ঠিক এই সময় ঠান্ডাঘরের দিক থেকে খুব জোরে কতগুলো ঠকঠক শব্দ, তার পরেই এমনি ঝঝন্ যে কান ঝালপালা হয়ে গেল। বড়ো মাস্টার ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লেন। কী জানি ওঁর বাড়িতেই কিছু হল না তো। পঙ্গু বউ একলা আছে।
ছোটো মাস্টার বললেন, বরফ ফাটলে ওইরম শব্দ হয়। রাখেশ আর তার বন্ধুরা বলছিল যে ঘর এত বেশি ঠান্ডা করে ফেলেছে যে কয়েকটা পেঙ্গুইন পাখি দেখা দিয়েছে।
গুপি বলল, ওরা তো ভূতও দেখে।
সেদিন সবাই একটু তাড়াতাড়ি চলে গেল। রামকানাই ঘরে এসে বলল, তিনজনে এসে পঁচিশটা কচুরি সাঁটাল, অথচ বেড়ালের একটা গতি করতে পারল না। আমার কিন্তু বুড়ি মেমকেই সন্দেহ হয়।
আমি বললাম, ওর বেড়াল-ও তো গেছে। তুমি সবাইকে সন্দেহ কর।
–সবাইকে সন্দেহ না করেই-বা করি কী। তুমি তো তেওয়ারির দুঃখে গলে যাও। আহা, বেচারা, রোদে-বৃষ্টিতে চাটাইয়ের ছাউনির নীচে বসে চা জলখাবার তৈরি করে আর বিক্রি করে। রাতে শোবার একলা ভালো জায়গা পায় না, হেনা তেনা কত কী বল। জান, ওই চারতলা ঠান্ডা ঘরটির মালিক কে? ওই তেওয়ারি ছাড়া আর কেউ নয়। তোমার বাবাকে তেওয়ারি কিনে ফেলতে পারে, তা জান?
ভীষণ রেগে গিয়ে গড়বড় করে গাড়িটা চালিয়ে জানলার কাছে গেলাম। দেখলাম বুড়ি ভিকিরি তেওয়ারির সঙ্গে কী নিয়ে ঝগড়া করছে। রামকানাই-ও জানলার ধারে এসে বলল, ওই আরেক জন। আমার হাতে দিয়ে ওর জন্যে কত পয়সাই-না পাঠিয়েছ তুমি। তোমার মার কাছ থেকে চেয়ে খদ্দরের চাদর পর্যন্ত ওকে দিয়ে আসতে হয়েছে। আর তেওয়ারি তো প্রত্যেক দিন সন্ধ্যে বেলায় দোকান বন্ধ করার আগে, শালপাতার ঠোঙা ভরে ওকে ঝড়তিপড়তি খাবার দেয়। তাই নিয়েই আবার ঝগড়া করে বুড়ি। আর ওই যে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে অনেক রাতে একটা বুড়ো ভিক্ষে করে, চোখে দেখে না। মুখে কথা নেই, শুধু হাতটা পেতে দেয়। ওকে দেখে সকলের দয়া হয়, সবাই পয়সা দেয়। দু-জনার তফাতটা দেখেছ তো?
আমি বললাম, তা দেখেছি। তাই বলে ঝগড়াটি বুড়িকে চাদর দেবনা কেন? ওর-ও তো ঠান্ডা লাগে।
রামকানাই বলল, তা লাগে বই কী। তা ছাড়া ঝগড়াটে বুড়ি আর ভালোমানুষ বুড়ো একই লোক।
০৫.
