়েই নয়। তিনি অবাক হয়ে গালে আঙুল দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বললেন–”ওমা, এ যে আলাদিনের ভাড়ার ঘর। ব্যাটা ঠ্যাঙাড়ে বাটপাড়, কি দাঁওটাই মেরেছিস!” বলে দু হাতে জড়ো করে একটিপি ধনরত্ন মাটিতে নামালেন। আর একটা হাঙরের নকশা-আঁকা লাল বর্মিবাক্সও টেনে নামালেন। খুড়ো হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসে বললেন– “আহা, ওটা থাক, ওটাতে যে আমার সব প্রাইভেট পেপার আছে!”
৩-৪. পদিপিসী থপ করে
“পদিপিসী থপ করে মাটিতে থেবড়ে বসে বললেন-–‘চোপরাও শালা। নয়তো সব প্রাইভেট ব্যাপার। খবরের কাগজে ছেপে দেবা’ বলে কাগজপত্র বের করে ফেলে দিয়ে, ঐ-সব ধনরত্ন বর্মিবাক্সে ভরে নিয়ে, আবার রান্নাঘরে গিয়ে জলচৌকিতে বসে কড়াটা উনুনে চাপালেন। সারারাত ঘুমলেন না, বাক্স আগলে জেগে রইলেন, ভোর না-হতেই আবার গোরুর গাড়ি চেপে শালবনের মধ্যে দিয়ে লাল আলোয়ান গায়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।”
পাঁচুমামা এবার থামল। আর আমি মাথা বাগিয়ে জিগগেস করলাম–”তারপর?” এবং সেই চিম্ড়ে ভদ্রলোকও নিশ্বাস বন্ধ করে বললেন–”তারপর? তারপর?” পাঁচুমামা বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনার কী মশাই?” ভদ্রলোক অপ্রস্তুতপানা মুখ করে বললেন– “না, না– গল্পটা বড় লোমহর্ষণ কিনা–”
পাঁচুমামা আরো কি বলতে যাচ্ছিল, আমি হঠাৎ ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে ইংরজিতে বললাম–”চুপ, চোখ ইজ জ্বলজ্বলিং।” পাঁচুমামা তাঁকে কিছু না বলে আবার বলতে লাগল–”এত কষ্ট করে পাওয়া বর্মিবাক্স নিয়ে পদিপিসী সারাদিন গোরুর গাড়ি চেপে বাড়িমুখো চলতে লাগলেন। দুপুরে সজনে গাছতলায় গাড়ি থামিয়ে খিচুড়ি আর সজনে ফুল ভাজা খাওয়া হল, তার পর আবার’গাড়ি চলল। এমনি করে রাত দশটা নাগাদ পদিপিসী বাড়ি পৌঁছুলেন। কেউ মনেই করে নি পিসী এত শিগগির ফিরবেন, সবাই অবাক। সবাই বেরিয়ে এসে পদিপিসীকে আর জিনিসপত্র পোটলা-পাটলি টেনে নামাল। তার পর গোলমাল, চ্যাঁচামেচি, ডাকাতের গল্প, অবিশ্যি ডাকাতের সঙ্গে খুড়োর যোগের কথা পদিপিসী ছাড়া কেউ সন্দেহও করে নি, পদিপিসীও চেপে গেলেন। হঠাৎ বাক্সটার কথা মনে পড়তে বগল থেকে সেটাকে টেনে বের করে দেখেন, যেটাকে বর্মিবাক্স বলে সযত্নে গাড়ি থেকে-নামিয়েছিলেন সেটা আসলে পানের ডিবে। বমিবাক্স পাওয়া যাচ্ছে না।”
পাঁচুমামা চোখ গোল করে চুল খাঁড়া করে চিঁচিঁ করে বলতে লাগল আর আমি আর সেই চিম্ড়ে ভদ্রলোক নিশ্বাস বন্ধ করে শুনতে লাগলাম। “সে বাক্স একেবারে হাওয়া হয়ে গেল। সেই রাতদুপুরে পদিপিসী এমন চ্যাঁচামেচি শুরু করলেন যে বাড়িসুদ্ধ সবাই যে যেখান থেকে পারে মশাল, মোমবাতি, লণ্ঠন, তেলের পিদিম জ্বেলে নিয়ে এসে এ ওর পা মাড়িয়ে দিয়ে মহা খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিল। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পদিপিসী নিজে হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিলেন। বললেন, ‘নেই বললেই হল! এই আমার বগলদাবী করা ছিল, আর এই তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। একটা আধহাত লম্বা শক্ত কাঠের বাক্স একেবারে কর্পূরের মতন উড়ে গেল। একি মগের মুল্লুক?
“বলে গোরু খুলিয়ে, গোরুর গাড়ির ছাউনি তুলিয়ে, বাঁশের বাঁধন আলগা করিয়ে, গাড়োয়ানের দুহাতি ধুতি ঝাড়িয়ে আর রমাকান্তকে দস্তুর মতো সার্চ করিয়ে এমন এক কাণ্ড বাঁধালেন যে তার আর বর্ণনা দেওয়া যায় না। শেষে যখন গোরু দুটোর ল্যাজের খাঁজে খুঁজতে গেছেন তখন গোরু দুটো ধৈর্য হারিয়ে পদিপিসীর হাঁটুতে এইসা গুতিয়ে দিল যে পদিপিসী তখুনি বাবাগো মাগো বলে বসে পড়লেন। কিন্তু বসে পড়লে কি হবে, বলেইছি তো সিংহের মতন তেজ ছিল তার, বসে-বসেই সারারাত বাড়িসুদ্ধ সবাইকে জাগিয়ে রাখলেন। কিন্তু সেবাক্স আর পাওয়াই গেল না। এতক্ষণ যারা খুঁজছিল তারা কেউ বাক্সে কী আছে না-জেনেই খুঁজছিল। এবার পদিপিসী কেঁদে ফেলে সব ফাঁস করে দিলেন। বললেন, “নিমাইখুড়ো আমাকে দেখে খুশি হয়ে ঐ বাক্স ভরে কত হীরে-মোতি দিয়েছিল, আর সে তোরা কোথায় হারিয়ে ফেললি।” তাই-না শুনে যারা খুঁজে-খুঁজে হয়রান হয়ে বসে পড়েছিল, তারা আবার উঠে খুঁজতে শুরু করে দিল। শুনেছি তিন দিন তিন রাত ধরে মামাবাড়িসুদ্ধ
কেউ খায়ও নি ঘুমোয়ও নি। বাগান পর্যন্ত খুড়ে ফেলেছিল। যাদের মধ্যে বিষম ভালোবাসা ছিল তারাও পরস্পরকে: সন্দেহ করতে লেগেছিল।”
আমি আর সেই চিমড়ে ভদ্রলোক বললাম, “তার পর? তার পর?” পাঁচুমামা বলল, “তার পর আর কি হবে? এক সপ্তাহ সব ওলটপালট হয়ে রইল, খাওয়া নেই শোয়া নেই, কারু মুখে কথাটি নেই। সারা বাড়ি সবাই মিলে তোলপাড় করে ফেলল। কত যে রাশি-রাশি ধুলো, মাকড়সার জাল, ভাঙা শিশি-বোতল, তামাকের কৌটো বেরুল তার ঠিক নেই। কত পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া চিঠি বেরুল; কত গোপন কথা জানাজানি হয়ে গেল; কত হারানো জিনিস খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু পদিপিসীর বর্মিবাক্স হাওয়ায় উড়ে গেল। এমন ভাবে হাওয়া হয়ে গেল যে শেষ অবধি অনেকে এ কথাও বলতে ছাড়ল না যে বাক্স-টাক্স সব পদিপিসীর কল্পনাতে ছাড়া আর কোথাও ছিল না। কেবলমাত্র রমাকান্ত বার বার বলতে লাগল–নিমাইখুড়োর বাড়ি থেকে পদিপিসী যে খালি হাতে ফেরেন নি এ কথা ঠিক গোরুর গাড়িতে আসবার সময়ে বাক্সটা চোখে না-দেখলেও পদিপিসীর আঁচল চাপা শক্ত চৌকো জিনিসের খোঁচা তার পেটে লাগছিল, এবং সেটা পানের বাটা নয় এও নিশ্চিত, কারণ পানের বাটার খোঁচা তার পিঠে লাগছিল।
“বাক্সের শোকে পদিপিসী আধখানা হয়ে গেলেন। অত হীরে-মোতি লোকে সারাজীবনে কল্পনার চোখেও দেখে না আর সে কিনা অমন করে কোলছাড়া হয়ে গেল! শোকটা একটু সামলে নিয়ে পদিপিসী আবার রমাকান্তকে নিয়ে নিমাইখুড়োর খোঁজে গেছিলেন যদি কিছু পাওয়া যায়। গিয়ে দেখেন বত্রিশবিঘার শালবনের মাঝখানে নিমাইখুড়োর আড্ডা ভেঙে গেছে, জনমানুষের সাড়া নেই, বুনো বেড়াল আর হুতুমপ্যাচার আস্তানা। “তার পর কত বছর কেটে গেল। বাক্সের কথা কেউ ভুলে গেল, কেউ আবছায়া মনে রাখল। একমাত্র পদিপিসীই মাঝে-মাঝে বাক্সের কথা তুলতেন। আরো বহু বছর বাদে পদিপিসী স্বর্গে গেলেন। যাবার আগে হঠাৎ ফিক করে হেসে বললেন, এই রে। বাক্সটা কী করেছিলাম এদিন পরে মনে পড়েছে। বলেই, চোখ বুজলেন। তাই শুনে পদিপিসীর শ্রাদ্ধের পর আর-এক চোট খোঁজাখুজি হয়েছিল কিন্তু কোনো ফল হয় নি।”
চিম্ড়ে ভদ্রলোক বললেন, “তারপর?”
