“বলে গোরু খুলিয়ে, গোরুর গাড়ির ছাউনি তুলিয়ে, বাঁশের বাঁধন আলগা করিয়ে, গাড়োয়ানের দুহাতি ধুতি ঝাড়িয়ে আর রমাকান্তকে দস্তুর মতো সার্চ করিয়ে এমন এক কাণ্ড বাঁধালেন যে তার আর বর্ণনা দেওয়া যায় না। শেষে যখন গোরু দুটোর ল্যাজের খাঁজে খুঁজতে গেছেন তখন গোরু দুটো ধৈর্য হারিয়ে পদিপিসীর হাঁটুতে এইসা গুতিয়ে দিল যে পদিপিসী তখুনি বাবাগো মাগো বলে বসে পড়লেন। কিন্তু বসে পড়লে কি হবে, বলেইছি তো সিংহের মতন তেজ ছিল তার, বসে-বসেই সারারাত বাড়িসুদ্ধ সবাইকে জাগিয়ে রাখলেন। কিন্তু সেবাক্স আর পাওয়াই গেল না। এতক্ষণ যারা খুঁজছিল তারা কেউ বাক্সে কী আছে না-জেনেই খুঁজছিল। এবার পদিপিসী কেঁদে ফেলে সব ফাঁস করে দিলেন। বললেন, “নিমাইখুড়ো আমাকে দেখে খুশি হয়ে ঐ বাক্স ভরে কত হীরে-মোতি দিয়েছিল, আর সে তোরা কোথায় হারিয়ে ফেললি।” তাই-না শুনে যারা খুঁজে-খুঁজে হয়রান হয়ে বসে পড়েছিল, তারা আবার উঠে খুঁজতে শুরু করে দিল। শুনেছি তিন দিন তিন রাত ধরে মামাবাড়িসুদ্ধ
কেউ খায়ও নি ঘুমোয়ও নি। বাগান পর্যন্ত খুড়ে ফেলেছিল। যাদের মধ্যে বিষম ভালোবাসা ছিল তারাও পরস্পরকে: সন্দেহ করতে লেগেছিল।”
আমি আর সেই চিমড়ে ভদ্রলোক বললাম, “তার পর? তার পর?” পাঁচুমামা বলল, “তার পর আর কি হবে? এক সপ্তাহ সব ওলটপালট হয়ে রইল, খাওয়া নেই শোয়া নেই, কারু মুখে কথাটি নেই। সারা বাড়ি সবাই মিলে তোলপাড় করে ফেলল। কত যে রাশি-রাশি ধুলো, মাকড়সার জাল, ভাঙা শিশি-বোতল, তামাকের কৌটো বেরুল তার ঠিক নেই। কত পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া চিঠি বেরুল; কত গোপন কথা জানাজানি হয়ে গেল; কত হারানো জিনিস খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু পদিপিসীর বর্মিবাক্স হাওয়ায় উড়ে গেল। এমন ভাবে হাওয়া হয়ে গেল যে শেষ অবধি অনেকে এ কথাও বলতে ছাড়ল না যে বাক্স-টাক্স সব পদিপিসীর কল্পনাতে ছাড়া আর কোথাও ছিল না। কেবলমাত্র রমাকান্ত বার বার বলতে লাগল–নিমাইখুড়োর বাড়ি থেকে পদিপিসী যে খালি হাতে ফেরেন নি এ কথা ঠিক গোরুর গাড়িতে আসবার সময়ে বাক্সটা চোখে না-দেখলেও পদিপিসীর আঁচল চাপা শক্ত চৌকো জিনিসের খোঁচা তার পেটে লাগছিল, এবং সেটা পানের বাটা নয় এও নিশ্চিত, কারণ পানের বাটার খোঁচা তার পিঠে লাগছিল।
“বাক্সের শোকে পদিপিসী আধখানা হয়ে গেলেন। অত হীরে-মোতি লোকে সারাজীবনে কল্পনার চোখেও দেখে না আর সে কিনা অমন করে কোলছাড়া হয়ে গেল! শোকটা একটু সামলে নিয়ে পদিপিসী আবার রমাকান্তকে নিয়ে নিমাইখুড়োর খোঁজে গেছিলেন যদি কিছু পাওয়া যায়। গিয়ে দেখেন বত্রিশবিঘার শালবনের মাঝখানে নিমাইখুড়োর আড্ডা ভেঙে গেছে, জনমানুষের সাড়া নেই, বুনো বেড়াল আর হুতুমপ্যাচার আস্তানা। “তার পর কত বছর কেটে গেল। বাক্সের কথা কেউ ভুলে গেল, কেউ আবছায়া মনে রাখল। একমাত্র পদিপিসীই মাঝে-মাঝে বাক্সের কথা তুলতেন। আরো বহু বছর বাদে পদিপিসী স্বর্গে গেলেন। যাবার আগে হঠাৎ ফিক করে হেসে বললেন, এই রে। বাক্সটা কী করেছিলাম এদিন পরে মনে পড়েছে। বলেই, চোখ বুজলেন। তাই শুনে পদিপিসীর শ্রাদ্ধের পর আর-এক চোট খোঁজাখুজি হয়েছিল কিন্তু কোনো ফল হয় নি।”
চিম্ড়ে ভদ্রলোক বললেন, “তারপর?”
