আমি বললাম, এই পাড়া থেকে গত ছয় মাসে একত্রিশটা বেড়াল নিখোঁজ। কালো মেমের হলদে ট্যাবি পর্যন্ত। বিদঘুঁটে কিছু অত বেড়াল খায়নি। আর খায়ই যদি তো আমার নতুন খাতা নিয়ে গেছে কেন?
ছোটো মাস্টার বললেন, নিতাই সামন্তকে বললে হয় না? যে অত চোরাই গাড়ি খুঁজে দেবে, সে একটা সামান্য বেড়াল খুঁজে দিতে পারবে না?
একথা আমার আগে মনে হয়নি।
গুপি বলল, আমার ছোটোমামাকেও বললে হয়, তার খুব বুদ্ধি। সে বলেছে চাদে মাটি নিয়ে যেতে হবে। ওখানকার মাটিতে ফসল হবে না। তা ছাড়া কেঁচোও নিয়ে যেতে হবে। তারা তলার মাটি উপরে তোলে। তাহলে বেশি ভারী ভারী ট্রাক্টর নিতে হবে না।
বড়ো মাস্টার ঠিক সেই সময় এসে ঘরে ঢুকলেন। বড়ো দেরি হয়ে গেল, পানু। ওই রাখেশ আর বকু ভূতের ভয়ে আজ কিছুতেই বাড়ি থেকে বেরুবে না! শেষপর্যন্ত নিজে গিয়ে টেনে বের করে আনতে হল। নাকি মোড়ের ওই কোম্পানির আমলের গুদোম বাড়ির দেয়াল থেকে ভূত নামতে অনেকে দেখেছে। সাহেব মেম ভূত। সেজেগুঁজে, নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে চলে যায়, কারো দিকে তাকায় না।
গুপি বলল, কিছু বলে না তো ওরা ভয় পায় কেন?
বড়ো মাস্টার বললেন, সে কথা কে বলে!
ছোটো মাস্টার বললেন, পানুর অমন ভালো বেড়ালটাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
–তাই নাকি? রামকানাইকে দিয়ে পাড়া খোঁজাও। ওই চীনে হোটেলের পেছনে ঠান্ডাঘরের কাঠের সিঁড়িতে রোজ রাতে বেড়ালদের সভা বসে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাদের মধ্যে নেপো আছে কি না একবার দেখে আসুক।
রামকানাই ঝুরিভাজা এনেছিল। সে বললে, সে কি আর বাকি রেখেছি, মাস্টারবাবু। সিঁড়িতে থিকথিক করছে বেড়াল; কোন সময় হোটেল থেকে চিংড়ি মাছের খোলা বাইরে পড়ে সেই আশাতেই বসে আছে। কিন্তু তার মধ্যে নেপো নেই। তিনি কাঁটা কি খোলা খান না। পানুদাদা মাছ বেছে দিলে তবে তিনি মুখে তোলেন।
বড়ো মাস্টার চেয়ারে বসে বললেন, খায় না আবার! তেমন অবস্থায় পড়লে, না খায় এমন জিনিস থাকে না। একবার আমরা বড়ো বোট নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের ছোটো ছোটো দ্বীপে গুয়ানো খুঁজছিলাম। সমুদ্রের পাখিদের ময়লা জমে থাকে, তাকেই গুয়ানো বলে, বাজারে চড়া দামে বিক্রি হয়।
একটা ছোট্ট দ্বীপে উঠছি, সমুদ্রের তীরে অনেকটা বালি, দ্বীপটা কিন্তু পাথরে তৈরি, ওপরটা চ্যাপটা। পাথরের খাঁজে খাঁজে যেখানে মাটি একটু পুরু, সেখানেই বেঁটে বেঁটে গাছপালা, ঝরনাও আছে নিশ্চয়। ভাবলাম এখানে নোঙর করে দু-দিন বিশ্রাম করা যাবে। দেখে মনে হল মাছের আর পাখির ডিমের অভাব হবে না। নৌকোর ক্যাপ্টেন আর আমি আর আমার পোষা বেড়াল ম্যাও আগে নামলাম। আমরা দেখে এলে অন্যেরা নামবে।
