- বইয়ের নামঃ নেপোর বই
- লেখকের নামঃ লীলা মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১-০৫. এটা কিন্তু সত্যিকার নেপোর বই নয়
এটা কিন্তু সত্যিকার নেপোর বই নয়। আসল বইটিকে নেপো নিয়ে চলে গিয়েছিল। পরে যখন পাওয়া গেল, দুমড়োনো, মুচড়োনা, আঁচড়ানো, কামড়ানো, খিমচোনো, কাদামাখা, গলো কালো থাবার দাগ লাগা, কোনো কাজেই লাগে না। কিছু পড়া যায় না, মাঝে মাঝে খোবলানো ছাদা। ভাগ্যিস তাতে কিছু লেখা ছিল না, নইলে হয়েছিল আর কী। শুধু মলাটটাই খোলা ছিল আর তাই দিয়েই গুপি এই বালি কাগজের খাতাটাকে বাঁধিয়ে দিয়েছে। হলদে মলাট, তার ওপর বেগনি কালি দিয়ে লেখা নেপোর বই। নইলে নেপো কিছু এমন সৎ বেড়াল নয় যে ওর নামে বইয়ের নাম রাখব। সৎ হলে আর ওর ল্যাজটা সে যাক গে। মোট কথা ভজুদা বলেছিলেন বইয়ের নাম রাখতে পানুপুরাণ।
আমার নাম পানু, আমার বয়স বারো। সাত মাস আগে বাস থেকে পড়ে গিয়ে আমার শিরদাঁড়ার হাড় জখম হয়েছিল। সেই থেকে আমি হাঁটতে পারি না। তবে একটু একটু করে গায়ে জোর পাচ্ছি আর ডাক্তারবাবু বলেন আমি নাকি চেষ্টা করলেইহাঁটতে পারব, কিন্তু আসলে তা পারিনা। আমার একটা দু-চাকাওয়ালা ছোটো গাড়ি আছে, দাদু করিয়ে দিয়েছেন, তাতে করে আমি বাড়িময় ঘুরে বেড়াই। তাতে বসেই আমি আমাদের তিন তলার ফ্ল্যাটের প্রত্যেকটি জানলা দিয়ে রাস্তা দেখি। তা যদি না দেখতাম তা হলে আর এ বই লিখবার দরকারই হত না। কিছু টেরই পেতাম না।
বেশিরভাগ সময় আমি নিজের ঘরে থাকি আর নিজের জানলা দিয়ে দেখি। আমার ঘরে দুটো। জানলা। একটার নীচে, বাইরে কার্নিসের উপর লম্বা টিনের টবে বড়ো মাস্টার আমাকে গাছ-গাছলা করতে শিখিয়েছেন। অদ্ভুত চেহারার সব কাঁটাগাছ, কী সুন্দর ফুল ফোটে। অথচ রোদ লাগলেও মরে না, গরমের সময়ও শুকোয় না। রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে গুনে এক মগ জল দিতে হয়।
অন্য জানলার নীচে ভজুদার টব, তাতে ধনে পাতা, রসুন, কাঁচালঙ্কা, টোমাটো ফলাই। বড়ো মাস্টারের পোড়া বউও নাকি ওঁদের ছাদের কোণে জলের ট্যাঙ্কের পাশে গাছ গজায়, বেল, জুই, রজনীগন্ধা; কুমড়ো গাছে কুমড়ো হয়, মাটির হাঁড়ির তলা ফুটো করে তাতে পুঁই ডাটা হয়। বউকে কেউ নাকি চোখে দেখেনি। তবে দূর থেকে জানলা দিয়ে ওর ঘোমটাপরা মাথা দেখতে পাই। আগে নাকি বউ পরমাসুন্দরী ছিল, দূর থেকে লোকে তাকে দেখতে আসত। তারপর আধখানা মুখ পুড়ে কালি হলে পর আর কারো সামনে বেরোয় না। তাই নিয়ে বড়ো মাস্টার কত দুঃখ করেন। বলেন, সংসারের সব-ই অসার।
বড়ো মাস্টার প্রত্যেক রবিবার বিকেলে আমাকে গল্প বলতে আসেন। ওই সময় আমাদের বাড়ির সবাই বেড়াতে চলে যায়, খালি রামকানাই থাকে। সে আমাদের জন্যে চা আর মাছের কচুরি, মেটুলির ঘুগনি, এইসব করে দেয়। আটটার সময় বাড়ির লোকেরা ফিরে এলে, বড়ো মাস্টার বাড়ি যান।