পাঁচুমামা বলল, “সেই বাক্স আমি বের করব। কিন্তু আপনার তাতে কী মশাই?”
পাঁচুমামা এইখানে চিম্ড়ে ভদ্রলোকের দিকে একদৃষ্টে কটমট, করে চেয়ে থাকার ফলে চিমূড়ে ভদ্রলোক উঠে গিয়ে সুড় সুড় করে নিজের জায়গায় বসে নিবিষ্ট মনে দাঁত খুটিতে লাগলেন ইতিমধ্যে বেশ রাত হয়ে যাওয়াতে তার স্ত্রী-পুত্র পরিবার সবাই ঘুমিয়ে-টুমিয়ে পড়ে একেবারে স্তুপাকার হয়ে রয়েছে দেখা গেল।
আমি আশা করে বসেই আছি পাঁচুমামা লোমহর্ষণ আরো কিছু বলবে, কিন্তু পাঁচুমামা দেখলাম চটিটি খুলে ঘুমোবার জোগাড় করছে। তাই দেখে আমার কেমন অস্বস্তি বোধ হতে লাগল আর চিম্ড়ে ভদ্রলোক থাকতে না পেরে দাঁত খোটা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন, “একশো বছর ধরে যা এত খোঁজা সত্ত্বেও পাওয়া যায় নি, তাকে যে আবিষ্কার করবেন, কোনো পায়ের ছাপ বা আঙুলের ছাপ জাতীয় চিহ্নটিহ্ন কিছু পেয়েছেন?”
পাঁচুমামা বলল, “ঠিক পাই নি, তবে পেতে কতক্ষণ? পদিপিসীর শেষ কথায় তো মনে হয় যে চোখের সামনেই কোথাও আছে, চোখ ব্যবহার করলেই পাওয়া যাবে। লুকিয়ে রাখবার তো সময়ই পান নি। আর মনে পড়ে যখন হাসি পেয়েছিল তখন নিশ্চয় চোরেও নেয় নি। কিন্তু পাঁচশোবার বলছি মশাই আপনার তাতে কী?” চিম্ড়ে ভদ্রলোক কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা পর্যন্ত মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
সবাই শুয়ে পড়ল আর আমি একা জেগে অন্ধকার রাত্রের মধ্যে ঝোপেঝাড়ে হাজার-হাজার জোনাকি পোকার ঝিকিমিকি আর থেকেথেকে এঞ্জিনের ধোঁয়ার মধ্যে ছোট-ছোট আগুনের কুচি দেখতে লাগলাম। ক্রমে সে-সব আবছা হয়ে এল, আমার চোখের সামনে খালি দেখতে লাগলাম বড় সাইজের একটা বর্মিবাক্স, লালচে রঙের উপর কালো দিয়ে আঁকা বিকট হিংস্র এক মাছ প্যাটনের ড্রাগন, তার চোখ দিয়ে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে, নাক দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, জিভ লকলক করছে। আরো দেখতে পেলাম যেন বাক্সর চাকনিটা খোলা হয়েছে আর তার ভিতর পায়রার ডিমের মতন, মোরগের ডিমের মতন, হাঁসের ডিমের মতন, উটপাখির ডিমের মতন সব হীরেমণি আমার চোখ ঝলসে দিচ্ছে। হঠাৎ ঘচ করে ট্রেন থেমে গেল।
মামাবাড়ির স্টেশনে পৌঁছলাম গভীর রাতে স্টেশনের বেড়ার পেছনে কতকগুলো লম্বা-লম্বা শিশুগাছের পাতার মধ্যে একটা ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়া সিরসির করে বয়ে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে জনমানুষ নেই। ছোট্ট স্টেশন বাড়ির কাঠের দরজার কাছে স্টেশনমাস্টার একটা কালো শেড় লাগানো লণ্ঠন নিয়ে হাই তুলছেন। পান খেয়েছেন অজস্র, আর বহুদিন দাড়ি কামান নি। একটা গাড়ি নেই, ঘোড়া নেই, গোরুর গাড়ি দূরে থাকুক, একটা বেড়াল পর্যন্ত কোথাও নেই।
আমি পাঁচুমামার দিকে তাকালাম; পাঁচুমামাও ফ্যাকাশে মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তখন আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, “তুমি যে প্রায়ই বল আমরা এখানকার জমিদার, এরা তোমাদের প্রভুভক্ত প্ৰজা, এই কি তার নমুনা? আমি তো ভেবেছিলাম আলো জ্বলবে, বাদ্যি বাজবে, মালাচন্দন নিয়ে সব সারে সারে দাঁড়িয়ে থাকবে। তার পর আমরা চতুর্দোলায় চেপে মামাবাড়ি যাব। গিয়ে গরম-গরম–”
পাঁচুমামা এইখানে আমার খুব কাছে ঘেঁষে এসে কানে-কানে বলল, “চোপ ইডিয়ট! দেখছিস না চার দিক থেকে অন্ধকারের মতন বিপদ ঘনিয়ে আসছে? রক্তলোলুপ নিশাচররা যাদের পিছু নিয়েছে তাদের কি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা শোভা পায়?”
চমকে উঠে বক্ততা থামিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পেলাম একটা নিবুনিবু দু-সেলওয়ালা টর্চ জ্বেলে চিমড়ে ভদ্রলোক গাড়ি থেকে রাশিরাশি পোটলা-পাটলি ছেলেপুলে ও মোটা গিন্নিকে নামাচ্ছেন। তারা নামতে না-নামতেই গাড়িটাও ঘড়ঘড় করে চলে গেল, আর অন্ধকার লম্বা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে কেমন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে লাগল। তার মধ্যে শুনতে পেলাম পাঁচুমামা আমার ঘাড়ের কাছে ফোঁসফোঁস্
করে নিশ্বাস ফেলছে। এমন সময় অন্ধকার ভেদ করে কে চ্যাঁচাতে লাগল, “অ পাঁচুদাদা, অ মেজদিমণির খোকা। বলি এয়েচ না আস নি?” পাঁচুমামার যেন ধড়ে প্রাণ এল, খচমচ, করে ছুটে গিয়ে বলল, “ঘনশ্যাম এলি! আঃ বাঁচালি!”
ঘনশ্যাম কিন্তু পাঁচুমামার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল, “ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগে না পাঁচুদাদা। এ দিকে বড় গোরু তো আসনসিঁড়ি হয়ে বসে পড়েছেন, কত টানাটানি করলাম, কত কাকুতিমিনতি করলাম, কত ল্যাজ মোচুড়ালাম। শেষ অবধি গাড়ির বাঁশ খুলে নিয়ে পেটের নীচে চাড় দিয়ে পর্যন্ত ওঠাতে চেষ্টা করলাম। সে কিন্তু নড়েও না, ঐরকম বসে ঘাস চাবায়।”
পাঁচুমামা বলল, “অ্যা ঘনশ্যাম। তবে কী হবে?”
