দেখলাম সেজ-দাদামশাই ইয়া শিঙ-বাগানো গোফ, হিংস্র চোখ, দিব্যি টেরিকাটা চুল নিয়ে ইজিচেয়ারে বালাপোশ গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। বুকের ভিতর ধক করে টের পেলাম শক্র নম্বর ওয়ান! সেজ-দাদামশাইকে প্রণাম করতেই একটু মুচকি হেসে আমাকে মাথা থেকে পা অবধি দেখে নিয়ে বললেন, “হুঁ।“
.
০৪.
ভীষণ রাগ হল। রেগেমেগে দিদিমার সঙ্গে খাবার ঘরে গিয়ে আমার দাদামশাই যে বড় পিঁড়িতে বসতেন তাতে আসন হয়ে বসে লুচি, বেগুনভাজা, ছোলার ডাল, ফুলকপির-ডালনা, চিংড়িমাছের মালাইকারি, চালতার অম্বল, রসগোল্লার পায়েস, এক নিশ্বেসে সমস্ত রাশি-রাশি পরিমাণে খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষ হলে দেখলাম পাঁচুমামাও কোন সময় আমার পাশে বসে খুঁটে খুঁটে খেতে শুরু করে দিয়েছে।
দু-একবার তাকালাম। পাঁচুমামার ভাবখানা যেন আমায় চেনেই না। তখন আমার ভারি দুঃখ হল। পাঁচুমামাও অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু হাত ধোবার সময় কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস্ করে বলল,
“দুজনে বেশি ভাব দেখালে মতলব ফেঁসে যাবে। ওল্ড লেডি নম্বর ওয়ান স্পাই।” আমি একটু আপত্তি করতে গেলাম, কারণ দিদিমাকে আমার ভালো লাগছিল।
পাঁচুমামা বলল, “চোপ, আমার খুড়ি আমি চিনি না।”
পুরনো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে, হাতে মোমবাতি নিয়ে দিদিমার সঙ্গে সঙ্গে দোতলায় বিশাল এক শোবার ঘরে শুতে গেলাম। কতরকম কারুকার্য করা ভীষণ প্রকাণ্ড আর ভীষণ উঁচু এক খাটে শুলাম। সেটা এমনি উঁচু যে সত্যিকারের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তাতে উঠলাম। খাটের উপর আবার দু-তিনটে বিশাল-বিশাল পাশবালিশ। আর খাটের নীচে মস্ত-মস্ত কাঁসা-পেতলের কলসি-টলসি কি সব দেখতে পেলাম। দিদিমা একটা রঙচঙে জলচৌকির উপর মোমবাতিটা নামিয়ে রেখে আমাকে বেশ ভালো করে ঢাকা দিয়ে, মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আজ টপ করে ঘুমিয়ে পড় তো মানিক। আমি খেয়ে এসে তোমার পাশে শোব। কাল তোমাকে পদিপিসীর বর্মিবক্সর গল্প বলব। একা শুয়ে থাকতে ভয় পাবে না তো?” পদিপিসীর নাম শুনে আমার বুক ঢিপটিপ করতে লাগল। মুখে বললাম, “আলোটা রেখে যাও, তা হলে কিছু ভয় পাব না।” দিদিমা আদর করে চলে গেলেন। পাঁচুমামা কেন বলল স্পাই নম্বর ওয়ান!
