আমি তাকিয়ে দেখলাম ছাদ পর্যন্ত বাঁদর তাড়াবার সিঁড়ির খাজগুলো দেওয়ালের গায়ে কাটা-কাটা তখনো রয়েছে।
সব পুরনো বাড়ির মতন মামাবাড়ির ঘরগুলো বিশাল-বিশাল, সিঁড়িগুলো মস্ত-মস্ত, বারান্দাগুলোর এ মাথা থেকে ডাকলে ও মাথা থেকে শোনা যায় না। আর দুপুরে সমস্ত বাড়িখানা অদ্ভুত চুপচাপ হয়ে গেল! পাঁচুমামার টিকিটি সকাল থেকে দেখা যায় নি। নেহাত আমার সঙ্গে এক ট্রেনে এসেছিল, নইলে ও যে জন্মেছে তারই কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। বাড়িসুদ্ধ কেউ ওর নাম করল না। দুপুরে পদিপিসীর বর্মিবাক্সর সন্ধান নিচ্ছি এমন সময় কানে এল খুব একটা হাসি-গল্পের আওয়াজ।
রান্নাঘরে আনন্দ কোলাহল এমন কথা তো জন্মে শুনি নি। অবাক হয়ে এগিয়ে-বাগিয়ে চলোম। বারান্দার বাঁকে ঘুরেই দেখি চাকর-বাকররা বিষম ঘটা করে অতিথি-সৎকার করছে। কে একটা রোগা লোক ঠ্যাং ছড়িয়ে বামুনঠাকুরের উঁচু জলচৌকিতে বসে রয়েছে। চার দিকে পানবিড়ি আর কাচি সিগারেটের ছড়াছড়ি। বামুনদিদি পর্যন্ত ঘোমটার মধ্যে বিড়ি টানছে। ঘনশ্যামট্যাম সবাই উপস্থিত আছে, পান খেয়ে-খেয়ে সব চেহারা বদলে ফেলেছে।
আমার পায়ের শব্দ পেয়েই নিমেষের মধ্যে রান্নাঘর ভোঁভাঁ, কে যে কোথায় চম্পট দিল ঠাওরই করতে পারলাম না। চোখের পাতা না ফেলতেই দেখি কেউ কোথাও নেই, খালি বামুনদিদি ঘোমটার ভিতরে হাই তুলছে এবং বিড়িটার শেষ চিহ্ন পর্যন্ত গোপন করে ফেলেছে! কিন্তু একটা জিনিস আমার চোখ এড়াতে পারে নি। ঠাং ছড়ানো রোগা লোকটা হচ্ছে আমাদের পরিচিত সেই চিম্ড়ে ভদ্রলোক। ভাবতে ভাবতে গা শিউরে উঠল। এতদূর সাহস যে ভোরবেলা দুরবীন দিয়ে পরখ করে নিয়ে দুপুর না গড়াতে একেবারে ভেতরে এসে সেঁদিয়েছে। চুলগুলো আমার সজারুর কাটার মতন উঠে দাঁড়াল। বামুনদিদিকে জিজ্ঞেস করলাম, “কে লোকটা?” বামুনদিদি যেন আকাশ থেকে পড়ল।
“কোন লোকটা খোকাবাবু? তুমি-আমি ছাড়া আর তো লোক দেখছি না কোথাও!” বলেই সে সরে বসল, অমনি তার কোলের মধ্যে কতকগুলো রুপোর টাকা ঝনঝন করে বেজে উঠল। বুঝলাম ঘুষ দিয়ে চাকর সম্প্রদায়কে হাত করেছে! কি ভীষণ।
এদিকে পাঁচুমামার সঙ্গে পরামর্শ করব কি! সে যে সকাল থেকে কোথায় গা ঢাকা দিয়েছে তার আর কোনো পাত্তাই নেই! একবার কি একটা গুজব শুনেছিলাম নাকি ভুলে বেশি জোলাপ খেয়ে ফেলেছে। তবুও তখুনি তার খোঁজে বেরুলাম। চার-পাঁচটা ভুল দরজা খুলে চার-পাঁচবার তাড়া খাবার পর দেখি পূর্বদিকের ছোট ঘরে তক্তপোশের ওপর শুয়ে-শুয়ে পাংশুপানা মুখ করে পাঁচুমামা পেটে হাত বুলচ্ছে। আমাকে দেখেই বিষম বিরক্ত হয়ে নাকিসুরে বলল, “কেন আবার বিরক্ত করতে এসেছ। যাও না এখান থেকে।” আমি বললাম, “চার দিকে যেরকম ষড়যন্ত্র চলেছে এখন আর তোমার আরাম করে শুয়ে-শুয়ে পেটে হাত বুলনো শোভা পায় না! এদিকে শক্র এসে ঢুকেছে সে খবর রাখ কি?” পাঁচুমামা কোথায় আমাকে হেল্প করবে, না তাই-না, শুনে এমনি ক্যাও-ম্যাও শুরু করে দিল যে আমি সেখান থেকে যেতে বাধ্য হলাম!
