তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে পাহাড় থেকে নেমে এলাম। কত হরিণ, কত পাখি, কত সবুজ পায়রা দেখলাম, দিনের শেষে বাসায় ফিরছে। ডেরায় ফিরতেই দেখি হরিদাস তল্পিতল্পা বেঁধে যাবার জন্যে তৈরি। বললে, জায়গাটা সত্যি ভালো না! সেইদিনই ফিরে এলাম।
মাস্টারমশাই থামলে গুপি বলল, এ আবার কীরকম ভূতের গল্প?
বড়ো মাস্টার হেসে বললেন, ভূতের গল্পের আবার এ-রকম সে-রকম হয় নাকি? যেমন দেখেছিলাম, বললাম। তলাপাত্রকে কেমন লাগল?
আমি বললাম, ভালো। কিন্তু বাবা বললেন সোজা তাকায় না কেন? মা বললেন– যাকে-তাকে ঘরে ঢুকতে দিস না। আচ্ছা, মাস্টারমশাই, আমার পা দুটোতে কি কোনো তফাত দেখতে পাচ্ছেন? আমি স্বপ্নে খুব দৌড়োই।
মাস্টারমশাই বললেন, সে আর এমন কী। আমার নেই-পাটাতে যখন চুলকোয়, তখন কী করে আরাম পাই বল দিকিনি?
গুপি তখন কথা পালটে বলল, জানেন মাস্টারমশাই, মহাকাশযানগুলো যখন অনেক উপরে, অনেক দূরে চলে যায় তখন আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে না। কোনো জিনিস নীচের দিকে যায় না, সব উপরে উঠতে থাকে। আমার চন্দ্রযাত্রার নতুন বইটাতে আছে যাত্রীরা যদি নানান উপায়ে নিজেদের নীচে আটকিয়ে না রাখে, তাহলে সবাই বেলুনের মতো উড়ে আকাশযানের ছাদের কাছে ঝুলে থাকবে।
বড়ো মাস্টার মহাকাশযাত্রার কথা শুনলে চটে যান। বিরক্ত হয়ে বললেন, নিশ্বাস ফেলবার বাতাস নিয়ে যেতে হয়-না বোতলে ভরে? যাত্রীরা উড়ে বেড়াবার জায়গা কোথায় পাবে?
গুপি বলল, আমার চন্দ্রযাত্রার বইয়ের লোকরা একরকম আগাছা নিয়ে গেছিল, তারা যাত্রীদের নিশ্বাস-ফেলা কার্বন ডাই-অক্সাইডগুলোকে আবার অক্সিজেন বানিয়ে দিত। ওই আগাছার নাম ডাক-উইড। বোতলে করে কত বাতাস নেবে? আর শুধু চাদে গেলেই তো হল না, চাঁদটা খালি একটা টিকিট কাটার স্টেশনের মতো।
বড়ো মাস্টার উঠে পড়ে, ঠুক ঠুক করে কাঠের পা ঠুকতে ঠুকতে যেই এক পা পেছু হটেছেন অমনি ই–য়া–য়া–ও করে সে কী বিকট চিৎকার! তাকিয়ে দেখি কেঠো পা ঠিক পড়েছে নেপোর বেঁড়ে ল্যাজের ডগায়! পাটা তুলতেই এক ঝিলিক বিদ্যুতের মতো নেপো জানলা টপকে ধনে পাতার গাছ মাড়িয়ে কার্নিশ পেরিয়ে, পাশের ফ্ল্যাটের কালো মেমের জানলা গলে হাওয়া!
মাস্টারমশাই কাঁপতে কাঁপতে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। মুখটা একেবারে সাদা, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, ভাঙা গলায় বললেন, নেপোর গলা থেকে ওই শব্দ বেরুল! আশ্চর্য! ওকে একটু ধরা যায় না?আর ধরা! ততক্ষণে মেমের রান্নাঘর থেকে ঝনঝন কাঁও ম্যাও, তারপর সব চুপ।
০৪.