ঘনশ্যাম বলল, “হবে আবার কী? চল দেখবে চলা”
আমরা সেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কাঁকর-বেছানো প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে গেটের মধ্যে দিয়ে ওদিকে ধুলোমাখা রাস্তায় এসে পড়লাম। সেইখানে দেখি রাস্তার ধারে একটা গোরুর গাড়ি তার একটা গোরু পা গুটিয়ে: মাটিতে বসে-বসে দিব্যি ঘুমুচ্ছে, অন্য গোরুটা তার দিকে হতাশভাবে তাকিয়ে জাবর কাটছে।
সত্যি-সত্যি সে গোরু কিছুতেই উঠল না। তখন ঘনশ্যাম পাঁচুমামাকে আর আমাকে জিনিসপত্রসুদ্ধ গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে সেই গোরুটার জায়গায় নিজেই গাড়ি টানতে শুরু করে দিল। গাড়ি আমনি চলতে লাগল।
স্টেশন ছাড়িয়েই ডানহাতে পুরনো গোরস্থান। সেখানটাতে আবার মস্ত-মস্ত বুলো-ঝুলো পাতাওয়ালা উইলোগাছ জমাট অন্ধকার করে রয়েছে। সেখানে পৌঁছতেই পাঁচুমামা ফিসফিস করে আমাকে ইংরিজিতে বলল, “এখানে সব সিপাই বিদ্রোহের সময়কার কবর আছে।” অমনি ঘনশ্যাম গাড়ি থামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে বলল, “ইংরিজিতে সব ভূতের গল্প বললে ভালো হবে না পাঁচুদাদা। এইখানেই গাড়ি নামিয়ে চম্পট দেব বলে রাখলাম।”
পাঁচুমামা ব্যস্ত হয়ে বলল, “আরে ভূতের গল্প নয় রে ঘনশ্যাম। কবরের কথা বলছিলাম।” ঘনশ্যাম আরো বিরক্ত হয়ে বলল, “ভূতের কথা নয় মানে? কবর, আর ভূত কি আলাদা? ইংরিজি জানি না বলে কি তোমাদের চালাকিগুলোও ধরতে পারব না নাকি! না পাঁচুদা, আমার পোষাবে না” বলেই ঘনশ্যাম গাড়িটা দুম্ করে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
এমন সময় খটখট,-খটাখট শব্দ করে একটা ছ্যাকড়া গাড়ি এসে উপস্থিতা আমাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম সাদা ফ্যাকাশে মুখ করে চিম্ড়ে ভদ্রলোক জ্বলজ্বলে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।
পাঁচুমামা তথুনি হাত-পা ছুঁড়ে মূৰ্ছা গেল। ঘনশ্যাম বললে, “ইয়ার্কি ভালো লাগে না পাঁচুদাদা।” বলে আবার গাড়ি টানতে শুরু করল। পাঁচুমামাও রুমাল দিয়ে মুখ মুছে উঠে বসল। অনেক রাতে মামাবাড়ি পৌঁছলাম। মনে পড়ল পদিপিসীও এমনি দুপুর রাতে রমাকান্তকে নিয়ে নিমাইখুড়োর বাড়ি থেকে ফিরেছিলেন। সত্যি, বর্মিবাক্সটা গেল কোথায়? পাঁচুমামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “হাত থেকে পড়ে-উড়ে যায় নি তো?”
পাঁচুমামা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “সস চুপ, এটা শক্রর আস্তানা। বুক থেকে হৎপিণ্ড উভড়ে নিলেও পদিপিসীর বর্মিবাক্সর নাম মুখে আনবি না।”
গাড়িবারান্দার নীচে গোরুর গাড়ি নামিয়ে ঘনশ্যাম সিঁড়ির উপর বসে পড়ল। ঘরের মধ্যে থেকে প্যাঁচা, ফিঙে, নটবর, খেন্তি, পেঁচী, ইত্যাদিরা সব বেরিয়ে এল মজা দেখবার জন্যে। কিন্তু গাড়ি থেকে লটবহর নামাতে কেউ সাহায্যও করল না। পাঁচুমামাও নেমেই কোথায় জানি চলে গেল। শেষ অবধি আমি মনে-মনে ভারি রেগে জিনিসপত্র দুমদাম করে মাটিতে ফেলতে লাগলাম। সেই দুমদাম শুনে দিদিমা বেরিয়ে এসে আমাকে চুমুটুমু খেয়ে একাকার। দিদিমা আমাকে সেজ-দাদামশাইয়ের কাছে নিয়ে গেলেন।
দেখলাম সেজ-দাদামশাই ইয়া শিঙ-বাগানো গোফ, হিংস্র চোখ, দিব্যি টেরিকাটা চুল নিয়ে ইজিচেয়ারে বালাপোশ গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। বুকের ভিতর ধক করে টের পেলাম শক্র নম্বর ওয়ান! সেজ-দাদামশাইকে প্রণাম করতেই একটু মুচকি হেসে আমাকে মাথা থেকে পা অবধি দেখে নিয়ে বললেন, “হুঁ।“
.
০৪.
ভীষণ রাগ হল। রেগেমেগে দিদিমার সঙ্গে খাবার ঘরে গিয়ে আমার দাদামশাই যে বড় পিঁড়িতে বসতেন তাতে আসন হয়ে বসে লুচি, বেগুনভাজা, ছোলার ডাল, ফুলকপির-ডালনা, চিংড়িমাছের মালাইকারি, চালতার অম্বল, রসগোল্লার পায়েস, এক নিশ্বেসে সমস্ত রাশি-রাশি পরিমাণে খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষ হলে দেখলাম পাঁচুমামাও কোন সময় আমার পাশে বসে খুঁটে খুঁটে খেতে শুরু করে দিয়েছে।
দু-একবার তাকালাম। পাঁচুমামার ভাবখানা যেন আমায় চেনেই না। তখন আমার ভারি দুঃখ হল। পাঁচুমামাও অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু হাত ধোবার সময় কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস্ করে বলল,
“দুজনে বেশি ভাব দেখালে মতলব ফেঁসে যাবে। ওল্ড লেডি নম্বর ওয়ান স্পাই।” আমি একটু আপত্তি করতে গেলাম, কারণ দিদিমাকে আমার ভালো লাগছিল।
পাঁচুমামা বলল, “চোপ, আমার খুড়ি আমি চিনি না।”
পুরনো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে, হাতে মোমবাতি নিয়ে দিদিমার সঙ্গে সঙ্গে দোতলায় বিশাল এক শোবার ঘরে শুতে গেলাম। কতরকম কারুকার্য করা ভীষণ প্রকাণ্ড আর ভীষণ উঁচু এক খাটে শুলাম। সেটা এমনি উঁচু যে সত্যিকারের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তাতে উঠলাম। খাটের উপর আবার দু-তিনটে বিশাল-বিশাল পাশবালিশ। আর খাটের নীচে মস্ত-মস্ত কাঁসা-পেতলের কলসি-টলসি কি সব দেখতে পেলাম। দিদিমা একটা রঙচঙে জলচৌকির উপর মোমবাতিটা নামিয়ে রেখে আমাকে বেশ ভালো করে ঢাকা দিয়ে, মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আজ টপ করে ঘুমিয়ে পড় তো মানিক। আমি খেয়ে এসে তোমার পাশে শোব। কাল তোমাকে পদিপিসীর বর্মিবক্সর গল্প বলব। একা শুয়ে থাকতে ভয় পাবে না তো?” পদিপিসীর নাম শুনে আমার বুক ঢিপটিপ করতে লাগল। মুখে বললাম, “আলোটা রেখে যাও, তা হলে কিছু ভয় পাব না।” দিদিমা আদর করে চলে গেলেন। পাঁচুমামা কেন বলল স্পাই নম্বর ওয়ান!
