এই তো সুবর্ণ সুযোগ সেই গোপন চিঠি পড়বার। পকেট থেকে বের করে দেখলাম লাল কালিতে লেখা–শ্ৰীযুতবাবু বিপিন বিহারী চৌধুরীর কাছ হইতে ২০০ পাইলাম। স্বাঃ নিধিরাম শর্মা।
পুঃ সব অনুসন্ধানাদি গোপন থাকিবেক।
অবাক হয়ে ভাবছি সেজ-দাদামশাই কী উদ্দেশ্যে চিমড়েকে টাকা দিলেন, কী অনুসন্ধান? এ বিষম সন্দেহজনক! এমন সময় দরজা খুলে পাঁচুমামা ঝড়ের মতন ঘরে ঢুকেই দুম করে দরজা বন্ধ করে তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বোয়ালমাছের মতন হাঁপাতে লাগল। মুখটা দেখলাম আগের চাইতেও সাদা, কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে, চুল উস্কোখুস্কো।
চিঠিটা পকেটে গুঁজে লাফিয়ে খাট থেকে নেমে বললাম, “কী হয়েছে পাঁচুমামা? আবার জোলাপ খেয়েছ?”
পাঁচুমামা শুকনো ঠোঁট আরো শুকনো জিভ দিয়ে চাটতে চেষ্টা করে বলল, “খেন্তিপিসী এসেছে।”
আমি বললাম, “খেস্তিপিসীটা আবার কে?” পাঁচুমামা আমসি হেন মুখটি করে বলল, “পদিপিসী দি সেকেণ্ড!”
.
০৬.
চিঠিটা পাঁচুমামার নাকের সামনে নেড়ে বললাম, “ও-সব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে বৃথা সময় নষ্ট কোরো না মামা! স্বয়ং সেজ-দাদামশাই এতে ভীষণভাবে জড়িত আছেন, এই দেখ তার প্রমাণ!” পাঁচুমামা চোখ গোল গোল করে চিঠিটা সবে পড়তে যাবে এমন সময় প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে দরজা গেল খুলে, আর সত্যি বলছি, অবিকল আমার সেই স্বপ্নে দেখা পদিপিসীর মতন কে একজন তোলোহাড়ির মতন মুখ করে ভিতরে এলেন। বুঝলাম, ঐ খেন্তিপিসী। পাঁচুমামা দরজার ঠেলা খেয়ে ছিটকে আমার খাটের উপর পড়েছিল, সেখান থেকে সরু গলায় চেঁচিয়ে বলল, “কী করতে পার আমার তুমি? এমন কোনো স্ত্রীলোক জন্মায় নি যাকে আমি ভয় পাই! জানো আমার বুকের মধ্যে সিংহ–” এইটুকু বলতেই খেন্তিপিসী কোমরে কাপড় জড়িয়ে খাটের দিকে। একপা এগুলেন আর পাঁচুমামাও অন্যদিক দিয়ে টুপ করে নেমে খাটের তলায় অগুনতি হাড়ি-কলসির মধ্যে সেঁদিয়ে গেল।
খেন্তিপিসী তখন আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে আপাদমস্তক আমাকে কাঠফাটা দৃষ্টিট দিয়ে দেখতে লাগলেন, আমার হাত এমনি কাঁপতে লাগল যে চিঠিটা খড়মড়, খড়মড় করে উঠল। তাই শুনে খেন্তিপিসী এমনি চমকালেন যেন বন্দুকের গুলি শুনেছেন। কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সে কথা বলবার আগেই সেজ-দাদামশাই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। খেন্তিপিসীকে দেখে একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আ খেন্তি, তুই আবার এখানে কেন?”
খেন্তিপিসী চায়না ক্যাণ্ডেল পাওয়ারের চোখ দুটো আমার ওপর থেকে সরিয়ে বরফের মতন ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “কেন, তোমার কি তাতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে? পুজোর সময় একটা কাঁচকলাও দিলে না, আমার ভজাকে যে কাপড় দিলে সেও অতি খেলো সস্তা রাবিশ। বাপের বাড়ি থেকে কলাটা-মুলোটা দূরে থাকুক কচুটারও মুখ দেখি না। তাই বলে বৌদির ঘরের কোনায়ও একটু জায়গা হবে না?”
