“পদিপিসীও নিমাইখুড়োর কথা জানতে পেরে মহাখুশি!”
পাঁচুমামা ঢোক গিলে চোখ গোল করে আরো কত কি বলল। “পদিপিসীর ভীষণ বুদ্ধি, ধাঁ করে টের পেয়ে গেলেন খুড়োই ডাকাতদলের সর্দার। পদিপিসী খুড়োর বাড়ি দুপুর রাতে পৌঁছেই খুড়োর চোখের ওপর চোখ রেখে, দাঁতে-দাঁত ঘষে বললেন–”শালবনে আমাকে ডাকাতে ধরেছিল, তাড়াতাড়ি গোরুর গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে আমার তসরের চাদর খানিকটা ছিঁড়ে গেছে, পায়ের বুড়ো আঙুলে হোঁচট লেগেছে, আর তা ছাড়া মনেও খুব একটা ধাক্কা লেগেছে। এর কী প্রতিশোধ নেব এখনো ঠিক করি নি। এখন রান্না করব, খাব, তার পর পান মুখে দিয়ে শুয়ে শুয়ে ভেবে দেখব।”
“খুড়োর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, হাত থেকে রুপোবাঁধানো গড়গড়ার নলটা মাটিতে পড়ে গেল; খুড়োমশাই বিদ্যাসাগরী চটি পায়ে তারই উপর একটু কাত হয়ে দাঁড়িয়ে গোফ নাড়তে লাগলেন, মুখ দিয়ে কথা বেরোল না! পদিপিসী তাই দেখে প্রসন্ন হয়ে বললেন–”আমার মধ্যে যে-সব সন্দেহরা ঝাঁক বেঁধে অন্ধকার বানিয়ে রেখেছে, তারা যাতে মনের মধ্যেই থেকে যায়, বাইরে প্রকাশ পেয়ে তোমার অনিষ্ট ঘটায়, তার ব্যবস্থা অবিশ্যি তোমার হাতে’ বলে চাদরটা চৌকির উপর রেখে কুঁজো থেকে খাবার জল নিয়ে পা ধুলেন। তার পর রান্নাঘরে গিয়ে খুড়িকে ঠেলে বের করে দিয়ে মনের সুখে গাওয়া ঘি দিয়ে নিজের মতন চারটি ঘিভাত রাঁধতে বসে গেলেন। খুড়োও আস্তে-আস্তে সেইখানে উপস্থিত হয়ে বললেন-–”তোমায় পঞ্চাশ টাকা দেব যদি ডাকাতের কথা কাউকে না বল।”
“পদিপিসী একমনে রাঁধতে লাগলেন। “খুড়ো বললেন—’একশো টাকা দেব।‘ পদিপসী একটু হাসলেন। খুড়ো বললেন–”পাঁচশো টাকা দেব। পদিপিসী একটু কাশলেন। খুড়ো মরীয়া হয়ে বললেন-”হাজার টাকা দেব, পাঁচ হাজার টাকা দেব, আমার লোহার সিন্দুক খুলে দেব, যা খুশি নিয়ো। পদিপিসী খুন্তিকড়া নামিয়ে রেখে সোজা সিন্দুকের সামনে উপস্থিত হলেন। খুড়ো সিন্দুক খুলতেই হীরে-জহরতের আলোয় পদিপিসীর চোখ ঝলসে গেল। খুড়ো ভেবেছিলেন সেইসঙ্গে পদিপিসীর মাথাও ঘুরে যাবে, কী নেবে না-নেবে কিছু ঠাহর করতে পারবে না। কিন্তু পদিপিসী সে মেয়েই নয়। তিনি অবাক হয়ে গালে আঙুল দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বললেন–”ওমা, এ যে আলাদিনের ভাড়ার ঘর। ব্যাটা ঠ্যাঙাড়ে বাটপাড়, কি দাঁওটাই মেরেছিস!” বলে দু হাতে জড়ো করে একটিপি ধনরত্ন মাটিতে নামালেন। আর একটা হাঙরের নকশা-আঁকা লাল বর্মিবাক্সও টেনে নামালেন। খুড়ো হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসে বললেন– “আহা, ওটা থাক, ওটাতে যে আমার সব প্রাইভেট পেপার আছে!”