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, যখন ঘুম ভাঙল দেখি ভোর হয়ে গেছে। দিদিমা কখন উঠে গেছেন। আমিও খচমচ করে খাট থেকে নেমে আস্তে-আস্তে গিয়ে ঘরের সামনের বাড়ান্দায় দাঁড়ালাম। দেখি ফুলবাগান থেকে, আর তার পেছনে আমবাগান থেকে কুয়াশা উঠছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। সেইজনেই হোক, কিংবা আমগাছতলায় যা দেখলাম সেইজন্যেই হোক, আমার সারা গা সিরসির করে উঠল। দেখলাম ছাইরঙের পেন্টেলুন আর ছাইরঙের গলাবন্ধ কোট পরে মুখে মাথায কম্ফটার জড়িয়ে চিম্ড়ে ভদ্রলোক চোখে বাইনাকুলার লাগিয়ে একদৃষ্টে বাড়ির দিকে চেয়ে রয়েছেন। তাই-না দেখে আমার টনসিল ফুলে কলাগাছ।
৫-৬. আমগাছের ছায়া
এমনি সময় সুট করে সে আমগাছের ছায়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল আর ভোরবেলাকার প্রথম সূর্যের আলো এসে বাগান ভরে দিল। ফিরে দেখি আমার পাশে লাল নীল ছককাটা লুঙি আর সবুজ কম্বলের ড্রেসিংগাউন পরে আম-কাঠির দাঁতন চেবাতে-চেবাতে সেজ-দাদামশাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
সেজ-দাদামশাই বললেন, “জানিস, এই বারান্দাটাতে আমার ছোটকাকা কত কি করিয়েছিলেন। বিলেত থেকে ছোটকাকা ভীষণ সাহেব হয়ে ফিরলেন ঘাড়-ছাঁট চুল, কোটপ্যান্ট পরা, হাতে ছড়ি, মুখে চুরুট, কথায়-কথায় খারাপ কথা। ক্রমেই বললেন, “আমি মেম আনিব, বিলেতে সব ঠিক করে রেখে এসেছি। এই দোতলার উপর শোবার ঘরের সঙ্গে লাগা এক বাথরুম বানাব, লম্বা বারান্দাটা তো আছেই, তার এক কোণ দিয়ে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বানাব। সাদা পাগড়ি মাথায় দিয়ে ঐ সিঁড়ি বেয়ে জমাদার ওঠানামা করবে। নইলে মেম আসবে না বলেছে। তাই-না শুনে আমার ঠাকুমা-পিসিমা আর জেঠিমারা হাত-পা ছুঁড়ে বললেন, “অমা! সে কি কথা গো! মেমদের যে লাল চুল, কটা চোখ, ফ্যাকশা রঙ আর মড়াখেকো ফিগার হয়। কি যে বলিস তার ঠিক নাই, মেমরা যে ইয়েটিয়ে পর্যন্ত খায় শুনেছি। ছোটকাকা বিরক্তমুখ করে বললেন, “অবিশ্যি তোমরা যদি চাও যে আমি সন্নিসী হই, তা হলে আমার আর কিছুই বলবার নেই। বল তো নাগা সন্নিসীই হই, মেমেও দরকার নেই, নতুন সুটগুলোতেও দরকার নেই।” তাই শুনে ঠাকুমারা সবাই আরো চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিলেন। কিন্তু ভয়ে ঠাকুরদার কানে কেউই কথাটা তুললে না। ছোটকাকাও সেই সুযোগে মিস্ত্রি লাগিয়ে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি তৈরি করিয়ে ফেললেন। ঐখানে রেলিং কেটে সিঁড়ি বসানো হয়েছিল। দোতলা থেকে ছাদে ওঠবার কাঠের সিঁড়ি একটা ছিলই, বাদর তাড়াবার জন্যে, তারই ঠিক নীচে দিয়ে নতুন সিঁড়ি হল। এখন খালি বাথরুম বানানো আর জমাদারের পাগড়ি কেনা বাকি রইল। ঠাকুরদার কাছে কী ধরনের মিথ্যে কথা বলে টাকা বাগানো যায় দিনরাত ছোটকাকা সেই চিন্তাই করতে লাগলেন। এদিকে পাড়ার চোররাও সুবিধে পেয়ে রোজ রাত্রে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতে শুরু করে দিল। তাদের জ্বালায় ঘুমোয় কার সাধ্যি! শেষটা একদিন ঠাকুরদার ঘুম ভেঙে গেল, গদা হাতে করে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন, চোররাও সিঁড়ি দিয়ে ধপধপ নেমে বাগানের মধ্যে দিয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড় দিল। চাঁদের আলোয় ঠাকুরদা অবাক হয়ে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পর আস্তে-আস্তে আবার শুতে গেলেন। পরদিন সকালে উঠেই মিস্ত্রি ডাকিয়ে ঐ সিঁড়ি খুলিয়ে ফেললেন। রাগের চোটে ছাদে ওঠবার কাঠের সিঁড়িটা অবধি খুলিয়ে দিলেন। কাটা রেলিং ফের জোড়া দেওয়ালেন। আর ছোটকাকাকে ডেকে বললেন, “পানুর ছোটমেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। টোপর পরে প্রস্তুত হও। শেষটা ঐ পানুর ফর্সা মোটা গোলচোখো বারো বছরের মেয়ের সঙ্গে ছোটকাকার বিয়ে হয়ে গেল। এবং বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তারা সারাজীবন পরম সুখে কাটাল। পাঁচুটা তো ওরই নাতি। এই রে, ঘনশ্যাম আবার আমার ঈশপগুল নিয়ে আসছে। বলিস যে আমি বেরিয়ে গেছি।” বলেই সেজ-দাদামশাই হাওয়া!
আমি তাকিয়ে দেখলাম ছাদ পর্যন্ত বাঁদর তাড়াবার সিঁড়ির খাজগুলো দেওয়ালের গায়ে কাটা-কাটা তখনো রয়েছে।
সব পুরনো বাড়ির মতন মামাবাড়ির ঘরগুলো বিশাল-বিশাল, সিঁড়িগুলো মস্ত-মস্ত, বারান্দাগুলোর এ মাথা থেকে ডাকলে ও মাথা থেকে শোনা যায় না। আর দুপুরে সমস্ত বাড়িখানা অদ্ভুত চুপচাপ হয়ে গেল! পাঁচুমামার টিকিটি সকাল থেকে দেখা যায় নি। নেহাত আমার সঙ্গে এক ট্রেনে এসেছিল, নইলে ও যে জন্মেছে তারই কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। বাড়িসুদ্ধ কেউ ওর নাম করল না। দুপুরে পদিপিসীর বর্মিবাক্সর সন্ধান নিচ্ছি এমন সময় কানে এল খুব একটা হাসি-গল্পের আওয়াজ।
রান্নাঘরে আনন্দ কোলাহল এমন কথা তো জন্মে শুনি নি। অবাক হয়ে এগিয়ে-বাগিয়ে চলোম। বারান্দার বাঁকে ঘুরেই দেখি চাকর-বাকররা বিষম ঘটা করে অতিথি-সৎকার করছে। কে একটা রোগা লোক ঠ্যাং ছড়িয়ে বামুনঠাকুরের উঁচু জলচৌকিতে বসে রয়েছে। চার দিকে পানবিড়ি আর কাচি সিগারেটের ছড়াছড়ি। বামুনদিদি পর্যন্ত ঘোমটার মধ্যে বিড়ি টানছে। ঘনশ্যামট্যাম সবাই উপস্থিত আছে, পান খেয়ে-খেয়ে সব চেহারা বদলে ফেলেছে।
আমার পায়ের শব্দ পেয়েই নিমেষের মধ্যে রান্নাঘর ভোঁভাঁ, কে যে কোথায় চম্পট দিল ঠাওরই করতে পারলাম না। চোখের পাতা না ফেলতেই দেখি কেউ কোথাও নেই, খালি বামুনদিদি ঘোমটার ভিতরে হাই তুলছে এবং বিড়িটার শেষ চিহ্ন পর্যন্ত গোপন করে ফেলেছে! কিন্তু একটা জিনিস আমার চোখ এড়াতে পারে নি। ঠাং ছড়ানো রোগা লোকটা হচ্ছে আমাদের পরিচিত সেই চিম্ড়ে ভদ্রলোক। ভাবতে ভাবতে গা শিউরে উঠল। এতদূর সাহস যে ভোরবেলা দুরবীন দিয়ে পরখ করে নিয়ে দুপুর না গড়াতে একেবারে ভেতরে এসে সেঁদিয়েছে। চুলগুলো আমার সজারুর কাটার মতন উঠে দাঁড়াল। বামুনদিদিকে জিজ্ঞেস করলাম, “কে লোকটা?” বামুনদিদি যেন আকাশ থেকে পড়ল।
“কোন লোকটা খোকাবাবু? তুমি-আমি ছাড়া আর তো লোক দেখছি না কোথাও!” বলেই সে সরে বসল, অমনি তার কোলের মধ্যে কতকগুলো রুপোর টাকা ঝনঝন করে বেজে উঠল। বুঝলাম ঘুষ দিয়ে চাকর সম্প্রদায়কে হাত করেছে! কি ভীষণ।
এদিকে পাঁচুমামার সঙ্গে পরামর্শ করব কি! সে যে সকাল থেকে কোথায় গা ঢাকা দিয়েছে তার আর কোনো পাত্তাই নেই! একবার কি একটা গুজব শুনেছিলাম নাকি ভুলে বেশি জোলাপ খেয়ে ফেলেছে। তবুও তখুনি তার খোঁজে বেরুলাম। চার-পাঁচটা ভুল দরজা খুলে চার-পাঁচবার তাড়া খাবার পর দেখি পূর্বদিকের ছোট ঘরে তক্তপোশের ওপর শুয়ে-শুয়ে পাংশুপানা মুখ করে পাঁচুমামা পেটে হাত বুলচ্ছে। আমাকে দেখেই বিষম বিরক্ত হয়ে নাকিসুরে বলল, “কেন আবার বিরক্ত করতে এসেছ। যাও না এখান থেকে।” আমি বললাম, “চার দিকে যেরকম ষড়যন্ত্র চলেছে এখন আর তোমার আরাম করে শুয়ে-শুয়ে পেটে হাত বুলনো শোভা পায় না! এদিকে শক্র এসে ঢুকেছে সে খবর রাখ কি?” পাঁচুমামা কোথায় আমাকে হেল্প করবে, না তাই-না, শুনে এমনি ক্যাও-ম্যাও শুরু করে দিল যে আমি সেখান থেকে যেতে বাধ্য হলাম!
