মামাবাড়ির স্টেশনে পৌঁছলাম গভীর রাতে স্টেশনের বেড়ার পেছনে কতকগুলো লম্বা-লম্বা শিশুগাছের পাতার মধ্যে একটা ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়া সিরসির করে বয়ে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে জনমানুষ নেই। ছোট্ট স্টেশন বাড়ির কাঠের দরজার কাছে স্টেশনমাস্টার একটা কালো শেড় লাগানো লণ্ঠন নিয়ে হাই তুলছেন। পান খেয়েছেন অজস্র, আর বহুদিন দাড়ি কামান নি। একটা গাড়ি নেই, ঘোড়া নেই, গোরুর গাড়ি দূরে থাকুক, একটা বেড়াল পর্যন্ত কোথাও নেই।
আমি পাঁচুমামার দিকে তাকালাম; পাঁচুমামাও ফ্যাকাশে মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তখন আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, “তুমি যে প্রায়ই বল আমরা এখানকার জমিদার, এরা তোমাদের প্রভুভক্ত প্ৰজা, এই কি তার নমুনা? আমি তো ভেবেছিলাম আলো জ্বলবে, বাদ্যি বাজবে, মালাচন্দন নিয়ে সব সারে সারে দাঁড়িয়ে থাকবে। তার পর আমরা চতুর্দোলায় চেপে মামাবাড়ি যাব। গিয়ে গরম-গরম–”
পাঁচুমামা এইখানে আমার খুব কাছে ঘেঁষে এসে কানে-কানে বলল, “চোপ ইডিয়ট! দেখছিস না চার দিক থেকে অন্ধকারের মতন বিপদ ঘনিয়ে আসছে? রক্তলোলুপ নিশাচররা যাদের পিছু নিয়েছে তাদের কি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা শোভা পায়?”
চমকে উঠে বক্ততা থামিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পেলাম একটা নিবুনিবু দু-সেলওয়ালা টর্চ জ্বেলে চিমড়ে ভদ্রলোক গাড়ি থেকে রাশিরাশি পোটলা-পাটলি ছেলেপুলে ও মোটা গিন্নিকে নামাচ্ছেন। তারা নামতে না-নামতেই গাড়িটাও ঘড়ঘড় করে চলে গেল, আর অন্ধকার লম্বা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে কেমন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে লাগল। তার মধ্যে শুনতে পেলাম পাঁচুমামা আমার ঘাড়ের কাছে ফোঁসফোঁস্
করে নিশ্বাস ফেলছে। এমন সময় অন্ধকার ভেদ করে কে চ্যাঁচাতে লাগল, “অ পাঁচুদাদা, অ মেজদিমণির খোকা। বলি এয়েচ না আস নি?” পাঁচুমামার যেন ধড়ে প্রাণ এল, খচমচ, করে ছুটে গিয়ে বলল, “ঘনশ্যাম এলি! আঃ বাঁচালি!”
ঘনশ্যাম কিন্তু পাঁচুমামার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল, “ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগে না পাঁচুদাদা। এ দিকে বড় গোরু তো আসনসিঁড়ি হয়ে বসে পড়েছেন, কত টানাটানি করলাম, কত কাকুতিমিনতি করলাম, কত ল্যাজ মোচুড়ালাম। শেষ অবধি গাড়ির বাঁশ খুলে নিয়ে পেটের নীচে চাড় দিয়ে পর্যন্ত ওঠাতে চেষ্টা করলাম। সে কিন্তু নড়েও না, ঐরকম বসে ঘাস চাবায়।”
পাঁচুমামা বলল, “অ্যা ঘনশ্যাম। তবে কী হবে?”