৩-৪. পদিপিসী থপ করে
“পদিপিসী থপ করে মাটিতে থেবড়ে বসে বললেন-–‘চোপরাও শালা। নয়তো সব প্রাইভেট ব্যাপার। খবরের কাগজে ছেপে দেবা’ বলে কাগজপত্র বের করে ফেলে দিয়ে, ঐ-সব ধনরত্ন বর্মিবাক্সে ভরে নিয়ে, আবার রান্নাঘরে গিয়ে জলচৌকিতে বসে কড়াটা উনুনে চাপালেন। সারারাত ঘুমলেন না, বাক্স আগলে জেগে রইলেন, ভোর না-হতেই আবার গোরুর গাড়ি চেপে শালবনের মধ্যে দিয়ে লাল আলোয়ান গায়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।”
পাঁচুমামা এবার থামল। আর আমি মাথা বাগিয়ে জিগগেস করলাম–”তারপর?” এবং সেই চিম্ড়ে ভদ্রলোকও নিশ্বাস বন্ধ করে বললেন–”তারপর? তারপর?” পাঁচুমামা বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনার কী মশাই?” ভদ্রলোক অপ্রস্তুতপানা মুখ করে বললেন– “না, না– গল্পটা বড় লোমহর্ষণ কিনা–”
পাঁচুমামা আরো কি বলতে যাচ্ছিল, আমি হঠাৎ ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে ইংরজিতে বললাম–”চুপ, চোখ ইজ জ্বলজ্বলিং।” পাঁচুমামা তাঁকে কিছু না বলে আবার বলতে লাগল–”এত কষ্ট করে পাওয়া বর্মিবাক্স নিয়ে পদিপিসী সারাদিন গোরুর গাড়ি চেপে বাড়িমুখো চলতে লাগলেন। দুপুরে সজনে গাছতলায় গাড়ি থামিয়ে খিচুড়ি আর সজনে ফুল ভাজা খাওয়া হল, তার পর আবার’গাড়ি চলল। এমনি করে রাত দশটা নাগাদ পদিপিসী বাড়ি পৌঁছুলেন। কেউ মনেই করে নি পিসী এত শিগগির ফিরবেন, সবাই অবাক। সবাই বেরিয়ে এসে পদিপিসীকে আর জিনিসপত্র পোটলা-পাটলি টেনে নামাল। তার পর গোলমাল, চ্যাঁচামেচি, ডাকাতের গল্প, অবিশ্যি ডাকাতের সঙ্গে খুড়োর যোগের কথা পদিপিসী ছাড়া কেউ সন্দেহও করে নি, পদিপিসীও চেপে গেলেন। হঠাৎ বাক্সটার কথা মনে পড়তে বগল থেকে সেটাকে টেনে বের করে দেখেন, যেটাকে বর্মিবাক্স বলে সযত্নে গাড়ি থেকে-নামিয়েছিলেন সেটা আসলে পানের ডিবে। বমিবাক্স পাওয়া যাচ্ছে না।”
পাঁচুমামা চোখ গোল করে চুল খাঁড়া করে চিঁচিঁ করে বলতে লাগল আর আমি আর সেই চিম্ড়ে ভদ্রলোক নিশ্বাস বন্ধ করে শুনতে লাগলাম। “সে বাক্স একেবারে হাওয়া হয়ে গেল। সেই রাতদুপুরে পদিপিসী এমন চ্যাঁচামেচি শুরু করলেন যে বাড়িসুদ্ধ সবাই যে যেখান থেকে পারে মশাল, মোমবাতি, লণ্ঠন, তেলের পিদিম জ্বেলে নিয়ে এসে এ ওর পা মাড়িয়ে দিয়ে মহা খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিল। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পদিপিসী নিজে হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিলেন। বললেন, ‘নেই বললেই হল! এই আমার বগলদাবী করা ছিল, আর এই তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। একটা আধহাত লম্বা শক্ত কাঠের বাক্স একেবারে কর্পূরের মতন উড়ে গেল। একি মগের মুল্লুক?