সারাদিন ভেবে-ভেবেও একটা কুলকিনারা করতে পারলাম না। রাত্রে দিদিমা পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলতে-বুলতে বললেন, “বলেছিলাম তোকে পদিপিসীর বর্মিবাক্সের গল্প বলব, তবে শোন।”
দিদিমা সবুজ বালাপোশ ভালো করে জড়িয়ে গালের পান দাঁতের পেছনে তুসে গল্প বলবার জন্যে রেডি হলেন। আর আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। দিদিমা বলতে লাগলেন, “পদিপিসীর ইয়া ছাতি ছিল, ইয়া পাঞ্জা ছিল। রোজ সকালে উঠে আধ সের দুধের সঙ্গে এক পোয়া ছোলা ভিজে খেতেন। কি তেজ ছিল তারা সত্যি মিথ্যে জানি না, শুনেছি একবার একটা শামলা গোরু হাম্বা-হাম্বা ডেকে ওর দুপুরের ঘুমের ব্যাঘাত করেছিল বলে উনি একবার তার দিকে এমনি করে তাকালেন যে সে তিনদিন ধরে দুধের বদলে দই দিতে লাগল। পদিপিসী একবার শীতকালে গোরুর গাড়ি চেপে কাউকে কিছু না-বলে রমাকান্ত নামে একটিমাত্র সঙ্গী নিয়ে কোথায় জানি চলে গেলেন ফিরে এলেন দুপুর-রাত্রে। এসেই মহা হৈ-চৈ লাগালেন কি একটা নাকি বর্মিবাক্স হারিয়েছে। সবাই মিলে নাকি দেড়বছর ধরে ঐ বাক্স খুঁজেছিল। কোথায় পাওয়া যাবে! কেউ চোখে দেখেনি সে বাক্স। শেষপর্যন্ত সে পাওয়াই গেল না!” আমি নিশ্বেস বন্ধ করে বললাম, “তাতে কী ছিল?”
দিদিমা বললেন, “কে জানে! মসলা-টসলা হবে। ঐ পদিপিসীর একটিমাত্র ছেলে ছিল, তার নাম ছিল গজা। কালো রোগা ডিগডিগে, এক মাথা কোঁকড়া-কোঁকড়াতেল-চুকচুকে চুলে টেরি বাগানো। দিনরাত কেবল পান খাচ্ছে আর তামাক টানছ। পড়াশুনো কি কোনোরকম কাজকর্মের নামটি নেই। সারাদিন গোলাপি গেঞ্জি আর আদির ঝুলো পাঞ্জাবি পরে পাড়াময় টোটো কোম্পানি। সখের থিয়েটার, এখানে-ওখানে আড্ডা। অথচ কারু কিছু বলবার জো নেই, পদিপিসী তা হলে আর কাউকে আস্ত রাখবেন না।
“জনিস তো ভালো লোকের কখনো ভালো হয় না। যত সব জগতের বদমায়েস আছে সবাই সুখে জীবন কাটিয়ে যায়। গজারও তাই হল। যখন আরো বড় হল, গাঁজা গুলি খেতে শিখল, জুয়োর আড্ডায় গিয়ে জুটল। মাঝে-মাঝে একমাস-দুমাস দেখা নেই। আবার একগাল পান নিয়ে হাসতে-হাসতে ফিরে আসে। পদিপিসী যেখান থেকে যেমন করে পারেন টাকা জোগান। পাজি ছেলেকে পায় কে!
“হঠাৎ দেখা গেল গজার অবস্থা ফিরেছে। কথায়-কথায় বাড়িসুদ্ধ সবাইকে পাঁঠার মাংস খাওয়ায়, ঝুড়ি ঝুড়ি সন্দেশ আনে। একবার সমস্ত চাকরদের গরম বেনিয়ান কিনে দিল। ঘোড়ার গাড়ি কিনল, হীরের আংটি কিনল। বাড়িসুদ্ধ সবাই থরহরি কম্পমান! কে জানে কোথা থেকে এত টাকা পায়! পদিপিসী অবধি চিন্তিত হলেন। অথচ চুরি-ডাকাতি করলে তো এতদিনে পেয়াদা এসে হানা দিত। টাকা ভালো, কিন্তু পায় কোথা?”
গজার উপাখ্যান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরই পাই নি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। রাতের অদ্ভুত চুপচাপের মধ্যে শুনতে পেলাম পাহাড়ে-পাশবালিশটার আড়ালে দিদিমা আস্তেআস্তে নাক ডাকাচ্ছেন। আর কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। তার পর শুনলাম দূরে হুতুমপ্যাঁচা ডাকছে, আর মাথার উপর পুরনো কাঠের কড়িগুলো মটমই করে মোড়ামুড়ি দিচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম এ-সবের জন্যে ঘুম ভেঙে যায় নি। যার জন্যে ঘুম ভেঙেছে সে নিশ্চয় আরো লোমহর্ষক। শুয়ে-শুয়ে যখন শুয়ে থাকা অসহ্য হল, পা সিরসির করতে লাগল, আর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, জল না খেয়ে আর এক মিনিটও থাকা অসম্ভব হল, আস্তে-আস্তে খাট থেকে নামলাম। আস্তে-আস্তে দরজা খুলে বাইরে প্যাসেজে দাঁড়ালাম। ঐ একটু দূরে সারি সারি তিনটে কলসিভরা জল রয়েছে, কিন্তু মাঝখানের ঘুরঘুঁটে অন্ধকারটুকু পেরোতে ইচ্ছা করছে না। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বাঁ পায়ের গুলিটা চুলকোচ্ছি আর মন ঠিক করছি এমন সময় কার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম।
কি আর বলব! হাত-পা পেটের মধ্যে সেদিয়ে গেল। যেদিকে শব্দ সেদিকে সেজ-দাদামশাইয়ের ঘর। কল্পনা করতে লাগলাম দাঁত দিয়ে ছোরা কামড়ে ধরে হাত দিয়ে সিঁদ কাটতে-কাটতে, কানে মাকড়িপরা, লাল নেংটি, গায়ে তেল-চুকচুকে সব চোর-ডাকাতেরা সেজ-দাদামশাইয়ের ঘরে ঢুকে ওর হাতবাক্স সরাচ্ছে, রুপোর গড়গড়া নিচ্ছে, মখমলের চটি পায়ে দিচ্ছে!