তবে অনেকেরই খুব রাগ, ম্যাও নামছে অথচ তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে? যাই হোক, আমরা বালি পেরিয়ে হাঁচড়পাঁচড় করে দ্বীপের পাথুরে গা বেয়ে উঠতে লাগলাম। দেখতে দেখতে নৌকো আমাদের চোখের আড়াল হয়ে গেল।
আগে আগে ক্যাপ্টেন, তারপর আমি, আমার কাঁধে ম্যাও বসে। ক্যাপ্টেন বলল, দ্বীপটা যেন একটু অদ্ভুত ঠেকছে। পাখির ডাক নেই কেন? সত্যি, এমন চুপচাপ দ্বীপ কখনো দেখিনি। সমুদ্রের শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যায় না। গুয়ানো ছেড়ে দিলাম, একটা জন্তুজানোয়ার বা পাখি, কিছু দেখতে পেলাম না। তার উপর ম্যাও ঘাড়ের লোম ফুলিয়ে কেবলি রেগে গরগর করতে লাগল।
যাকে গাছগাছড়া ভেবেছিলাম তাও দেখলাম কাটাঝোঁপ ছাড়া কিছু নয়। অনেক খুঁজে ছোট্ট একটা ঝরনা পেলাম। আর একটু রোদ উঠলে কী সাংঘাতিক গরম হবে ভেবে তাড়াতাড়ি পাথর। বেয়ে নামতে লাগলাম। ওই ন্যাড়া পাথর তেতে উঠলেই হয়েছে আর কী! খানিকটা পথ বাকি থাকতে অবাক হয়ে চেয়ে দেখি সমুদ্রের তীর চঁছাপোছা, দূরে জলের উপর একটা কালো দাগ ক্রমে ছোটো হতে হতে শেষটা মিলিয়ে গেল। নাবিকদের নামতে দেওয়া হয়নি বলে তারা রেগেমেগে আমাদের ফেলে চলে গেছে।
হতাশ হয়ে যেখানে ছিলাম, বসে পড়লাম। অমনি ম্যাও এক লাফে আমার ঘাড় থেকে নেমে, রেগে তিনগুণ বড়ো হয়ে গর-র করতে লাগল। দেখি পাশেই একটা গুহার মুখ।
রোদ থেকে আশ্রয়ের আশায় ঢুকে পড়লাম তার ভিতর। খানিকদূর গিয়ে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে এখানে ওখানে জোড়া জোড়া চোখ জ্বলছে। টর্চের আলো ফেলে দেখি পাথরের থাকে থাকে বেড়াল। কালো, হলদে, সাদা, ছাই, পাটকিলে। বোধ হয় ম্যাওকে দেখেই, তারা সব উঠে দাঁড়িয়ে, চার পা এক জায়গায় জড়ো করে, পিঠ কুলোর মতো বাঁকিয়ে, পাথরের উপর নখ ঘষতে লাগল। তার খড়খড় শব্দে আমাদের গায়ে কাঁটা দিল। ম্যাও একেবারে কাঠ!
কোনোমতে হোঁচট খেতে খেতে পড়িমরি করে গুহা থেকে বেরিয়ে বাঁচলাম। অবাক হয়ে দেখি আমাদের নৌকো আবার ফিরে আসছে। আমরা নীচে পৌঁছোবার আগেই ম্যাও গিয়ে নৌকোয় উঠে পাটাতনের তলায় গুটিসুটি হয়ে বসে পড়ল। বেড়ালের খাদ্যের কথাই যদি বল, ওই দ্বীপে তারা খেত কী? পাখি নেই, প্রাণী নেই, গাছপালা নেই। হয়তো পরস্পরকেই
ছোটো মাস্টার বললেন, না, না, নিশ্চয় সমুদ্রের মাছ ধরে খেত। ঢেউয়ের সঙ্গে যেসব ঝিনুক, শামুক, তারামাছ, সমুদ্রের ঘোড়া, জেলিফিস এসে বালির উপর পড়ে, তাও খেত।
বড়ো মাস্টার বললেন, পরে শুনেছিলাম, এক জাহাজের ক্যাপ্টেনের দুটো বেড়াল ছিল। তাদের উৎপাতে টেকা দায় হয়ে উঠেছিল বলে নাবিকরা লুকিয়ে ওদের ওখানে ফেলে দিয়ে গেছিল। ওরা নাকি টিনের মাছ ছাড়া কিছু খেত না। এদিকে নাবিকরা শুকনো মাংস পেত। ওইসব বেড়াল নিশ্চয় তাদেরই বংশধর।