“হঠাৎ দেখা গেল গজার অবস্থা ফিরেছে। কথায়-কথায় বাড়িসুদ্ধ সবাইকে পাঁঠার মাংস খাওয়ায়, ঝুড়ি ঝুড়ি সন্দেশ আনে। একবার সমস্ত চাকরদের গরম বেনিয়ান কিনে দিল। ঘোড়ার গাড়ি কিনল, হীরের আংটি কিনল। বাড়িসুদ্ধ সবাই থরহরি কম্পমান! কে জানে কোথা থেকে এত টাকা পায়! পদিপিসী অবধি চিন্তিত হলেন। অথচ চুরি-ডাকাতি করলে তো এতদিনে পেয়াদা এসে হানা দিত। টাকা ভালো, কিন্তু পায় কোথা?”
গজার উপাখ্যান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরই পাই নি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। রাতের অদ্ভুত চুপচাপের মধ্যে শুনতে পেলাম পাহাড়ে-পাশবালিশটার আড়ালে দিদিমা আস্তেআস্তে নাক ডাকাচ্ছেন। আর কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। তার পর শুনলাম দূরে হুতুমপ্যাঁচা ডাকছে, আর মাথার উপর পুরনো কাঠের কড়িগুলো মটমই করে মোড়ামুড়ি দিচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম এ-সবের জন্যে ঘুম ভেঙে যায় নি। যার জন্যে ঘুম ভেঙেছে সে নিশ্চয় আরো লোমহর্ষক। শুয়ে-শুয়ে যখন শুয়ে থাকা অসহ্য হল, পা সিরসির করতে লাগল, আর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, জল না খেয়ে আর এক মিনিটও থাকা অসম্ভব হল, আস্তে-আস্তে খাট থেকে নামলাম। আস্তে-আস্তে দরজা খুলে বাইরে প্যাসেজে দাঁড়ালাম। ঐ একটু দূরে সারি সারি তিনটে কলসিভরা জল রয়েছে, কিন্তু মাঝখানের ঘুরঘুঁটে অন্ধকারটুকু পেরোতে ইচ্ছা করছে না। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বাঁ পায়ের গুলিটা চুলকোচ্ছি আর মন ঠিক করছি এমন সময় কার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম।
কি আর বলব! হাত-পা পেটের মধ্যে সেদিয়ে গেল। যেদিকে শব্দ সেদিকে সেজ-দাদামশাইয়ের ঘর। কল্পনা করতে লাগলাম দাঁত দিয়ে ছোরা কামড়ে ধরে হাত দিয়ে সিঁদ কাটতে-কাটতে, কানে মাকড়িপরা, লাল নেংটি, গায়ে তেল-চুকচুকে সব চোর-ডাকাতেরা সেজ-দাদামশাইয়ের ঘরে ঢুকে ওর হাতবাক্স সরাচ্ছে, রুপোর গড়গড়া নিচ্ছে, মখমলের চটি পায়ে দিচ্ছে!