এমন সময় ঠুস করে সেজ-দাদামশাইয়ের দরজা খুলে গেল আর বিড়ি ধরাতে-ধরাতে যে বেরিয়ে এল বিড়ির আগুনে স্পষ্ট তাকে দেখে চিনলাম সেই চিম্ড়ে ভদ্রলোক-বগলে জুতো নিয়ে পা টিপেটিপে এগুচ্ছে।
আমার তো আর তখন নড়বার-চড়বার ক্ষমতা ছিল না তাই চুপ করে ভীষণ মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হতে লাগলাম। লোকটা কিন্তু কি-একটা পেরেকে না কিসে হোঁচট খেয়ে ”দুর শালা!” বলে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। একটু বাদেই নীচের তলায় একটা দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনতে পেলাম।
এতক্ষণে আমার চলবার শক্তি ফিরে এল, ভাবলাম জল খেয়ে কাজ নেই। ঘরেই ফিরে যাওয়া যাক। একবার বেরুল চিম্ড়ে ভদ্রলোক, এর পরে হয়তো বেরুবে দামড়া ডাকাত। ফিরতে যাব এমন সময় একটা সাদা কাগজ উড়ে এসে আমার পায়ে জড়িয়ে গেল। নিমেষের মধ্যে সেটা তুলে নিয়ে সবেমাত্র পকেটে পুরেছি এমন সময় আবার সেজদাদামশাইয়ের দরজা খুলে গেল এবং এবার স্বয়ং সেজ-দাদামশাই বেরিয়ে এসে টর্চ হাতে নিয়ে আতিপাতি করে কি যেন খুঁজতে লাগলেন। আমি তো এদিকে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। ধরে ফেললে কী যে হবে ভাবা যায় না। এমন সময় সেই একই পেরেকে না কিসে হোঁচট খেয়ে সেজ-দাদামশাইও হাত-পা ছুঁড়ে কত কি যে বললেন তার ঠিক নেই। ভালোই হল, আমাকে দেখবার আগেই খোঁড়াতে-খোঁড়াতে ঘরে ফিরে গিয়ে বোধ হয় কিছু লাগালেন টাগালেন।
আমি যে কি ভাবব ঠাওর করতে না-পেরে খানিকটা জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। পকেটে কাগজটা করকর, করতে লাগল, কিন্তু দিদিমা আলো নিভিয়ে দিয়েছেন, পড়বার উপায় নেই। রঙ-চঙে চৌকির উপর রোজকার মতন আজও দেশলাই মোমবাতি রাখা ছিল, কিন্তু সব জানাজানি হয়ে যাবার ভয়ে আর জ্বালোম না। সকালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
অপেক্ষা করতে-করতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন দেখলাম পদিপিসী এসে পেছনের বারান্দার দরজা থেকে আমাকে ডাকছেন। ইয়া ষণ্ডা চেহারা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, থান পরা, ছোট করে চুল ছাঁটা, কপালে চন্দন লাগানো-অবিকল পাঁচুমামা যেমন বলেছিল। এক হাত দিয়ে ইশারা করে আমাকে ডাকছেন, আর অন্য হাতটা পেছনে রেখেছেন। আমি কাছে যেতেই বললেন, “বাক্স পেয়েছিস?” আমি বললাম, “কই না তো! নিমেষের মধ্যে বাক্স কোথায় ফেলেছিলে যে কবছর ধরে খুঁজে-খুঁজেও পাওয়া যায় নি, আমার আশা আছে যে আমি দুদিনেই খুঁজে দেব? কোথায় রেখেছিলে?”
পদিপিসী বললেন, “ভালো করে খুঁজে দেখা পেলে তুইই নিস। পাঁচুটা একটা ইডিয়ট, জোলাপের পর্যন্ত ডোজ ঠিক করতে পারে না, তুইই নিস। বাক্সের মধ্যে লাল চুনীর কানের দুল আছে, তোর মাকে দিস। আর দেখ, ঐ ব্যাটা চিড়েটাকে আর ঐ বুড়োটাকে একেবারে কাইণ্ড অফ বোকা বানিয়ে দিস। বিশ্বনাথের কৃপায় গজার আমার কোনো অভাব নেই, জুড়িগাড়ি কিনেছে, বাড়ি কিনেছে, গাঁজার ব্যবসা করেছে। আহা বাবা বিশ্বনাথ না দেখলে পাপিষ্ঠদের কী গতি হবে?” বলে আমাকে চুমু খেয়ে পদিপিসী ছোটকাকার তৈরি সেই কাঠের সিঁড়ি বেয়ে বাগানের দিকে চললেন, এবং পেছন ফিরতেই দেখলাম যে হাতটা পেছনে। রেখেছিলেন তাতে ইয়া মস্ত এক গদা!
গদা দেখে এমন চমকে গেলাম যে ঘুমই ভেঙে গেল। দেখলাম সকালবেলার রোদ পেছন দিকের বারান্দা দিয়ে ঘরে এসে বিছানা ভরে দিয়েছে। কাটা সিঁড়ির দাগটা চকচক করছে। হঠাৎ কেন জানি মনে হল সিঁড়িটা একটা ভারি ইমপরট্যান্ট জিনিস।
এই তো সুবর্ণ সুযোগ সেই গোপন চিঠি পড়বার। পকেট থেকে বের করে দেখলাম লাল কালিতে লেখা–শ্ৰীযুতবাবু বিপিন বিহারী চৌধুরীর কাছ হইতে ২০০ পাইলাম। স্বাঃ নিধিরাম শর্মা।
পুঃ সব অনুসন্ধানাদি গোপন থাকিবেক।
অবাক হয়ে ভাবছি সেজ-দাদামশাই কী উদ্দেশ্যে চিমড়েকে টাকা দিলেন, কী অনুসন্ধান? এ বিষম সন্দেহজনক! এমন সময় দরজা খুলে পাঁচুমামা ঝড়ের মতন ঘরে ঢুকেই দুম করে দরজা বন্ধ করে তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বোয়ালমাছের মতন হাঁপাতে লাগল। মুখটা দেখলাম আগের চাইতেও সাদা, কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে, চুল উস্কোখুস্কো।
চিঠিটা পকেটে গুঁজে লাফিয়ে খাট থেকে নেমে বললাম, “কী হয়েছে পাঁচুমামা? আবার জোলাপ খেয়েছ?”
পাঁচুমামা শুকনো ঠোঁট আরো শুকনো জিভ দিয়ে চাটতে চেষ্টা করে বলল, “খেন্তিপিসী এসেছে।”
আমি বললাম, “খেস্তিপিসীটা আবার কে?” পাঁচুমামা আমসি হেন মুখটি করে বলল, “পদিপিসী দি সেকেণ্ড!”
.
০৬.
চিঠিটা পাঁচুমামার নাকের সামনে নেড়ে বললাম, “ও-সব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে বৃথা সময় নষ্ট কোরো না মামা! স্বয়ং সেজ-দাদামশাই এতে ভীষণভাবে জড়িত আছেন, এই দেখ তার প্রমাণ!” পাঁচুমামা চোখ গোল গোল করে চিঠিটা সবে পড়তে যাবে এমন সময় প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে দরজা গেল খুলে, আর সত্যি বলছি, অবিকল আমার সেই স্বপ্নে দেখা পদিপিসীর মতন কে একজন তোলোহাড়ির মতন মুখ করে ভিতরে এলেন। বুঝলাম, ঐ খেন্তিপিসী। পাঁচুমামা দরজার ঠেলা খেয়ে ছিটকে আমার খাটের উপর পড়েছিল, সেখান থেকে সরু গলায় চেঁচিয়ে বলল, “কী করতে পার আমার তুমি? এমন কোনো স্ত্রীলোক জন্মায় নি যাকে আমি ভয় পাই! জানো আমার বুকের মধ্যে সিংহ–” এইটুকু বলতেই খেন্তিপিসী কোমরে কাপড় জড়িয়ে খাটের দিকে। একপা এগুলেন আর পাঁচুমামাও অন্যদিক দিয়ে টুপ করে নেমে খাটের তলায় অগুনতি হাড়ি-কলসির মধ্যে সেঁদিয়ে গেল।
খেন্তিপিসী তখন আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে আপাদমস্তক আমাকে কাঠফাটা দৃষ্টিট দিয়ে দেখতে লাগলেন, আমার হাত এমনি কাঁপতে লাগল যে চিঠিটা খড়মড়, খড়মড় করে উঠল। তাই শুনে খেন্তিপিসী এমনি চমকালেন যেন বন্দুকের গুলি শুনেছেন। কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সে কথা বলবার আগেই সেজ-দাদামশাই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। খেন্তিপিসীকে দেখে একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আ খেন্তি, তুই আবার এখানে কেন?”
খেন্তিপিসী চায়না ক্যাণ্ডেল পাওয়ারের চোখ দুটো আমার ওপর থেকে সরিয়ে বরফের মতন ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “কেন, তোমার কি তাতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে? পুজোর সময় একটা কাঁচকলাও দিলে না, আমার ভজাকে যে কাপড় দিলে সেও অতি খেলো সস্তা রাবিশ। বাপের বাড়ি থেকে কলাটা-মুলোটা দূরে থাকুক কচুটারও মুখ দেখি না। তাই বলে বৌদির ঘরের কোনায়ও একটু জায়গা হবে না?”
পাঁচুমামা এখানে দুটো হাড়ির মাঝখান দিয়ে মুণ্ড বের করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “জায়গা হবে কি না হবু তাতে তো তোমার ভারি বয়ে গেল! এই ভরসকালে আমার ঘরেই-বা তোমার কত জায়গা–” বলেই কচ্ছপের মুণ্ডুর মতন সুই করে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল!