পাঁচুমামা বলল, “সেই বাক্স আমি বের করব। কিন্তু আপনার তাতে কী মশাই?”
পাঁচুমামা এইখানে চিম্ড়ে ভদ্রলোকের দিকে একদৃষ্টে কটমট, করে চেয়ে থাকার ফলে চিমূড়ে ভদ্রলোক উঠে গিয়ে সুড় সুড় করে নিজের জায়গায় বসে নিবিষ্ট মনে দাঁত খুটিতে লাগলেন ইতিমধ্যে বেশ রাত হয়ে যাওয়াতে তার স্ত্রী-পুত্র পরিবার সবাই ঘুমিয়ে-টুমিয়ে পড়ে একেবারে স্তুপাকার হয়ে রয়েছে দেখা গেল।
আমি আশা করে বসেই আছি পাঁচুমামা লোমহর্ষণ আরো কিছু বলবে, কিন্তু পাঁচুমামা দেখলাম চটিটি খুলে ঘুমোবার জোগাড় করছে। তাই দেখে আমার কেমন অস্বস্তি বোধ হতে লাগল আর চিম্ড়ে ভদ্রলোক থাকতে না পেরে দাঁত খোটা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন, “একশো বছর ধরে যা এত খোঁজা সত্ত্বেও পাওয়া যায় নি, তাকে যে আবিষ্কার করবেন, কোনো পায়ের ছাপ বা আঙুলের ছাপ জাতীয় চিহ্নটিহ্ন কিছু পেয়েছেন?”
পাঁচুমামা বলল, “ঠিক পাই নি, তবে পেতে কতক্ষণ? পদিপিসীর শেষ কথায় তো মনে হয় যে চোখের সামনেই কোথাও আছে, চোখ ব্যবহার করলেই পাওয়া যাবে। লুকিয়ে রাখবার তো সময়ই পান নি। আর মনে পড়ে যখন হাসি পেয়েছিল তখন নিশ্চয় চোরেও নেয় নি। কিন্তু পাঁচশোবার বলছি মশাই আপনার তাতে কী?” চিম্ড়ে ভদ্রলোক কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা পর্যন্ত মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
সবাই শুয়ে পড়ল আর আমি একা জেগে অন্ধকার রাত্রের মধ্যে ঝোপেঝাড়ে হাজার-হাজার জোনাকি পোকার ঝিকিমিকি আর থেকেথেকে এঞ্জিনের ধোঁয়ার মধ্যে ছোট-ছোট আগুনের কুচি দেখতে লাগলাম। ক্রমে সে-সব আবছা হয়ে এল, আমার চোখের সামনে খালি দেখতে লাগলাম বড় সাইজের একটা বর্মিবাক্স, লালচে রঙের উপর কালো দিয়ে আঁকা বিকট হিংস্র এক মাছ প্যাটনের ড্রাগন, তার চোখ দিয়ে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে, নাক দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, জিভ লকলক করছে। আরো দেখতে পেলাম যেন বাক্সর চাকনিটা খোলা হয়েছে আর তার ভিতর পায়রার ডিমের মতন, মোরগের ডিমের মতন, হাঁসের ডিমের মতন, উটপাখির ডিমের মতন সব হীরেমণি আমার চোখ ঝলসে দিচ্ছে। হঠাৎ ঘচ করে ট্রেন থেমে গেল।