সারাদিন ভেবে-ভেবেও একটা কুলকিনারা করতে পারলাম না। রাত্রে দিদিমা পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলতে-বুলতে বললেন, “বলেছিলাম তোকে পদিপিসীর বর্মিবাক্সের গল্প বলব, তবে শোন।”
দিদিমা সবুজ বালাপোশ ভালো করে জড়িয়ে গালের পান দাঁতের পেছনে তুসে গল্প বলবার জন্যে রেডি হলেন। আর আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। দিদিমা বলতে লাগলেন, “পদিপিসীর ইয়া ছাতি ছিল, ইয়া পাঞ্জা ছিল। রোজ সকালে উঠে আধ সের দুধের সঙ্গে এক পোয়া ছোলা ভিজে খেতেন। কি তেজ ছিল তারা সত্যি মিথ্যে জানি না, শুনেছি একবার একটা শামলা গোরু হাম্বা-হাম্বা ডেকে ওর দুপুরের ঘুমের ব্যাঘাত করেছিল বলে উনি একবার তার দিকে এমনি করে তাকালেন যে সে তিনদিন ধরে দুধের বদলে দই দিতে লাগল। পদিপিসী একবার শীতকালে গোরুর গাড়ি চেপে কাউকে কিছু না-বলে রমাকান্ত নামে একটিমাত্র সঙ্গী নিয়ে কোথায় জানি চলে গেলেন ফিরে এলেন দুপুর-রাত্রে। এসেই মহা হৈ-চৈ লাগালেন কি একটা নাকি বর্মিবাক্স হারিয়েছে। সবাই মিলে নাকি দেড়বছর ধরে ঐ বাক্স খুঁজেছিল। কোথায় পাওয়া যাবে! কেউ চোখে দেখেনি সে বাক্স। শেষপর্যন্ত সে পাওয়াই গেল না!” আমি নিশ্বেস বন্ধ করে বললাম, “তাতে কী ছিল?”
দিদিমা বললেন, “কে জানে! মসলা-টসলা হবে। ঐ পদিপিসীর একটিমাত্র ছেলে ছিল, তার নাম ছিল গজা। কালো রোগা ডিগডিগে, এক মাথা কোঁকড়া-কোঁকড়াতেল-চুকচুকে চুলে টেরি বাগানো। দিনরাত কেবল পান খাচ্ছে আর তামাক টানছ। পড়াশুনো কি কোনোরকম কাজকর্মের নামটি নেই। সারাদিন গোলাপি গেঞ্জি আর আদির ঝুলো পাঞ্জাবি পরে পাড়াময় টোটো কোম্পানি। সখের থিয়েটার, এখানে-ওখানে আড্ডা। অথচ কারু কিছু বলবার জো নেই, পদিপিসী তা হলে আর কাউকে আস্ত রাখবেন না।
“জনিস তো ভালো লোকের কখনো ভালো হয় না। যত সব জগতের বদমায়েস আছে সবাই সুখে জীবন কাটিয়ে যায়। গজারও তাই হল। যখন আরো বড় হল, গাঁজা গুলি খেতে শিখল, জুয়োর আড্ডায় গিয়ে জুটল। মাঝে-মাঝে একমাস-দুমাস দেখা নেই। আবার একগাল পান নিয়ে হাসতে-হাসতে ফিরে আসে। পদিপিসী যেখান থেকে যেমন করে পারেন টাকা জোগান। পাজি ছেলেকে পায় কে!