সেজ-দাদামশাই এবার গলা পরিষ্কার করে পাঁচুমামাকে তাড়া দিয়ে বললেন, “এই পাঁচু হতভাগা, বেরিয়ে আয় বলছি। আমার একটা ইমপরট্যান্ট কাগজ হারিয়েছে, খুঁজে দে বলছি, নইলে ভালো হবে না।” সঙ্গে সঙ্গে থেন্তিপিসীও বললেন, “বেরো একখুনি। তুইই নিশ্চয় আমার সুটকেশ থেকে বাড়ির নকশাটা সরিয়েছিস। বেরো বলছি। তোকে আমি সার্চ করবই করবা না বেরোলে ঐ খাটের তলায় সেদিয়েই সার্চ করব। আমি জানি না তোদের সব চালাকি! পদিপিসীর বাক্সর জন্যে তোরাও ছোঁক-ছোঁক করে বেড়াচ্ছিস। অথচ বাক্সতে আর কারো অধিকার নেই। ওটা স্ত্রীধন, ওটা আমি পাব।” সেজ-দাদামশাই রেগে বললেন, “তুই পাবি মানে? তোর ভজার পেটে যাবে বল। আমি আইন পাস করেছি, তা জানিস? কেউ যদি পায় তো আমি পাব। জানিস আমি দুশো টাকা খরচ করে ডিটেকটিভ লাগিয়েছি। ও বাক্স আমি বের করবই!”
এইবার দরজার কাছ থেকে একটা নরম কাশির শব্দ শোনা গেল। দেখলাম চিমড়ে ভদ্রলোক সেখানে কালো আলস্টার পরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছেন। বিড়িটা এবার বের করে বললেন, “মনে থাকে যেন তিনভাগের একভাগ আমার। যদি বাক্স পান আমার অদ্ভুত বুদ্ধির সাহায্যেই পাবেন।”
খেন্তিপিসী হঠাৎ আবিষ্কার করলেন খাটের তলা থেকে পাঁচু-মামার ঠ্যাং দুটো অসাবধানতাবশত একটুখানি বেরিয়ে রয়েছে। আর যায় কোথা, নিমেষের মধ্যে হিড় হিড় করে টেনে পাঁচুমামাকে বের করে এনে
দুই থাপড় লাগালেন, তার পর বুকপকেট থেকে একটা মোটামতন কাগজ টেনে বের করে বললেন, “তবে না নকশা নিস নি।”
তার পর কাগজটা খুলে বললেন, “ইস, দেখেছ সেজদা, ব্যাটাছেলে সংস্কৃতে উনিশ পেয়েছে।”
সেজ-দাদামশাইও অমনি বললেন, “কই দেখি-দেখি!”
চিম্ড়ে ভদ্রলোকও এগিয়ে বললেন, “মানুষ হওয়াই একরকম অসম্ভব।”
পাঁচুমামা তখন একদৌড়ে আবার ধাটের তলায় ঢুকল এবং এবার পা গুটিয়ে সাবধানে বসে বলল, “আমার কলেজের পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়ে তোমাদের কী দরকার শুনি? বিশেষত খেন্তিপিসীর মতন একজন। আকাট মুখ্য স্ত্রীলোকেরা নকশা হারিয়েছে। দরকারি কাগজ হারিয়েছে। তাই আমার ওপর হামলা। আর ঐ ইজের-পরা ছোকরার হাতে যে কাগজটা আছে সেটা কী?”
পাঁচুমামার কাছে আমি এমন বিশ্বাসঘাতকতা আশা করি নি। কিন্তু তখন দেখলাম আপত্তি-টাপত্তি করবার সময় নেই। দেখলাম খেন্তিপিসী, সেজ-দাদামশাই আর চিম্ড়ে ভদ্রলোক নিজেদের ঝগড়া ভুলে, পাঁচুমামার সংস্কৃতের নম্বর ভুলে, গোল হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। শুনতে পেলাম ফোঁস্-ফোঁস্ করে ওদের ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। বুঝলাম বিপদ সন্নিকট!
হঠাৎ ‘ও দিদিমা’ বলে চেঁচিয়ে ধা করে আমার পেছনের দরজা দিয়ে বারান্দায় উপস্থিত হলাম। বুঝলাম দেয়ালে সিঁড়ির খাঁজকাটার কাজ শেষ হয় নি। নিমেষের মধ্যে খাঁজের মধ্যে মধ্যে পায়ের বুড়ো আঙুল গ জে গুঁজে একেবারে ছাদে উপস্থিত হলাম। এবার আমি নিরাপদ, যদিও আমি এখন অবধি চা পাই নি তবু নিরাপদ। আমি ছাদে শুয়ে খুব খানিকটা হাপরের মতন হাঁপিয়ে নিলাম। আমি জানি ওদের কারু সাধ্য নেই ওপরে ওঠে।
আস্তে–আস্তে রোদ এসে ছাদটাকে ভরে দিল। আমার পায়ের আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা ঝিরঝিরে। হাওয়া বইতে লাগল। দেখলাম ছাদে রাশি-রাশি শুকনো পাতা জমেছে কত বছর ধরে কে বা জানে। শুনলাম কত-কত পায়রা বুক ফুলিয়ে বকবকম করছে। দেখলাম বাড়ির সামনের দিকে গম্বুজের মতন করা, তাতে খোপ খোপ আছে, পায়রারা তার মধ্যে থেকে যাওয়া-আসা করছে। চারদিক একটা পায়রা-পায়রা গন্ধ! খিদে যে পায় নি তা নয়। তবু যেই মনে হল নীচে সব ওৎ পেতে বসে আছে, নেমেছি কি কপাং করে ধরবে, আমনি আর আমার নামবার ইচ্ছে রইল না। দরকার হলে ছাদে শুধু দিনটা কেন, রাতটাও কাটাব স্থির করলাম।
কিছু করবার নেই, কিছু দেখবার নেই। চার দিকে পাঁচিল, ওপরে আকাশ আর ক’শো পায়রা কে জানে! শুনতে পাচ্ছিলাম ওরা নানান সুরে কখনো রেগে চেঁচিয়ে, কখনো নরম সুরে ফুসলিয়ে আমাকে ডাকছে। আমি সে ডাকের কাছ থেকে যতদূরে পারি সরে গিয়ে একেবারে খোপওয়ালা গম্বুজের পাশে এসে দাঁড়ালাম। যেন পায়রাদের রাজ্যে এসেছি। খোপের ভেতর থেকে দেখলাম কচিকচি লালমুখোরা আমাকে অবাক হয়ে
দেখছে, আর তাদের মায়েরা চ্যাঁ-চ্যাঁ লাগিয়ে দিয়েছে। সারি সারি খোপে শত-শত পায়রার বাসা। চার দিকে। পায়রার পালক, পায়ের নীচে পায়রার পালকের নরম গালচে তৈরি হয়েছে।।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি সব খোপে পায়রার বাসা, কেবল এক কোণে দুটো খোপ ছাড়া!
তখন আমার গায়ের লোমগুলি খড় খড় করে একটার পর একটা উঠে দাঁড়াল আর পা দুটো তুলতুলে মাখনের মতন হয়ে গেল, কানের মধ্যে স্পষ্ট শুনতে পেলাম শোঁ-শাঁ করে সমুদ্রের শব্দা যে আমি কোনোদিনও অঙ্কে চল্লিশের বেশি পেলাম না, সেই আমি কি তবে আজকে একশো বছর ধরে কেউ যা পায় নি সেই খুঁজে পাব?