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, যখন ঘুম ভাঙল দেখি ভোর হয়ে গেছে। দিদিমা কখন উঠে গেছেন। আমিও খচমচ করে খাট থেকে নেমে আস্তে-আস্তে গিয়ে ঘরের সামনের বাড়ান্দায় দাঁড়ালাম। দেখি ফুলবাগান থেকে, আর তার পেছনে আমবাগান থেকে কুয়াশা উঠছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। সেইজনেই হোক, কিংবা আমগাছতলায় যা দেখলাম সেইজন্যেই হোক, আমার সারা গা সিরসির করে উঠল। দেখলাম ছাইরঙের পেন্টেলুন আর ছাইরঙের গলাবন্ধ কোট পরে মুখে মাথায কম্ফটার জড়িয়ে চিম্ড়ে ভদ্রলোক চোখে বাইনাকুলার লাগিয়ে একদৃষ্টে বাড়ির দিকে চেয়ে রয়েছেন। তাই-না দেখে আমার টনসিল ফুলে কলাগাছ।
৫-৬. আমগাছের ছায়া
এমনি সময় সুট করে সে আমগাছের ছায়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল আর ভোরবেলাকার প্রথম সূর্যের আলো এসে বাগান ভরে দিল। ফিরে দেখি আমার পাশে লাল নীল ছককাটা লুঙি আর সবুজ কম্বলের ড্রেসিংগাউন পরে আম-কাঠির দাঁতন চেবাতে-চেবাতে সেজ-দাদামশাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
সেজ-দাদামশাই বললেন, “জানিস, এই বারান্দাটাতে আমার ছোটকাকা কত কি করিয়েছিলেন। বিলেত থেকে ছোটকাকা ভীষণ সাহেব হয়ে ফিরলেন ঘাড়-ছাঁট চুল, কোটপ্যান্ট পরা, হাতে ছড়ি, মুখে চুরুট, কথায়-কথায় খারাপ কথা। ক্রমেই বললেন, “আমি মেম আনিব, বিলেতে সব ঠিক করে রেখে এসেছি। এই দোতলার উপর শোবার ঘরের সঙ্গে লাগা এক বাথরুম বানাব, লম্বা বারান্দাটা তো আছেই, তার এক কোণ দিয়ে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বানাব। সাদা পাগড়ি মাথায় দিয়ে ঐ সিঁড়ি বেয়ে জমাদার ওঠানামা করবে। নইলে মেম আসবে না বলেছে। তাই-না শুনে আমার ঠাকুমা-পিসিমা আর জেঠিমারা হাত-পা ছুঁড়ে বললেন, “অমা! সে কি কথা গো! মেমদের যে লাল চুল, কটা চোখ, ফ্যাকশা রঙ আর মড়াখেকো ফিগার হয়। কি যে বলিস তার ঠিক নাই, মেমরা যে ইয়েটিয়ে পর্যন্ত খায় শুনেছি। ছোটকাকা বিরক্তমুখ করে বললেন, “অবিশ্যি তোমরা যদি চাও যে আমি সন্নিসী হই, তা হলে আমার আর কিছুই বলবার নেই। বল তো নাগা সন্নিসীই হই, মেমেও দরকার নেই, নতুন সুটগুলোতেও দরকার নেই।” তাই শুনে ঠাকুমারা সবাই আরো চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিলেন। কিন্তু ভয়ে ঠাকুরদার কানে কেউই কথাটা তুললে না। ছোটকাকাও সেই সুযোগে মিস্ত্রি লাগিয়ে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি তৈরি করিয়ে ফেললেন। ঐখানে রেলিং কেটে সিঁড়ি বসানো হয়েছিল। দোতলা থেকে ছাদে ওঠবার কাঠের সিঁড়ি একটা ছিলই, বাদর তাড়াবার জন্যে, তারই ঠিক নীচে দিয়ে নতুন সিঁড়ি হল। এখন খালি বাথরুম বানানো আর জমাদারের পাগড়ি কেনা বাকি রইল। ঠাকুরদার কাছে কী ধরনের মিথ্যে কথা বলে টাকা বাগানো যায় দিনরাত ছোটকাকা সেই চিন্তাই করতে লাগলেন। এদিকে পাড়ার চোররাও সুবিধে পেয়ে রোজ রাত্রে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতে শুরু করে দিল। তাদের জ্বালায় ঘুমোয় কার সাধ্যি! শেষটা একদিন ঠাকুরদার ঘুম ভেঙে গেল, গদা হাতে করে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন, চোররাও সিঁড়ি দিয়ে ধপধপ নেমে বাগানের মধ্যে দিয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড় দিল। চাঁদের আলোয় ঠাকুরদা অবাক হয়ে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পর আস্তে-আস্তে আবার শুতে গেলেন। পরদিন সকালে উঠেই মিস্ত্রি ডাকিয়ে ঐ সিঁড়ি খুলিয়ে ফেললেন। রাগের চোটে ছাদে ওঠবার কাঠের সিঁড়িটা অবধি খুলিয়ে দিলেন। কাটা রেলিং ফের জোড়া দেওয়ালেন। আর ছোটকাকাকে ডেকে বললেন, “পানুর ছোটমেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। টোপর পরে প্রস্তুত হও। শেষটা ঐ পানুর ফর্সা মোটা গোলচোখো বারো বছরের মেয়ের সঙ্গে ছোটকাকার বিয়ে হয়ে গেল। এবং বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তারা সারাজীবন পরম সুখে কাটাল। পাঁচুটা তো ওরই নাতি। এই রে, ঘনশ্যাম আবার আমার ঈশপগুল নিয়ে আসছে। বলিস যে আমি বেরিয়ে গেছি।” বলেই সেজ-দাদামশাই হাওয়া!