তার পরের রবিবারে গুপি এসেই বলল, একটা মুশকিল হচ্ছে স্পেস-স্টেশনটাকে নিয়ে। ছোটোমামা বলছে নাকি মাধ্যাকর্ষণের এলাকা ছাড়বামাত্র ওটাকে তিন সেকেন্ডে এক বার করে পাক খেতে হবে। নইলে ধপাস করে পড়ে যাবে। তা হলে তো জিনিসপত্র ভেঙেচুরে মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি খেয়ে একাকার হবে। মহাকাশযানগুলোই-বা সারানো হবে কী করে? আমি আঁতকে উঠলাম।
অ্যাঁ, তাহলে আমাদের বাতাসের বোতলের ব্যাবসার কী হবে? ডাক-উইড দিয়ে যে অক্সিজেন তৈরি হবে তাকে রাখব কীসে?
গুপি বিরক্ত হয়ে বলল, এই বিদ্যে নিয়ে হয়েছে তোর চন্দ্রযাত্রা! বাতাসের বোতল পাতলা প্লাস্টিকের হবে, তাও জানিস না? কাচ তো বেজায় ভারী। কিন্তু মিনিটে কুড়ি বার ঘোরালে বাতাস থেকে মাখন-টাখন না উঠলে বাঁচা যায়। ছোটোমামা এই নিয়ে এত বেশি ভাবছে যে এবারও পরীক্ষায় কী হয় কে জানে।
ছোটো মাস্টার সেদিন আগেই এসেছিলেন। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ধনে পাতা চিবুচ্ছিলেন আর তেওয়ারির দোকানের বুড়িকে অবাক হয়ে দেখছিলেন। এবার তিনি হঠাৎ পকেট থেকে সবুজ মলাটের একটা বই বের করে বললেন, ছোটোমামাকে ভাবতে বারণ কর। বরং পড়াশুনো করুক। এই বইতে লেখা আছে কী করে কলকজার সাহায্যে বাইরের খোলটা পাক খাবে, অথচ ভিতরকার জিনিসপত্র শূন্যে ঝুলে থাকবে, এতটুকু নড়বে না। এই দেখ ছবি, এই লোকগুলো সাত ঘণ্টা পাক খেয়েছে, মাখন-টাখন কিচ্ছু ওঠেনি।
তারপর গুপি আমার দিকে ফিরে বলল, ও কী, তোর চোখ লাল কেন?
রামকানাই মাছের কচুরি এনেছিল। আমার গোল টেবিলে সেগুলোকে নামিয়ে রেখে, ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, লাল হবে না তো কী। দু-দিন ধরে পাতি বেড়ালের শোকে কান্নাকাটি হয়েছে যে!
তাই শুনে গুপি আর ছোটো মাস্টার দু-জনেই অবাক। সে কী! নেপোর সাংঘাতিক কিছু হয়েছে নাকি? রামকানাই বলল, হবে আবার কী! পেয়ারের বেড়াল হাওয়া। আজ তিন দিন সে বাড়ি আসেনি।
ছোটোমাস্টার বললেন, গেল কোথায়?
শুনে রামকানাইয়ের কী হাসি! গেছে কার বাড়ির পাতকুড়ুনি খেতে।
ভারি রাগ হল। চেঁচিয়ে বললাম, মোটেই না। নেপো কারো পাতকুড়ুনি খায় না। বিদঘুঁটে ওকে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে।
ছোটো মাস্টার বললেন, বিদঘুটে আবার কে? আমি কিছু বলার আগেই রামকানাই সর্দারি করে বলল, ওই যে নটে-কান কেঁদো হুলো তা ছাড়া আবার কে! শুধু কি ডাস্টবিন ঘেঁটে ওর অমন গতর হয়েছে নাকি? গোলগাল বেড়াল দেখলেই তাকে ভুলিয়ে অন্ধকার গলিতে নিয়ে গিয়ে কপ। নেপো হতভাগাকে পইপই করে মানা করেছি, ওর সঙ্গে মিশিস নে, তা কে কার কথা শোনে। এখন বোঝ ঠ্যালা! কোথায় ঠ্যাং ছড়িয়ে রামকানাই চুপ করল।