পাঁচুমামা এখানে দুটো হাড়ির মাঝখান দিয়ে মুণ্ড বের করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “জায়গা হবে কি না হবু তাতে তো তোমার ভারি বয়ে গেল! এই ভরসকালে আমার ঘরেই-বা তোমার কত জায়গা–” বলেই কচ্ছপের মুণ্ডুর মতন সুই করে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল!
সেজ-দাদামশাই এবার গলা পরিষ্কার করে পাঁচুমামাকে তাড়া দিয়ে বললেন, “এই পাঁচু হতভাগা, বেরিয়ে আয় বলছি। আমার একটা ইমপরট্যান্ট কাগজ হারিয়েছে, খুঁজে দে বলছি, নইলে ভালো হবে না।” সঙ্গে সঙ্গে থেন্তিপিসীও বললেন, “বেরো একখুনি। তুইই নিশ্চয় আমার সুটকেশ থেকে বাড়ির নকশাটা সরিয়েছিস। বেরো বলছি। তোকে আমি সার্চ করবই করবা না বেরোলে ঐ খাটের তলায় সেদিয়েই সার্চ করব। আমি জানি না তোদের সব চালাকি! পদিপিসীর বাক্সর জন্যে তোরাও ছোঁক-ছোঁক করে বেড়াচ্ছিস। অথচ বাক্সতে আর কারো অধিকার নেই। ওটা স্ত্রীধন, ওটা আমি পাব।” সেজ-দাদামশাই রেগে বললেন, “তুই পাবি মানে? তোর ভজার পেটে যাবে বল। আমি আইন পাস করেছি, তা জানিস? কেউ যদি পায় তো আমি পাব। জানিস আমি দুশো টাকা খরচ করে ডিটেকটিভ লাগিয়েছি। ও বাক্স আমি বের করবই!”
এইবার দরজার কাছ থেকে একটা নরম কাশির শব্দ শোনা গেল। দেখলাম চিমড়ে ভদ্রলোক সেখানে কালো আলস্টার পরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছেন। বিড়িটা এবার বের করে বললেন, “মনে থাকে যেন তিনভাগের একভাগ আমার। যদি বাক্স পান আমার অদ্ভুত বুদ্ধির সাহায্যেই পাবেন।”
খেন্তিপিসী হঠাৎ আবিষ্কার করলেন খাটের তলা থেকে পাঁচু-মামার ঠ্যাং দুটো অসাবধানতাবশত একটুখানি বেরিয়ে রয়েছে। আর যায় কোথা, নিমেষের মধ্যে হিড় হিড় করে টেনে পাঁচুমামাকে বের করে এনে
দুই থাপড় লাগালেন, তার পর বুকপকেট থেকে একটা মোটামতন কাগজ টেনে বের করে বললেন, “তবে না নকশা নিস নি।”
তার পর কাগজটা খুলে বললেন, “ইস, দেখেছ সেজদা, ব্যাটাছেলে সংস্কৃতে উনিশ পেয়েছে।”
সেজ-দাদামশাইও অমনি বললেন, “কই দেখি-দেখি!”
চিম্ড়ে ভদ্রলোকও এগিয়ে বললেন, “মানুষ হওয়াই একরকম অসম্ভব।”
পাঁচুমামা তখন একদৌড়ে আবার ধাটের তলায় ঢুকল এবং এবার পা গুটিয়ে সাবধানে বসে বলল, “আমার কলেজের পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়ে তোমাদের কী দরকার শুনি? বিশেষত খেন্তিপিসীর মতন একজন। আকাট মুখ্য স্ত্রীলোকেরা নকশা হারিয়েছে। দরকারি কাগজ হারিয়েছে। তাই আমার ওপর হামলা। আর ঐ ইজের-পরা ছোকরার হাতে যে কাগজটা আছে সেটা কী?”