ঘনশ্যাম বলল, “হবে আবার কী? চল দেখবে চলা”
আমরা সেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কাঁকর-বেছানো প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে গেটের মধ্যে দিয়ে ওদিকে ধুলোমাখা রাস্তায় এসে পড়লাম। সেইখানে দেখি রাস্তার ধারে একটা গোরুর গাড়ি তার একটা গোরু পা গুটিয়ে: মাটিতে বসে-বসে দিব্যি ঘুমুচ্ছে, অন্য গোরুটা তার দিকে হতাশভাবে তাকিয়ে জাবর কাটছে।
সত্যি-সত্যি সে গোরু কিছুতেই উঠল না। তখন ঘনশ্যাম পাঁচুমামাকে আর আমাকে জিনিসপত্রসুদ্ধ গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে সেই গোরুটার জায়গায় নিজেই গাড়ি টানতে শুরু করে দিল। গাড়ি আমনি চলতে লাগল।
স্টেশন ছাড়িয়েই ডানহাতে পুরনো গোরস্থান। সেখানটাতে আবার মস্ত-মস্ত বুলো-ঝুলো পাতাওয়ালা উইলোগাছ জমাট অন্ধকার করে রয়েছে। সেখানে পৌঁছতেই পাঁচুমামা ফিসফিস করে আমাকে ইংরিজিতে বলল, “এখানে সব সিপাই বিদ্রোহের সময়কার কবর আছে।” অমনি ঘনশ্যাম গাড়ি থামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে বলল, “ইংরিজিতে সব ভূতের গল্প বললে ভালো হবে না পাঁচুদাদা। এইখানেই গাড়ি নামিয়ে চম্পট দেব বলে রাখলাম।”
পাঁচুমামা ব্যস্ত হয়ে বলল, “আরে ভূতের গল্প নয় রে ঘনশ্যাম। কবরের কথা বলছিলাম।” ঘনশ্যাম আরো বিরক্ত হয়ে বলল, “ভূতের কথা নয় মানে? কবর, আর ভূত কি আলাদা? ইংরিজি জানি না বলে কি তোমাদের চালাকিগুলোও ধরতে পারব না নাকি! না পাঁচুদা, আমার পোষাবে না” বলেই ঘনশ্যাম গাড়িটা দুম্ করে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
এমন সময় খটখট,-খটাখট শব্দ করে একটা ছ্যাকড়া গাড়ি এসে উপস্থিতা আমাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম সাদা ফ্যাকাশে মুখ করে চিম্ড়ে ভদ্রলোক জ্বলজ্বলে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।
পাঁচুমামা তথুনি হাত-পা ছুঁড়ে মূৰ্ছা গেল। ঘনশ্যাম বললে, “ইয়ার্কি ভালো লাগে না পাঁচুদাদা।” বলে আবার গাড়ি টানতে শুরু করল। পাঁচুমামাও রুমাল দিয়ে মুখ মুছে উঠে বসল। অনেক রাতে মামাবাড়ি পৌঁছলাম। মনে পড়ল পদিপিসীও এমনি দুপুর রাতে রমাকান্তকে নিয়ে নিমাইখুড়োর বাড়ি থেকে ফিরেছিলেন। সত্যি, বর্মিবাক্সটা গেল কোথায়? পাঁচুমামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “হাত থেকে পড়ে-উড়ে যায় নি তো?”
পাঁচুমামা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “সস চুপ, এটা শক্রর আস্তানা। বুক থেকে হৎপিণ্ড উভড়ে নিলেও পদিপিসীর বর্মিবাক্সর নাম মুখে আনবি না।”
গাড়িবারান্দার নীচে গোরুর গাড়ি নামিয়ে ঘনশ্যাম সিঁড়ির উপর বসে পড়ল। ঘরের মধ্যে থেকে প্যাঁচা, ফিঙে, নটবর, খেন্তি, পেঁচী, ইত্যাদিরা সব বেরিয়ে এল মজা দেখবার জন্যে। কিন্তু গাড়ি থেকে লটবহর নামাতে কেউ সাহায্যও করল না। পাঁচুমামাও নেমেই কোথায় জানি চলে গেল। শেষ অবধি আমি মনে-মনে ভারি রেগে জিনিসপত্র দুমদাম করে মাটিতে ফেলতে লাগলাম। সেই দুমদাম শুনে দিদিমা বেরিয়ে এসে আমাকে চুমুটুমু খেয়ে একাকার। দিদিমা আমাকে সেজ-দাদামশাইয়ের কাছে নিয়ে গেলেন।