খট্ করে হাঁটু দুটো ফের শক্ত হয়ে গেল আর আমি তরতর করে গম্বুজের খাঁজে খাঁজে পা দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। উপরে গিয়ে দেখি গম্বুজের চার দিকটা গোলপানা বটে কিন্তু মাঝখানটা ফোপরা, কেমন। একটু ভিজে ভিজে গন্ধ, আর ভিতরের দেয়াল কেটে লেখা খোঁচাখোঁচা হরফে–
“ইতি শ্রীগজার একমাত্র আশ্রয়।”
ধপাস করে লাফিয়ে পড়লাম ওর ভেতরে। দেখলাম গম্বুজের গায়ে কুলুঙ্গির মতন ছোট তাক করা আছে, বোধ হয় তারই বাইরের দিকটাতে যে খোপ আছে তাতেই জায়গার অভাবে পায়রা বাসা করে নি। তাই দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল।
মাটিতে বসে দুহাত দিয়ে কুলুঙ্গির মধ্যে থেকে মাঝারি সাইজের একটা বাক্স নামালাম। কি আর বলব! তার রঙ একটুও চটে নি, একেবারে চকচক করছে, আর ঢাকনার উপর আঁকা ড্রাগনের সবুজ চোখ জ্বলজ্বল করছে।
৭. কোলের উপর সেই বাক্স
কোলের উপর সেই বাক্স রেখে তার চাকনা খুলে ফেললাম। উপরে খানিকটা ছেঁড়ামতন হলদে হাতে তৈরি কাগজ, মাঝখানে একটা ছ্যাদা করে সুতো চালিয়ে কাগজগুলো একসঙ্গে আটকানো, যাকে বলে পুঁথি। তার একপৃষ্ঠায় সংস্কৃত মন্ত্র লেখা, অন্যপৃষ্ঠায় খোঁচা-খোঁচা হরফে গজা কি সব লিখেছে।
সেই পুঁথিও নামালাম। নামিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। বাক্সের মধ্যে আট-দশটা সাদা লাল নীল সবুজ পাথর বসানো আংটি. হার, বালা আর একজোড়া জুলুজ্বলে লাল চুনী বসানো কানের দুল। বুঝলাম স্বপ্নে পদিপিসী এইটাই আমার মাকে দিতে বলেছিলেন। তাই সেটা তখুনি পকেটে পুরলাম।
তার পর পুঁথিটা খুলে, কি আর বলব, দেখলাম যে শ্রীগজার লেখা পড়া আমার সাধ্যি নয়। বুঝলাম পুঁথিটা সেজ-দাদামশাইয়ের হাতে দেওয়া দরকার, বাক্সটা দিদিমাকে দেব, যেমন খুশি ভাগ করে দেবেন। তখন আমি ওদের ক্ষমা করলাম। আমাকে গোল হয়ে মিছিমিছি আক্রমণ করার জন্য ওদের ওপর একটুও রাগ রইল না।
বাক্সটা নিয়ে সে যে কত কষ্ট করে দেয়াল বেয়ে গম্বুজের মাথায় উঠলাম, আবার দেয়াল বেয়ে বাইরের দেয়াল দিয়ে নামলাম সে আর কি বলব। তার পর বাঁদর-তাড়ানো সিঁড়ির খাঁজ বেয়ে নামাটাও প্রায় অমানুষিক কাজ। নেমে দেখি ওরা সবাই চক্রাকারে তখনো আমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে, কিন্তু আমার হাতে ধরা একশো বছর আগে হারানো পদিপিসীর বমিবাক্স দেখে সবাই নড়বার-চড়বার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, কেবল ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি কাউকে কিছু না-বলে দিদিমার হাতে বাক্স দিলাম, আর ঢাকনির তলাটা থেকে হলদে পুথি বের করে সেজ-দাদামশায়ের হাতে দিলাম। সেজ-দাদামশাই অন্যমনস্কভাবে সেটা হাতে নিয়ে ওলটাতে লাগলেন। আর চিম্ড়ে ভদ্রলোকও অভ্যাসমতন নিঃশব্দে এগিয়ে ওর ঘাড়ের উপর দিয়ে দেখতে চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু সেজদাদামশাই খুব লম্বা আর চিম্ড়ে ভদ্রলোক খুব বেঁটে হওয়াতে বিশেষ সুবিধে হল না।
হঠাৎ সেজ-দাদামশাই বিষম চমকে উঠে বললেন, “আরে, এ যে বাবার পদিপিসীর ছোটোবোন মণিপিসীর বিয়ের আসন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই পুথি। এ কোথায় পেলি! আরে, এ হারানোর ফলেই তো পুরুতঠাকুর ভুলভাল মন্ত্র পড়িয়েছিলেন, আর তার ফলেই বাবার মণিপিসী আর পিসেমশাই সারাটা জীবন ঝগড়া করে কাটিয়েছিলেন।”
তার পর পাতা ওলটাতেই গজার হাতের লেখা চোখে পড়াতে আরো বিষম চমকে গিয়ে বললেন, “শোনো-শোনো, পদিপিসীর ছেলে শ্রীগজা কী লিখেছে শোনো। আরে, এটা যে একটা ডায়েরির মতন শোনাচ্ছে, না আছে তারিখ, না আছে বানানের কোনো নিয়মকানুন। ব্যাটা সাক্ষাৎ মাসির বিয়ের জায়গা থেকে বিয়ের মন্ত্রের পুথি চুরি করে তাতে কী লিখেছে দেখ!
“সোমবার।। সর্বনাশ হইয়াছে। মাতাঠাকুরানীর গোরুর গাড়ি উঠানে প্রবেশ করিতেই আগে নামিয়া আমার হাতে বর্মিবক্স গুঁজিয়া দিয়া মাতাঠাকুরানী সমস্ত ভুলিয়া গিয়াছেন ও অভ্যাসমতন বাড়িসুদ্ধ সকলকে তাড়নপীড়ন করিতেছেন।
“মঙ্গলবার।। আর পারা যায় না। বাক্স আমি কিছুতেই কাহাকে দেব না, স্থির করিয়াছি; অথবা ইহারা যেরূপ খোঁজাখুঁজি শুরু করিয়াছে, বাক্স বগলে লইয়া উহাদের সঙ্গে সঙ্গে খোঁজা ছাড়া কোনো উপায় নাই। বগলে কড়া পড়িয়া গিয়াছে।
“শুক্রবার।। সৌভাগ্যবশতঃ তাড়িওয়ালার বাড়িতে বাক্স লুকাইবার সুবিধা পাইয়াছি। খোঁজাখুঁজি বন্ধ হইলে বাড়ি আনিব।
“সোমবার।। তাড়িওয়ালার সহিত পরামর্শ করিয়া গাঁজার ব্যবসা শুরু করিয়াছি। বিষম লাভ হইতেছে। এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরিও করিতে হয়।
“শনিবার।। জিনিসপত্র বহু কিনিয়াছি, বহু দানও করিয়াছি। ইহারা জিনিস লয় অথচ আমাকে সন্দেহের চক্ষে দেখে তাই মনে করিয়াছি শহরে বাড়ি কিনিব।
“রবিবার।। ঘটনাক্রমে গম্বুজের ভিতরকার এই নির্জন স্থান আবিষ্কার করিয়াছি। এখানেই আমার এই লিপি ও বাকি গুটিকতক অলংকার রাখিলাম। ইহাদের বিবাহাদি হইলে উপহার দেওয়া যাইবেক। ইতি শ্ৰীগজা।”
সেজ-দাদামশায় হতাশ গলায় বললেন, “তার পরই বোধ হয় ঠাকুরদা বাঁদরের সিঁড়ি কাটিয়ে দিয়েছিলেন, গজার আর কাউকে গয়না উপহার দেয়া হয় নি। শেষে তো সে কলকাতাতেই থাকত শুনেছি। পদিপিসীর ফিক করে হাসারও কারণ বোঝা গেল। তার মতে গজার থেকে বাক্স পাবার যোগ্য পাত্র আর কেই বা,ছিল।”
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ভেন্তিপিসী বললেন, “বাক্সে কী আছে?”
দিদিমা ঢাকনি খুলে দেখলেন। বললেন, “আমি ভাগ করে দিচ্ছি। খেন্তি, যদিও তুই আমার কাছ থেকে সেবার তিনশো টাকা ধার নিয়ে শোধ দিস নি, তবু এই হারটা তুই নো” সেজ-দাদামশাইকে বললেন, “ঠাকুরপো, তোমার কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো: তুমি এই হীরের আংটি নাও। এটা মেজঠাকুরপোর ছেলেকে দেব, এটা পাঁচুর; এটা ন্যাড়ার প্রাপ্য, এটা পুঁটকি পাবে, এটা কুঁচকি পাবে, এই বালাজোড়া আমার ভাগ, আমার মেয়েকে দেব।” বলে মাকে দেবার জন্য আমার হাতে দিলেন। তার পর সকলের সামনে আমাকে আদর করে বললেন, “বাকি রইল এই পান্নার আংটি, এটা দাদা তোমার, কারণ তুমি খুঁজে না-দিলে এদের দ্বারা হত না। এবার চল দিকিন, কত পুলি বানিয়েছি হাতমুখ ধুয়ে খাবে চল। হ্যাঁ, বাক্সটা কিন্তু আমি নিলাম, মসলা রাখব।”
দিদিমার সঙ্গে চলে যেতে-যেতে শুনলাম থেন্তিপিসী পাঁচুমামাকে বলছেন, “তাকে দিল সাত নহর আর আমার বেলা এক ছড়া!” আর চিমড়ে ভদ্রলোক সেজ-দাদামশাইকে বলছেন, “স্যার, আমার দুশো টাকা?”