শুনে আমি হাঁ। তাকিয়ে দেখি বুড়ি তেওয়ারির নিজের ভাগ থেকে আরো দুটো পুরি নিয়ে, ঝগড়া শেষ করে, খাবারগুলোকে কেঁচড়ে বেঁধে, তরতর করে ঠান্ডাঘরের বাঁশের ভারা বেয়ে উপরে উঠে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল! ভারায় চড়ার আগে এক বার চারদিকে চেয়ে দেখল। মুখের উপর রাস্তার আলো এসে পড়ল। অবাক হয়ে দেখলাম রামকানাই ঠিকই বলেছে। মোড়ের মাথার বুড়োর আর ঝগড়াটি বুড়ির মুখ অবিকল এক।
বললাম, রামকানাইদা, ওরা তো যমজও হতে পারে।
রামকানাই কাষ্ঠ হেসে বলল, তাহলে দুজনকে একসঙ্গে দেখা যায় না কেন? না পানুদা, পৃথিবীতে কাকেও বিশ্বাস হয় না। বিশেষ করে তোমাদের নতুন বন্ধু ওই ছোটো মাস্টারটিকে তো নয়ই। এদিকে তলাপাত্র বলতে বুড়ো মাস্টার অজ্ঞান! ওঁর কপালে দুঃখ আছে বলে রাখলাম।
এই বলে রামকানাই দরজা খুলে দিতে গেল। বাবা-মা নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরে এসেছেন। সঙ্গে আবার কাকু আর নিতাই সামন্তও এসেছিলেন। নিতাই সামন্তকে আজকাল এই পাড়ায় রাতে ডিউটি দিতে হয়, তাই এক পেয়ালা গরম চা না হলে চলে না। এক পেয়ালা মানেই দুই পেয়ালা আর গোটা দুই পান।
আমি গাড়ি চালিয়ে বসবার ঘরে গিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনতে লাগলাম। খালি বিনু তালুকদারের অদ্ভুত বুদ্ধির গল্প। বিনু তালুকদারের চেহারা নাকি দিল্লির দু-একজন বড় কর্তা ছাড়া, কেউ দেখেনি। তার টিকটিকিদেরও কেউ চেনে না। এখানকার পুলিস বিভাগের কেউ তো নয়ই। নিতাই সামন্ত এক টিপচুন দাঁতে লাগিয়ে বললেন, কে জানে মশাই, ওই যে-লোকটাকে সন্দেহ করে আজ এই রাতের অন্ধকারে, ভূতের গলিতে যাচ্ছি, সে-ই হয়তো বিনু তালুকদারের গুপ্ত গোয়েন্দা, ছদ্মবেশে বেড়াচ্ছে। আমার অবিশ্যি ভূতের ভয় নেই। কারণ প্রথমত ভূত আছে বলেইবিশ্বাস করি না। দ্বিতীয়ত আমার হাতে গুরুদেবের দেওয়া অব্যর্থ মাদুলি বাঁধা আছে। ভূতে আমার কিছু করতে পারবে না।
নিতাই সামন্ত চলে গেলে পর বাবা বললেন, ওই গুপিটার পাল্লায় পড়ে তুই-ও যেন পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে শুধু চাদে যাবার জোগাড়যন্ত্র করিস না। চাঁদে গেলেই হল আর কী!
আমি বললাম, না, বাবা, শুধু চাঁদে যাওয়া নয়, চাঁদ থেকে আরও দূরে যাওয়া হবে। ওটা হল প্রথম স্টেশন, ওখানেই নাকি টিকিট কাটতে হবে, গুপির ছোটোমামা বলেছেন।
শুনে বাবা তো হেসেই কুটোপাটি। আর ছোটোমামা! আরে তোদের গুপির ছোটোমামা তো ফেরারি আসামি! একবাক্স স্কুরু-ট্রু নিয়ে হাওয়া। লিখে রেখে গেছে যে সামান্য বি.এসসি. পাস করে তার কিছু হবে না। সে চাঁদে যাওয়ার চেষ্টায় আছে।
আমার কান্না পেল। তাহলে গুপিকে আমাকে না নিয়েই ছোটোমামা চাঁদে চলে গেলেন নাকি? জমি-টমি কিনে রেখেছেন বোধ হয়, কিন্তু
বাবা এত বেশি হাসতে লাগলেন যে থামতে হল। বাবা বললেন, না, না, অত ভাবনার কারণ নেই। চোঁয়াঢেকুর ওঠাতে সে আবার ফিরে এসেছে।
সঙ্গেসঙ্গে আবার সেই ঝনঝন শব্দ। আমি বললাম, বরফ ফাটছে। ওখানে পেঙ্গুইন গজিয়েছে।
বাবা এমনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে হাসি থেমে গেল। আমি যদি হাঁটতে পারতাম, একদিনও বাড়িতে থাকতাম না।