এমন সময় ঠুস করে সেজ-দাদামশাইয়ের দরজা খুলে গেল আর বিড়ি ধরাতে-ধরাতে যে বেরিয়ে এল বিড়ির আগুনে স্পষ্ট তাকে দেখে চিনলাম সেই চিম্ড়ে ভদ্রলোক-বগলে জুতো নিয়ে পা টিপেটিপে এগুচ্ছে।
আমার তো আর তখন নড়বার-চড়বার ক্ষমতা ছিল না তাই চুপ করে ভীষণ মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হতে লাগলাম। লোকটা কিন্তু কি-একটা পেরেকে না কিসে হোঁচট খেয়ে ”দুর শালা!” বলে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। একটু বাদেই নীচের তলায় একটা দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনতে পেলাম।
এতক্ষণে আমার চলবার শক্তি ফিরে এল, ভাবলাম জল খেয়ে কাজ নেই। ঘরেই ফিরে যাওয়া যাক। একবার বেরুল চিম্ড়ে ভদ্রলোক, এর পরে হয়তো বেরুবে দামড়া ডাকাত। ফিরতে যাব এমন সময় একটা সাদা কাগজ উড়ে এসে আমার পায়ে জড়িয়ে গেল। নিমেষের মধ্যে সেটা তুলে নিয়ে সবেমাত্র পকেটে পুরেছি এমন সময় আবার সেজদাদামশাইয়ের দরজা খুলে গেল এবং এবার স্বয়ং সেজ-দাদামশাই বেরিয়ে এসে টর্চ হাতে নিয়ে আতিপাতি করে কি যেন খুঁজতে লাগলেন। আমি তো এদিকে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। ধরে ফেললে কী যে হবে ভাবা যায় না। এমন সময় সেই একই পেরেকে না কিসে হোঁচট খেয়ে সেজ-দাদামশাইও হাত-পা ছুঁড়ে কত কি যে বললেন তার ঠিক নেই। ভালোই হল, আমাকে দেখবার আগেই খোঁড়াতে-খোঁড়াতে ঘরে ফিরে গিয়ে বোধ হয় কিছু লাগালেন টাগালেন।
আমি যে কি ভাবব ঠাওর করতে না-পেরে খানিকটা জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। পকেটে কাগজটা করকর, করতে লাগল, কিন্তু দিদিমা আলো নিভিয়ে দিয়েছেন, পড়বার উপায় নেই। রঙ-চঙে চৌকির উপর রোজকার মতন আজও দেশলাই মোমবাতি রাখা ছিল, কিন্তু সব জানাজানি হয়ে যাবার ভয়ে আর জ্বালোম না। সকালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
অপেক্ষা করতে-করতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন দেখলাম পদিপিসী এসে পেছনের বারান্দার দরজা থেকে আমাকে ডাকছেন। ইয়া ষণ্ডা চেহারা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, থান পরা, ছোট করে চুল ছাঁটা, কপালে চন্দন লাগানো-অবিকল পাঁচুমামা যেমন বলেছিল। এক হাত দিয়ে ইশারা করে আমাকে ডাকছেন, আর অন্য হাতটা পেছনে রেখেছেন। আমি কাছে যেতেই বললেন, “বাক্স পেয়েছিস?” আমি বললাম, “কই না তো! নিমেষের মধ্যে বাক্স কোথায় ফেলেছিলে যে কবছর ধরে খুঁজে-খুঁজেও পাওয়া যায় নি, আমার আশা আছে যে আমি দুদিনেই খুঁজে দেব? কোথায় রেখেছিলে?”
পদিপিসী বললেন, “ভালো করে খুঁজে দেখা পেলে তুইই নিস। পাঁচুটা একটা ইডিয়ট, জোলাপের পর্যন্ত ডোজ ঠিক করতে পারে না, তুইই নিস। বাক্সের মধ্যে লাল চুনীর কানের দুল আছে, তোর মাকে দিস। আর দেখ, ঐ ব্যাটা চিড়েটাকে আর ঐ বুড়োটাকে একেবারে কাইণ্ড অফ বোকা বানিয়ে দিস। বিশ্বনাথের কৃপায় গজার আমার কোনো অভাব নেই, জুড়িগাড়ি কিনেছে, বাড়ি কিনেছে, গাঁজার ব্যবসা করেছে। আহা বাবা বিশ্বনাথ না দেখলে পাপিষ্ঠদের কী গতি হবে?” বলে আমাকে চুমু খেয়ে পদিপিসী ছোটকাকার তৈরি সেই কাঠের সিঁড়ি বেয়ে বাগানের দিকে চললেন, এবং পেছন ফিরতেই দেখলাম যে হাতটা পেছনে। রেখেছিলেন তাতে ইয়া মস্ত এক গদা!
গদা দেখে এমন চমকে গেলাম যে ঘুমই ভেঙে গেল। দেখলাম সকালবেলার রোদ পেছন দিকের বারান্দা দিয়ে ঘরে এসে বিছানা ভরে দিয়েছে। কাটা সিঁড়ির দাগটা চকচক করছে। হঠাৎ কেন জানি মনে হল সিঁড়িটা একটা ভারি ইমপরট্যান্ট জিনিস।