পাশেই বাড়ি; আসলে ছাপাখানা। আমাদের বাড়ির গলি দিয়ে মাপলে আট ফুট তফাতে। একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি ও-বাড়ির চার তলা থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে এক তলা অবধি নেমে গেছে। সেটা থেকে মাপলে আরও কাছে। গুপি বলে আমাদের ঘোরানো সিঁড়ি থেকে রং মিস্ত্রিদের একটা তক্তা ফেলে ও নাকি ওদের ঘোরানো সিঁড়িতে গিয়ে উঠতে পারে। তবে বড়ো মাস্টার থাকেন পাঁচ তলার উপরে ছাদের কোণে দুটো ঘরে, ঘোরানো সিঁড়ি অত দূর ওঠে না। বড়ো মাস্টার ছাপাখানার ভিতরের সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করেন।
ওইখানে উনি প্রুফ দেখেন, তাই ঘর পান। সন্ধ্যে বেলায় ছাপাখানার বড়ো সাহেবরা চলে গেলে, তাদের গাড়ির শেডে মাস্টারের নাইট স্কুল বসে, তার জন্যে সামান্য মাইনে পান। কষ্টেসৃষ্টে দিন চলে, বড়ো মাস্টার বলেছেন। অথচ এককালে কী বড়োলোকমিটাই-না করেছেন। শুনে কষ্ট হয়।
রবিবার ছাড়া রোজ সকালে ভজুদা এসে আমাকে তিন ঘণ্টা পড়ান, আটটা থেকে এগারোটা। ক্লাসের বই নিয়ে ঠেসে পড়ান, ইংরিজি, অঙ্ক, বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল, হিন্দি, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান। কী জানেন ভজুদা। ছবি-দেওয়া মোটা মোটা বই এনে আশ্চর্য সব ছবি দেখান। মরুভূমির বালিতে চাপাপড়া হেলিওপোলিসের রাস্তার প্রাচীন কালের রথের চাকার দাগ, আরো কত কী!
ভজুদা খুব ভালো, কিন্তু বেজায় কড়া। আমি তো বাড়িতে বসেই বার্ষিক পরীক্ষা পাস করে উপরের ক্লাসে উঠেছি। এ-বছর সাতজন নতুন নতুন ছেলে ভরতি হয়েছে আমাদের ক্লাসে। তাদের কাউকে অবিশ্যি এখনও দেখিনি, গুপির কাছে সব খবর পেয়েছি।
গুপি আমার বন্ধু। প্রত্যেক রবিবার আর ছুটির দিনে সে আমাকে দেখতে আসে। বড়ো মাস্টারের গল্প শোনে, অদ্ভুত সব গল্প। ওঁর সত্যিকার অভিজ্ঞতার কাহিনি। বর্মার গল্প; প্রশান্ত মহাসাগরে আশ্চর্য সব দ্বীপের গল্প, যার কথা কেউ জানে না; সমুদ্রে ঝড়ের গল্প, জাহাজডুবির গল্প, যুদ্ধের গল্প, ভয়ংকর সব অগ্নিকাণ্ডের গল্প; উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরুর কথা। মেক্সিকো, ব্লেজিল, কোথায় যাননি বড়ো মাস্টার, ব্যাবসার খাতিরে! তারপর বউ পুড়ল, মাস্টারের বাঁ ঠ্যাং কাটা গেল, ঘোঘারাঘুরি ঘুচল। একদিন যে মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকার কারবার করত, আজ সে সামান্য কটা টাকার জন্যে সরকারি ছাপাখানায় কপালে এক জোড়া ম্যাগনিফাইং চশমা এঁটে প্রুফ দেখে আর সন্ধ্যে বেলা নাইট স্কুল চালায়।